বই পর্যালোচনায় কবি সুবীর সরকার

হিন্দোল,বাংলা কবিতায়,একজন শার্প শুটার

১|
“উত্তরপুরুষ,তুমি” এবং “একটি গোপন বাঘ”।কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য রচিত দুটি কবিতার বই।প্রথমটি ৪০ টি আর পরেরটি ২৬ টি কবিতায় মোড়া।অমিত মন্ডল ও সুপ্রসন্ন কুণ্ডুর প্রচ্ছদ অত্যন্ত আকর্ষক,প্রতীকী।
দুটি বইই প্রকাশিত হয়েছে ডিসেম্বর, ২০২১_এ।
প্রকাশক যথাক্রমে “সিগনেট প্রেস” ও “প্লাটফর্ম”।
সম্প্রতি আমাকে একাধিক পাঠ পর্বের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, এই বই দুটিকে ঘিরে একটা অদ্ভুত পাঠ জার্নি সেটা বলা ভালো।
হিন্দোল ভট্টাচার্য বাংলা ভাষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একজন কবি।সেই নয়ের দশকেই হিন্দোল তৈরি করে ফেলেছিলেন তার কবিতার নিজস্ব ভাষা,স্বর ও সুর।
তীব্র সময় সচেতন,দেশ কাল পরিপার্শ্ব ছায়া দুলিয়ে হেঁটে যায় তার কবিতার ভুবনজোতে।
তার কবিতায় কেবল ব্যাক্তি নয়,আমিসর্বস্ব নয়।

২|
“উত্তরপুরুষ,তুমি” এই বইটির পরতে পরতে এক তুমুল ইশারা কিভাবে বুঝি সাংকেতিক হয়ে ওঠে!
অথচ হিন্দোল তো জানেন কোথাও জায়মানতা থাকে না।বিন্দু বিন্দু ছড়ানো জলকণা কিভাবে সমো চ্চারিত এক সামগ্রকতা নিয়ে জীবনের কালো আর আলোর কথা ছড়িয়ে দিতে থাকে।
হিন্দোল আমাদের দেখান,কিংবা আমরা দেখে ফেলতে থাকি_
“জল নয়, যেন মৃত্যু গুনগুন করছে ঘাটে।এই প্রবাহের ভিতর তুমি আছ।
আমি তোমাকে কামনা করি।বৃক্ষে,জ্যোৎস্নায়,সহজ কবিতায়।
একটি রূপকথা লিখবো বলে তুলে নিয়েছিলাম কলম।তুমি চতুর্দিক থেকে আমায় আক্রমণ করলে।
যেন আদিবাসীদের গ্রাম ঘিরে ফেলছে জমিদার।”
আমরা বুঝে ফেলি সেই চিরদিনের রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রযন্ত্রের আবহমান খেলায় মত্ত হবার চেনা স্ক্রিনশট।
আসলে উপসর্গহীন অসুখের মতো মনে হয় সব দিনকাল।অতিমারি,অসুখ মোড়ানো সময়ের অসহায়তা বারবার তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় কবিকে।চেনা পৃথিবী আর চারপাশের বদলে যাওয়াটা ভারি বিষন্ন বিপন্ন করে তোলে কবিকে।
তখন দূরাগত মেঘের নিচে উড়ে যাওয়া পাখিদের ছায়ায় বিছিয়ে থাকা পচে যাওয়া মৃতদেহ যার ইতিহাস আমাদের জানা নেই।

৩|
প্রেম প্রেমহীনতা বন্ধুত্ব বিষাদ ক্রোধ দ্রোহ আশ্চর্য ঘোড়া খুরধ্বনি গান আর সমস্তকিছু থেকে ফিরে আসতে থাকা এক মহাজীবন দিয়ে সাজিয়ে দিতে থাকেন হিন্দোল তার কবিতার দিপ্র ঘরবাড়ি,যেখানে মৃদুসুরে লিখিত হয়_
“মানুষের দুঃখের গান,যেভাবে লুকিয়ে থাকে, আঁচলে,আগুনে।”

৪|
“একটি গোপন বাঘ”_বইটি জুড়ে থাকে সুতীব্র সব ইশারা,সংকেত,প্রতীক।বাঘ এখানে অনেক সত্যিই বহন করে।এই বহমানতায় লিপ্ত হতে গিয়ে পাঠক টের পান_
“কোথাও তদন্তসূত্র নেই তার।গোয়েন্দা রয়েছে।”
আর সেকারণেই_
“যুদ্ধবিরতির গন্ধ লটকে থাকে মহানিমগাছে।”

৫|
হিন্দোল এক অসামান্য মানবজমিন জুড়ে চাষাবাদ করে চলেছেন।অসুখ তাকে আর্তনাদের দিকে নিয়ে যায় আর কবি ফিরে আসতে থাকেন আর্তনাদ বিপন্নতা অসুখ থেকে বারবার সূর্যালোকের এক পৃথিবীতে এই আশাবাদ তার কবিতার মূল জীবনীশক্তি।কবি আত্মজীবনী নয় আত্মকথা বলেন এইভাবে বুঝি_
“আমি মৃতদেহ পড়ে থাকা যুদ্ধক্ষেত্র। আমিই পুড়ে যাওয়া কবিতার বই। রেডবুক।চর্যাপদ।মনসামঙ্গল।”
কবিতা কত কিছু বলে।শেখায়।স্তব্ধ করে রাখে।
হিন্দোল তার কবিতায় ব্যপ্ত আর বিস্তারিত এক মহাজগতের ইশারা বয়ে আনেন আমাদের জন্য_
“ঝিঁঝি ডাকে সন্ধ্যাবেলা।বাঘ ডাকে,অন্য কোথাও।”

৬|
আর কিছুই নয়।এটুকুই বলি,হিন্দোল ভট্টাচার্য,বাংলা কবিতায় একজন শার্প শুটার।
সো,হ্যাটস অফ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।