ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজ আমেরিকার ডায়েরি || সুব্রত সরকার – ১৫

।। আমেরিকার ডায়েরি ।।

।। সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লসটন, ৫ সেপ্টেম্বর।। 

ভোরের আলো-অন্ধকারে মায়ামির হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে উবেরে উঠলাম। যাব মায়ামির এয়ারপোর্টে। আজ নতুন ভ্রমণ। নতুন জায়গা। ফ্লোরিডা থেকে চলে যাব সাউথ ক্যারোলাইনা। আকাশপথের এই সফরে একটা লে ওভার আছে আটলান্টায়। তারপর অনেকটা অপেক্ষার পর দ্বিতীয় বিমান ধরে পৌঁছে যাব চার্লসটন। সাউথ ক্যারোলাইনার বন্দর শহর।

মায়ামির ঘুমিয়ে থাকা শহরটাকে শেষবারের মত দেখতে দেখতে চলেছি। দুদিন আগে আসার সময় উবেরের চালক ফিদেল বলেছিলেন, “মায়ামি তোমার ভালো লাগবে।” কিউবার সেই উবের চালক ফিদেলের কথা সত্যি হয়েছে। মায়ামি বড় সুন্দর। খুব ভালো লেগেছে।  অনেক সুন্দর স্মৃতি নিয়ে মায়ামিকে গুডবাই করে চলে যাচ্ছি।

এবার আমার ডেল্টা এয়ারলাইন্সের বিমান। এয়ারপোর্টে  সিকিউরিটি চেক ও বোর্ডিং পাস নিয়ে বিমানে গিয়ে বসলাম। বেশ বড় বিমান।

জানলার ধারে সিট পেয়ে বেজায় খুশি। কফিতে চুমুক দিয়ে সিটের সামনের ছোট্ট মনিটরে আমার জার্নি রুট দেখতে দেখতে চলে গেলাম আটলান্টা।

আটলান্টা বিমানবন্দরে একটা দারুণ ঝলমলে ইনডোর ডেকোরেশন দেখে মুগ্ধ হলাম। আমেরিকার ছোট বড় যে কটা বিমানবন্দরে নেমেছি, দেখেছি সব বিমানবন্দরই খুব সাজানো গোছানো। নিট এন্ড ক্লিন। ওয়াশরুমগুলো তো চমৎকার।

আটলান্টা থেকে এবার চলে এলাম চার্লসটন।

এয়ারপোর্টে নামতেই ডুলুং এর ফোন, ল্যান্ডিং এর খবর পেয়ে বলল,” তুমি এখানে কিছু খেয়ে একটু রেস্ট নাও। হোটেল চেক ইন চারটের সময়। এখন তো বাজে দুটো।  উবেরে করে লা কুইন্টায় যেতে সময় লাগবে কুড়ি মিনিট।”

LA QUINTA হোটেলের নাম।  বস্টনেও  লা কুইন্টাতে ছিলাম। ভালো লেগেছিল। চার্লসটনের লা কুইন্টাও আশা করি ভালো লাগবে।

এয়ারপোর্টে Dunkin Donuts পেয়ে গেলাম। পেট ভরার মত একটা চিকেন র‍্যাপ নিলাম। খাওয়া শেষে একটু উইন্ডো শপিং করে সময় কাটালাম। একলা ভ্রমণে এই ছোট ছোট অভিজ্ঞতাগুলো এক বাড়তি আনন্দ দেয়।

সময় মত ডুলুংই ফোন করে বলল, “এবার উবের বুক করে দিচ্ছি। তুমি এক্সিট গেট দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।”

আমার এই একলা ভ্রমণের সমস্ত পরিকল্পনা ডুলুং খুব নিখুঁত ভাবে করে রেখেছে। হোটেল বুকিং, ফ্লাইটের টিকিট, সাইট সিয়িং এর টিকিট সব ও করে সাজিয়ে দিয়েছে। সোহমও দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মত নজরদারী রেখে চলেছে। তাই এতটকু অসুবিধা হচ্ছে না। শুধু সাহস করে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে এসে উবেরে উঠলাম। শহরের পথে চলেছি। চার্লসটন সাউথ ক্যারোলাইনার এক ঐতিহাসিক শহর। এর ইতিহাস খুব সমৃদ্ধ ও বর্ণময়। এই শহরে সুন্দর এক নদী আছে ASHLEY। নদী বন্দর আছে চমৎকার।

হোটেল লা কুইন্টা একদম নদী বন্দরের পাশেই।চমৎকার পরিবেশ। বন্দরে ছোট ছোট অনেক বোট দাঁড়িয়ে আছে। পাল তোলা নৌকোগুলোকে দেখতে বেশ লাগছে। নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে বহু টুরিস্ট নৌকো। এই জলভ্রমণ খুব মজার।

লা কুইন্টায় সুন্দর একটা ঘর পেলাম চারতলায়। দারুণ সাজানো। সব কিছু একদম ঠিকঠাক আছে। আমেরিকায় সব হোটেলেই দেখলাম বেসিক জিনিসগুলো একদম নিঁখুত থাকে। ঘরে ঢুকে কোনও অসুবিধা হয় না। এটি একটা ডবল বেড রুম। একদিনের ভাড়া একশো দশ ডলার। দুদিন থাকব দুশো কুড়ি ডলার। ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি।

হোটেলে ঢুকতেই বিকেল হয়ে গেল। একটু ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলাম। পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম নদী বন্দরের কাছে। নির্জন সুন্দর জায়গাটায় একটা মস্ত বড় রেঁস্তোরা রয়েছে। নাম CALIFORNIA  DREAMING। শেষ বিকেলটা একা একা অনেকটা সময় কাটালাম। এখানে একটা মজার ব্যাপার হলো- আমি একটা শর্ট পাঞ্জাবী পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। শান্তিনিকেতনের খোয়াই হাটের পাঞ্জাবি। সেই পাঞ্জাবি দেখে এক আমেরিকান লেডি বেশ মজা করে বললেন,” your garment is so nice.”

আমি মনে মনে হাসলাম। খোয়াই হাটের পাঞ্জাবি জিন্দাবাদ!…

সন্ধের অনেকটা সময় নদী বন্দরের পথে পথে হেঁটে বেড়িয়ে কাটালাম। এই নির্জনতাকে বেশ উপভোগ করলাম। আগামীকাল সারাদিনের টুর আছে। ডুলুং বুক করে রেখেছে। হোটেলে ফিরে এলাম। একটু  পরেই ডিনার চলে এলো। ডুলুংই অনলাইনে বুক করে পাঠিয়ে দিয়েছে। Panda Express থেকে খাবার এলো। আজ খেলাম Fried rice, Kung Pao Chiken ও Mushroom Chiken। খাবারগুলো খুবই সুস্বাদু। ডুলুংকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিলাম।

রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমেরিকার ডায়েরি লেখার হোমওয়ার্ক নিয়ে বসলাম। এই চলমান ভ্রমণ ডায়েরির লেখাগুলো লিখে খুব আনন্দ হচ্ছে। একটা সময়কে ধরে রাখতে পারলাম। স্মৃতি রোমন্থনের আনন্দ সঞ্চয় করাও হয়ে যাচ্ছে লেখাগুলোর মধ্যে দিয়ে। বহু পাঠক বন্ধু পেলাম, যারা লেখাগুলো মন দিয়ে পড়ছেন, পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছেন, আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। এ অনেক বড় এক প্রাপ্তি।

।।  একদিন সারাদিন চার্লসটনে…।।

Adventure Sight Seeing.com এর  Historic City Tours & Plantation Tours এর সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। চার্লসটনের চারপাশে ছড়ানো টুরগুলো হলো-City Tour, Museum Tour, Harbor Tour, Magnolia Plantation Tour, Boone Hall Plantation Tour, Tea Garden & Winery Tour।

ডুলুং আমার জন্য Boone Hall Plantation Tour বুক করে রেখেছে। এটি হাফ ডে টুর। তারপর ফিরে এসে পায়ে হেঁটে আমি ঘুরে  বেড়িয়ে দেখব চার্লসটনের বিখ্যাত সিটি মার্কেট, রেইনবো মার্কেট, ওয়াটার ফ্রন্ট পার্ক, চার্লসটন ব্যাটরি। এই Historic Walking Tours এর রুট ম্যাপও ডুলুং করে দিয়েছে।

সকালে হোটেলের কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট করে উবের ধরে চলে গেলাম চার্লসটনের ডাউনটাউনে। এবারের চালক একজন হাসিখুশি আমেরিকান লেডি। সে আবার ভারত সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। দিল্লি, রাজস্থান ঘুরে গেছে। কলকাতার নাম জানে।

ডাউনটাউন থেকে শুরু হল আজকের সিটি টুর ও বুন হল প্ল্যান্টেশান টুর। ডাউনটাউনের বড় বড় বাড়ি, অফিস, মল দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। সুন্দর শহর। শান্ত শহর। ঐতিহাসিক বাড়ি ঘর যথেষ্ট চোখে পড়ল। বেশ একটা প্রাচীন গন্ধ লেগে রয়েছে চার্লসটনের শরীর জুড়ে।

শহর থেকে খুব দূরে নয় বুন হল প্ল্যান্টেশন। এখানে ঢুকেই মন যেন হারিয়ে গেল। মনে হল এক অপূর্ব বাগানে চলে এসেছি। চারদিকে প্রাচীন বড় বড় সব পাইন, ওক, ম্যাপল গাছ সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  আর সব গাছেই ঝুলছে স্প্যানিশ মস। ফলে এই সৌন্দর্য দেখে মন ভরে যায়।

বুন হল প্ল্যান্টেশন টুর এর শুরুতেই সেল্ফ গাইডেড এক Formal Garden Tour আছে। এই সুন্দর ফুলের বাগানে সবাই নিজের মত করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমিও বেড়ালাম। এই বাগানের গোলাপের একটা বিশেষত্ব রয়েছে।

এরপর দেখতে ঢুকলাম জন বুন এর হলঘরে। একজন গাইড এই বুন হল স্থাপনের ( ১৬৮১) গল্প কাহিনি শোনালেন। আমার সাথে রয়েছে নানান দেশের পর্যটক। আমিই একমাত্র ভারতীয়। এত অচেনা মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়ে ঘুরে বেড়াতে বেশ মজাই লাগছিল।

বুন হলের বড় আকর্ষন হল – Black History in America। এ এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। ১৭৯০- ১৮১০ এই সময়ের কালো মানুষদের গল্প দিয়ে সাজানো ন’টা কেবিন রয়েছে। লাল ইটের গাঁথনি দিয়ে গড়া এই ছোট ছোট ঘরগুলোর মধ্যে আমেরিকান স্লেভ হিস্ট্রি মর্যাদার সাথে সাজানো রয়েছে। প্রতিটা ঘরের দেওয়ালে তার গল্পকথা, অডিও শোনার সুব্যবস্থাও রয়েছে।

এই নটা ঘরের আলাদা আলাদা নাম আছে- Praise House, Slave Crafts, Life+ Family,

Archeological Discoveries, Work+ Life,  Emancipation + Freedom,  Struggle for Civil Rights, Leaders+ Heroes, gullah theater। প্রতিটি ঘর ঘুরে দেখতে দেখতে আমেরিকান ব্ল্যাক হিস্ট্রির অনেকটা জানা হয়ে যায়। এই ভ্রমণটা এক অসাধারণ শিক্ষামূলক সুন্দর ভ্রমণ।

এই Black History in America দেখা শেষ করে চলে গেলাম The Dock House এর কাছে। এখানে একটা আঁকাবাকা সরু নদী রয়েছে, নাম তার Wampancheone Creek। বুন হল থেকে এই সরু আঁকাবাঁকা নদী পথে পণ্য সরবরাহ করা হোত চার্লসটন বন্দরে। মূলত তাঁত ও পোড়া ইট ছিল এখানকার মূল পণ্য। এবং এই দুই পণ্যের গুণগত মান ছিল খুবই উৎকৃষ্ট। ডক হাউস জায়গাটা খুব নির্জন সুন্দর।  চুপ করে বসে থাকতে ভালো লাগে। অনেক নৌকো দেখতে পেলাম। জল টলটল এই সরু নদী বড় মায়াবী।

এরপর প্ল্যান্টেশান ও গার্ডেন টুর করলাম বেশ সুন্দর এক গাড়ি- Tractor- Pulled, open-air wagon এ চড়ে। দারুণ মজার এই ভ্রমণ। বুন হলের বিশাল এলাকা জুড়ে যে জঙ্গল, চাষবাস ও বাগান রয়েছে তা এক চক্কর ঘুরে দেখার আনন্দ খুব উপভোগ করলাম। এখানে কৃষি বলতে দেখলাম মাঠে রয়েছে ভুট্টা আর বাগানে স্ট্রবেরি ও ব্লুবেরির চাষ।

সবশেষে দেখতে গেলাম Gullah Culture। এখানে আলাপ হল নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে আসা অল্পবয়সী এক আমেরিকান দম্পতির সাথে। ছেলেটি কৃষ্নাঙ্গ ও মেয়েটি শ্বেতাঙ্গ।  দুজনেই খুব ভারী চেহারার হাসিখুশি স্বভাবের। গুলাও কালচার এর ইতিহাস একজন মহিলা বেশ সুন্দর ভাবে গল্পের ছলে বলে গেলেন। শুনতে ভালো লাগছিল। এই লাইভ শো দেখা শেষ হতেই বুন হাউস ভ্রমণও শেষ হল। এবার ফিরে যাব আবার ডাউনটাউনে।

Adventure Sight seeing এর গাড়িতে উঠে বসলাম। বুন হাউস ভ্রমণ সার্থক। চার্লসটনের সেরা দর্শনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে বুন হাউস প্ল্যান্টেশান অন্যতম।

চার্লসটনের ডাউনটাউনে চলে এলাম। এবার আমার শুরু হবে পায়ে পায়ে একলা ভ্রমণ-Historic Walking Tours। ডুলুং বলে দিয়েছে, রুট ম্যাপ করে দিয়েছে – কি কি দেখব আর পথেরও একটা নকশা আমার মোবাইলে পাঠিয়ে দিয়েছে।

শুরুতেই চোখে পড়ল পথের ধারের বিরাট The Charleston Museum। এই মিউজিয়াম আমেরিকার অন্যতম প্রাচীন এক মিউজিয়াম। কিন্তু বেলা শেষের দিকে। এখন মিউজিয়াম ঘুরে দেখতে গেলে আর কোনও কিছুই দেখা হবে না। তাই বাইরে থেকে যতটুকু দেখার দেখে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম চার্লসটন সিটি মার্কেটের দিকে।

এই শহরে আমি এখন একদম একা। পথে সবাই বিদেশী। পরিচিত কেউ নেই। আমি কোন সূদুর ভারতবর্ষ থেকে চলে এসেছি অচেনা আমেরিকায়। ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর আবার একটু কেমন যেন করছেও মনের অতলে। একবার একটু পথ ভুল হল। দাঁড়িয়ে পড়লাম এক বিরাট গির্জার পাশে। মোবাইল খুলে রুট ম্যাপ দেখে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। পথে লোকজনও বড় কম। হাঁটতে হাঁটতে এবার ঠিক চিনে চলে এলাম চার্লসটন সিটি মার্কেটে। এই সিটি মার্কেট খানিকটা যেন আমাদের কলকাতার নিউ মার্কেটের মত লাগল দেখতে। হরেক পসরা সাজিয়ে দোকানীরা বসে আছেন। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দেখছেন, কিনছেন। বেশির ভাগ দোকানীকেই দেখলাম মহিলা। ভালোই বেচাকেনা চলছে। আমি এই জনারণ্যে একা। জিনিসগুলো দেখছি। বেশিরভাগই ঘর সাজাবার জিনিস। দু’একটা জিনিসের দরদাম করতে গিয়ে দোকানীদের সাথে একটু কথাও বলা হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বেশ স্মার্ট। সুন্দর কথা বলছেন। আমি সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এই প্রাচীন এক শহরে বেড়াতে এসেছি এটা ওদের কাছে বেশ আনন্দের। একজন দোকানী হাসতে হাসতে বললেন,” I hope you are enjoying our city.”

সিটি মার্কেটের পাশেই রেনবো মার্কেট। এখানে সুন্দর সুন্দর সাইকেল রিক্সা দেখলাম। ঘোড়ার গাড়ি দেখলাম। অনেকেই ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ঘুরে দেখছে শহরটাকে।

রেনবো মার্কেট থেকে হাঁটতে হাঁটতেই চলে গেলাম চার্লস রিভারের কাছে। এখানে একটা সুন্দর Waterfront Park আছে। নদীতে ভেসে বেড়ানোর জন্য Water Taxi আছে। পার্কের কাছে যেতেই দেখলাম যিশুর বই ও ছবি নিয়ে কয়েকজন ধর্মপ্রচারক দাঁড়িয়ে আছেন। আমেরিকার প্রায় সব শহরেই এদের দেখেছি। কিন্তু কোথাও কথা বলার সুযোগ হয় নি। আজ সেই সুযোগ পেয়ে গেলাম। ওরাও আমাকে ওয়েলকাম করল, আমিও ওদের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। যিশুর কথা। মানুষের মঙ্গলের কথা। মঙ্গলময় ঈশ্বরের কথা ওরা গভীর বিশ্বাস থেকে বলে গেল। আমি শুনলাম। আমাকে বুঝিয়েও দিল, গুগুল সার্চ করে বাংলায় কিভাবে বাইবেল পড়তে পারি। পৃথিবীতে কত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। সব ধর্মেরই  সার কথা মানুষের মঙ্গল।  দয়া, মায়া, ভালোবাসার কথা সব ধর্মেই বলা হয়। এই ধর্মপ্রচারকরাও নিষ্ঠা ভরে সেই কাজটা করছেন। আমি শুনলাম। আমার সেই অর্থে কোনও ধর্মীয় পরিচয় নেই। আমি জন্মসূত্রে হিন্দু। কিন্তু আমার কর্মময় জীবনে এই হিন্দুত্ব নিয়ে কোনও ছুঁতমার্গ রাখি নি। একজন নিরীশ্বরবাদী সহজ মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই, মানুষের জন্য একটু হলেও নিজের মত করে কিছু কাজ করে যেতে চাই।

ওয়াটারফ্রন্ট পার্কে দুটো সুন্দর ঝর্ণা রয়েছে। একটার নাম আবার Pineapple Fountain। বেশ সুন্দর এই পাইনআপেল ফাউন্টেন। একদম আনারসের মতই দেখতে। এর পাশে দেখলাম প্রিওয়েডিং শুট হচ্ছে। দারুণ সুন্দর করে সেজে ছেলে ও মেয়েটা ছবি তুলছে। নতুন জীবন শুরুর সুন্দর মুহূর্ত। মনে মনে ওদের জন্য শুভ কামনা জানিয়ে এগিয়ে চললাম রেনবো স্ট্রিটের দিকে।

রেনবো স্ট্রিট ভারী মজার। এখানে সারি সারি  রঙিন বাড়ি। একটা বাড়ির সাথে অন্য বাড়ির রঙের কোনও মিল নেই। যেন সাতরঙা রঙে সেজে দাঁড়িয়ে আছে রেনবো পাড়াটা। এখানে এক অদ্ভুত মজার ঘটনা হলো। একদল হাসিখুশি বালিকা রঙিন পোষাকে প্রজাপতির মত উড়ে উড়ে আসছিল। ওরা হঠাৎ আমাকে পেয়ে বলল,” Sir, can you please take a photo of ours?” বলেই একজন মোবাইলটা এগিয়ে দিল। আমি তুলে দিলাম কয়েকটা ফটো। কি খুশি। অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা এগিয়ে গেল।

এরপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম চার্লসটন,  Battery র কাছে। Battery হল নদীর ধারের জায়গা। বড় সুন্দর এই ব্যাটরি। চার্লস নদীর জল বালুতটে এসে আছড়ে পড়ছে। নদীতে ভাসছে জেলে নৌকো। রঙিন বোট। এই নদীর পারেই দেখতে পেলাম অনেকগুলো রক্তকরবী ও শ্বেত করবীর গাছ। প্রথম দেখায় খুব আনন্দ পেলাম। ছবিও তুললাম। এই নদীর পাড়ের পাড়াটা খুব অভিজাত। সুন্দর সুন্দর বাড়ি দেখতে পেলাম। বাড়ির সামনে সব রাজকীয় গাড়ি।

পাশেই পেলাম ছোট্ট একটা পার্ক। ওয়াইল্ড লাইফ পার্ক। এই পার্কের নাইট হেরণ খুব বিখ্যাত। হেরণ হল এক ধরণের বড় পাখি।  তিন ধরণের হেরণ দেখতে পাওয়া যায়। Juvenile Night Herons, Adult Black crowned Night Heran, Adult Yellow Crowned Night Heron। এই পাখিদের সযত্নে রক্ষা করা হয়। আমি দিনের শেষে পার্কে ঢুকে পাখিদের ঘরে ফিরে এসে কিচিরমিচির খুব শুনেছি।

এই পার্কে কয়েকজন আমেরিকান মানুষের সাথে আলাপ হল। দু’চারটে কথা বিনিময় করে দুজনেই খুশি হয়েছি। বেড়াতে যাওয়া তো শুধু নতুন জায়গায় যাওয়া নয়, সেখানকার মানুষজনের সাথেও একটু কথা বলা, একটু মেলামেশা করার আনন্দ বেড়ানোর আনন্দকে আরও রঙিন করে তোলে।

দিন শেষ। ঘড়িতে সাড়ে সাতটা। সূর্য এবার ডুবু ডুবু করছে। সারাদিন চার্লসটন শহরটায় একা একা অনেক ঘুরে বেড়ালাম। কত কিছু দেখলাম। একটা প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর দেখার আনন্দ দারুণ উপভোগ করলাম। আমেরিকায় এই নিয়ে  দ্বিতীয় শহর এমন একা একা বেড়ালাম। মায়ামি ছিল সমুদ্র বন্দর শহর। চার্লসটন নদী বন্দর শহর। দুই শহরেই প্রাথমিক ভয় ও জড়তা কার্টিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ালাম। কত স্মৃতি সঞ্চয় করলাম। এবার একটু ক্লান্ত। ফিরে যাব হোটেল লা কুইন্টায়। উবের ডাকতে হবে। ডুলুংকে আর ফোন করলাম না। নিজেই ডেকে নিলাম উবের।

হোটেল লা কুইন্টায় ফিরে এসেছি। ফ্রেস হয়ে কফি বানিয়ে খেলাম। তারপর একটু গড়িয়ে নিলাম নরম বিছানায়। ডিনার আসবে অনলাইনে। আগামীকাল আবার চলে যাব নতুন ভ্রমণে, নতুন জায়গায়- জর্জিয়ার সুন্দর শহর সাভানা। কাল যাব সড়কপথে। গ্রে হাউন্ড বাসে করে।

রাত গভীর এখন। ডিনার শেষ করে আমার রাতের ওষুধটা খুঁজে দেখতে গিয়ে ড্রয়ার খুলেছি, হঠাৎ দেখি সেখানে রাখা একটা বাইবেল। হাতে তুলে নিলাম। পাতা উল্টে প্রথম পাতাতেই পেলাম…Are You…

Alone, Depressed, Addicted, Stressed… এমন আরও কয়েকটা অমোঘ শব্দ!..তারপরই লেখা..

Needing…

Hope, Peace, Joy, Comfort, Forgiveness…

নিজের এযাবৎ যাপন করে আসা জীবনটার সাথে এই প্রতিটি কথার কত মিল আছে। প্রতিটি শব্দ কত শব্দময়। কত মায়াজড়ানো। কত ভরসা মাখানো। তবু রাত্রির এই গভীরতায় কোনও শব্দই যেন সেভাবে মুখর হল না! আমাকে বিচলিত করতে পারল না।

আমি জানলার পর্দা সরিয়ে Ashley নদীর দিকে তাকিয়ে রাতের নির্জনতাকে দেখতে দেখতে আপনমনে গুণ গুণিয়ে উঠলাম , ” আমি   আশায় আশায় থাকি / আমার   তৃষিত- আকুল আঁখি /  ঘুমে – জাগরণে- মেশা   প্রাণে স্বপনের নেশা- / দূর দিগন্তে  চেয়ে কাহারে ডাকি…”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।