মার্গে অনন্য সম্মান শ্যামাপ্রসাদ সরকার (সর্বোত্তম)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৭৬
বিষয় – জীবনানন্দ দাশ

নির্জন নিয়তি

ধীর পায়েই মানুষটি চলেছে। ক্লান্তি আর অবসন্নতা তাঁর কাছে নির্জন নিয়তির মতো !
কোন পেশাতেই স্থিতু হতে তিনি অক্ষম। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনাটা তাও বেশ কিছুদিন করেছিলেন।

আজন্ম বন্ধনহীন তিনি। মোহময় অন্ধকার আর তার নির্জন স্বাক্ষর তাঁর শোণিত ধারায়। তিনি একা,একক, অন্তর্মুখী। বেশীর ভাগ লোকে তাঁকে ভুল বোঝে। তাতেও তিনি অবশ্য নিস্পৃহই।
…..

কাছেই বন্ধুবর বুদ্ধদেবের বাড়ি। সেখানে সর্বদাই অবারিত দ্বার তাঁর জন্য। বন্ধুপত্নী প্রতিভা সেখানে গেলে অন্নব্যঞ্জন দিয়ে তাঁকে আপ্যায়ন করেন। সেই পূর্ববঙ্গীয় স্বাদের খাদ্যগুলি তাঁকে বরিশালের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।

ওপার বাংলায় কি আর কখনো ফেরা হবে তাঁর?

ধলেশ্বরী,কীর্তনখোলা,রূপসা,ধানসিড়ি প্রভৃতি নামের নদীগুলি যেন নিজেরাই এক একটি কবিতার মত। এইসব নামগুলোকে তিনি আজীবন তাঁর বুকের মধ্যে লালন করে যাবেন। বাংলাকে এতটাই ভালবাসেন অন্তর থেকে যে সমগ্র পৃথিবী তাঁর কাছে অর্থশূন্য মনে হয় মাঝে মাঝে।

ধলেশ্বরী,কীর্তনখোলা,রূপসা,ধানসিড়ি প্রভৃতি নামের নদীগুলি যেন নিজেরাই এক একটি কবিতার মত। এইসব নামগুলোকে তিনি আজীবন তাঁর বুকের মধ্যে লালন করে যাবেন। বাংলাকে এতটাই ভালবাসেন অন্তর থেকে যে সমগ্র পৃথিবী তাঁর কাছে অর্থশূন্য মনে হয় মাঝে মাঝে।

কলেজ স্ট্রীটের খবর অবশ্য ভালো নয়। তাঁর অজানা আখর গুলি সেইভাবে প্রকাশকদের মনোমত হয়নি। কবিতার আধুনিক ভাষা সম্পর্কে পাঠক এখনো সচেতন নয়। যদিও একযুগ কাল সমাসন্ন যে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নির্বাপিত কিন্তু তাঁর কাব্যসুধায় এখনো বাঙালি যে বড় আচ্ছন্ন হয়ে আছে । তা থাকুক গে যাক!

মানুষটি যেন স্বগতোক্তির অন্তরাত্মা থেকে যেন অস্ফূটে একবার নিজের মনে মনে বলে ওঠেন –

“মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি/না এলেই ভালো হ’তো অনুভব ক’রে;
এসে যে গভীরতর লাভ হ’লো সে-সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয়—
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয় ”
…..

বিষাদ বৃক্ষের তলায় তিনি শেষ পর্যন্ত নিজের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন। তাই জাগতিক চাহিদাপূরণের নির্দয় ভারমুক্ত হতে পেরছেন একটু একটু করে।

ঘরে স্ত্রী লাবণ্যর সাথে কথা খুবই কম বলেন আজকাল। কারণ এতদিনে তিনি বোঝেন যে দুটি অসম মনের মানুষের ঘরবাঁধা সত্যি খুব দুরূহ। তাঁর সব অসম্পূর্ণতাকে স্বীকার করে তাঁকে ভালবাসা যে সহজ নয়। বোধহয় একজনই পারে তা এই সাতটা তারার তিমিরের নীচের পৃথিবীতে। যাকে তিনি অন্য নামেই ডেকে যাবেন আজন্মকাল।
…..
ট্রামলাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনটা উন্মনা হয়ে যায় তাঁর। কোলকাতার আকাশে কাক ছাড়া অন্য কোনও পাখি আজকাল বেশী দেখা যায় না। ‘ বড় ছাতাটির মত পাতাটির নীচে বসে আছে ভোরের দোয়েল পাখি’ আর কিছুদিন পরে তাঁর কবিতার বাইরে দেখাই যাবে না হয়তো। অবশ্য সেগুলি যদি মুদ্রিত হয় তবেই। একটি ট্রাঙ্কের ভিতরে বেশ কটি খাতায় উপন্যাস ও ছোট গল্পগুলি আপাতত শীতঘুমেই।

হঠাৎ যেন একটু দূরেই দেখতে পান সুচেতনাকে। সে যাদবপুরের দিকে উদ্বাস্তু কলোনীতেই থাকে না? একটি ইস্কুলে অস্থায়ী শিক্ষিকার চাকরি তার। বেতন টেতনও অনিয়মিত। পায়ের চটিটা বোধহয় ছিঁড়ে গেছে। পা টেনে টেনে হাঁটছে যেন।
…..

সুচেতনা কে ইশারায় ডাকছেন অনেক্ষণ থেকে। কিন্তু সে এখনো শুনতে পাচ্ছে না। দু টাকার মুড়ি আর বাদামভাজা কিনে একসাথে হেঁটে হেঁটে যাওয়া যেত তবে। আজ অবশ্য তাঁর পোশাকটি মলিন। দাড়িটুকুও আজ কামাতে ইচ্ছে হয়নি। তাই কি সুচেতনা চিনতে পারছেনা ওঁকে?

একটা ট্রাম অনেকক্ষণ ধরে ঘন্টা বাজাচ্ছে সরে যাবার জন্য।

কিন্তু সুচেতনা কি সত্যিই আজ সাড়া দেবেনা তাঁকে! তিনি ভিতরে ভিতরে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন।

এইবার ট্রামটি ক্রমশঃ তাঁর উপরে উঠে আসে। জ্ঞান হারানোর আগে তিনি যেন স্পষ্ট শুনতে পান তাঁর অতিপ্রিয় নারীকন্ঠের আবাহন,
– “সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী; ফুরায়
এ- লেনদেন ;/থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।