ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সমীরণ সরকার (পর্ব – ২০)

সুমনা ও জাদু পালক

প্রবল বেগে বাতাস বইছে সারা দ্বীপ জুড়ে। অনুভব করতে পারছে সুমনা। বাতাসের বেগে উড়ছে ওর চুল ,উড়ছে ওর পোশাকের অংশ। আর চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, দুধরাজের ধবধবে সাদা লম্বা কেশর শরতের কাশফুলের মত দুলছে বাতাসে। কিন্তু কই, গাছের একটা পাতা ও তো নড়ছে না। গাছগুলো থেকে ঝুলছে যে লতা গুলো ,সেগুলো তো দুলছে না ।রংবেরঙের গোছা গোছা যে ফুলগুলো ঝুলে আছে, সেগুলো তো দুলছে না।
আর পাখিগুলোই বা এত চুপচাপ কেন? এডাল ওডাল করছে না কেন?শিস দিচ্ছে না কেন?
ওরা ডাকছে না,কোন চঞ্চলতা নেই।যেন প্রাণের প্রকাশের কোন তাগিদ নেই। সব যেন স্থির হয়ে আছে কোন এক অদৃশ্য শক্তির নির্দেশে। কিন্তু কেন? কিসের জন্য?কার নির্দেশে?

 ‌ অদৃশ্য কণ্ঠ বলল ,তুমি একটু পরেই তোমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে সুমনা। চলো, এবার এগোনো যাক দুধরাজ ।দুধরাজ বড় বড় গাছ গুলোর ফাঁক দিয়ে এগিয়ে চলল ধীরে ধীরে। লতা থেকে ঝুলন্ত গোছা গোছা রং-বেরংয়ের স্থির হয়ে থাকা ফুলগুলো দু' হাত দিয়ে ছুঁতে খুব ইচ্ছে করছিল সুমনার। ওর খুব ইচ্ছে করছিল ওই অচেনা অজানা ফুলগুলোর গন্ধ বুক ভরে নিতে।

কিন্তু পরক্ষনেই ওর বুকের ভিতর থেকে কে যেন ওকে সাবধান করে দিলো।কে যেন বলে উঠলো, না সুমনা, অমন ভুল করোনা ,হাত দিয়ে ছুঁয়োনা ওই অচেনা ফুল ।
সুমনা তাই ভয়ে সেটা করলো না।হাত বাড়িয়েও পিছিয়ে নিল। ও মনে মনে ভাবলো , পালক বন্ধুরা তো বলেছিল যে, অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে তাকে। আসন্ন বিপদের আভাস ও দিয়েছিল। কাজেই সাবধানে থাকতে হবে তাকে।

      দুধরাজ চলছে তো চলছেই ।পথ যেন আর ফুরোয় না ।কত বড় এই হাসি খুশি দ্বীপ? সুমনা ভাবে ।আরো কিছু সময় পরে সুমনা দেখে,

গাছপালার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে ।পাতলা হয়ে আসছে জঙ্গল ।হঠাৎ সুমনা র চোখের সামনে যেন জঙ্গল ফুঁড়ে ভেসে উঠলো এক অতিকায় প্রাসাদের মাথা।
দুধরাজের লক্ষ্য কি তবে ওই প্রাসাদ? কারা থাকে ওই প্রাসাদে? সুমনাকে নিয়ে ওখানে কেনই বা চলেছে দুধরাজ ?
আরো কিছুটা পথ চলার পর,, চারিদিকে বেশ চওড়া পরিখা দিয়ে ঘেরা এক মস্ত প্রাসাদ দেখতে পেল সুমনা। প্রাসাদ টা বিরাট হলেও এখন যেন জৌলুসহীন। প্রাসাদের স্থানে স্থানে জমেছে শ্যাওলা। দেওয়ালের ফাটলে আগাছার বিস্তার।
দাঁড়িয়ে গেল দুধরাজ পরিখার এপারে। পরিখার ওপারে নজরে আসছে সুউচ্চ প্রাচীর । প্রাচীর শুধু উঁচু নয় ,বেশ চওড়া ও ।
প্রাচীরের উপরে কিছুটা অন্তর ছোট ছোট ঘেরা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র পাহারাদার। ওরাও জঙ্গলে দেখা গাছগুলোর মতই স্থির, ,নিস্পন্দ।
তাহলে কি এই ‘হাসিখুশি দ্বীপে’ কেউ গতিশীল নয় ?সবাই স্থির ?তাহলে তাকে এখানে নিয়ে আসার কারন কি? দুধরাজ দাঁড়িয়ে গেল কেন? ডানা মেলে পার হবে না পরিখাটা?
অদৃশ্য কন্ঠ অনেকক্ষণ বাদে আবার বলে উঠল, সুমনা, দুধরাজের এই পরিখা পেরিয়ে যাওয়ার হুকুম নেই। ওই পরিখা তোমাকে একাই পার হতে হবে ।আমিও তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারব না ।
—আমাকে পরিখা পার হতে হবে কেন? কোথায় যেতে হবে আমাকে?
— পরিখা পার হলেই তুমি অনেক কিছু জানতে পারবে। জানতে পারবে তোমার আসল পরিচয়। ও হ্যাঁ, একটা কথা মনে রেখো। ওই পরিখায় আজও ঘুরে বেড়ায় বিশাল বড় বড় কুমির। কোন কারনে কেউ পরিখায় পড়ে গেলে তাকে গিলে খায় ওরা।
—- কিন্তু আমি পরিখা পার হবো কিভাবে?
— ভেবে দেখো ।ঠিক পারবে তুমি ।
সুমনা পরিখার দিকে তাকায়। বড় বড় ঘাস জঙ্গলে বুজে এসেছে পরিখা। হয়তো ওর নিচেই আছে জল আর মানুষখেকো কুমির।

       এদিক ওদিক তাকায় সুমনা।পরিখার এপারে দুধরাজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে পেল্লাই লম্বা একটা শাল গাছ দাঁড়িয়ে আছে।আবার  ঠিক তার বিপরীতে পরিখার ওপারে দাঁড়িয়ে রয়েছে  একটা ঝাঁকড়া অর্জুন গাছ। সেটাও পেল্লাই লম্বা।

সুমনার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে। এ দুটো গাছকে যদি কোনভাবে সংযুক্ত করা যায় তো সহজেই ওপারে যাওয়া যায়।
কিন্তু কে সাহায্য করবে তাকে?
এবার মনে মনে লালপরীর পালক বন্ধুকে স্মরণ করে সে। মুহূর্তেই হাজির হলো লাল পরীর পালক ।
লাল পালক বলল ,আমাকে স্মরণ করেছো কেন বন্ধু ?কী চাও আমার কাছে ?
—আমি পরিখা পার হয়ে ওপারে যেতে চাই ।——–আমিতো তোমাকে নিয়ে ওপারে যেতে পারবো না।হুকুম নেই আমার।
— আমি তা চাইও না ।আমি শুধু সাহায্য চাইছি।দু’ধারের ওই পেল্লাই গাছ দুটোকে যদি বিঁধা যায়।ন
—– ও । তা ওই দুটো গাছকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তুমি কি করবে ?
—আমি ঝুলে ঝুলে ঠিক পৌঁছে যাব ওপারে । ——–পারবে ?
—আমি এইরকম কত করেছি আমাদের গ্রামে ।বটের ঝুরির সঙ্গে ঝুরি বেঁধে ঝুলে ঝুলে দূরে চলে যেতাম।
— বেশ ,তুমি চোখ বন্ধ করো।
সুমনা চোখ বন্ধ করে।ও অনুভব করে, তার চোখে কেউ যেন কিছু আলতো করে বুলিয়ে দিচ্ছে । ওই লাল পালক বন্ধুই করছে কিছু । একটু সময় পরে পালক বন্ধু বললো, এবার চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখো সুমনা।
সুমনা চোখ খুলতেই দেখতে পেলো, দুটো গাছের মাথা সংযুক্ত করা হয়েছে একটা দড়ি দিয়ে।
লাল পরীর পালক তখনো ভাসছে সামনে।
ও বলল, ওই সূক্ষ্ম দড়িটা তুমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পাবেনা। তুমি যখন চাইবে, তখনই দড়িটা যুক্ত হয়ে যাবে।তুমি না চাইলে থাকবে না দড়ি। যাও, এবার ওপারে যাও ।তবে খুব সাবধান ,নিচে কিন্তু কুমির আছে। আমি এখন চলে যাচ্ছি বন্ধু।
—-তোমার দেখা আবার কখন পাবো বন্ধু ?
—-ঠিক সময়ে পাবে । তবে এরপর তোমার কোন সমস্যা হলে, তুমি কমলাপরীর পালক কে ডেকো। কথা শেষ করেই শূন্যে মিলিয়ে গেল লাল পরীর পালক।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।