ধারাবাহিক ভ্রমন সিরিজে শতদ্রু ঋক সেন – ৫৩

ফেরা

অন্যরকম গল্প

মিশ্রা জী, খৈনীর ডিব্বা আর আকাশ যাত্রা

ঘটনা টির বর্ণ বর্ণ সত্যি.. খালি নাম ধাম এট্টু বদলে দিলাম এই আর কি….

ভোলা পরসাদ মিশ্রার আদি নিবাস গোরখপুর.. তবে গত পচ্চিস বছর ধরে সে কোলকাতায় কর্মরত। এক বিদেশী কোম্পানির কোলকাতার কারখানায় সে চাকরি করে, যথেষ্ট ভালো মাইনে পত্তর পায়, এছাড়াও দেশ দেহাতে তার জমি বাড়ি, চাষাবাদ, মোটর সাইকিল সবই আছে।

এহেন মিশ্রাজীর দুটো দুর্বলতা আছে.. এক কারখানায় ওভার টাইম পেলে সে সবার আগে ছোটে.. তার নিজের ভাষায় হামি ব্রামহিন আছি, যোতো কাজ বেশী করবো, তত হামার পূণ্যি হবে। আর তাছাড়া আমি যতটা পোডাকসন দিব, ততটা আর কেউ দিবে না, এককথায় হামি পোডাকসন কিং আছি। (বলতে নেই মিশ্রাজির কাজ করার নিষ্ঠা আর ক্ষমতা সত্যিই ঈর্ষনীয়)। আর দ্বিতীয় তথা প্রধান দূর্বলতা হলো তার বৌ তথা তিন ছেলেমেয়ের মা শোভা দেবী। বৌ কাছে থাকলে মিশ্রা রোজ টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে অভ্যস্ত(বুঝো সাধু না কর সন্ধান)। নিন্দুকেরা বলে একবার দুপুরে অফিস থেকে ফিরে মিশ্রা ঘুমিয়ে পড়ার পর তার কোন এক ছোটো শালা তার পাশে শুয়ে পড়েছিল, খানিক পরেই তাকে তার দিদি ভেবে মিশ্রা টি টোয়েন্টি খেলতে গেছিল, দশ মিনিটের মাথায় সেই যে শালা দৌড় মেরেছে, আজ দশটি বছর হয়ে গেল সে আর কোলকাতায় পা বাড়ায়নি।

এহেন মিশ্রার বেশ কয়দিন যাবৎ মন খারাপ। ছেলে মেয়ে বড়ো হচ্ছে বলে বৌ ইদানীং দেহাতেই থাকে.. এক দু মাস আগে ঘর যাবে ভেবেছিল, কিন্তু তখন ওভারটাইম এর ধুম, কিং কি করে নিজের সাম্রাজ্য ছেড়ে যায়। অতএব পুজোর ছুটিই ভরসা। এদিকে টিকিট জুটেছে ১৮০ ওয়েটিং। দুদিন পর গেলে কনফার্মড টিকিট ছিলো, কিন্তু দুদিনের টি টোয়েন্টি ম্যাচ ছাড়া? মোটেই নয় মশাই মোটেই নয়। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো আছে একটা ছোকরা একজিকিউটিভ এর টীকা টীপ্পনী। দেখা হলেই হুল ফোটায়.. কেয়া মিশ্রাজী আউর কিতনা দিন বাকি হ্যায় টি টোয়েন্টি খেলা স্টার্ট হোনেমে? ক্ষেপে গেলেও মিশ্রা চুপ থাকে আর মনে মনে দিন গোনে।

এদিকে যাওয়ার দিন এসে যায়, টিকিট কনফার্ম হয়না। রাত পোহালেই পরদিন দুপুরে যাত্রা। কি করবে ভাবতে ভাবতে মিশ্রার ঘুম উড়ে গেছে। হঠাৎ দেবদূতের মতো উদয় হয় তার বস.. ছোকরা সুপারভাইজার। মিশ্রা কে বলে কোই বাত নেহী, তোমার ডেবিট কার্ড নিয়ে এসো, প্লেনের টিকিট কেটে দিচ্ছি.. এবার বৌয়ের কাছে উড়ে যাও। বাড় খেয়ে মিশ্রাও চেগে যায়, তার আরেক দেশোয়ালি ভাই ও সাথে যাবে কথা দেয়। টিকিট কাটা হয়, মিশ্রার মনে হয়, কেউ যেন লোহা গরম করে ছেঁকা দিচ্ছে, ৫৪০০ টাকা? যাকগে টাকা, বৌ তো আগে, ভেবে চুপ থাকে। মনে মনে ভাবে মোট কটা ওভার টাইম করলে সে এই টাকা তুলে নিতে পারবে।

পর দিন দুপুর .. মিশ্রা ও তার সাথী মাহাতো পৌঁছে গেল দমদম। কিন্তু এয়ার পোর্টে ঢুকেই কেস, মিশ্রার পকেটে থাকা খৈনীর ডিব্বা বাজেয়াপ্ত হয়। বেচারা সারা এয়ারপোর্ট ঢুঁড়ে ফেলে এক প্যাকেট খৈনীর জন্য, কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা, কোথাও পায় না। উল্টে একবার খোদ সিকিউরিটি ইনচার্জের কাছে খৈনীর হদিস জানতে চাওয়ায় ওকে আরও চারবার চেক করে সিকিউরিটির লোকজন। তবে প্লেন আসলে উঠে পড়ে, তবে সেখানেও বিধি বাম, মাহাতো আগেই জানালার ধারে সিট দখল করে নিয়েছে। বেজার মুখে আইলের ধারের সিটে বসে মিশ্রা। সিটবেল্ট লাগাতে পারেনি ঠিক করে, ভাবে এয়ার হোস্টেস দের সাহায্য নেবে, কিন্তু ঠিক সাহসে কুলোয় না। বসে আছে তো বসেই আছে, কেউ এক কাপ চাও দেয় না। একজনকে জিগ্যেস করে জানতে পারে যে এক কাপ চা দেড়শো টাকা দিয়ে কিনে খেতে হবে.. ভিরমি খেতে খেতে সামলে নেয় কোনোরকমে, মনে মনে ভাবে বেঁচে থাক বাবা কোম্পানির চায়ের কল, কাপ নিয়ে গেলেই হোলো, ফ্রিতে যত খুশী খাও। খালি খৈনীর ডিব্বার জন্য মনটা হুহু করে ওঠে মাঝে মধ্যেই।

বসে বসে এক ঘণ্টা কেটে যায়, প্লেন মনে হয় নড়েও না, চড়েও না। হঠাৎ ইংরেজি তে কি সব ঘোষণা হয়, তার পাচঁ মিনিটের মধ্যেই মাহাতো এসে বলে চল মিশ্রা, গোরখপুর আগৈলবা। আ্যঁ বলে কি বেটা, মিশ্রার মনে হয় বেটা নিশ্চয়ই গুল মারছে। এতো তাড়াতাড়ি কখনো পৌছনো যায়? নিশ্চয়ই প্লেন টা খারাপ হয়েছে… অন্য প্লেনে যেতে হবে, এই ভেবে মাহাতোর সাথে নেমে পড়ে। এয়ারপোর্টের এক কর্মী যখন বলে যে গোরখপুর মে আপকা স্বয়াগত হ্যায়, তাকেও ঘোরতর মিথ্যাবাদী মনে হয় তার। তবুও লোকটি দেশোয়ালি দেখে শুধায়.. ইয়ে সাচমুচ গোরখপুর হ্যায়? একগাল হেসে কর্মীটি সাইনবোর্ড এর দিকে আঙুল দেখায়… সেখানে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে গোরখপুর…

মিশ্রা লাফিয়ে ওঠে.. আরে হাম পৌছ গয়া। প্লেন টার দিকে মুখ ফিরিয়ে লম্বা পরনাম দেয় সে। দৌড় লাগায় একজিট এর দিকে। আহঃ ঘর, বিবি, টি টোয়েন্টি ম্যাচ.. জয় মা। তবে ঘর ঢোকার আগে একটি জরুরি কাজ সারবে ঠিক করে মিশ্রা… আগে একটা খৈনী সমেত ডিব্বা কিনতে হবে তুরন্ত..

বি দ্র.. ছুটির পর মিশ্রা কাজে যোগ দিয়েছে। এখন রোজ সে তার বসের কাছে শীতের ছুটি আর পরের পুজোর প্লেন টিকিট বুকিং করার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করছে। কানাঘুষায় এটাও প্রকাশ পেয়েছে যে প্লেনের গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সে এবার টি টোয়েন্টি নয়, বরং টি টেন খেলেছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।