সমীপেষু

যা চণ্ডী

হাউস টেকটাচটকের পক্ষ থেকে এবার পুজোতে ঘরে বসেই পুজো কাটানোর ব্যবস্থা করেছিলো। তাও যেকোনো ভাবে নয়, ষষ্ঠী থেকে দশমী প্রতিদিন প্রতিঘন্টায় একঝাঁক করে কবি সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, দশমীর দিন বৈঠকি আড্ডার ব্যবস্থাও করেছিলো আপনাদের নিয়ে। সুতরাং সব নিয়ে এবছরের বৃহত্তম ওয়েব ম্যাগাজিন প্রকাশ পেয়েছে। দুই বাংলাকে সাহিত্যে সংযুক্তিকরণ ইতিপূর্বেই ঘটিয়েছিলো টিম টেক-টাচ-টক। এইবারে বাংলাদেশ ছাড়াও আরও ৪টি দেশের প্রবাসী বাঙালি আমাদের লেখা পাঠিয়ে সমৃদ্ধ করেছে। ওখানকার প্রবাসী বাঙালিদের থেকে ভালোবাসা পেয়ে আমরা কতটা আনন্দিত তা লেখার যোগ্য নয়। বলবারও নয়। ওদের জন্য আমাদের তরফ থেকে স্যালুট।
সে যাইহোক, নিজের ঢাক পিটিয়েও হাত ব্যাথা করে। আমারও করছে। তাই বিষয়ান্তরে যাই। দশমীতে অন্যান্যদের সাথে আমারও একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো। সেখানে দশমীপুজোর অনঙ্গ অঙ্গ অপরাজিতা পুজো নিয়ে কিছু আলোকপাত করতে চেষ্টা করেছিলাম। সেই লেখাটিতে মার্কণ্ডেয় পুরাণ তথা শ্রীশ্রী চণ্ডীর কোনো উদ্ধৃতি বা ব্যাপ্তি প্রকাশ করিনি। ইচ্ছা করেই করিনি। সবাই যা জানে তা নতুন করে বলবো না বলেই বলিনি। পাঠককুল তাতে বেঁকে বসে। আমাকে চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ করতেই হবে। সুতরাং তাঁদের কথা দিয়েছিলাম পরের লেখাতেই সেই অভাবকে অভাবনীয়তে পরিবর্তন করার চেষ্টা করবো। সেই চেষ্টাই করছি মাত্র।
বস্তুত সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানবসভ্যতার শুভ এবং অশুভ শক্তির সমান্তরাল অস্তিত্ব বিদ্যমান, সেটা অন্তর্জগতেই হোক আর বাহ্যজগতে। বাহ্যজগতে যেমন চলছে সুর আর অসুরের নিয়ত যুদ্ধ, তেমনি অন্তর্জগতে চলছে সুর আর অসুরের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। তবে আমাদের সুখের কথা হলো এই যে, অশুভ বা অসুর শক্তি যতই প্রতাপশালী হোক না কেন, শুভশক্তির কাছে তার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। দুর্গাপূজা তথা শক্তিপূজার আধ্যাত্মিক ভার বা তাৎপর্য মূলত এটাই। শক্তিকে আমরা মা বলি, কারণ তিনি নির্গুণ ব্রহ্মে শক্তি স্বরূপিনী পরমব্রহ্মমহীয়সী। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘মাতৃ উপাসনা একটি স্বাতন্ত্র্য দর্শন। আমাদের অনুভূত বিবিধ ধরনার মধ্যে শক্তির স্থান সর্বপ্রথম। প্রতি পদক্ষেপে এটি অনুভূত হয়। অন্তরে অনুভূত শক্তি আত্মা, বাইরে অনুভূত শক্তি প্রকৃতি। এই দুইয়ের সংগ্রামই মানুষের জীবন। আমরা যা কিছু জানি, অনুভব করি তা এই দুই শক্তির সংযুক্ত ফল। মানুষ দেখেছিল ভালো-মন্দ উভয়ের ওপরই সূর্যের আলো সমভাবে পড়েছে। ঈশ্বর সম্পর্কে এ এক নতুন ধারণা। এক সার্বভৌম শক্তি সবকিছুর পশ্চাতে। এভাবেই মাতৃভাব উদ্ভূত… । যুগে যুগে আমাদের মধ্যে এই শুভ-অশুভের সংগ্রাম ছিল, আছে এবং থাকবে। তাই যখনই আসুরিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে তখনই মা আসবেন বা মহাশক্তির জাগরণ ঘটবে। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে মা বলেছেন-
ইত্থং যদা যদা বাধা দানব- বোত্থা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবর্তীর্য্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্। (শ্রীশ্রী চণ্ডী ১১/৫৫)।
অর্থ_ যখন এ রূপ দানবজনিত অত্যাচার সংঘটিত হবে, তখন আমি অবতীর্ণ হয়ে অসুরদের বিনাশ করব।
গল্পের শুরু দুজনকে দিয়ে। একজন হচ্ছেন রাজা সুরথ, অন্য জন সমাধি বৈশ্য। সুরথ একজন গুণী রাজা তিনি প্রজাদের ভালবাসতেন। কিন্তু শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রাজ্য হারিয়ে তিনি বনবাসী হলেন। বনে ঘুরতে ঘুরতে তিনি সুন্দর এক তপোবনে পৌছালেন, যেটা ছিল মেধা ঋষির আশ্রম। আশ্রমে সবার আপ্যায়ন এবং সমাদর পেলেন তিনি, সেখানে শুধু শান্তি, হিংসাদ্বেষ কোনটাই নেই। তবুও রাজার চিত্ত চঞ্চল শান্তি নেই মনে শুধু সর্বক্ষণ চিন্তা তার হারানো রাজ্যের। এর মধ্যে তার দেখা হল সমাধি নামক বৈশ্যের সাথে, তিনিও বনবাসী, ঘুরতে ঘুরতে তপোবনে এসে পড়েছেন। দুজনের কথাবার্তা হল তারপর সমাধির মুখ থেকে জানা গেল তিনি বৈশ্য (ব্যবসায়ী), তার ভাগ্য আরও খারাপ। সে তার স্ত্রীপুত্রদের দ্বারাই লাঞ্চিত, তার সমস্ত ধন কেড়ে নিয়ে তাকে বের করে দেয়া হয়েছে। এ দুঃখের পরও দুরাত্মা স্বজন পরিজনের কথা ভুলতে পারছেন না, স্ত্রীপুত্রদের কথাই মনে হচ্ছে বারবার। দুজনের অবস্থা প্রায় একই, তাই তারা মেধা মুনির কাছে গিয়ে বললেন, হে মুনিবর আমরা দুজনেই নিজেদের লোক দ্বারা নিপীড়িত ও বিতাড়িত হয়ে আজ এই তপোবনবাসী। তারপরও দেখা যাচ্ছে আমি আমার রাজ্যের কথা এবং সমাধি তার স্ত্রীপুত্রের কথা ভুলতে পারছে না। আমরা যে নির্বোধ তাও না, মানুষ পরিজন নিয়ে যে সুখ পায় তা থেকে আমরা বঞ্চিত এবং সংসার অনিত্য, কেউ কারও নয় জেনেও মন মানে না, এমন বিভ্রমের কারণ কি?
মুনি বললেন সবারই জ্ঞান আছে, পশুপাখিদেরও জ্ঞান আছে তবে একেক জনের জ্ঞান একেক রকম। সবাইতো চোখ দিয়ে দেখে, কিন্তু পেঁচা দিনের আলোতে, কাক রাতে আর কেঁচো দিনরাত কখনও দেখতে পায় না। সকল প্রাণীর মায়া মমতা আছে পাখি নিজে না খেয়ে তার শাবককে খাওয়ায়, মানুষও ছেলে মেয়ে বড় করে তার প্রতি আশা করে। এই মায়া জ্ঞানীর চিত্তও আকর্ষণ করে অজ্ঞানীর মত কাজ করায়। এসব দেবী মহামায়ার মায়া, সংসারে সকল কিছুকে সে তার মায়ায় আবদ্ধ করে রেখেছে। এই মায়া আমাদের অনিত্য বস্তুর দিকে টেনে নেয়, নিত্যকে ফেলে। এমনকি স্বয়ং পরমেশ্বরও কখনও কখনও নিজের এই মোহিনী মায়ায় বশ হয়ে থাকেন।
এই বিশ্ব সংসার তিনিই সৃষ্টি করেছেন, তাই এ বিশ্ব তার প্রতিমূর্তি। তাকে যদি ভক্তিভরে প্রসন্ন করা যায়, তবে মোহবন্ধন মুক্ত করে ঈশ্বরের পথে তিনি নিয়ে যান। এখানে মহামায়া সম্পর্কে মুনি যা বললেন তাতে তার স্বরূপ বোঝা গেল, বিশ্লেষণে কলেবর বৃদ্ধির প্রয়োজন নাই।
মুনির বর্ণনা শুনে রাজা সুরথ বললেন আপনি যাকে দেবী মহামায়া বলছেন তিনি কে? কি প্রকারে জন্মেছেন? কার্যই বা কি? যেভাবে যে আকৃতি নিয়ে তিনি প্রকাশিত হয়েছিলেন তার বর্ণনা করুন। এরপর মুনি দেবীর কাহিনি বলতে লাগলেন। পুরো চণ্ডিতে এই দেবীর তিনটি চরিত্রের বর্ণনা আছে। দেখা যাক এই তিন চরিত্রের বর্ণনা কেম এবং কেমন এর আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক চেতনা।
প্রথম চরিতঃ
মুনি দেবীর বর্ণনা করতে লাগলেন, বললেন তার জন্ম-মৃত্যু নেই তথাপি বিভিন্ন সময় দেবতাদের স্তুতিতে তিনি বিভন্ন রূপে আসেন।প্রলয়ের পর জগত যখন এক বিরাট সমুদ্রে পরিণত হল, তখন পরমাত্মা শ্রীবিষ্ণু অনন্ত নাগের শয্যায় যোগ নিদ্রায় গেলেন। তার কর্ণমূল থেকে সৃষ্টি হল মধু এবং কৌটভ নামরে দুই অসুর, সৃষ্টি হয়েই সে বিষ্ণু নাভি কমলে অবস্থিত ব্রহ্মাকে মারতে উদ্দ্যত হলেন, ব্রহ্মার সৃষ্টি রক্ষায় বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। তখনই ব্রহ্মা বিষ্ণু নিদ্রারূপী তামসিক মহামায়া যোগ নিদ্রা দেবীর স্তব করতে লাগলেন শ্রীবিষ্ণুকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য। স্তবে তুষ্ট হয়ে দেবী বিষ্ণুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে বাহির হলেন এবং বিষ্ণু দানবদের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন, এসময় মহামায়ার প্রভাবে মধু কৌটভের গর্ব হল আর শ্রীবিষ্ণুকে বর দিতে চাইলেন। বিষ্ণু বললেন তোমরা আমার হাতে নিহত হও, মধু কৌটভ বিপদে পড়ে গেল, তখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখে বলল ঠিক আছে আমরা তোমার বধ্য হব তবে কোন স্থলভাগে বধ করতে হবে তখন শ্রীবিষ্ণু তার উরুর উপর রেখে তাদের বধ করলেন।তারপর সেই অসুরদের মেদ থেকে সৃষ্টি হল মেদিনী, এ হল মধু কৈটভ বধের কাহিনী।
এবার বিশ্লেষনে আসা যাক, প্রথমেই দেখা গেল স্তবে যে দেবী আবির্ভূত হলেন ইনি তামসিক দেবী মহাকালী তার ধ্যান চণ্ডিতে বর্ণিত আছে ইনি দশ মুখ, দশ হাত, দশ পা এবং বিভিন্ন ভয়াবহ অস্ত্রে সজ্জিত। তার কারণ সৃষ্টির প্রারম্ভে থাকে বিশৃঙ্খলা, জলেই প্রাণের সৃষ্টি তাই মধু কৌটভ সৃষ্টিকে সূচনাতেই নষ্ট করতে চেয়েছিল তাই মার এমন ভয়াবহরূপ। একটু ভাবলে বোঝা যায় আদিম মানুষ বর্বর ছিল তারা ছিল নৃশংস। বিজ্ঞান বলে পৃথিবী এক সময় সম্পূর্ণ জল ছিল, পরে স্থল ভাগ জেগে ওঠে, এবং বিজ্ঞানীরা এটাও বলেছেন প্রাণের প্রথম বিকাশ জলেই হয়, চণ্ডিতে এসব প্রচ্ছন্নভাবে বর্নিত আছে।
এদিকে বিজ্ঞান বলে সূর্যের ছিন্ন অংশ থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি, চণ্ডিতেও দেখা যায় শ্রীবিষ্ণুর সাথে পরাজিত মৃত অসুরের মেদ থেকে মেদিনী সৃষ্টি হল। বলা প্রয়োজন শ্রীবিষ্ণু হচ্ছে আদিত্য, আদিত্যই সূর্য। তাই এখান থেকেও বৈজ্ঞানিক সত্যের সাথে ধর্মের মিল বন্ধনের অভ্যাস পাই।
দ্বিতীয় চরিতঃ
মহিষাসুর নামে এক পরাক্রমশালী অসুর যিনি ছিলেন রম্ভাসুরের পুত্র এবং তার মাতা ছিল মহিষানী। সেই মহিষাসুর দেবতার বরে পুরুষের অবধ্য ছিলেন।এক সময় সে ইন্দ্রদি দেবগনকে স্বর্গ ছাড়া করলেন। তারা পৃথিবীতে এসে ছদ্মবেশে ঘুরতে লাগল। পরে দেবতারা একত্রিত হয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলেন কিন্তু তার বরেই যে অসুর অপরাজেয় তাই দেবতারা তাকে নিয়ে বৈকুণ্ঠে গিয়ে দেখলেন শ্রীবিষ্ণু আর শিব কথা বলছেন। তারা সকল কথা বিষ্ণু এবং শিবকে বললেন। সব শুনে বিষ্ণু এবং শিব ক্রোধিত হলেন সাথে ব্রহ্মা এবং দেবতারাও ক্রোধান্বিত হলেন, এসময় তাদের সেই তেজ থেকেই সৃষ্টি হল মহাশক্তি জগত জননী দেবী মহামায়া দুর্গা। শম্ভুর তেজে এই দেবীর মুখমণ্ডল, বিষ্ণুর তেজে বাহুযুগল ইত্যাদি এবং সমস্ত দেবতারা তাকে নানা অলঙ্কার এবং বিবিধ অস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করলেন। শিব ত্রিশুল; বিষ্ণু সুদর্শন চক্র, গদা, ব্রহ্মা অক্ষমালা কমন্ডলু, হিমালয় সিংহ প্রভৃতিতে সজ্জিত দেবী অট্টহাসিতে বিশ্বসংসার প্রকম্পিত করে তুললেন। তারপর তিনি অসুরকে বধ করতে গেলেন এবং বধ করলেন। মহিষাসুর বধে দেবী যে রূপে অবতীর্ন হয়েছিলেন তা হচ্ছে মহালক্ষী। ইনি অষ্টাদশভূজা অর্থাৎ আঠারো হাত এবং প্রসন্ন বদনা তবে আমরা মার এই মহিষাসুর বধ রূপে তাকে দুর্গাপূজায় বন্দনা করি, কিন্তু আমরা দেখি মূর্তিতে দেবীর দশ হাত আর এখানে দেবীর আঠেরো হাত কারণ কালিকা পুরানের ৬০তম অধ্যায়ে বর্নিত আছে- প্রথমকল্পে ভগবতী মহামায়া অষ্টদশভূজা উগ্রচন্ডারূপে মহিষাসুরকে বধ করেন [ বলা বাহুল্য শিবের বর লাভ করে মহিষাসুর রম্ভাসুরে ঔরসে তিনবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং দেবী তিনবার বা তিন কল্পে তিন রূপে অসুর বধ করেন ] দ্বিতীয় কল্পে ষোড়শভূজা ভদ্রকালীর রূপে অসুর বধ করেন। আর তৃতীয় অর্থাৎ বর্তমান এই শ্বেত বরাহকল্পে দেবী দশভূজা মহিষাসুরমর্দ্দিনী। তাহলে বোঝাই গেল আমরা যে কল্পের মানুষ অর্থাৎ শ্বেত বরাহকল্পে দেবী দশভূজা তাই দুর্গাপূজায় মাকে আমরা দশভূজা রূপেই দেখি।
উত্তম চরিতঃ
এবার যাওয়া যাক শেষ বা উত্তম চরিতের কাহিনিতে। মহিষাসুরের পর শুম্ভ নিশুম্ভ নামে দুই অসুর আবার দেবতাদের পরাজিত করল।রাজ্যহারা দেবতারা সেই মা দুর্গার কথা ভাবতে লাগলেন। তখন সমবেত দেবতারা হিমালয়ে দেবীর স্তব করতে লাগলেন। এসময় আবার দেবী গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যা পার্বতী রূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি স্নান করতে যাচ্ছিলেন, দেবতাদের স্তব করতে দেখে বললেন আপনারা কার স্তব করছেন, তখন পার্বতীর দেহ থেকে এক আলোকময়ী দিব্যমূর্তি বেরিয়ে এসে বললেন অসুর দ্বারা পরাজিত দেবতারা আমার স্তব করছে। পার্বতীর শরীর কোষ থেকে বেড়লো বলে তার নাম হল কৌষিকী। কৌষিকী দেবী প্রকটিত হবার পর পার্বতীর গায়ে রং হল কৃষ্ণ বর্ণ, তাই তার নাম হল কালী। দেবী তাদের আশ্বস্ত করলেন এবং তার দিব্য সৌন্দর্য বিলিয়ে হিমালয়ে বিচরণ করতে লাগলেন। এসময় চণ্ড মুণ্ড নামে শুম্ভ নিশুম্ভের দুই অনুচর দেবীকে দেখে শুম্ভ নিশুম্ভের কাছে যেয়ে তার রূপের বর্ণনা করল। তখন শুম্ভ তাকে অথবা তার ভাইকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে দূত পাঠালেন দেবীর কাছে। এদিকে দূত মারফত দেবী শম্ভু নিশুম্ভের পরাক্রমের কথা সব শুনে বললেন তুমি যা বললে তাতে ভুল নেই কিন্তু আমি অল্প বয়সের দরুন এক নির্বুদ্ধিতার কাজ করে ফেলেছি। ছোট কালে বুদ্ধি কম থাকায় আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আমাকে যুদ্ধে হারাতে পারবে তাকেই আমি বর মাল্য দেব। দূত অবাক হয়ে ফিরে এসে শুম্ভকে সবিস্তারে সব বললেন। ক্রোধান্বিত শুম্ভ প্রথমে তার সেনাপতিদের পাঠালেন, সবাই পরাজিত এবং ধবংস হল। দেবীর ভয়ঙ্কর অট্টহাসিতে বিশ্বসংসার নিনাদিত হতে লাগল, এসময় রক্তবীজের আগমন হল। তাকে মারলে তার রক্ত মাটিতে পরার সাথে সাথে আরও অসুর সৃষ্টি হতে লাগল। এদিকে শুম্ভের সেনাপতি চণ্ড মুণ্ড বধের সময় দেবীর ক্রোধান্বিত ললাট থেকে এক ভীষণ খড়গধারিনী নৃমুন্ডমালিনী দেবী সৃষ্টি হয়েছিল। সেই দেবী, অম্বিকার আদেশে অসুরের সমস্ত রক্ত পান করে রক্তবীজ বধ করলেন। এরপর নিশুম্ভকে ধবংশ করলেন, তারপর শুম্ভ যুদ্ধ করতে এসে দেবীকে বললেন তুমি গর্ব করো না কারণ অন্যের বলের সহায়তায় যুদ্ধ করে তুমি জয়ী হচ্ছো। [ বলাবাহুল্য এ ভয়াবহ যুদ্ধে বিভিন্ন দেবতাদের শক্তি দেবীর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন যেমন শিবের শিবদূতি, বিষ্ণুর বৈষ্ণবী প্রভৃতি। যদিও এগুলো সেই অম্বিকা দেবীরই প্রতিরূপ ] শুম্ভের কথা শুনে দেবী বললেন ,“ একৈবাহং জগত্য এ দ্বিতীয়া কা মমাপরা ”। অর্থাৎ জগতে আমি একাই আছি আমার আর ভিন্ন কে আছে, দেখ এসব মাতৃবিভূতি আমাতেই লয় পাইতেছে। তারপর দেবীতে সমস্ত শক্তিলয় পেয়ে গেল এবং তিনি একাকিনী হয়ে যুদ্ধ করে শুম্ভকে বধ করলেন- শেষ হল উত্তম চরিত। এখানে দেবী বলেছেন আমাকে হারাতে পারলে আমি বশ্যতা মেনে নেব। তাহলে দেখা যাচ্ছে শক্তিকে কখনও হারানো যায় না, তাই শুম্ভ ভ্রমজনিত কারনে মহাশক্তির সামনে অহমিকা প্রকাশ করতে এসে ধবংস হল। আবার মা বলছেন “ জগতে আমি একাই আছি ”। আমরা প্রথমেই জেনেছি শক্তিই মা। এখানেও দেখলাম বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুক্তির চরম নিদর্শন কারণ বিজ্ঞান বলে কোন কিছু সৃষ্টি করা যায় না, ধ্বংস করা যায় না, শুধু রূপান্তর করা যায় মাত্র। মাতৃমূর্তি গুলো মা সৃষ্টি করেছিলেন যা মা’তেই লয় পেয়ে গেল, শুধু রূপান্তর হয়েছিল মাত্র।
এবার শেষ করবো এই বলে—
গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, ‘সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের মায়ায় আমি আবৃত থাকি বলে সকলের কাছে প্রকাশিত হই না। কেবল কোনো কোনো ভক্তের কাছে আমি প্রকাশিত হই। তাই এই মোহে অন্ধ জগতের মানুষ জন্ম-মৃত্যুশূন্য আমার স্বরূপ জানতে পারে না (গীতা-৭ / ২৫)।’ উপমায় বলা হয়েছে, সামনে রাম পরমাত্মা, পেছনে লক্ষ্মণ জীবাত্মা, আর মাঝে মহামায়া সীতা। সীতা একটু সরে না গেলে লক্ষ্মণ রূপ জীব রামরূপ পরমাত্মাকে দেখতে পায় না। ভগবান যে মায়ার কথা বলেছেন, তার স্বরূপ ও প্রভাব জানতে পারলে আমরা তাঁকে প্রসন্ন করে মুক্ত হতে পারি, মহামায়ার কৃপায় ঈশ্বর লাভ করে মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারি।
দুর্গাপূজায় দেবীর প্রণাম মন্ত্রে বলা হয়: ‘জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।/ দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোস্তুতে।’ তিনি সর্বোৎকৃষ্টা বলে তাঁকে বলা হয় ‘জয়ন্তী’। তিনি জন্ম-মৃত্যু বিনাশিনী, তাই তিনি ‘মঙ্গলা’। প্রলয়কালে সমগ্র জগৎকে গ্রাস করেন বলে তিনি ‘কালী’। তিনিই সুখদান করেন, এ জন্য ‘ভদ্রকালী’। সৃষ্টির কারণকে রক্ষা করেন বলে তিনি ‘কপালিনী’। অনেক দুঃখেই তাঁকে পাওয়া যায়, এ জন্য তিনি ‘দুর্গা’। তিনি চৈত্যস্বরূপিণী, তাই ‘শিবা’, করুণাময়ী বলে তাঁর নাম ‘মা’, বিশ্ব ধারণ করে থাকেন বলে ‘ধাত্রী’, দেবগণের পোষণকারিণী বলে তিনি ‘স্বাহা’ এবং পিতৃলোক পোষণকারিণী বলে তিনি ‘স্বধা’। চরাচরের সর্বত্রই তিনি।
দুর্গাপূজার ঐতিহ্যও আছে। রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আরাধনা করেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়ের জন্যে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন দুর্গার স্তব করলেন: ‘নমস্তে বিশ্বসেনানী আর্যে মন্দারবাসিনি…’ ইত্যাদি। মার্কন্ডেয় মুনির পরামর্শে এই পূজা করেই সুরথ রাজা তাঁর রাজ্য ফিরে পেলেন। আবার সমাধি বৈশ্য সমস্ত মোহ ও মমতার সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হলেন। এটাও ঐতিহ্য। প্রাচীনকালে যেমন সত্য ছিল, বর্তমান কালেও তাই। বর্তমানেও মানুষ ধন-পুত্র, যশ, রূপ, জয় ইত্যাদি লাভের জন্য দুর্গাপূজা করে থাকেন। ভক্তি ও মুক্তিলাভের জন্যও করেন। দুর্গাপূজায় ভক্ত অনুভব করেন, আমরা সকলেই একই মায়ের সন্তান সকলেই আমরা আপন। সকলের মধ্যে সম্প্রীতি দুর্গাপূজার এক বিশেষ দিক।

শাল্যদানী

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।