সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ১১)

আমার মেয়েবেলা

কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা কারোর জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করেন। পরোপকারিতা তাদের যেন একটা নেশা। নিজের জীবন বিপন্ন করতেও এক মুহূর্ত ভাবেন না। এঁদের কোনও চাওয়া থাকে না। বিনিময়ের আশা না করেই এরা মানুষের উপকারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমার বাবা এরকমই একজন অসম্ভব কর্তব্যপরায়ণ মানুষ ছিলেন। যাঁর মধ্যে ছিল কাজের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা।
আমি যেকোনো কাজে সর্ব প্রথম বাবাকেই এগিয়ে যেতে দেখতাম।
আজ এই একাদশ পর্বে বাবার পরোপকারিতার কথাই বলব।
১৯৭৬|৭৭ সালের একটা ঘটনার কথা বলি। তারিখ মনে নেই তবে কোনও একটা মহালয়ার দিন সেটা বেশ মনে আছে। চারদিকে
একটা পুজো পুজো গন্ধ। জামা কাপড় কেনা হয়ে গেছে। দুটো জামা দুটো ঘটি প্যান্ট একটা টেপজামা।। আর স্কুলের সাদা মোজা , বেল্ট দেওয়া কালো জুতো (ব্যালেরিনা)।
তো যাই হোক মহালয়ার দিন। সকলের কোয়ার্টার থেকেই ভুরভুর করে মাংসের গন্ধ বেড়োচ্ছে । মনটা বেশ খুশি খুশি।। একটা অসাধারণ সুন্দর আনন্দের পরিবেশ। ঠাকুর রঙ হচ্ছে। ঢাকিরা আসতে শুরু করেছে। বাঁশের ওপর চারিদিকে ত্রিপলে মোড়া
প্যান্ডেল সাজানোর কাজ চলছে।
সেই মহালয়ার এমন একটা সুন্দর দিনে খবরটা যেন সবাই কে থমকে দিল। বাবাদের বন্ধু মহাদেব কাকু গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে মারা গেছে। মারা গেছে মানে কাকু সেই যে ডুব দিল আর উঠলই না। কাকু কে পাওয়া যাচ্ছে না। বেলা একটা বাজল , দুটো বেজে গেল কাকুকে আর পাওয়া ই গেল না। কী হল? মারা গেল নাকি ভেসে গেল! কোথায় গেল মহাদেব কাকু?
ভোর বেলা গঙ্গায় তর্পন করতে গিয়েছিল। কাকু তো প্রতি দিনই স্নান করতে যায়। চেনা রাস্তা চেনা জায়গা, চেনা গঙ্গার ধার, চেনা গঙ্গার ঘাট,,, তাই জয়ন্তী কাকিমাও (মহাদেব কাকুর স্ত্রী) প্রথমে অতটা বুঝতে পারেনি। বলা যায় বিশ্বাসই করতে পারে নি। আমরা কেউই তখনও যেমন বিশ্বাস করতে পারি নি। আজও বিশ্বাস করতে পারি না যে কাকু নেই। মনে হয় কাকুর ডেড বডি তো পাওয়া যায় নি তাই নিশ্চয়ই বেঁচে আছে কোথাও না কোথাও।
হৈচৈ বেধে গেল। গোটা ফারাক্কার মানুষ বিভিন্ন ভাবে নৌকা, ডুবুরি দিয়ে গঙ্গা যেন ছেনে ফেলল। কিন্তু কাকুকে আর কিছু তেই পাওয়া গেল না। গঙ্গার একটা ঘাটে এক কোমর জলের পর একটা চোরা ঘূর্ণি ছিল। সব সময়ই ঐ খানের জলটা ঘুরত। আমরা পাড় থেকে কাগজের নৌকা ফেলতাম। ওটা কেমন ঘুরেই হুশ্ করে ডুবে যেত। ওখানে কেউই স্নান করত না। প্রায় নব্বই ফুট গর্ত ছিল। তাই ওখানে যাওয়া সকলের বারণ ছিল।।
আমরা সেদিন সবাই এটাই ভেবেছিলাম কাকু হয়তো ঐ ঘূর্ণি তেই পড়ে গিয়ে ছিল। জয়ন্তী কাকিমা পাগলের মতো দুটো ছেলেকে জড়িয়ে বাবাদের (কাকুর বন্ধু দের) বলেছিল কী হবে এবার? কী করে মানুষ করব এদের? সে তো স্বার্থপরের মতো চলে গেল। ওকে তো পাওয়া গেল না। কোনও টাকা পয়সা চাকরি কিচ্ছু পাব না। বাঁচব কীভাবে?
সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম জীবন কত নিষ্ঠুর। জীবন এগিয়ে যাবেই, কারোর জন্য থেমে থাকবে না। জীবন জীবনের মতো ঠিক রাস্তা খুঁজে নেয়। আজ যাকে ছাড়া আমি বাঁচব না , কাল বাঁচার জন্য সবথেকে আগে তাকেই ভুলতে হবে। পৃথিবী একটা নাট্যশালা। আর আমরা সবাই এক একজন নাট্যকর্মী। যার যতটা সময় অভিনয় করার ঠিক ততটা সময়ই থাকতে পারবে এই ভগবান পরিচালিত রঙ্গমঞ্চে।
যাইহোক আলোচনা শুরু হল বাবাদের মধ্যে। কী করা যায় এই ভয়ঙ্কর অবস্থায়। সেই আলোচনার পান্ডা ছিলেন অবশ্যই আমার বাবা।
মহাদেব কাকু ছিলেন ওয়ার্কশপ ডিভিশন এর টাইম কিপার।
বাবা এবং পাড়া,, বেপাড়ার সব অফিসের কাকুরা মিলে একটা মিটিং করলেন জি এম সাহেবের সঙ্গে। জি এম সাহেব বললেন একটা ডেডবডি দেখাতে হবে। তাহলে আমি মহাদেব বাবুর মিসেসের চাকরি এবং অন্যান্য টাকা পয়সা পাওয়ার ব্যবস্থা করব। দিল্লি তে মহাদেব রায়ের ডেড সার্টিফিকেট পাঠাতে হবে। যে মানুষ টি কে পাওয়া ই গেল না তার ডেড সার্টিফিকেট কি করে জোগাড় হবে?
সেই সময় ফরাক্কা ব্যারেজের (১০৯ টা) গেটে মানে গঙ্গায় প্রতিদিনই একটা/ দুটো,, পাঁচ সাত দিনের বাসি বেওয়ারিশ লাশ ভেসে আসত। আর কোনও না কোনও ভাবে গেটে আটকে যেত।
বাবা আর কোনও উপায় না দেখে কোন একটা বেওয়ারিশ লাশকে দেখিয়ে মহাদেব রায় এর ডেড সার্টিফিকেট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। গেটের নিচে নামার মতো সাহস বা ক্ষমতা সেই সময় আর কারোর ছিল না। গেটের তলায় অমন উত্তাল জল উপর থেকে দেখলেই শরীর হিম হয়ে আসে। মাথা ঘুরে যায়। ওখানে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। কোমরে দড়ি বেঁধে সেই জলে বাবা কিভাবে যে নেমে ছিল আমি আজও ভাবতে পারি না। আজও গেটের নিচে তাকালেই যেন দেখতে পাই বাবা একটা সাতদিনের পচা লাশ কে বুকে জড়িয়ে জলের তোড়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছে। মনে হয় ঐ তো ওপরের দিকে তাকিয়ে বাবা
বার বার দড়িটা নাড়িয়ে সিগন্যাল দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে সরে আসি।
সেদিন কত বড় বিপদ হতে পারত! কোমরের দড়িটা জলের তোড়ে যদি খুলে যেত! একটা পরিবার কে বাঁচাতে নিজের জীবন কে কেউ এমন ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে বাবাকে কাছ থেকে যে না দেখেছে সে বিশ্বাস করতেই পারবে না।
বাবা ছিল আমার সেই হিরো যাকে আমি প্রথম ভালোবেসে ছিলাম। এরপর জীবনে চলার রাস্তায় কতজনের সঙ্গে আলাপ হল, সখ্যতা হল, কিন্তু হিরো হতে পারল না আর কেউই।
যাইহোক সেই দিন বাবা বাড়ি ফিরে শুনিয়েছিল
সেই ভয়ঙ্কর সত্যি ঘটনাটা।
#####
বুঝলি মামনি আমি তো কোমরে দড়ি বেঁধে নিচে নামছি। ওরা ওপর থেকে আস্তে আস্তে দড়ি ছাড়ছে। ওদের বলে রেখেছিলাম, দড়ি নাড়ালেই যেন দড়ি টানতে শুরু করে। তাহলেই আমি ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসব।
আস্তে আস্তে যখন গেটের একেবারে তলায়, ঐ উত্তাল
জলে গিয়ে পড়লাম তখন তো দশ মিনিট লাগল নিজেকে ধাতস্থ করতে। কিছুতেই লাশটা কে ধরতে পাচ্ছিলাম না।জলের তোড়ে আমি যেমন আছাড় খাচ্ছি ,,, ওলোটপালট হচ্ছি। ডেডবডি টাও তো হচ্ছে। হাতে এসেও জলের তোড়ে ছিটকে যাচ্ছে। এক সময় হাঁপিয়ে উঠলাম। আর পারছিলাম না। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ওরাও ওপর থেকে দেখছিল। আমার সঙ্গে আর একজন থাকলে সুবিধে হত। কিন্তু কেউ ই আর ভয়ে নামতে চায় নি। যাইহোক ভগবান কে স্মরণ করে বললাম মহাদেব দার ফ্যামিলি টা নষ্ট হয়ে যাবে। ওরা না খেতে পেয়ে মরবে। সাহায্য কর ঠাকুর। মনে মনে গায়ত্রী মন্ত্র বলতে লাগলাম। এক সময় ঠিক ধরে ফেললাম ডেডবডি টাকে। সাতদিনের বাসি মরা। মাংস খুলে খুলে পড়ছে। প্রচন্ড দুর্গন্ধ। একহাতে দড়ি আর এক হাতে ডেডবডি নিয়ে প্রাণপণে দড়ি নাড়াতে লাগলাম। ওরা বুঝতে না পেরে দড়ি আরও ঢিল দিতে লাগল। আসলে টেনশনে ওরা আমাকে অত নীচে ঠিকমত দেখতেও পাচ্ছিল না। তাই ঠিক বুঝতে না পেরে দড়ি ঢিল দিচ্ছিল। এরপর আমি দেখলাম আর বাঁচার আশা নেই। ওরা দড়ি লুজ করেই যাচ্ছে। আমি এবার প্রাণপণে ডেডবডি টাকে বুকে চেপে ধরে জলের তোড়ে ঘুরতে লাগলাম। আর গেটের গায়ে ধাক্কা খেতে লাগলাম। এত ওলোটপালট খাচ্ছি কিন্তু ডেডবডিটা কে ছাড়িনি। আমার মনে হয়েছিল আমি মরে গেলে আমার বডি পাওয়া যাবে। কিন্তু জয়ন্তী বৌদি আমার আশায় বসে আছে। পারলে আমিই পারব। তাই আমার মৃত্যু হলেও জয়ন্তী বৌদির চাকরিটা পেতে যেন কোন অসুবিধা না হয়।
শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে দেখতে পেয়েছিল। আর যখন বুঝতে পারল যে এবার আমিই শেষ হয়ে যাব। তখন ওরা দড়িতে টান দিতে শুরু করল।
ওপরে যখন উঠলাম তখন অর্ধেক মৃতদেহ আমার দু হাতের মধ্যে । সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়েছিলাম। হসপিটালে নিয়ে আসা হল। ডাক্তার এসে আমার জ্ঞান ফেরাল। মহাদেব দার ডেড সার্টিফিকেটও পাওয়া গেল। সেই সার্টিফিকেট জি এম এর কাছে জমাও দেওয়া হল।
জয়ন্তী বৌদির চাকরি টা হয়ে যাবে বুঝলি।
অনেকক্ষণ কথা বলতে পারি নি। বাবা ছিলেন সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ । জীবনে অনেক ঝড় ঝাপটা সামলেও কোনও দিন একদিনের জন্যও স্নানের পর গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে ভোলেন নি। ভাই কে শ্মশানে পুড়িয়ে এসেও স্নান করে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করেছিলেন। ব্রহ্ম জ্ঞানই ব্রাহ্মণত্বের পরিচয়। যেটা আমার বাবার পূর্ণমাত্রায় ছিল।। তাই সেদিন বাবা জয়ী হয়েছিলেন ভগবান কে বিশ্বাস করে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে। অবশ্য এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। আমি বরাবরই বিজ্ঞানে কাঁচা ছিলাম।
বাবাকে হারানোর প্রচন্ড ভয় আমাকে চেপে বসেছিল অনেকদিন। তারপর থেকে আর স্বাভাবিক ভাবে গেটের তলায় তাকাতে পারতাম না। কি যে প্রচন্ড ভয়,,, উৎকন্ঠায় গলা শুকিয়ে যেত। কিন্তু আমার বাবা ছিল হিরো। তাই কোনও দুঃসাহসী কাজে বাধাও দিতে পারতাম না।
সব শুনে মা ছলছল চোখে একটু ঝাঁঝিয়ে বলল, তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কী হত? তুমি একবার আমার কথা ভাবলে না!
বাবা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল আমি তো জানি আমার এখন মৃত্যু নেই। আরে বাবা আমি এখন মরব না। অনেক দেরি আছে মরতে।
বাবার কথা আমরা সবাই বিশ্বাস করলাম। কারণ আমরা জানতাম বাবা যে কথাটা বলে সেটাই সত্যি হয়।
বাবার গা থেকে বিচ্ছিরি পচা গন্ধ বেড়োচ্ছিল।
বাবা বলল আমি স্নান টা সেরে আসি বুঝলি? ভাল করে সাবান মাখতে হবে। খুব বাজে গন্ধ বেড়োচ্ছে তোর মা আবার রেগে যাবে। ভাত টা বাড়। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
স্নান সেরে বাবা হাতে পৈতে জড়িয়ে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে লুঙ্গি পরে খেতে বসল। আমরা সবাই খুব আনন্দে খেতে শুরু করলাম। বাবাকে আমরা সবাই খুব বিশ্বাস করতাম। বাবার কথা খুব ফলে যেত। আসলে আমার বাবা খুব বড়ো জ্যোতিষী ছিল। বাবা তুড়ি মেরে ভবিষ্যতের কথা বলতে পারত। ভাই এর মৃত্যু দিনটাও বাবা জানত।। সে কথা আর একদিন না হয় বলব…

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।