T3 || স্বাধীনতার খোঁজে || বিশেষ সংখ্যায় সুকুমার রুজ

স্বাধীনতার খেলা

মেয়েটা এখনো বাড়ি ফেরেনি। কোচিং-ক্লাস শেষ হয় সাড়ে ছ’টায়। তালতলা থেকে বাসে মিনিট-কুড়ি। বড়রাস্তায় নেমে পাঁচমিনিট হাঁটলেই বাড়ি। আসতে একটু দেরি হলেও সাতটা পনেরোর মধ্যে ফিরে যাওয়ার কথা। আজ পৌনে আটটা হয়ে গেল। এখনো ফিরল না! হতচ্ছাড়ি আজ আবার মোবাইলফোন-টাও পড়ার টেবিলে ফেলে রেখে গেছে। হয়তো নিতে ভুলেছে!
‘ঠিক আছে, টাকা তো আছে কাছে! বুথ থেকেও তো একটা ফোন করে জানাতে পারিস! কিংবা বন্ধুদের ফোন থেকে! কী কারণে দেরি হচ্ছে, কে জানে! আজকালকার ছেলেমেয়েরা হয় মাথামোটা, নয় ত্যাঁদড়!’— এমন ভাবতে ভাবতে নিখিলবাবু ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। মনে নানা দুশ্চিন্তার ওড়াউড়ি। এখন দিনকাল যা পড়েছে, পথে-ঘাটে নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। বিশেষত মেয়েদের বিপদ সবচেয়ে বেশি। নাহ! এবার ওই দূরের কোচিং সেন্টারের সাবস্টিটিউট কিছু একটা ভাবতেই হচ্ছে।
নিখিলবাবুর চিন্তা-কুঞ্চিত চোখ কিছুটা দূরে কর্পোরেশনের প্রাইমারি স্কুলের ওপাশে। প্রতি মুহূর্তেই ভাবছেন, পথের বাঁকে এবার মেয়েটাকে দেখা যাবে। রোজ আবার ঠিক এইসময়ে লোডশেডিং হচ্ছে। আলো না থাকলে দু’ধারে বাড়ির মাঝে এই গলিটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়।
ওই বোধহয় আসছে! নাহ! মেয়ে নয়, ছেলে। একজন নয়, পাঁচ-ছ’জন ছেলেকে পথের বাঁকে দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে ওরা। দেখে মনে হচ্ছে, ছেলেগুলো হাউজিংয়ের নয়। কী ব্যাপার! কোনও ঘটনা ঘটলো নাকি! একসঙ্গে এতগুলো ছেলে…!
নিখিলবাবুর হার্টবিট বেড়ে যায়। ছেলেগুলো সোজা তার ফ্ল্যাটের দিকে আসছে। কী আশ্চর্য! সত্যিই ছেলেগুলো পায়ে পায়ে তার ফ্ল্যাটের সামনে এসে বারান্দার গ্রিল ছুঁয়েছে। উনি যে বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে, তা বোধহয় ওরা খেয়াল করেনি। নিখিলবাবু দু’পা সরে এসে ওদের সামনে — কী ব্যাপার! তোমরা…?
কাকু গেট-টা খুলুন!
কেন কী ব্যাপার? কোন দুঃসংবাদ?
না কাকু, সুসংবাদ। এবার আর ওই প্যানপ্যানানি দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে আর কুচো ফুল ছড়িয়ে জাতীয় পতাকা তুলে স্বাধীনতা পালন করা হবে না।
নিখিলবাবু কিছুটা আশ্বস্ত ও কৌতূহলী — সেকি! স্বাধীনতা দিবস পালন হবে না, এটা সুসংবাদ?
না না, পালন হবে। তবে ওইসব স্টাইল ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। এবার স্বাধীনতা দিবসে আমরা মানববন্ধন করব।
নিখিলবাবুর আদৌ খেয়াল নেই কবে পনেরোই আগস্ট। আসলে রিটায়ার্ড হওয়ার পর ক্যালেন্ডার দেখার তেমন প্রয়োজন পড়ে না। তবে আগস্ট চলছে, এটা মনে আছে। উনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেট খুলতে খুলতে বলেন — এ তো বেশ ভালো কথা! স্বাধীনতা দিবস নিয়েও তোমরা, ইয়ং জেনারেশন যে নতুন কিছু ভাবছো, এটা ভালো। অনেকে স্বাধীনতার মানেই তো বোঝে না। এখন এটা শুধুমাত্র একটা উৎসবের দিন হয়ে উঠেছে।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন কাকু! তো উৎসব করতে গেলে তো খরচ আছে। তাই আমরা চাঁদা নিতে এসেছি দিন পঞ্চাশটাকা চাঁদা দিন!
নিখিলবাবু বিস্মিত হন — স্বাধীনতা দিবসেও চাঁদা!
চাঁদা ছাড়া আজকাল কি কিছু হয় কাকু! মানব-বন্ধনের এতগুলো লোককে শুধু লেবু-চিনির শরবত খাওয়াতে গেলে কত টাকা খরচ হবে বলুন তো! আর সবার কাছে একশো নিয়েছি। আপনি রিটায়ার্ড তাই পঞ্চাশ। আমরা অবিবেচক নই, বুঝেছেন!
তোমরা কোন ক্লাবের?
ক্লাবের নয়, পার্টির লোকাল কমিটি। আরে এই পটকা! পতাকাটা গুটিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিস কেন? কাকু আমাদের চিনতে পারছেন না। এই নিন কাকু বিল।
পটকা পকেট থেকে পার্টির ঝান্ডা বের করে হাতের লাঠিতে গুঁজে দেয়। এমন সময় নিখিলবাবুর মেয়ে ছেলেগুলোর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। রীতিমত হাঁফাচ্ছে। ওর উদ্বিগ্ন গলা — দেখি দেখি, সরুন! কী ব্যাপার বাবা! কী হয়েছে?
নিখিলবাবু ওদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গলি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। মেয়েকে দেখে মনটা ভারমুক্ত হয় — ও, তুই এসে গেছিস! দেরি হল যে…?
ছেলেগুলোর পাশ কাটিয়ে মেয়েটা বারান্দায় ওঠে — বাবা, মা ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ, কারুর কিছু হয়নি। এরা সব স্বাধীনতা…। যা তুই ভেতরে যা!
মেয়েটা ছেলেগুলোর উপর এক ঝলক চোখ বুলিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। সামনের ছেলেটা বলে ওঠে — কাকু, আপনার মেয়ে বুঝি! খুব নম্র-ভদ্র। আমরা রোজ দেখি তো! সুরেন্দ্রনাথে পড়ে, তাই না?
হ্যাঁ, তোমরা দাঁড়াও একটু, আমি টাকা এনে দিচ্ছি।
ঘরে আওয়াজ দিন না, কেউ দিয়ে যাবে। এখন কাজের কথাটা শুনুন! কাল সকাল ন’টায় বড় রাস্তার মোড়ে অবশ্যই যাবেন আমাদের মানববন্ধনে। আপনারা সিনিয়র সিটিজেন, স্বাধীনতার আসল মানেটা বোঝেন। না গেলে মানববন্ধন জমবে না।
পেছন থেকে একজন আওয়াজ দেয় — ইচ্ছে করে ভুলে যাবেন না কিন্তু! আমরা চাই না, আমাদের মানববন্ধন ফ্লপ করুক।
নিখিলবাবুর স্ত্রী বারান্দায় না বেরোলেও দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছিলেন। উনি মেয়েকে বলেন — দেরাজ থেকে পঞ্চাশটাকা বের করে নিয়ে বাবার হাতে দিয়ে আয় তো! আমার হাতে আটা-মাখা।
মেয়ে বাবার হাতে টাকা দিয়ে আসে। ছেলেগুলো আড়চোখে মেয়েটাকে দেখে। সামনের ছেলেটা টাকা নিতে নিতে বলে — তাহলে ওই কথাই রইল। কাল সকাল ন’টায় বড় রাস্তার মোড়ে। মানববন্ধনে সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার উদ্দীপনা আমরা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চাই। আমাদের কাউন্সিলর এবং বিধায়ক থাকবেন। আপনি আসছেন কিন্তু।
এক-পা এগিয়ে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে, এমনভাবে ছেলেটি বলে — ও! ভালো কথা, প্রায়ই দেখি আপনার মেয়ে সন্ধের দিকে একা একা ফেরে। ওই গলির মোড়টা সুবিধের নয়। ব্যাপারটা নিয়ে ভাববেন একটু। ঠিক আছে, কাল দেখা হচ্ছে।
ছেলেগুলো এগিয়ে গিয়ে অন্য গেটের সামনে। নিখিলবাবু গেট টেনে দিয়ে বারান্দায় আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। তার চোখ সামনের গলিতে। আটটা বাজতে না বাজতেই গলিটা কেমন শুনশান! শুধু কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট দাঁড়িয়ে হলুদ আলো ছড়াচ্ছে। সে আলো খুবই ক্লান্ত যেন! তাই গলিটাতে আবছায়া। পোস্টের বাতিগুলোকে ঝড়-ঝাপটা থেকে বাঁচানোর জন্য তার চারপাশে ঘেরা কাচের ঢাকনা। তবে ভেতরে বিস্তর ময়লা জমেছে। ধুলো আর কাচের ঘেরাটোপে আটকে পড়া মৃত কীটপতঙ্গের স্তূপ হবে হয়তো! বাতিগুলো স্বাধীনভাবে আলো ছড়াতে পারছে না। ঘেরাটোপ সাফ করার বড় প্রয়োজন।
দুই

পরের দিন সকালটার কেমন মুখ-গোমড়া। আকাশ জুড়ে মেঘ। মেঘের ছায়া হাউজিং এস্টেটের গায়ে-গতরে, আনাচে-কানাচে। কোত্থেকে রাজ্যের মেঘ এসে জুটেছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। একটু দূরে কর্পোরেশনের প্রাইমারি স্কুলের সামনে গুটিকয় বাচ্চা দেখা যাচ্ছে। একটু পরে দু’জন শিক্ষককেও দেখা গেল। দড়ি টেনে বাঁশের মাথায় জাতীয় পতাকা তুললেন একজন শিক্ষক। সকলের বন্দেমাতরম-ধ্বনি আর ফিনফিনে বৃষ্টি একসঙ্গে শুরু। বাচ্চাগুলো বন্দেমাতরম থামিয়েছে, কিন্তু ওখান থেকে নড়েনি। কয়েক মিনিট পর ওরা বিস্কুট কিংবা লজেন্স পেল হাতে। হাত মুঠো করে ওরা ছুটল বাড়ির দিকে। যেন ওই লজেন্স কিংবা বিস্কুট বাচ্চাগুলোকে স্বাধীন করে দিলো।
নিখিলবাবু ইজিচেয়ারে দেহ এলিয়ে ওই দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা নয়ের ঘর পেরোলো। কিন্তু বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। নিখিলবাবু বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ঘনত্ব বোঝার চেষ্টা করছেন। বৃষ্টির মধ্যেই একটা কাক এদিক থেকে ওদিকে উড়ে যাচ্ছে। নিখিলবাবুর মনে উড়ে বেড়াচ্ছে কাল চাঁদা নিতে আসা ছেলেগুলোর মুখ। কানে বাজছে, ‘ইচ্ছে করে ভুলে যাবেন না কিন্তু!’
ওঁর মনে দোলাচল। কখনো ভাবছেন তেড়ে বৃষ্টি এলে ভালো হয়। ওইসব মানববন্ধনের ধাষ্টামো বন্ধ হয়। আবার কখনো ভাবছেন, এখুনি বৃষ্টি ছেড়ে যাওয়াই ভালো। বৃষ্টি বেশিক্ষণ তো হবে না। থেমে গেলেই ওরা মানববন্ধনের তোড়জোড় শুরু করবে। বৃষ্টির দাপট কম থাকলেও ওদের দাপট তো কম নয়! শুধু শুধু বৃষ্টির জন্য দেরি হবে।
বেশ কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করার পর নিখিলবাবু ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়লেন। প্রাইমারি স্কুলের চাতালে খুঁটির আগায় জাতীয় পতাকা গুটিসুটি মেরে চুপ। বৃষ্টিতে ভিজে নেতিয়ে পড়েছে। স্বাধীনভাবে ওড়ার ক্ষমতাও তার নেই। স্কুল পেরোতেই গলির মোড়। কাল ছেলেগুলো বলেছিল গলির মোড়টা সুবিধের নয়। মোড়ে পৌঁছতেই কথাটা মনে পড়ে গেল। উনি দু’পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে অসুবিধা বোঝার চেষ্টা করলেন। তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। ঠিক মোড়ের মাথায় দুটো খুঁটিতে আটকানো ক্যানেস্তারার পাতে রাজনৈতিক দলের দৈনিক মুখপত্র সাঁটানো। জলে ভিজে জবজব করছে। কাগজের একপ্রান্ত টিন থেকে খুলে গিয়ে ঝুলছে। খুঁটির পাশে দু’ থাক ইটের ওপর একটা কংক্রিট স্ল্যাব। দেখে ছোট বেঞ্চির মত লাগছে। উনি ভাবেন, এ পথ দিয়ে রোজই যান, কিন্তু কোনদিনও এভাবে খুঁটিয়ে দেখেন না। শুধু চোখে পড়ে, কয়েকজন চ্যাংড়া ছেলে ওই বেঞ্চিতে বসে আড্ডা মারে।
এমন নিরীহ জায়গাটা রাতে অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে কী করে, ভাবতে ভাবতে উনি বড়রাস্তার দিকে এগোন। ওঁর মনে তখন কাটা ঘুড়ির মতো ভেসে বেড়ায় কলেজে পড়া নিজের মেয়ের মুখ।
বড় রাস্তার মোড়ে অসংখ্য ছাতার জমায়েত। কালোর মাঝে লাল, সবুজ, গেরুয়া, ফুল-ফুল রঙের ছাতা। সাদা ছাতা নেই একটাও। হয়তো সাদা ছাতা আজকাল তৈরিই হয় না!
কাল চাঁদা তুলতে আসা ছেলেগুলোর একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। নিখিলবাবু হাজিরা নিশ্চিত করতে কাষ্ঠহাসি হাসেন। ছেলেটা সে হাসি দেখতে পায় কিনা বোঝা যায় না। তাই খেজুরে আলাপ করতে গলাখাকারি দিয়ে বলেন — আজ তিনটে হাত থাকলে ভালো হতো, নাকি বলো ভাই!
ছেলেটা ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। সে চোখের ভাষা বোঝা দায়। নিখিলবাবু আমতা আমতা করেন — না, মানে, মানববন্ধনে দু’জনের হাত ধরতে হবে তো দু’হাতে! তাহলে ছাতা ধরব কোন হাতে! অসময়ে বৃষ্টি, আমার আবার নিমোনিয়ার ধাত।
ছেলেটা বলে — হ্যাঁ, শ্লা, আজকের দিনেই বৃষ্টি! আবহাওয়া দপ্তরটাও শ্লা ওদের তাঁবেদার হয়ে গেছে। বৃষ্টি হওয়ার আগাম খবর দেয় না। এক কাজ করুন, ডানহাতে ছাতা ধরুন, বাঁ-হাতে ছাতা ধরা কনুইটা ধরুন। মাথায় ছাতাও রইল, আবার মানববন্ধনও হলো। নিন, আর দেরি নয়। ঝটপট বন্ধনের একজন হয়ে যান। ওদিকে বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে বিধায়ক হেমেনদা’ এসে গেছেন। এক্ষুনি মাইকে তার গলা শুনতে পাবেন।
বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে লাইন ক্রমশ বাড়ছে। মাইকে শোনা যাচ্ছে বন্দেমাতরম ধ্বনি। তারপর শুরু হল বিধায়ক হেমেনবাবুর বক্তৃতা — বন্ধুগণ! আজ এই স্বাধীনতা দিবসের দিনে আমাদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। আজ আমরা সকলে একসঙ্গে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে চাই। আপনারা সকলে…!
এমন সময় লুঙ্গি-পরা, খালি-গা একজন লোক গলি থেকে বেরোয়। লাইনের কাছে আসে। তার বাঁ-হাতটা কনুই থেকে কাটা। ডানহাতে ভিজে লুঙ্গি ধরে আছে। সে হলুদ দাঁত বের করে বলে — আমিও তোমাদের সঙ্গে দাড়িয়াবান্দা খেলব।
মানববন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকা একজন বলে — যা ভাগ! পাগল কোথাকার!
অন্য একজন বলে — ওরে পাগল! এ খেলা নয়, এ হল স্বাধীনতা দিবস পালন। স্বাধীনতা-টতা বুঝিস কিছু?
লোকটা এবার চোখ পাকিয়ে বলে — ওইভাবে হাতে হাত ধরে আমিও স্বাধীনতা পালন খেলব।
একজন বলে — তুই কী করে খেলবি! তোর তো একখানা হাত নেই।
এবার লোকটা বিরক্তির স্বরে ব’লে ওঠে — আমার একটা হাত নেই তাতে কী হয়েছে! যেমন হাত নেই, তেমনি ছাতাও তো নেই। ব্যস! এই হাতে তোমাদের হাত ধরবো, আর তোমরা আমার এই কাটা কনুইটা ধরবে। আমি খেলব।
লোকটা ঠেলেঠুলে লাইনে ঢোকার চেষ্টা করে। বেশ শোরগোল শুরু হয়। তা শুনে সেই নেতা গোছের ছেলেটা আসে — কী হয়েছে? এখানে এত হল্লা কিসের?
লুঙ্গি-পরা লোকটা কান্না মেশানো গলায় বলে — দেখো না, ওরা আমাকে খেলায় নিচ্ছে না। আমিও ওরকম লাইনে দাঁড়াবো।
নেতা ছেলেটা কয়েক পলক থেমে থাকে। তারপর নেতাসুলভ গলায় বলে — এই যে! আপনারা ওকে বাধা দিচ্ছেন কেন? নিন নিন, লাইনে ঢুকিয়ে নিন। আজ কোন ভেদাভেদ নয়। ও তো আপনাদের মতোই স্বাধীন দেশের নাগরিক। একখানা হাত নেই তাতে কী হয়েছে! ওর মাথায় শুধু ছাতা নেই, বাদবাকি সব আপনাদের মতো। অ্যাই পটকা, টিভির লোকজনদের এদিকে ডেকে নিয়ে আয় তো! নিন, ও বেচারাকেও স্বাধীন হতে দিন।
লোকটা লাইনে ঢুকে যায়। মিডিয়ার ক্যামেরা তার কাটা কনুইয়ে ক্লোজ শট নেয়। প্যান হয়, জুম হয়। অনেকেই পস্তায় — ইশ! লোকটাকে পাশে নিলেই ভাল হত! টিভিতে একবার অন্তত মুখ দেখানো যেতো!
পেছন থেকে লাইনের সব্বাইকে এক রকম লাগছে। ছাতার তলায় হাত কনুইয়ের বন্ধন বাড়ছে। তবে বন্ধন তেমন দৃঢ় হচ্ছে না। ঠেলাঠেলিতে কনুই থেকে মাঝে মাঝে হাত ফসকে যাচ্ছে। একটা হাত মাথায় ছাতা সামলাতে ব্যস্ত, অন্য হাতে ঠেলাঠেলি সামলে নিজেকে খাড়া রাখার চেষ্টা। যতদূর চোখ যায় ততদূর এই একই ছবি।
এমন সময় রাস্তার ওপার থেকে একটা মেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে লাইনের কাছে আসে। তাকে মেয়ে না ব’লে যুবতী বলাই ঠিক। কেউ সোজাসুজি, কেউ তেরছাভাবে যুবতীর বুকের ওঠানামা দেখে। ত্রস্ত চোখে সে লাইনের মধ্যে কাউকে খুঁজছে। হঠাৎ হাতকাটা লোকটাকে দেখতে পেয়ে হুড়মুড়িয়ে সে কাছে আসে। তর্জন করে — বাবা, বেরিয়ে এসো বলছি! লাইন থেকে শিগগির বেরিয়ে এসো! এখনো তোমার শখ মিটল না! যেই একটু চোখের আড়াল হয়েছি, ব্যাস! অমনি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে! নিজে পাগল হয়েছ, এবার আমাকেও পাগল করবে।
লোকটা লাইন থেকে বেরোচ্ছে না দেখে ওই যুবতী এগিয়ে গিয়ে তার আস্ত হাতখানা ধরে টানতে থাকে — তোমার কি একটুও লাজ-লজ্জা নেই! ওই পার্টি-পার্টি করে বাঁ-হাতখানা গেল বোম বাস্ট হয়ে। আবার সেই পার্টির লাইনে ঢুকছো!
ওই মেয়েটাকে দেখে নিখিলবাবুর মনে পড়ে নিজের মেয়ের কথা। সকালে মেয়েটা বলছিল, ‘বাবা, ও সব পার্টি-পলিটিক্সের ব্যাপার, তোমার না যাওয়াই ভালো।’
নিখিলবাবু তখন কিছুতেই মেয়েকে বলতে পারেননি বৃষ্টির মধ্যেও ছাতা নিয়ে মানববন্ধনে যোগ দিতে যাওয়ার আসল কারণ। নিজের অসহায়তা নগ্ন করতে চাননি। ভাবেন, মেয়ে তাকে রুখতে পারেনি। কিন্তু এ মেয়েটা তার বাবাকে বিরত করবেই যেন!
মেয়েটার টানাটানিতে হাতকাটা লোকটার ভিজে লুঙ্গির কষি আলগা হয়ে গেছে। জলে-ভেজা ভারী লুঙ্গি আলগা হয়ে কোমর থেকে নেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। ওদিকে বিধায়কের বক্তৃতা শেষে স্লোগান চলছে, স্বাধীনতা দিবস কি জ্যায়…। এদিকে মেয়ের টানাটানিতে একসময় লোকটা পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে যায়, নাকি সত্যিকারের স্বাধীন হয়ে যায়, কে জানে!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।