হৈচৈ ছোটদের গোয়েন্দাগল্পে সুদীপ্ত পারিয়াল

সোনার হরিণ
এর আগে কোনদিন ডায়েরি লিখিনি।এই যে প্রথম লিখছি তার পেছনে একটা অদ্ভুত রহস্য আছে।সামান্য ঘটনাগুলো একেক সময় যে কত বড় হয়ে যায় এ যেন তারই প্রমাণ।আমি খুব গরিব ঘরের ছেলে ছিলাম।বলতে আজ কোন অসুবিধা নেই আমি মা আর গুরুজির আসল ছেলে নই।আমার নিজের মা বেঁচে নেই।সাপের কামড়ে মারা গেছে।ভাই-বোন দুটোকে মাসিরা নিয়ে গেছিল।আমার নিজের বাবাকে মনে পড়ে না,তবে গুরুজি আমার নিজের বাবার থেকেও অনেক ভাল এটা বলতে পারি।আমি সেইসব ঘটনাগুলোকে পূর্বজন্মের স্মৃতি বলে মনে করি।সব কথা তেমন আর মনেও নেই।ঠাম্মি বলে এসব বিপদের কথা যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায় ততই ভাল।আমাকে হয়তো আমার মা আর গুরুজি নিতই না।যদি না আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় রণদা আমার জন্য জেদ ধরত।এই ‘নিতই না’ ব্যাপারটার বাংলা আমি জেনে গেছি।দত্তক।আমার দাদা রণবীর গাঙ্গুলি।এ বছর সে মাধ্যমিক দিল।আমাকে একবার কয়েকটা ভন্ড কাপালিক ধরে নিয়ে গেছিল।মেরেই ফেলত আমাকে নরবলি দিয়ে, যদি না আমার রণদা সময় মতন গিয়ে আমাকে বাঁচাত।সুজনদাদাও সাথে ছিল।আমরা প্রায়ই নৌকা করে রোজই কোথাও না কোথাও ঘুরতে চলে যাই।আগে রোজই যেতাম,এখন আমারও উঁচু ক্লাস,রণদার মাধ্যমিক সদ্য শেষ হয়েছে,কম্পিউটার নিয়ে কি একটা ট্রেনিং-এর জন্য ও সদরে যাতায়াত করে।
আমি এ বছর ক্লাস এইটে উঠলাম।আমার প্রিয় বিষয় অংক।সেই সেবার দত্তবণিক ভিলা রহস্যে আমাদের স্কুলের সুদর্শন মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি গিয়ে যেসব কাণ্ডকারখানা দেখেছি,তারপর থেকে অংক সম্পর্কে আমার একটা ভালোবাসা জন্মে গেছে।অংক একটা শিল্প।নিরন্তর সাধনা দরকার।যদি সঠিকভাবে সাধনা করা যায়,অংককে কখনই কঠিন মনে হবে না।বেশি পরিশ্রম করতে হবে না।শুধু মাথা পরিষ্কার রাখতে হবে আর তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।আমার এই অংকপ্রীতি থেকেই বোধহয় গোয়েন্দা উপন্যাসের ওপর আমার এত ভালবাসা।স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বেশ কিছু বই আমি পড়েছি।এছাড়া শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ সিরিজের গল্প উপন্যাসগুলো পড়তে বেশ ভালো লাগে।প্রিয় লেখক সত্যজিৎ রায়।তাই তো তোপসের দেখাদেখি আমিও আমিও রণদার অ্যাসিস্ট্যান্ট।যাই হোক,আসল কথায় এবার আসা যাক।রণদার এক বন্ধু শুভঙ্কর রায়,আজ দুপুরে তাদের বাড়িতে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল।রণদার খুব প্রিয় বন্ধু তাই আমাকেও বলা হয়েছিল।গিয়ে দেখি এক বিপত্তি।এখানে বলে রাখি দাদা সেই বন্ধুর বাড়ি সদরে।বন্ধুটি দাদার কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের।আমাদের বাড়িতে কয়েকবার যাতায়াত করেছে।অল্পদিনেই ভালো পরিচয় ঘটে গেছে।গিয়ে শুনলাম শুভঙ্করদাদার ছোট ভাই নিখোঁজ।স্কুল থেকে ফিরছে না।বাড়ির লোক আনতে গিয়ে শুনছে সে নাকি অনেক আগেই স্কুল থেকে চলে গেছে।কেউ একজন তাকে নিতে এসেছিল।অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ভিড় করে আসছে,আজ জন্মদিন সে যদি না আসে তাহলে জন্মদিন হবে কি করে?প্রথমেই আমাদের আনন্দে জল পড়ে গেল।যার জন্মদিন তাকে আজ স্কুলে পাঠানো হল কেন!শুভদাদা যদিও বলল,আসলে বন্ধুদের চকলেট দেবে বলে ও স্কুলে যাবার জন্য জেদ ধরেছিল।সেটা তো কালও দেওয়া যেত!একটা বাচ্চার জেদকে শান্ত করতে পারল না ওরা!বুঝতে পারলাম রণদা খুব রেগে গেছে।যখন রণদা রেগে যায়,তার কপালে দু’পাশের শিরা ফুলে ওঠে।চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে যায়।এই ব্যাপারে ওর এত রেগে যাওয়াটা আমার কাছে বড্ড অস্বাভাবিক মনে হল।তবুও সাহস করে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না।
শুভদাদার ভাই এল না।আবার যারা আনতে গেছিল,তারা নিরাশ হয়ে ফিরে এল।কেই বা তাকে স্কুলে আনতে গেল?আর ওই বা অচেনা কারও সাথে আসবে কেন?আর স্কুল কর্তৃপক্ষ বাড়ির লোক ছাড়া অন্য কারোর কাছে ওকে ছাড়ল কেন?স্বাভাবিকভাবে আমার মনের মধ্যে এই সমস্ত প্রশ্নগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল।যদিও কারুর কাছে প্রকাশ করিনি।শুভদাদার বাবা-মা দুজনেই প্রচন্ড ভেঙে পড়েছে।ওদের সামলাতেই শুভদাদা ব্যস্ত।পুলিশে খবর দেওয়ার কথা কারুর মনে নেই।রণদা পুলিশের কথা বলাতেই চমকে উঠল শুভদাদা।
-পুলিশ?ভাইটা কি আমার সত্যিই হারিয়ে গেল!দাঁড়া না খুঁজে দেখি আমরাই,চল…
শুভদাদার বাকি বন্ধুরাও একই কথা বলল।রণদা আর দ্বিরুক্তি করল না।শুভদাদাদের জিপে চেপেই চিরুনি তল্লাশি করতে বেরুল।অগত্যা আমি আমার সাইকেল নিয়ে বাড়ি চলে এলাম।রণদাদের আরেক বন্ধু শোভনদাদা আমাকে খানিকটা এগিয়ে দিল।শুভদাদার ভাইয়ের জন্য হৃদয়ের মধ্যে তুমুল আলোড়ন উঠছিল ঠিক কথা,কিন্তু খিদের চোটে পেটের মধ্যেও মোচড় লাগছিল।শরীর তা জানান দিচ্ছিল থেকে থেকে।রান্নাবান্না সেখানে প্রায় সারা ছিল।মাংসের ঝোলের গন্ধে অজ্ঞান হয়ে যাবার জোগাড়।কিন্তু…
আজকের ঘটনাটা আমার হৃদয়কে যেন একটা অন্য বিষাদে জড়িয়ে দিয়েছে।খিদে পেয়েছে;মা খেতে ডাকতে এত দেরি করছে কেন?বাড়ি এসে লিখতে বসে গেছি।আবার শুভদাদার ভাইয়ের জন্য খুব চিন্তাও হচ্ছে।কখন যে রণদা আসবে কে জানে?
২
এখনও আমার বুকটা ধুকপুক করছে।বিশ্বাসই হচ্ছে না ব্যপারটা।এখনও আমার মনে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে একটা সাত বছরের বাচ্চার সাথে কার এত শত্রুতা থাকতে পারে?ব্যাপারটা শোনার পর থেকেই আমার হার্টবিট হু-হু করে বেড়ে গেছিল।দাদা যখন ফিরল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।রাস্তার অনুজ্জ্বল আলোগুলো আমাদের ঘরে এসে পড়েছে।মা আমাদের বাড়ির আলোগুলো জ্বেলে দিচ্ছিল একটা একটা করে।ঠাম্মি আজকাল খুব একটা নিজের ঘর ছেড়ে বেরোয় না।কিন্তু তার সাধের বাগানে রোজ একবার করে না ঘুরে আসলে ঠাম্মির ভাত হজম হয় না!তাছাড়া এখন আমাদের পাকা বাড়ি।দাদা নিজের রোজগারের টাকায় ঘর তুলেছে।অবশ্য গুরুজিও অনেকটা সাহায্য করে।মা তুলসীতলায় শাঁখ বাজাচ্ছিল।আমি বারান্দায় বসে তানপুরাটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করছিলাম।এ বাড়িতে এখন রোজ একটু-আধটু গানের চর্চা হয়।
এটা রণদার নতুন অভ্যাস।ওকে যারা আমাদের বীরপুর গ্রামের ভন্ড কাপালিক কান্ডের সময় দেখেছ,এখন দেখলে আর চিনতেও পারবে না।সেই লাবণ্যময় কিশোর আর নেই।সে এখন সুপুরুষ।সুঠাম শরীর,রোজ সকালে বারবেল ডাম্বেল নিয়ে দাদা কসরত করে কি সব যেন।সেই তুলনায় আমি বরং আদরের ঠেলায় অন্ধকার।যাই হোক,রণদা ঘরে এসে থপাস করে খাটে বসে পড়ল।আমি একটা নতুন সুর নিয়ে পাগলামি করছিলাম বলে ওর আসবার সময় বুঝতে পারিনি,কিন্তু থপ করে খাটে বসে পড়ার আওয়াজ পেয়ে ছুটে ঘরে এলাম…
-রণদা পেয়েছ?পাওয়া গেছে?
ও কোন উত্তর দিল না।চোখ কুঁচকে তাকাল আমার দিকে।ওর মুখটা কালো।রগের শিরাগুলো এখনও ফোলা।এখনও ওর মধ্যে রাগটা আছে বুঝলাম।তার মানে দাদা কিছু একটা নিয়ে ভাবছে।
-কি হয়েছে রণদা?শুভদাদার ভাই…
কথাটা শেষ করতে দিল না রণদা।কুনাল মাকে বল না রে,একটু মুড়ি-টুড়ি কিছু থাকলে দিতে। চায়ে চুমুক দিতেই রণদার জিভ পুড়ে গেল।অসাবধানবসত এটা হয়।মুখে রুটি-তরকারি পুড়ে ও বলল,স্কুলে গরমের ছুটি,তাই না?
-কাল হয়ে ছুটি পড়বে।
এ প্রসঙ্গে রণদার এই প্রশ্নের যুক্তি বুঝলাম না।
-কাল তুই আমার সঙ্গে যাবি।বাড়িতে বলবি… না থাক কিছু বলতে হবে না তোকে,যা বলার আমি বলব।
-শুভদাদার ভাই-
-বিপদ,খুব বিপদ,ওকে যদি বাঁচাতে না পারি তাহলে আমি শুভর কাছে খুব ছোট হয়ে যাব।
-রণদা এমন কেন বলছ?এত ভেঙে পড়ছ কেন?
-ভেঙে পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে।যে বা যারা এই কিডন্যাপ করুক না কেন…
-কিডন্যাপ!!! আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম।
-আস্তে!চেঁচাস না,আমরা যে যাব বাড়িতে কিছু-
কথাটা থামাতে হল,মা এসেছে।
-কী বলছিস রে তোরা?কোথায় যাবি?কার সাথে যাবি?
এই রে!সাড়ে সব্বনাশ!আমরা যদি গোয়েন্দাগিরির ছিঁটেফোটাও করি,আমাদের মাথাঠাকুরানীও কম যান না।
-মা,আমার একটা বন্ধুর দাদার বিয়ে।আমাদের দু’জনকেই যেতে হবে।সত্যি!রণদা একটা জিনিয়াস।এই জন্যই তো ও আমার হিরো!কি স্মার্টলি গল্প বানাতে পারে।যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল।যাই হোক,এখন একটু হলেও আনন্দ লাগছে।কাল আমরা তিনজন উত্তরবঙ্গে যাচ্ছি।দাদাদের সেই বন্ধু যে আমাকে এগিয়ে দিল তারও যাওয়ার কথা ছিল।ওর মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় যাওয়া বাতিল হয়েছে।প্রথমে এখান থেকে হাওড়া অব্দি লোকাল ট্রেন।তারপর হাওড়া থেকে বাসে করে শিয়ালদা।সেখান থেকে ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত।তারপর সেখান থেকে বাস বা প্রাইভেট ট্যাক্সি করে প্রায় সত্তর কিলোমিটার যেতে হবে।জায়গাটার নাম অবশ্য রণদা বলেনি।ওর মধ্যে এখন সবসময় একটা চিন্তা,চিংড়ি মাছ দাদার এত প্রিয়,তবু ছুঁয়েও দেখল না আজ।শোয়ার আগে আমরা দুই ভাই একটা ব্যাগেই সব জামা-কাপড় গুছিয়ে নিলাম।শুভদাদার ভাইয়ের ডাক নাম পিন্টু,ওর জন্য দাদা একটা ‘শিশু’কিনেছিল,ওটা আমাদের পড়ার টেবিলের ওপরেই পড়ে আছে।খুব কষ্ট হচ্ছে আমার আজ।পিন্টু কোথায় আছে?কেমন আছে?কে জানে!
৩
এখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছবে।শিয়ালদহ জংশন থেকে কাল সন্ধ্যের দিকে আমাদের ট্রেন রওনা দিয়েছে।ফার্স্ট ক্লাস কামরা নেওয়া হয়েছে।পিন্টু যে উত্তরবঙ্গে আছে এই খবরটা কি করে দাদা জেনেছে তাড়াহুড়োতে কাল সেটা বলতে ভুলে গেছি।গতকাল ট্রেনে ওঠার আগে অবধি যেই সব বিচিত্র কান্ড আমাদের সাথে হল,সেইগুলো মনে আশঙ্কা সৃষ্টি করলেও,কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি।
যাইহোক,সেদিন যখন রণদা আর শুভদাদা ওদের জিপে করে বেরুল,তখন ওরা আগে গেল পিন্টুর স্কুলে।সেখানে গিয়ে ওরা যা জানল তা শুনে ওরা তো চোখে অন্ধকার দেখল।কেউ যেন স্কুল ছুটির ঘন্টা খানেক আগেই পিন্টুকে নিয়ে চলে গেছে।শুভদাদার আত্মীয় পরিচয় দেওয়ায় এবং পিন্টুও চিনতে পারায় স্কুল কতৃপক্ষ আর বাড়াবাড়ি করেনি।তবে স্কুল কর্তৃপক্ষের এমন হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য রণদা বেশ রেগে গিয়েছিল।কিন্তু যতই চিনতে পারুক।তাদের অচেনা ব্যক্তির হাতে পিন্টুকে ছাড়াটা কখনই উচিৎ হয়নি।ওরা এরপর থানায় গেল।সদর থানা সব শুনেও মিসিং ডায়েরি নিল না।কারণ চব্বিশ ঘন্টা না হলে ডায়েরি নেওয়ার কোন নিয়ম নেই।তবু দাদাকে চিনতে পেরে এক পুলিশ অফিসার ব্যাপারটা একটু যত্ন নিয়ে দেখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন।শুভদাদা জিপে উঠেই নাকি আরেক কান্ড করেছিল।ভ্যাঁ করে নাকি কেঁদে উঠেছিল বাচ্চাদের মতন।ভাই তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়।ঠিক সেই মুহূর্তেই কেউ যেন একটা কাগজের মণ্ড জিপের বাইরে থেকে বাইরে থেকে তাক করে দাদাদের দিকে ছুঁড়ে মারে।তার পরমুহূর্তেই সে অদৃশ্য হয়ে যায়।কে মারল?কেন মারল?সেই সব বুঝে ওঠার আগেই সে উধাও।তবুও দাদা গাড়ি নেমে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করল।আশেপাশের লোকজনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে কি যেন একটা ভাবতে ভাবতে জিপে উঠে এসেছিল।এই বর্ণনাটা শুভদাদার মুখ থেকেই শোনা।যদিও কাগজটা দাদাই খুলেছিল।সেখানে লেখা ছিল…
“শুভঙ্কর, তুমি চিন্তা ক’রো না।তোমার ভাই শ্রীমান সুমন্ত(পিন্টু) ভালোই আছে।ভালো চাও তো যত শীঘ্র সম্ভব সোনার হরিণ নিয়ে দার্জিলিং চলে এসো।বাকি কথা পরে হবে।পুলিশকে এইসব কথা জানালে ঘোরতর বিপদ।”
ছাপা অক্ষরে লেখা ছিল কথাগুলো।মনে হয় কাছাকাছি কোন সাইবার ক্যাফে থেকে টাইপ করানো হয়েছে।
সোনার হরিণ!প্রথমবার শোনার পর আমিও অবাক হয়ে গেছিলাম।এই সোনার হরিণ ব্যাপারটা তো আমাদের একদম জানা ছিল না।শুভদাদা বলেছিল,চল থানায় গিয়ে দেখাই।রণদা আপত্তি করে বলে,তুই দুটো,না না,তিনটে এনজিপির টিকিটের বন্দোবস্ত কর।
যাক গে,ও যে সময়মতো আমার কথা মনে করেছে তাতেই আমি ধন্য।একটা কথা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না,রণদা একটা উড়ো চিঠির ভরসায় কি করে এত বড় সিদ্ধান্ত নিল!ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল!
সেদিন রাত অবধি এতটুকুই জানতাম।কালকের কথায় আসা যাক।কাল আমরা অনেকগুলো দোকানে ঘুরলাম পিন্টুর স্কুলের কাছাকাছি।তদন্ত যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে একফোঁটাও জল আছে বলেও তো আমার মনে হয় না।তবু রণদাকে কিছু বলার সাহস নেই।এরপর ও এমন একটা জিনিস কিনল,সেটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।একটা শো-পিসের দোকান থেকে একটা দশ-বারো ইঞ্চি লম্বা সোনালী রংয়ের মাটির হরিণ কিনল।আমি বাড়ি চলে আসার অনেকক্ষণ পর ও ঢুকেছিল।চিন্তিত থাকার বদলে হাসছিল।আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,খবর আছে মাই ডিয়ার!
-কি রণদা?
-শুভদের বাড়ির টেলিফোনে একটা উড়ো ফোন এসেছিল,পিন্টু কথা বলেছে…
-তাই কি বলেছে?
-বলেছে!ভালো আছে।
৪
এখনও একটা আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে আছি।এরকম ট্রমা সেই কাপালিক কান্ডের সময় আমার হয়েছিল।আমাকে জোর করে ওরা কিছু একটা খাইয়ে দেওয়ার পর,অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলাম ঘুমে,তারপর দেখতে পাচ্ছি,আমায় বাঁধা হচ্ছে,কিন্তু কিছু করবার সাহস বা সামর্থ্য নেই।অনেক বছর পর অভিশাপের মতন সেই ঘটনা ফিরে এল।আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আমি জীবিত আছি।গত পরশু যখন এন. জি.পি তে পৌঁছালাম তখন বেলা আটটা।ট্রেন আধঘণ্টা লেট ছিল।শুভদাদার মোবাইলে উড়ো ফোন এল একটা,রেকর্ডিং ভয়েসে বলা হল,হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘায় উঠতে,অর্থাৎ এখান থেকে দার্জিলিং যেতে হবে।দুপুর একটা কুড়ি নাগাদ দার্জিলিং-এর হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘায় পৌঁছালাম।রণদা ও শুভদাদা দুজনে আমায় বলল,তুই হোটেল থেকে বেরোবি না।আমরা আসছি!
আমি আর কি করি।গ্রামের কথা বড্ড মনে পড়ছে,সামনে অমন সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেও,মন খারাপ লাগছে।আমি এর আগে কোনদিন এত দূরে ঘুরতে আসিনি।বলা যায় সুযোগই পায়নি।এই প্রথমবার এসে যে একটু ভালো করে ঘুরে দেখব,সেই অবসর কোথায়?একটা বই সাথে করে এনেছিলাম,সময় কাটানোর জন্য সেই বইটা পড়তে শুরু করলাম।তবে বইতে কিছুতেই মন বসছে না।বারবার মনে পড়ছে পিন্টুর কথা!ও কেমন আছে!রণদা কি পারবে ওকে উদ্ধার করতে?সুজন মাঝির কথা বড্ড মনে পড়ছে!আমাদের সবকটা অ্যাডভেঞ্চারে ও আমাদের সাথে ছিল।এই প্রথম ও আমাদের সাথে আসেনি।আসলে সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল,ওকে তেমন করে কিছু বলাই হয়নি।হয়তো ও ভীষণ রাগ করবে আমাদের উপর।অভিমান করবে,তবে একটা আট বছরের ছেলের জীবন নিয়ে যখন টানাটানি,আর সে কেসে রণদা নিজেকে শামিল করেছে,এ কথা শুনলে,সুজনদাদা একটুও রাগ করবে না।এসব আবোল-তাবোল ভাবছি,হঠাৎ আমাদের রুমে নক,দরজা খুলতে দেখি,একজন রুম বয়,একটা মোবাইল আমার হাতে দিয়ে বলল,আর্জেন্ট কল!
আমি ফোনটা হাতে নিয়ে কথা বলতে যাব,সাথে সাথে এমন একটা কাণ্ড ঘটল ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়।
রূম বয় পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে আমার মুখে ধরল।আর মুহূর্তে রণদা কোথা থেকে এসে লোকটাকে একটা ঘুষি মেরে ছিটকে ফেলে দিল,কিন্তু লোকটার গায়ে অসম্ভব জোর সেও রণদার নাকে একটা ঘুষি দিল।আমি হেল্প-হেল্প করে চিৎকার করতে যাব,পিছন থেকে আরও একজন এসে আমার নাকে রুমাল চেপে ধরল,চোখের সামনে দেখছি রূম বয়ের সাথে রণদা ধস্তাধস্তি করছে,কিন্তু আমার হাত পা ততক্ষণে অসাড়,চোখের পাতা ভাড়ি হয়ে আসছে,তারপর আসতে আসতে সব ঝাপসা,অন্ধকার।
যখন জ্ঞান ফিরল, তখন একটা অন্ধকার ঘরে আমার মুখ আর হাত বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছি,ঘরটা অতি ছোট,এটাও অনুভব করলাম,ঘরে আমি একা নেই।একটা মৃদু অতি চিকন কান্নার আওয়াজ।অনুমানে বুঝলাম ঘরে আরও কেউ আছে,কিন্তু কে বা কারা আমাদের এভাবে অপহরণ করেছে?কি বা লাভ তাদের? আরও একটু ধাতস্থ হওয়ার পর বুঝলাম।আমরা যে ঘরে আছি সে ঘর চলমান।প্রবল ঝাঁকুনি।এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানি না,কান্নার আওয়াজ থেমে গেছে।এক সময় হঠাৎ,ঘরের একপাশের দেওয়াল পুরোপুরি খুলে গেল,এবারে নিশ্চিত হলাম,এটা একটা বড় সরো মাল বোঝাই গাড়ি,দরজা খুলতেই দেখি রণদা আর শুভদাদা, দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে।১৪৪ ধারা জারি থাকলে এমনভাবে হাত তুলে দাঁড়াতে হয় এটা আমি জানি,আরও একটা কারণে দাঁড়াতে হয়,সেটা হল যখন কেউ বন্ধুক তাক করে।সেই বন্ধুকধারীকে এবার দেখতে পেলাম।এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।সত্যিই দেখছি তো,এ আর কেউ নয় রণদাদের সেই আরেক বন্ধু শোভনদাদা।আর চলমান ঘর থেকে যে কান্নার শব্দ আসছিল সেটা শুভদাদার ভাই পিন্টুর।
এক বিশ্রী হাসি শোভনদাদার মুখে,এবার যে খেলা শেষ করতে হবে শুভ!সোনার হরিণ দাও।আর তোমাদের ভাইদের নিয়ে যাও।তাড়াতাড়ি!
এবার আরও একটু চমকে গেলাম।আমরা যে জিপে করে দার্জিলিং এসেছি।তার ড্রাইভার ও আমাদের এক সহযাত্রী শোভনদাদার পিছনে এসে তাকে গ্রেফতার করে নিয়েছে।রণদা এবার ছুটতে লাগল,কোনদিকে ছুটল সেটা পরে জেনেছি কারণ তখন সেই নেপালি ড্রাইভার আমার আর পিন্টুর বাঁধন খুলছিল,রণদা আমাদের হোটেলের সেই রূম বয়-এর পিছনে ছুটছে।ধরে ফেললবেই।রণদা হারতে শেখেনি।
৫
হোটেল রুমে বসে কথা হচ্ছে।শোভনদাদা আর তার পার্টনার এখন এন.জি.পি থানায়।তাকে টাকা দিয়েই সে এসব করতে পেরেছে।একটা জিনিস আমি এখনও জানি না।এই সোনার হরিণটা কি?
শুভদাদা বলল,ওটা আর কিছুই না আমার ঠাকুরদার পৈতেতে কালীপ্রসন্ন সিংহ-এর দেওয়া একটা সোনার হরিণ-এর মূর্তি।এর ঐতিহাসিক মূল্য হয়তো অনেক,কিন্তু আমার ভাইয়ের জীবনের কাছে ওর কোন দাম নেই!ও যদি চাইত আমি ওটা ওকে এমনি দিয়ে দিতাম।ও আমার ভাইকে কেন কিডন্যাপ করল!
রণদার কথা এবার শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে।ও বোধহয়,সেই নেপালি ড্রাইভার আর আমাদের সেই সহযাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিল।এতক্ষণে আমি জেনে গেছি ড্রাইভারটি আসলে এন.জি.পি থানার একজন ইন্সপেক্টর।আর অন্য ভদ্রলোক আমাদের মেদিনীপুর জেলা থানার ইন্সপেক্টর।সেই মেদিনীপুর থেকেই উনি আমাদের সাথে ছিলেন।আমি বা শুভদাদা ওনার কথা বুঝতেই পারিনি।ওনারা আসার পর চা বলা হল,তারপর রণদা শুরু করল,এটা একটা সাংঘাতিক কেস।শুভ তোর এরপর থেকে সাবধানী হওয়া উচিৎ।এমন যাকে তাকে পারিবারিক জিনিসপত্র দেখাস না।আমার কিন্তু এই কেসে প্রথম থেকে শুভকেই সন্দেহ হয়।কিন্তু জিপে যখন ছাপাক্ষরে কাগজটা পাই তখন সন্দেহ অন্য একজনের দিকে মোড় নেয়।তাড়াহুড়োতে wide latin ইউনিকোডে টাইপ সবসময় শোভনই করে।এবারও ওই করেছে। কিন্তু ও যে বোকামি করে এত দূর চলে আসবে ভাবিনি।আমার বিশ্বাস তখনও অবধি পিন্টু ওখানেই ছিল।পিন্টু এখন ঘুমাচ্ছে পাশের ঘরে।সম্ববত ওকে অজ্ঞান করে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়।তারপর ওকে আমরা যে ট্রেনে আসি সে ট্রেনে করেই এখানে আনা হয়।টিটির প্যাসেঞ্জার লিষ্ট চেক করে আমি ওদের নাম পাই।সেটাও অবশ্য ইন্সপেক্টর মোহনবাবুর জন্যই সম্ভব হয়েছে।তারপর এখানে এসে কুনালকে ইচ্ছা করে হোটেলে রেখে আমরা বাইরে যাই।আমি জানতাম এই টোপ ওরা গিলবেই।রূম-বয়টিকে ও আগেই হাত করে নিয়েছিল।তাকে দিয়েই আমাদের ফোন করানো।তার বাড়িতেই পিন্টুকে রাখা হয়েছিল।কিন্তু এত কিছু করেও শেষ রক্ষা হল না।কুনালকে কিডন্যাপ করার পর আমি আর শুভ ওদের ফোন করে বলি সোনার হরিণ দেব,ওরা আমাদের শুটিং স্পটে আসতে বলে আমরা যেতেই ফোনে বলা হয় চোখে কাপড় বেঁধে দাঁড়াতে তারপর সোনার হরিণ দিতে,আমরা তাই করি।মাটির মূর্তি দেখে এবার আসল মানুষ বাইরে আসে।যার জন্য এত কাঠ-খড় পোড়ানো,তার কণ্ঠ শুনেই আমরা চিনতে পেরে চোখের কাপড় খুলে দেখি ওরা একটা টেম্পো নিয়ে এসেছে এবং আসল দোষী কে সেটাও!শোভন বোধহয় কল্পনাও করেনি,আমাদের সাথে দুজন সত্যিকারের বন্ধুকধারী পুলিশ আছে,নকল বন্ধুক দেখিয়ে আমাদের ভয় দেখিয়ে কুনাল আর পিন্টুকে দেখায়।তারপরের সবটা তো তুইও জানিস কুনাল।
পুলিশ অফিসার মোহনবাবু আমাকে হাত জোড় করে বলল,আসল দোষীর কাছে যাওয়ার জন্য আমাদের তোমাকে একটু বিপদে ফেলতে হয়েছিল ভাই।প্লিজ কিছু মনে করো না।
রণদা আমায় জড়িয়ে ধরেছে।শুভদাদা বলল,সরি ভাই,এন্ড থ্যাংক ইউ সো মাচ রণ-কুনাল!