গল্পেরা জোনাকি তে স্মার্ত পরিয়াল (শেষ অংশ)

হননের পর

দীননাথ পৌঁছে গেল শঙ্কর গাঙ্গুলীর বাড়ির সামনে।যৌবনে এসব অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এসেছিল দীননাথ,গৌরী,কার্তিক বা শঙ্কর।পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়া তাদের পক্ষে কোনো ব্যাপারই ছিল না।আজ শঙ্করের বাড়ির সামনে কড়া নিরাপত্তা দেখে দীননাথের সেসব মনে পরে যাচ্ছিল।কীকরে এই চক্রবূহ ভেদ করতে হয় সে জানে।সেই বুদ্ধি তার আছে,কিন্ত গায়ের জোর আর নেই।তাই মাথাটাই ভরসা।বাড়ির পেছনে তিনজন গার্ড।প্রতি তিনঘন্টায় গার্ড পাল্টায়।দীননাথ প্রায় সত্তর গজ দূর থেকে দুরবিনে সব দেখতে থাকল,অপেক্ষা করল।রাত বারোটা।এবার গার্ড পাল্টাবে।দীননাথ তার থেকে সামান্য দূরে একটা পাথর ফেলল।সেই শব্দে দুজন গার্ড একে অপরকে বলতে থাকল,
‘এই কী হল রে!’
-‘ধুর কিছু না,চলতো বাড়ি যাবো এবার।’
-‘সেই ভালো,চল,আমাদের ডিউটি শেষ।’
-‘হ্যাঁ চল।আচ্ছা তুই এগোতে থাক আমি একটু ইয়ে করে আসি।’
-‘আমি গেলাম।একদম ভাল্লাগছে না।’
-‘যতসব!ঠিক আছে যা।আর কী।’
দীননাথ এটাও জানতো,পরের গার্ড আসতে পাঁচ মিনিট সময় নেয়।ইতিমধ্যেই একজন গার্ড জঙ্গলের দিকেই আসছে ওর কাছে।সে একটা গাছের সামনে গিয়ে সবে দাঁড়িয়েছে,এমন সময় পেছন থেকে মাথায় প্রচন্ড জোরে একটা গাছের ডাল দিয়ে আঘাত করল দীননাথ।গার্ড অজ্ঞান হয়ে পরে গেল মাটিতে।তাকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে,তার ইউনিফর্ম খুলে সে নিজে পরে নিল।এরপর সে আসতে আসতে চলে গেল ঘরে।ইউনিফর্ম আর টুপির জন্য কেউ তাকে চিনতেও পারছে না।এই ঘরের সবকিছু চেনে সে।সবার আগে গিয়ে সে ঘরের পাওয়ার অফ করলে হই হই শুরু হল।সেই সুযোগে দীননাথ চলে গেল শঙ্করের ঘরে।তিনজন গার্ড ছিল সেখানে।দীননাথ চিৎকার করে বলল,’বড়োবাবু সবাইকে নীচে ডাকছে,দীননাথ ধরা পড়েছে।’
এই খবর শুনে আর কেউ কিছু ভাবল না।সবাই চলে গেল।কিন্ত দীননাথ ঘরের দরজা দিয়ে দিল।শঙ্কর বলে উঠল,’কী হল দরজা দিলে কেন?’
সেই সময় জানলা থেকে কেবলমাত্র চাঁদের আলো আসছে।যা দীননাথের কাজ পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট।সঙ্গে সঙ্গে দীননাথ বন্দুকের নল শঙ্করের মুখে ঢুকিয়ে বলল,’একটা শব্দ করলে এই বন্দুক তোমাকে শেষ করে ফেলবে।’
আসতে আসতে মুখ থেকে বন্দুক বার করল দীননাথ।শঙ্কর কাসতে কাসতে বলল,’দীননাথ!তুই,তুই বদলা নিতে চাইছিস?কীসের বদলা?কার জন্য বদলা?’
-‘ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করবে না।তোমার জন্য আমার অঞ্জলির….’
-‘হা হা হা…কেউ জানে না,কেউ কিচ্ছু জানে না।অঞ্জলি মরেনি কোনোদিন মরেনি।’
দীননাথ বিশ্বাস করল না।চুপ করে রইল,শঙ্কর বলতে থাকল,’তুই জানিস তুই কেন জেল খেটেছিস এতদিন?কে তোকে ধরিয়ে দিয়েছে?না আমরা নই।আমরা তোকে ভালোবাসতাম,নিজের ভাইয়ের মতো দেখেছি তোকে।বারণ করেছিলাম তোকে আমি এই মেয়ে ঠিক না তোর জন্য।’
দীননাথ কাঁপতে কাঁপতে বলল,’কিন্ত ও কেন?ও তো ভালোবাসতো….’
-‘তোর জেল হলে অঞ্জলিরও হতো।কারণ এতবছর ও তোর সাথে ছিল।আর থেকেও পুলিশকে জানায়নি এটা কী কম অপরাধ?যখন দেখল তুই ধরা পরবি তখন নিজে পুলিশের কাছে গিয়ে তোর,আমার সবার কথা বলে দিয়েছিল।এসব কেউ জানে না শুধু আমি জানি।গোটা পৃথিবীর কাছে অঞ্জলি মৃত,কিন্ত ও বেঁচে আছে।অ্যাক্সিডেন্টটা একটা নাটক ছিল,যেহেতু অঞ্জলি সব ইনফরমেশন দিয়ে দেয় তাই পুলিশেরা ওকে নতুন জীবন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।এখন সে অন্য নামে এই শহরেই আছে।’
-‘প্রতিশ্রুতি তো তোমাদেরও দিয়েছিল,নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ তোমরাও পেয়েছিলে তোমরা সবাই।তাহলে কেন আমি নয়?’
-‘তোর সাথে যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে,কিন্ত আমার একটা পরিবার আছে,তাদের কী হবে?’
-‘একটা শেষ কথা জিজ্ঞেস করব তোমাকে।’
-‘শেষ কথা?ঠিক আছে বল।’
দীননাথের গলা প্রচন্ড কাঁপছে,’গৌরীদা বলল ওইসময় অঞ্জলির….’
-‘ঠিক বলেছে’,মাথা নীচু করে বলল শঙ্কর,’তোর একটা ছেলে আছে।একসাথেই থাকে ওরা।’
পুলিশের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।দীননাথ তখনও বসে আছে,শঙ্কর বলল অঞ্জলির নতুন নাম এখন উর্মিলা রায়,ঠিকানাও বলে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে ওকে বেরোনোর পথ দেখিয়ে দিল,’যা পালা পালা।’
-‘কাজটা যে আমাকে করতেই হবে শঙ্করদা।ভালো থেকো।’
দুটো গুলির শব্দ পাওয়া গেল পরপর।একটা লাগল শঙ্করের বুকে আর একটা দীননাথের পায়ে।পালানোর সময় পুলিশ চলে এসেছিল।ওরাই চালিয়েছিল।কোনরকমে দীননাথ ছুটে পালায়।দীননাথের এখন লক্ষ্য একটাই,হিটলিস্টে আরও একটা নাম জুড়ল।উর্মিলা রায়,ওরফে অঞ্জলি।

সেই রাতেই দীননাথ পৌঁছে যায় অঞ্জলির বাড়িতে।দরজার লক খোলার কৌশল সে খুব ভালো করেই জানে।ঘরে গিয়ে দেখে অঞ্জলি নেই,তার ছেলে আছে,জেগে,কম্পিউটারে বসে।দীননাথ সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে দেয়।দীননাথ তাকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখে।নিজেও তার সামনেই বসে।জ্ঞান ফিরলে সে বলে,’ঘুম হলো?’
অঞ্জলির ছেলে চমকে ওঠে,’আ…আ…আপনি!আপনি কে?’
-‘মা কোথায়?’
-‘আপনার কী তাতে?কে আপনি?’
-‘এই দেখো ছোকরা,তোমার সাথে কোনো কাজ নেই আমার।আমার দরকার তোমার মাকে।অনেক কাজ বাকি।’
-‘মা বাড়ি নেই।’
তখনই একটা ফোন বেজে উঠল,দীননাথ বলল,’বাহ!যাকে খুঁজছিলাম সেই ফোন করেছে।’
এরপর ফোন তুলে দীননাথ বলল,’হ্যালো।উর্মিলা রায়।’
ফোনের ওপাশ থেকে উত্তর এল,’কে কে আপনি?’
-‘দেখলেই চিনতে পারবেন।বাড়ি আসুন।আপনার ছেলের তো খুব বিপদ।’
-‘কী হয়েছে?কী চান আপনি?’
-‘আপনাকে চাই,বাড়ি আসুন আপনি।এই দেখুন ছেলের গলা শুনুন।’
এই বলে ফোনটা তার ছেলের কাছে নিয়ে যেতে সে চিৎকার করে বলল,’না মা!আসবে না আমার কিচ্ছু হবে না।’
দীননাথ বলল,’খবরদার,পুলিশে খবর দিলে কিন্ত আপনার ছেলে বাঁচবে না।একা আসবেন, এক্ষুনি আসবেন,অঞ্জলি!’
অঞ্জলি নামটা শুনে উর্মিলা শিউরে উঠল।এই নামে তাকে তো কেউ চেনে না।ত্রিশ বছর তাকে এই নামে কেউ ডাকেনি।তবে কী….
এদিকে দীননাথ তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করল,’কী নাম?’
-‘অভিষেক।’
-‘কী করা হয়?’
-‘তাতে আপনার কী?’
-‘বাবা কোথায় তোমার’ গলা নরম করে বলল দীননাথ।
-‘বেঁচে নেই।আমি তাকে দেখিনি কোনোদিন।’
-‘মা কী বলেন বাবা সম্পর্কে?’
-‘খুব ভালো লোক ছিলেন আমার বাবা।মাকে খুব ভালোবাসতেন,এটুকুই জানি।’
-‘মা আর বিয়ে করেননি?’
-‘না।’
এসব শুনে দীননাথের মনটা ভারী হয়ে উঠছিল।তার নিজের ছেলেকে প্রথমবার চোখের সামনে দেখতে,তাও এই অবস্থায়।ইচ্ছে করছে আলিঙ্গন করতে,কিন্ত কী পরিচয় দেবে?একজন খুনি ওর বাবা?তার থেকে এমনই থাক সবটা।তার বাবার যে ছবিটা মনের মধ্যে আছে সেটাই থাকুক।

এর মধ্যে উর্মিলা এসে উপস্থিত।দীননাথকে দেখে উর্মিলার ভূত দেখার মতো অবস্থা।এটা কীকরে সম্ভব!সে বলল,’দীননাথ?’
-‘চিনতে পারলে তবে?’
-‘কী চাও তুমি?’
-‘কিচ্ছু না।আর কিছু বাকি নেই এই জীবনে।শুধু কিছু উত্তর চাই।’
-‘আমাদের ছেড়ে দাও।আমরা কিচ্ছু করিনি।’
এসব শুনে উর্মিলার ছেলে জিজ্ঞেস করতে থাকল,’ও কে মা,কে এই লোকটা।’
ছেলের জন্য দুজনে ঘরের বাইরে চলে আসে।অভিষেক ঘরেই থাকে চেয়ারে বাঁধা।
দীননাথ বলল,’এই ছিল প্রতিদান তোমার?’
-‘আমি কী করতাম আর?’
-‘কোন জিনিসটা আমি দিইনি তোমাকে?’
-‘যেটা ছাড়তে বলেছিলাম পেরেছিলে ছাড়তে?একবার না একশোবার বলেছি।’
-‘আমি চেষ্টা করছিলাম অঞ্জলি,বারবার করেছি,পারতাম আমি।’
-‘নাহ,এই খুন,চোরাকারবারি তুমি কোনোদিন ছাড়তে পারতে না।নিজেকে দেখো,ত্রিশ বছর হয়ে গেল,আজ‌ও তোমার হাতে বন্দুক।আজ‌ও খুন করছ তুমি।তুমি খুনি দীননাথ।কী বলতাম আমি আমার ছেলেকে?তার বাবা একজন গুন্ডা,মাফিয়া,সিন্ডিকেটের লোক?আমি কোনোদিন চাইনি আমার ছেলে তোমার ছায়ায় বড়ো হয়ে আর একটা দীননাথ তৈরি হোক।নিজের মতো করে বড়ো করতে চেয়েছিলাম ওকে।এসব থেকে অনেক দূরে যেতে চেয়েছিলাম আর তার জন্যই আমি পুলিশকে গিয়ে সব ইনফরমেশন দিয়েছি।’
-‘তুমি যদি আমাকে একবার বলতে এসব কথা,আমি নিজেই চলে যেতাম তোমার থেকে দূরে।’
-‘আমি চাইছিলাম তুমি যাতে মরে যাও।বাকিদের মতো তোমাকেও ছাড়ানো যেত।আমিই সেটা চাইনি।আবার চলে আসতে তুমি আমার জীবনে।’
-‘এতটা ঘৃণা?’
-‘আমি শুধুমাত্র আমার ছেলের একটা ভালো জীবন চেয়েছিলাম।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীননাথ বলল,’ আর আমার কথা ভাবোনি?ভাবলে না আমি কীভাবে এতগুলো বছর কাটাবো ওরকম জায়গায়।ত্রিশটা বছর আমি জ্বলেছি প্রতিশোধের আগুনে।কারণ ওদের জন্য তোমার মৃত্যু হয়েছিল।কীসের প্রতিশোধ!আমার একটা ছেলে আছে এদিকে কোনোদিন তাকে দেখলাম না,তার নাম জানলাম না,কিচ্ছু না।আরে তোমার থেকে তো শঙ্করদাই ভালো ছিল,ওরা কোনোদিন আমাকে ধরিয়ে দিত না তোমার মতো।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গলা নরম করে বলল,’তুমি নাকি অভিষেককে বলেছো তার বাবা ভালো মানুষ?কেন?’
-‘তুমি তো খারাপ না।তোমার কাজগুলো খারাপ ছিল,তোমার মন খুব ভালো ছিল,তারই প্রেমে পড়েছিলাম আমি।’
দীননাথ কান্নায় ভেঙে পড়ল।মাটিতে বসে পড়ল,বলল,’চলো অঞ্জলি,আবার আমরা নতুন করে সব শুরু করি।’
-‘না সেটা সম্ভব নয়।’
-‘কেন আমি অভিষেককে বোঝাবো সব।’
-‘না না।অসম্ভব!’
হঠাৎই পুলিশের গাড়ির শব্দ পেল দীননাথ,বলল,’অঞ্জলি তাড়াতাড়ি বলো,হাতে সময় নেই।হ্যাঁ কি না?’
-‘না!না!’
দীননাথ পকেট থেকে বন্দুক বার করে তাক করল অঞ্জলির দিকে,বলল,’প্লিজ অঞ্জলি এখনো সময় আছে।’
ইতিমধ্যেই পুলিশের গাড়ি এসে উপস্থিত।বন্দুক,রাইফেল হাতে একে একে তারাও ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল।এক গোয়েন্দা বলল,’দীননাথ,সারেন্ডার করে দাও।এখনো সুযোগ আছে,তোমার হয়ে আমি লড়ব কোর্টে।’
দীননাথ এখনো বলে যাচ্ছে অঞ্জলিকে,’প্লিজ,একটা উত্তর দাও ভেবে চিন্তে,নতুন করে শুরু করবে সব?’
উত্তর এল,’না!’
-‘তাহলে আমারও কোনো উপায় নেই।’
গোয়েন্দা বলল,’দীননাথ ফেলে দাও বন্দুক ,আমাকে বাধ্য করো না গুলি করতে।’
দীননাথ বন্দুকের লক যেই খুলল,সঙ্গে সঙ্গে তিনখানা গুলি এসে লাগে ওর গায়ে।দীননাথ মাটিতে লুটিয়ে পরে।অঞ্জলি দীননাথের কাছে গিয়ে বলল,’কেন এই বোকামিটা করলে?’
দীননাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে বলল,’আমার জীবনে আর কিছুই বাকি ছিল না তুমি ছাড়া অঞ্জলি।বাঁচলে তোমার সাথেই বাঁচতাম।শোনো অভিষেককে ওর বাবার পরিচয় জানতে দিও না।কোনোদিন যেন না জানতে পারে।’
দীননাথ এখন মৃত।অঞ্জলির চোখে জল।দীননাথের হাত থেকে বন্দুকটা নিজেই নিয়ে বলতে থাকল,’আমার থেকেও বেশি যে জিনিসটাকে ভালোবেসেছিলে….’
বলতে বলতে হঠাৎ একটা জিনিস দেখে থেমে গেল।বন্দুকের ভেতরে একটা গুলিও ছিল না।দীননাথ এটাই চেয়েছিল।হয় অঞ্জলির সাথে নতুন জীবন আর নাহলে মৃত্যু।অঞ্জলি সবটা বুঝে আর একটাও কথা বলতে পারল না,চুপ করে দীননাথের পাশে বসে রইল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।