হৈচৈ ছোটদের গল্পে সুদীপ্ত পারিয়াল

ভূতের মতো কিছু একটা

রণদা বলে, তুই যদি ফিল করিস ভূত বলে কিছু আছে, তাহলে তো অবশ্যই তা আছে। আর যদি মনে করিস কিছু নেই, তাহলে নেই।সুতরাং মনের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।বুঝলি? মন যদি বিশ্বাস করে তখন মন তার জন্য একটা যুক্তি খোঁজে, যুক্তি না পেলে মন কিন্তু কখনই ঘটনাটাকে গ্রাহ্য করে না।
আসলে ব্যাপারটা আর কিছুই না। কদিন ধরে আমার সাথে বেশ কয়েকটা অদ্ভুত কান্ড ঘটছে।
প্রথমে শুরু হয়েছিল স্বপ্ন দিয়ে। কে যেন আমাকে স্বপ্নে বারবার ভয় দেখাচ্ছে। মানে ভূতের ভয়। অশরীরী কিছু আত্মা যেন আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা আমার কলমের একটা আঁচড়ে মারা যায়, তাদের মুখগুলো তো দেখি, আবার কিছু পরিচিত মানুষের মুখও দেখি।
যেমন আমাদের স্বর্গীয় মাস্টারমশাই সুধীর দাস, আবার কখনও আমার সেই প্রায় ভুলতে বসা মাকে। জন্মের পর মা বলতে যাকে চিনি সে আমার অবচেতনে আছে। তাই তাকে দেখিয়ে হয়তো।
এই অব্দি সব ঠিক আছে। কিন্তু এরপর তাদের  সশরীরে দেখাটা আমার মানসিক অস্থিরতার বাড়াবাড়ির পরিচয় দিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটা শুরু হলো যখন আমাদের বৈরাগীতলার সাধুবাবা অবনীকান্ত মুখোপাধ্যায়কে দেখলাম। আমার মাঝেমধ্যে টিউশন থেকে পড়ে ফিরতে অনেক রাত হয়। সাইকেল নিয়ে আসি। যদিও আমাদের এখানকার রাস্তাঘাট অন্ধকার নয়, তবু রাতে একা ফিরতে যেন খানিকটা ভয় লাগে।
একদিন দেখি সেই পঞ্চানন মন্দিরের সামনে আমার পথ আগলে সাধুবাবা দাঁড়িয়ে। আসলে সাধু সন্ন্যাসীদের জটা-জুটো প্রায় সব একই লাগে আমার। তাই বিশেষ করে প্রভেদ করতে পারিনি। কিন্তু উনি যখন বললেন, বাবু একটু জল খাওয়াতে পারিস!
সেই অবিকল কণ্ঠ শুনে আমার স্নায়ু কাজ করা বন্ধ করে দিল। ঘেমে নেয়ে বাড়ি এসে রণদাকে সব বলায় রণদা তখন ওই যুক্তির কথাগুলো আমায় বলল। আমি ওকে বোঝাতেই পারলাম না যে সত্যিই আমি ওরকম কিছু একটা ভৌতিক জিনিস প্রত্যক্ষ করেছি।
অবশ্য আমাকে আর কিছু করতে হলো না। এরপর থেকে সব জায়গায় রটে গেল। এবং এরকম বহু সমস্যার কথা নিয়ে বহু লোক রণদাকে এসে বিব্রত করতে শুরু করল।
কিন্তু ভুতুড়ে কেসের আবার গোয়েন্দা তদন্ত হয় নাকি?
রণদার হেরে যাওয়াটাও আমার বরদাস্ত হবে না। আর তাই পঞ্চায়েত প্রধান নবীন সোমের বাড়িতে মিটিং বসেছে। আমাদের লোকাল থানার এস আই সমর মন্ডল এসেছেন।  রণদা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিটিংয়ে গেল।
বৈরাগীতলার আশ্রমের বর্তমান প্রধান নিতাই চন্দ্র চৌধুরী বললেন, দেখুন মাতব্বর, আমার মনে হয় গ্রামের লোকেদের মঙ্গলের জন্য এবং সাধুজির আত্মার শান্তির জন্য একটি হোম করা উচিত। সেই সাথে নরনারায়ন সেবা।
নবীনবাবু বললেন, তা না হয় হবে। কিন্তু যে উপদ্রব শুরু হয়েছে গ্রামে তার কিনারা কি করে হবে? এই ঘরে ঘরে রোজ মুরগি হাঁস চুরি। জনার্দন বসুর খড়ের গাদায় আগুন। এসব করে সাধুজীর  প্রেত কি শান্তি পাবেন?
জনার্দন বসু বললেন, আর বোলো না, সব থেকে বড় ক্ষতি তো আমারই হয়েছে।
গ্রামের আরেক বরিষ্ঠ নাগরিক সোমেশ্বর দে মন্তব্য করলেন, দ্যাখো প্রথম প্রথম আমিও বিশ্বাস করিনি। তারপর যখন দেখলুম রাতারাতি আমার সাধের অমন বাগান তছনছ করে দিল, তখন কি আর চুপ করে থাকা যায়?
সমর বাবু বললেন, দেখুন আমার তো মনে হয় কোন মানুষেরই কাজ এসব। বিজ্ঞান বলে ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই। আর এ যুগে বসে আপনারা যদি এ বিশ্বাসে অটল থাকেন যে এসব কান্ড মৃত সাধুর প্রেতাত্মা করেছে, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। রণবাবুর কথামতন আজ থেকে চারজন কনস্টেবল আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। রাতে ওরা গ্রাম পাহারা দেবে।
রণদা, কেন যে এসব ব্যাপারে চুপ করে থাকে বুঝি না। ওর অনেক বদ অভ্যাসের মধ্যে এটা একটা।
ভোলাদাদা হঠাৎ বলল, আচ্ছা রণ, শিবেন গোঁসাই-এর কাছে একবার যাবি?
ভোলাদাদা আজকাল গান শিখছে এক ক্ষ্যাপা বাউল-এর কাছে। তার বয়স বড়জোর ৪০ হবে। তবে দেখলে মনে হয় যেন ৬০ পেরিয়ে গেছে। দিনরাত নেশা করে পড়ে থাকে। তবে একবার যখন গান ধরে মানুষটা যেন পাল্টে যায়। একটা সুরও এদিক থেকে ওদিক হয় না নেশার ঘোরে। ওর অনেক কথা নাকি ফলে যায়। যাকে বলে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। তোমরা বললে বিশ্বাস করবে কি? এই করোনা মহামারী ২০২০ সালে আসবে সেটা ও ওর দশ বছর বয়সে বলে দিয়েছিল। আরও একবার কোন এক সঙ্গীতের আসরে ও বলেছিল সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর ৯২ বছর বয়সে ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পূজার বিসর্জনের দিন সুরলোকে পাড়ি দেবেন। তোমরা জানো নিশ্চয়ই গ্রামাঞ্চলের মানুষরা লতা মঙ্গেশকরকে নিজের বাড়ির মেয়ে বলেই মনে করে। সবাই তখন খেপে গিয়েছিল শিবেন বাউলের কথা শুনে। কিন্তু যখন ওর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল তখন শিবেন বাউলের কথা আর কেউ মনে রাখেনি। তবে এটা ঠিক লতা মঙ্গেশকার যেন আমাদের বাড়িরই মেয়ে। যখন উনি মারা গেলেন আমি ঠাম্মিকে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম। কোন শিল্পীর মৃত্যুতে বাড়ির কাউকে এমন কাঁদতে আমি কোনদিন দেখিনি।
কিন্তু যে মানুষটা ভবিষ্যৎ বলে সে ভূতের সমস্যা সমাধান করবে কি করে?
রণদা বলল, তুই আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিলি রে ভোলা। সমরবাবু, প্রয়োজনে আপনার হেল্প পাব আশা করি।
-অবশ্যই… এনি টাইম…
আমরা সদলবলে চললাম শিবেন বাউলের ঘরের দিকে। বাউল একাই থাকেন। আগে ওর বউ ছিল। কিন্তু সেও মারা গেছে। বাউল আর বিয়ে করেনি।
শিবেন বাউল এক মনে উঠোনে বসে গঞ্জিকা সেবন করছে। চোখ লাল। এই নেশা বিষয়টাকে রণদা একদম পছন্দ করে না। আর যাকে নেশা গ্রাস করেছে তাকেও করবে না বলা বাহুল্য। আমি জানি কোন পথই খোলা না দেখে রণদা এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে। অবশ্য ওর মুখ দেখে এমনটা মনে করা সত্যিই অমূলক।
ভোলাদাদা শিবেন বাউলকে ডাকল, গোসাই জি, বড় বিপদে পড়ে আমরা এখানে এসেছি।
– অবনী মুখার্জির ভূত… বলেই ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন।
… শোন বাছা, সর্ষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে তাহলে আসল ভূতকে ভয় করে লাভ কি?
রণদা ছাড়া কেউই এসব উদ্ভট কথাবার্তার জবাব দিতে পারবে না। ও বলল, ভূতের ব্যাপারটা তবে বুঝল কি সেটা আপনিও বিশ্বাস করেন?
– মানুষ মলে মুক্তি পায় বাপ! কিন্তু মুক্তি যদি না মেলে তখনই যত জ্বালা। মুক্তি তো শুধু মানুষটার একার নয় রে বাপ, সবাইকে নিয়েই তো মুক্তির একটা আখড়া। এই যে তোমরা একসাথে এখানে এলে সেই কবে মরে যাওয়া একটা সাধুর বেত্তান্ত শুনতে। তার মানে এটা তো মানতে হবে ওনার মুক্তির সাথে কোথাও না কোথাও তোমাদেরও মুক্তি। আসলে কি জানো বাবারা, আমাদের মুক্তির কোন শেষ নেই। দেহ ছেড়ে গেলেও পরিজন, পরিজন ছাড়লে আবার তার পরিজন। এভাবেই গোটা সংসার টাই একটা মুক্তির জালে বিধে আছে।
রণদা বলল, কিন্তু মূল বুজরকিটা কেন?
-আচ্ছা ছোট বাচ্চার যদি আঘাত লাগে তাহলে বড়রা কি করে বল তো?
আমি বললাম, তার সেবা করে। তাকে ভোলায়।
– এই, এই যে ঠিক ধরেছ। ভোলায়। যাতে কান্নাকাটি করে তার যেন বড় কিছু না ঘটে। সেরকমই এ ঘটনার পেছনে একটা বড় খেলা চলছে। মস্ত বড় একটা চক্রান্ত। দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এবার বিথীর ইচ্ছাতে তোমরা পারলে ঠেকাও সে চক্রান্ত।
ভোলাদাদা বলল, কিন্তু গোসাইজি, একটা মরা মানুষ এসে জল চাইছে, হাঁস-মুরগি মেরে ফেলছে এসব কেন?
– জলই তো চেয়েছে। পুকুর ভর্তি জল গেলা না, ঠেকায় কে!
রণদা ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসছিল, আমরা সাথে করে চাল ডাল ও তরিতরকারি নিয়ে গেছিলাম। কারণ শুনেছি ভদ্রলোক নাকি দক্ষিণা নেন না। উনি বললেন, বাবারা এত বেলায় আর হাত পুড়িয়ে রাঁধব না। ও বাবুজি, রণদাকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো, তুমি একটু ডালে-চালে ফুটিয়ে দেবে বাপ? তোমরাও চাড্ডি খেয়ে নাও। ব্রাহ্মণের পদধুলি বড় একটা তো পড়ে না।
আহারে! আমার বড্ড কষ্ট হলো লোকটার জন্য। রনদা, ওকে রান্না করে খাইয়ে দিল। আমরা ওনার থেকে বেশ কয়েকটা গান ও অনেক গল্প শুনলাম। একটা গান তো আমার মুখস্ত হয়ে গেছে।

দেহতরি ছেড়ে যাবি
কিসের তরে তবে মায়া
বিধিরে তোর রাখছে খেয়াল
দিচ্ছে যে দেখ মস্ত ছায়া

অমন বান ডেকেছে বলে কি আজ
ভাত খাবি না জেদ ধরেছিস
গরম ভাতের গন্ধে আছে
সর্বনাশা ভাবের মায়া

বিধিরে তোর তরি খানা
যাচ্ছে নিয়ে দিবা নিশি
একলা ঘরে বসিস না আর
ওরে অবোধ সবই মায়া।

পুলিশি পাহারার পর এমন আশ্চর্য কিছু ঘটল না। তবে এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে আমাদের এই অ্যাডভেঞ্চারের মোড় পুরোপুরি ঘুরে গেল। যদিও ঘটনাটা দুঃখজনক। শিবেন বাউলকে তার ঘরের উঠোনে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। অবশ্য মৃত্যু স্বাভাবিক কারণেই ঘটেছে। কিন্তু শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে গিয়ে রণদা বলল, বডি পোস্ট মর্টেমে পাঠাতে হবে। সুজনদাদা তুমি থানায় খবর দাও।
ভোলাদাদা খুব কাঁদছে। ও বলল, এসবের কি দরকার?
– ভোলা তোর গুরুজি তরি-তরকারি খেত। কিন্তু কখনো বিরিয়ানি খেতে দেখেছিস কি?
বুঝলাম রণদা এরই মাঝে শিবেন বাউলের ঘর থেকে ঘুরে এসেছে। সেখানে ও নাকি একটা আধ খাওয়া বিরিয়ানির প্যাকেট পেয়েছে।
আমি বললাম, বাউলকে তো সবাই এটা সেটা খাওয়ার দিয়ে যেত। সেরকমই বোধহয় কেউ…
-তাই যদি ধরিস তাহলে কি শুধুই অম্বল বা গ্যাস মাথায় উঠে মৃত্যু হয়েছে?
– হ্যাঁ তাই তো।
কিন্তু এটা নিয়ে রণদা এত কেন ভাবছে কেন কে জানে?
আমাদের সকলকে চমকে দিল শিবেন বাউলের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। খাদ্যে বিষক্রিয়ার মৃত্যু হয়েছে বাউলের। তবে বাহ্যিক কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। রণদা বলল, এর পিছনে কেউ তো একজন আছেই। যে আমাদের সকলের চোখে ধুলো দিয়ে কাজটা করছে।
-কিন্তু কে করতে পারে রণ? প্রশ্ন করল ভোলাদাদা।
– সেটাই তো প্রশ্ন রে! এর উত্তর পেয়ে গেলে ল্যাঠা চুকে যেত। কারোর হয়তো ওই ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া বাউল এর উপর ক্রোশ ছিল।
আমি বললাম, এমনও তো হতে পারে যাদের কাজ বাউল পন্ড করে দিয়েছিল তারাই এটা করেছে।
– সেটা হতে পারে। তবে তার আগে বাউলের ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশুনা করে নিতে হবে। কুনাল তোরা বাউলের বাড়ি গিয়ে ওর জিনিসপত্র ভালো করে দেখে নিবি। পুলিশকে আমি ফোন করে দিচ্ছি, ওরা ঢুকতে দেবে তোদের। আমার অন্য কাজ আছে। ওর কি কাজ আছে ও বলল না। তবু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমি বললাম, তুমি আগেভাগে গিয়ে সব দেখে আমাদের সময় নষ্ট করতে পাঠাচ্ছ না তো?
– না। গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল রণদা।
আমরা চললাম থানায়। বাউলের ঘর এখন বন্ধ। তার যাবতীয় জিনিসপত্র পুলিশের জিম্মায়। সমর মন্ডল বললেন, তোমার দাদা এল না? একটা ভালো খবর ছিল।
– কি খবর?
– সনাতন বহুরূপীকে আমরা ধরেছি।
– সে আবার কে?
– এই সেই ভূত যে গ্রাম শুদ্ধ লোকজনদের ভয় দেখাত। এর ওপরই তোমার দাদার সন্দেহ ছিল। সদরে গিয়ে বহুরূপী বেশে ও খেলা দেখায়। সেই লোকের বাড়ি জিনিসপত্র তছনছ করত।
– কারণটা কিছু বলেছে?
– এখনও বলেনি তবে এ কাজ ওর একার দ্বারা সম্ভব নয়। বুঝলে? ও তা তোমরা বাউলের জিনিসপত্র দেখতে চাও, যাও গিয়ে দেখো।
জিনিসপত্র বলতে একটা শীতল পাটি, ছেঁড়া পুরনো কাপড়চোপড় কিছু, সামান্য কিছু আসবাব, একটা মাটির কুঁজো, কিছু পুরনো গানের খাতা। ও একটা ছোট সুটকেস।
আমার কেন জানি না মনে হলো এই সামান্য জিনিসগুলোর মধ্যেই কোন না কোন সূত্র আছে। নইলে রণদা এগুলো দেখতে আমাদের পাঠাত না।
দুটো বড় চমক।
প্রথম,সুটকেসের মধ্যেই পেলাম সেই জিনিস। একটা বহুমূল্য পুরনো হাতে লেখা বই এর পান্ডুলিপি। লেখকের নাম দেখে আমরা সকলে চমকে গেলাম। এ বই শাহ আব্দুল করিমের নিজের হাতে লেখা অপ্রকাশিত অপ্রচলিত গানের বই। শুধু গান নয় গান বিষয়ক বেশ কিছু গদ্য রয়েছে এই বইতে।
দ্বিতীয় জিনিসটি পেলাম গোসাইয়ের গানের খাতায়। সেখানে করিম সাহেবের অসংখ্য গানের সন্ধান পেলাম। কোথাও যেন একটা যোগাযোগ খুঁজে পাচ্ছি। ধরতে পারছি না।
একজন বাংলাদেশী সুরকার তথা সঙ্গীতজ্ঞ যিনি ২০০৯ সালে মারা গেছেন তার একটা এমন বহুমূল্য গ্রন্থ শিবেন গোসাইয়ের কাছে কি করে এল? শিবেন বাউল কখনও শাহ আব্দুল করিমের গান গেয়েছে বলে তো শুনিনি। তাহলে গানের খাতায় কেনই বা তার গান রয়েছে। অক্ষরজ্ঞানহীন একজন বাউল এর খাতায় এইসব গান বড় বেমানান লাগছে।
রণদাকে সবকিছু বলায় ও খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে শুরু করল।
ঘন্টাখানেক পর ও বলল কোন ব্যাপার না কাল পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িতে কেসের ফয়সালা। যবনিকা পতনের সময় এসেছে।
গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে রণদা এবার কোনরকম ভনিতা না করেই বলে উঠল, খেল খতম জনার্দন বসু। নিজের খড়ের গাদায় নিজে আগুন লাগিয়ে সাধু সাজার চেষ্টা আপনার মাঠে মারা গেল। সনাতন বহুরূপীকে অসৎ পথে ব্যবহার করে আপনি যে অন্যায় করেছেন তার কোন ক্ষমা নেই।
গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম জনার্দন বসু। পঞ্চায়েত প্রধান নবীন সোম ওনাদের পরামর্শ নিয়েই কাজকর্ম করেন। উনিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। জনার্দন বাবুর মুখে বোকা বোকা হাসি।
– ছেলেমানুষি করে গোয়েন্দাগিরি করছ বলে তোমার সব বেয়াদপি আমাদের সহ্য করতে হবে, নিত্যবাবু আপনি কিছু বলবেন না?
গুরুজি বলল, ও তো কারণ ছাড়া বা প্রমাণ ছাড়া কাউকে কিছু বলে না জনার্দনবাবু?
রণদা বলল, বলছি, ধৈর্য ধরুন। তার আগে সকলের জানা উচিত এই কেসে যিনি মারা গেছেন, শিবেন গোসাই কোন সামান্য মানুষ ছিলেন না। আমি পড়াশোনা করে জেনেছি উনি বাংলাদেশের সিলেটে তার শৈশব কাটিয়েছেন। সেখানে শাহ আব্দুল করিমের কাছেই তার সঙ্গীত জীবনের হাতে খড়ি। এই কথা কিন্তু  গ্রামের আরেকজন ব্যক্তি জানত। তিনি আর কেউ নন জনার্দন বসু। তারও আদি বাড়ি সিলেটে। এবং শৈশব থেকেই তিনিও করিম সাহেবের ছাত্র ছিলেন। কিছু ভুল বলছি জনার্দন বাবু?
জনার্দন বসুর মুখ নিচু।
… তবে শিবেন গোসাই এই কেসে নিমিত্ত মাত্র। আরও বড় প্রতারণা জড়িয়ে আছে এর পিছনে। ওনার খুনই সবচেয়ে বড় বোকামি হয়েছে। সনাতন বহুরূপীর স্বীকারোক্তিতে আমরা পেয়েছি, শাহ আব্দুল করিমের একটি বহুমূল্য অপ্রকাশিত বই জনার্দন বসু তার মারফত সিলেট থেকে চুরি করে আনেন। এবং যাতে করে আমাদের সন্দেহ ওই বাউল এর উপর যায় তাই ওই বইটি তিনি গিয়ে বাউলের ঘরে রেখে আসে। অক্ষরজ্ঞানহীন বাউলের ঘরে তিনি তার নিজের হস্তাক্ষর ভরা কিছু গানের খাতা রেখে আসেন।
– শিবেন অক্ষরজ্ঞানহীন নয়।
জনার্দন বসু চিৎকার করে উঠল। ও গুরুজীর চোখের মনি। ও গান বাঁধতে পারতো, গান গাইত।
– আর আপনি তা পারতেন না তাই আপনার একটা পুরনো ক্রোধ ছিল অসহায় বাউলের ওপর। বাউল আমাদের ইঙ্গিতে অনেক বার বলতে চেষ্টা করেছে সে কথা। সেই মুহূর্তে আমরা কেউই সেটা বুঝতে পারিনি। এবং দুর্ভাগ্যবশত সেই জন্য বাউলকে আমাদের আজকে হারাতে হয়েছে। যাই হোক আপনার অন্যায় এখানেই শেষ নয়। করিম সাহেবের অপ্রকাশিত বই ছাড়াও আরও অনেক দুর্মূল্য পান্ডুলিপি এবং বহুমূল্য জিনিসপত্র আপনি সনাতন বহুরূপী মারফত বাংলাদেশ থেকে পাচার করে কলকাতায় পাঠাতেন এবং সেখানে বেআইনিভাবে সেগুলি বিক্রি করে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার সমস্ত তথ্য আমরা পেয়ে গেছি। নজরুল ইসলামের অপ্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ, এছাড়াও বাংলাদেশের অসংখ্য লেখক লেখিকার গ্রন্থ আপনি পাচার করেছেন। এ যে কি ভয়ানক অন্যায় আপনি নিজেও জানেন না। আরও মারাত্মক কাজ, গ্রামের মানুষকে বোকা বানানো। প্রেত সাজিয়ে অসহায় সনাতনকে টাকার লোভ দেখিয়ে আপনি গ্রামের মানুষকে ঠকিয়েছেন। কিন্তু আপনি বোধহয় জানেন না রণবীর চক্রবর্তী ভূতের ভয় পায় না।
যে রাতে কুনাল ভয় পেল। মানে আমাদের বৈরাগীতলার সাধুজির প্রেতকে দেখতে পেয়েছিল, সেই রাতেই আমি পঞ্চানন তলায় গিয়ে দেখতে পেয়েছি সাধু বাবার প্রেত রুপী সনাতন বহুরূপীকে। সেও আমাকে দেখে, তারপরেই চম্পট দেয়। আমার বিশ্বাস তারপরে আপনি ওকে জোরপূর্বক আবার ভয় দেখানোর কাজে নিযুক্ত করেন। কারণ এর পরে তাকে আমি ফলো করে জানতে পারি, সে কাজগুলো ইচ্ছায় করছে না। তবু আমি বাধা দিই না। বাধা দিলে আপনার কাছ অব্দি আসতে পারতাম না। এখন মনে হচ্ছে বাধা দিলেই ভালো হতো, তাহলে শিবেন গোসাইকে হারাতে হতো না। আমাদের এস আই সমর মন্ডলকে সমস্ত কিছু আগেই জানাই। কিন্তু যতক্ষণে তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছয় ততক্ষণে শিবেন গোসাইকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয়ে গেছে। তারপরই গ্রেফতার করা হয় সনাতনকে।
সমরবাবুর দুজন কনস্টেবল গিয়ে গ্রেফতার করেছেন জনার্দন বসুকে। কেঁদে ফেলল ভোলাদাদা, তোমার কঠিন সাজা হবে।
– ঠিক বলেছিস ভোলা, নিরপরাধী এক বাউলকে হত্যা করে উনি যে পাপ করেছেন তাতে ঈশ্বর ওকে ক্ষমা করলেও মানুষ কোনদিনই ক্ষমা করবে না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *