ক্যাফে গদ্যে সুকান্ত পাল (মুক্ত গদ্য)

কইছি কথা
আমরা প্রত্যেকেই নিজের ভাষায় ( Language) কথা (Speak) বলি। কথা দিয়েই নিজের ভাবনার প্রকাশ করি। কথা বলতে ভালোবাসি, কথা শুনতে ভালোবাসি। কথা দিয়েই একজন আরেকজনকে কাছে টেনে নিই আবার এই কথা দিয়েই আরেকজনকে দূরে ঠেলে দিই। কথা দিয়েই একজনের মানসিক যন্ত্রণায় প্রলেপ দিয়ে তাকে সজীব করে তুলতে পারি, জীবনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব থেকে বের করে এনে ইতিবাচক দিকে হাঁটতে সাহায্য করি। এটা একটা পারস্পরিক ব্যাপার।
কথা ছাড়া কখনো কখনো জীবন একাকীত্বের মধ্যে ঢুকে যায় — কারণ মানুষ কথা বলতে চায় মনের ভাব প্রকাশ করার মতো মনের ভার লাঘব করার জন্যেও। কথাতেই যুদ্ধ লাগে আবার কথাতেই যুদ্ধ থামে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এরকম একটা অত্যন্ত সাধারণ বিষয় নিয়ে এই ভ্যানতাড়া করতে বসার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? আছে, আছে। আসলে কথার যে কি প্রবল শক্তি আছে তা আমরা সব সময় বুঝে উঠতে পারি না। বক্তা এক ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কথা বলে ফেলল যার মানেটাই অনেক সময় উল্টো হয়ে গিয়ে শ্রোতার চেতনায় ধরা দিল। এর ফল মারাত্মক। যার জন্য ” উল্টো বুঝলি রাম” প্রবাদের প্রচলন। এবং উল্টো বুঝে অনেক উল্টোপাল্টা ঘটনা ঘটে যাওয়াটা কোনো বিচিত্র কিছু নয়। এরকম কিছু প্রবাদ দিয়েই কথার রাজ্যে প্রবেশ করছি।
একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলা প্রবাদ আছে। প্রবাদটি হলো —
” আঁকা কথা বাঁকা কথা
কথা ষোলো ধারায় বয়
কথা কইতে জানতে হয়।”
পরিষ্কার বুঝতে পারছি কথা বললেই হলো না, কথা বলারও একটা শৈলী আছে — যা আমার মতো অধিকাংশই জানি না বা তা রপ্তও করতে পারি নি। ফলে যা হবার তাই হয়। আমাদের ব্যক্তইগত জীবন থেকে সমাজ জীবন হয়ে প্রাতিষ্ঠান ঘুরে রাস্ট্রীয় জীবন সর্বত্রই একই পরিবেশ।
কথা যতই মন্দ হোক তাকেও ঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে পারলে শ্রোতার যতই রাগ হোক না কেন তাকে সেই কথা গিলতেই হবে। তারপর ভিতরে ভিতরে চলবে বিশ্লেষণ। একেই বলা হয় ‘কথা দিয়ে বশ করা ‘ । মিস্টি কথা কে না শুনতে চায়! দুর্মুখের কথা তো সহজে হজম হবার নয়! সে কথা যেমন তেতো তেমনি ঝাল। এ যেন সরাসরি শ্রোতার মুখের উপর ছুঁড়ে দেওয়া — যা হঠাৎ করে সামলানো মুস্কিল।
ঠিক এরকমই কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তি তুষার হাসান বলেন,
“কথার নাম মধুবাণী,
যদি কথা কইতে জানি
কথায় লোকে হাতি পায়
কথায় লোকে লাথি খায়।
কথায় লোকের ইজ্জত যায়
কথায় লোকে জ্ঞানী ও মূর্খ দেখায় ।”
সত্যি কথা তো মধুবাণী বটেই যদি তা ঠিক মতো কইতে পারা যায়। এই কইতে পারাটাই চর্চার বা অনুশীলনের দাবি রাখে । এইঅনুশীলন করে যদি নিজেকে তৈরি করা যায় তাহলে আর লাথি খেতে হবে না, ইজ্জতও যাবে না উপরন্তু হাতি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই মধুবাণী যেমন প্রয়োজন তেমনি এই মধুবাণীর মোহে আবার অনেক কিছু হারানোর ভয়ও কিন্তু আছে। কারণ সব সময় মনে রাখতে হবে আরো একটি প্রাচীন প্রবাদ “দুষ্টু লোকের মিস্টি কথা” । অবশ্য এ কথার অর্থ এই নয় যে যারা মধুবাণী দেন তারা সবাই দুষ্টু লোক। এখানে ঝাড়াই বাছাইয়ের বিষয়টা কিন্তু থেকেই যায়। এই বিষয়টি নিয়েই তদানীন্তন পূর্ববাংলায় বর্তমান বাংলাদেশের প্রবাদটি নিম্নরূপ
“দুষ্টু মাইসের মিস্টি কথা
ঘনাইয়া বহে কাছে
কথা দিয়া কথা নেয়
পরাণে মারে শ্যাষে।”
তাহলে বুঝতে পারছি যে কথা কওয়ার ক্ষমতা কতটা থাকলে হাঁড়ির খবর বের করে নিয়ে তাকে প্রাণে মারতেও কসুর করে না। অবশ্য প্রাণে মারা– আক্ষরিক অর্থে নয়, তার থেকে কথা নিচ্ছে তার ক্ষতি করাকেই বোঝাচ্ছে। এই কারণেই এর বিপরীতে অর্থাৎ এইসব মিস্টভাষী লোকজন থেকে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য অন্য প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে,
” কথা কিনবা
কিন্তু বেচবা না”
একটা কথা এখানে না বলে পারছি না। তা হলো আমাদের বিভিন্ন আলোচনা সভা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মঞ্চে যে বা যারা বক্তব্য রাখেন সকলের বক্তব্যই কিন্তু সমান ভাবে আমাদের আকর্ষিত করে না। কিছু জনের আলোচনা শুরু হলেই পিনপতন স্তব্ধতা নেমে আসে — সে শুধু মাত্র আলোচ্য বিষয় বস্তুর জন্য নয় — কারণ যিনি কথা কইছেন তিনি কথা কইতে জানেন। তার কথা মধুবাণী হয়ে আমাদের কানে প্রবেশ করে এবং আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ি, ঘড়ির দিকে চোখ রাখি না। আর যার কথা শুনতে শুনতে বারবার ঘড়ির দিকে চোখ চলে যায় তখনই বুঝে নিতে হয় তিনি কথা কইছেন বটে কিন্তু কিভাবে কইছেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আমাদের সমাজে তো বহু ধরণের মানুষ আছে, আছে তাদের বহুকৌণিক চিন্তা ভাবনা এবং স্বার্থ। কেউ প্রকৃত সৎবুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে জীবনে জয়ী হতে চান — যেটা প্রকৃতই কাম্য। কিন্তু এমন কিছু মানুষ আছে যারা শ্রম- বিমুখ এবং পরগাছা হয়ে বাঁচতে ভালোবাসে। তখন তারা এই ‘কথা’ র আশ্রয় নেয় এবং মিস্টভাষী হয়ে ‘ মুখে মারিতং জগত ‘ এর সাহায্যে পায়ের বদলে বুকে ভর দিয়ে চলে। অতএব এই ধরণের ‘কথা কইয়েদের ‘ থেকে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন আছে।
“কথায় কথা বাড়ে
ভোজনে পেট বাড়ে।”
কথা কইতে শুরু করলে যদি পরিমিতি বোধ না থাকে তাহলে আসল কথার বদলে উমড়ো – ঝুমড়ো কথার পাহাড় জমে ওঠে এবং ফলত অনেক অনভিপ্রেত বিষয় যেমন এসে পড়ে তেমনি কথা কাইয়েদের মধ্যেও বিভিন্ন মনোমালিন্যেরও উৎস হয়ে ওঠে।
এই একই প্রবাদের আরো একটি রূপ দেখি, সেখানে বলা হয়েছে,
” কথায় কথা বাড়ে, ক্রোধে ওঠে ঝড়. কথা না বাড়িয়ে সখি যাও তবে ঘর।”
অতএব কথা ঠিক মতো কইতে না পারলে “অকথা কুকথা ” বাড়বে এবং কিসের যে ঝড় উঠবে তা সহজেই অনুমেয়।
কথা যে কি ভয়ংকরভাবে আমাদের জীবনচর্যাকে, মন , মানসিকতাকে প্রভাবিত করে তার উদাহরণ পাওয়া যায় নিচের একটি প্রবাদে। অবশ্য প্রবাদটি দু দুটো রূপে বিরাজমান। নিচে পর পর দুটোকেই দিয়ে দিচ্ছি।
(এক)
” পড়লো কথা সভার মাঝে
যার কথা তার বুকে বাজে।”
(দুই)
“পড়লো কথা হাটের মাঝে
যার কথা তার কানে বাজে।”
একই প্রবাদ কিন্তু একটু ভিন্ন। একটাতে দেখছি বুকের ভিতর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং সেথায় দুরুদুরু কাঁপন নিশ্চয়ই শুরু হয়ে যায়! কি বিপদ সবার মাঝে যখন তার কওয়া গোপন কথাটি ছড়িয়ে পড়ে তখন না যায় গেলা, না যায় ফেলা। তখন ভাবতে বসি– কি দরকার ছিল ঐসব কথা কইবার? কিন্তু তীর যেমন একবার জ্যা মুক্ত হলে আর ফেরে না তেমনি কথা একবার কয়ে দিলে আর তাকে যেমন ফেরানো যায় না তেমনি তাকে আর পালিশ করেও প্রকাশ করা যায় না। আর যার কানে বাজল তার অবস্থা কি ? তার তো হাট- বাজার মাথায় উঠল! এরপর থেকে তাকে যে বুঝে সুঝে কথা কইতে হবে এই প্রতিজ্ঞা করে বসল। কিন্তু ভবিষ্যতে তা বোঝা যাবে।
যাক, আমরা এতক্ষনে বুঝে গেছি কথায় কথা বাড়ে। তাই কথা আর না বাড়িয়ে একটি অন্য প্রসঙ্গে আসি। ‘কথা একজনে কয় শোনে নয়’। তাই কথা যিনি কইবেন তিনি চাইবেন তার কথার মূল সুরটি যেন ভেঙে না যায়, নিরবিচ্ছিন্নভাবে এবং বাধাহীন ভাবে যেন তিনি তার কথাগুলো কইতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন ভালো শ্রোতারও কিন্তু সব সময় তা হয় না। বাঁধাও পড়ে । তখন সব কিছুই যেন মাটি হয়ে যায়। কথা কইয়ের মেজাজ নষ্ট হয়ে যায় ফলে তার কথা কওয়াটার গুন ক্ষুন্ন হয়ে পড়ে। তাই প্রবাদে বলা হয় ” কথার গুনে বার্তা নষ্ট”। অবশ্য শুধু বাধাপ্রাপ্ত নয়, কথা কইয়ের নিজস্ব কথা কওয়ার গুনের ঘাটতির জন্যও কথার বার্তা নষ্ট হয়ে যায় বৈকি। সে যে আসলে কি বলতে চায় সেটাই তখন বোধগম্য হয় না। আর তখনই তো ” কথার খেই হারিয়ে যায় ” !
এবার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে কথার একটু বিস্তার ঘটিয়ে নিচ্ছি। ১৮৮৩ সাল ১৯ আগষ্ট দক্ষিনেশ্বরে ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকার এবং তরুণ নরেন্দ্র নাথ ( বিবেকানন্দ) নিজেদের মধ্যে কথোপকথন করছিলেন। এমন সময় শ্রী রামকৃষ্ণ সেখানে এসে হাজির হন এবং সহাস্যে বলেন, কি গো! তোমাদের কি সব কথা হচ্ছে?
নরেন্দ্রও সহাস্যে বলেন, কত কি কথা হচ্ছে –” লম্বা ” ” লম্বা ” কথা।
কথার রকমফের এখানে লক্ষণীয়। ” লম্বাকথা” — অর্থ কি? অনেকক্ষন
ধরে কথা? লম্বা লম্বা বাক্য? না, আসলে বড়ো বড়ো ভাবের কথা, ভারী কথা।
কথা ভারী ও পাতলা বা হালকা হয়। ” ছোট কথা” “বড়ো কথা ” ” ভালো কথা”, ” বাজে কথা”, ” সোজা কথা “, “প্যাঁচানো কথা”, ” কথার মারপ্যাঁচ ” কথার যে কত অলিগলি ও রকমফের তা বুঝে ওঠা দুষ্কর। তবুও কথা বুঝতেই হয়। কথাও কইতে হয়। দিলখোলা হাসির মতো দিল খোলা কথাও আছে। তবে দিল খুলে কথা কইলে এই একবিংশ শতকের তথাকথিত আধুনিক মানুষের কাছে তা কেবল উপহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় — কারণ তারা না পারে দিল খুলে কথা কইতে , না পারে কারুর কথা মন দিয়ে শুনতে। খোলা বাতাসের মতো কথা কইতে না পেরে পেরে ভিতরে ভিতরে হাঁপিয়ে উঠছে। কিছু করার নেই। কইতেও পারে না, আবার শুনতেও পারে না। বেচারা!!
এখানে একটা কথা বলতেই হবে – শহর-গ্রাম- মফস্বলের শ্রমজীবী মানুষ কিন্তু এখনো দিলখোলা কথা কইতে জানে এবং কয়েই চলেছে। আর ওদের মুখের কথা কওয়াকেই তো ধার করে শহুরে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী নামধারীরা সাহিত্য থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই জুড়ে দিচ্ছে। প্রশ্ন, জোড়াটা ঠিকঠাক হচ্ছে তো ?
সে যাই হোক, কথা কওয়া নিয়ে কিছু ‘কথার কথা ‘ বলে ফেললাম।
নিশ্চিত করছি এই বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা কইব না। “কথার ফুলঝুরি” উড়িয়ে আর কোনো ” কথার হুল ফুঁটাবো ” না। ” কথায় কথায় বেলাও বাড়িয়ে ” দেব না। ” কথার ফাঁদে পা দিয়ে” আর এগিয়ে যাবো না।