সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ৮)
by
TechTouchTalk Admin
·
Published
· Updated
বেনু মশলাঘর
লোকটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে মেহেরবানু। বিস্ময়ে পলক পড়ে না চোখে। লোকটার কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই অবশ্য।সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা লাঠিসদৃশ বস্তটার মাথায় মাথায় একটা পুতুল, পুতুলের মাথাভর্তি কাজল-কালো একরাশ চুল, তার মাথায় কী একটা চিরুনি মতো বস্তু দিয়ে হরেকরকম খোপা তৈরি করে চলেছে লোকটা। মুখে চলছে বিরামহীন। কিছু লোক মেহেরবানুর মতো বিস্মিত, অবাক দৃষ্টিতে দেখছে তাকে, কেউ কেউ এগিয়ে গিয়ে কিনছেও। বিশটাকা দাম। কিনবে নাকি? মেহেরবানু ভাবল খানিক। তার নিজের জটাজুট বাধা চুলে এই জিনিস কোনো কাজেই অাসবে না, তবু দেখে লোভ হল বড়। আহা। এই একটা ক্লিপে এত হরেকরকম খোঁপা করা যায়! তাদের সময়ে কই ছিল এসব মরার জিনিস! বেনি বলতে তারা বুঝত শুধু বাংলা অার খেজুরে বেনি, খোঁপা বলতে চিনত কেবল হাত খোঁপা আর নারকেলি খোঁপা! খেজুরে বেনির ছিল নানান হ্যাপা, সবাই পারত না করতে, এপাড়া ওপাড়া ঘুরতে হত, জনে জনে জিগ্যেস করে, যে পারত তাকে বহুত হাতেপায়ে ধরে তবে করতে হত সে বেনি, নারকেলি খোঁপা ছিল অারেক কাঠি বাড়া। নারকেলের মালা চুলের মাঝখানে দিয়ে নানান কায়দা কসরত করে তবে করা যেত, যে পারত তার থাকত হরেক বাহানা, নানান ওজর। তবু সেসব দিন এখনও চোখে ভাসে মেহেরবানুর। একমাথা কালো কুচকুচে চুল ছিল তার, পিঠ ছাড়িয়ে হাঁটু গড়িয়ে নামত, দুধে অালতা গায়ের রঙে সে চুলে তাকে লাগত অাসমান থেকে নেমে অাসা কোনো পরি। বক্কর আলী তার গায়ের রঙটা পেয়েছে, চোখ, নাক, মুখও। কিন্তু কণার গায়ের রঙটা চাপা, বেশ ময়লা। বেনুও ফর্সা, ধবধবেও বলা যায়, তবু কণা কেন অমনধারা শ্যামলা রঙা হল কে জানে! বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলে মেহেরবানু। কণা তার রক্ত, তার একমাত্র নাতনী, তাকে নিজের মত দেখতে না হওয়ায় মনটা ভারি খারাপ হয় মেহেরবানুর, মাঝে মাঝেই এ নিয়ে অাফসোস করে সে। কণার কথা মনে হতেই পায়ে পায়ে লোকটার দিকে এগিয়ে গেল সে। কোমরের গাঁট থেকে সাবধানে টাকা বের করে গুনল। খুঁজে বিশটাকার একটা নোট লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমাকও এটা দেও রে বাপু। লাতিনডার লেগিন নেব।
লোকটার অত কথার সময় নাই। টাকাটা হাতে নিয়ে পকেটে পুরে একটা ক্লিপ মেহেরবানুর দিকে বাড়িয়ে দিল সে, সাথে একটা নির্দেশিকা। সেখানে কোন খোঁপা কেমন করে করতে হবে তার তরিকা বিশদ করে লেখা। হাত বাড়িয়ে নিল মেহেরবানু। তার নিজের ক অক্ষর গোমাংস, তাতে কী! নাতনী তার হবু ডাক্তার, এ তল্লাটে তার নাতনীর মতো বিদ্বান ক টা অাছে অার! কাগজটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে একগাল হাসি মুখে ঝুলিয়ে জনান্তিকে উদ্দেশ করে সে বলতে থাকে, অামি লেহাপড়া না জানলি কী অবি, অামার লাতিন জানে, ছেড়ি ডাক্তারি পইড়তেচে দো, মেলা কষ্ট হইরতেচে, যে মুটা মুটা বই পড়ে অামার লাতিন, বাবা! দেহলিই বয় হরে দো! ততক্ষণে পুঁউউ শব্দে একটা ট্রেন এসে থামে অার চিরুনি বিক্রেতা লোকটা একলাফে উঠে পড়ে তাতে। সেদিকে তাকিয়ে অার কথা বাড়ায় না মেহেরবানু। স্টেশনের প্লাটফর্মের এককোণায়, নিজের নির্দিষ্ট জায়গাটাতে গিয়ে আরাম করে বসে খানিকক্ষণ, ভাবে। বেশ খিদে পেয়েছে তার। সেই সকালে একটুকরো পাউরুটি অার একটা কলা খেয়েছিল, ট্রেনের জন্য অপেক্ষমান এক যাত্রী দিয়েছিল দয়া করে। কিন্তু এখন ওসবে চলবে না। ভাতের খিদে পেয়েছে এখন। ব্যাগ হাতড়ে দেখল মেহেরবানু। চাল অাছে খানিকটা। সকালে সবজিওলার কাছ থেকে নিয়ে রাখা ছোট একটা বাঁধাকপি অার খানিকটা ধনিয়া পাতাও অাছে। অতঃপর মাটির ছোট্ট চুলাটা জ্বালাল মেহেরবানু। ভাত রান্না করল, বাঁধাকপি কুচি করে কেটে ভাজতে বসল। কাঁচামরিচ দিল গোটাকয়, ধনিয়াপাতা কুচিও দিল কিছুটা। গন্ধটা নাকে হামলে পড়ল এসে। স্মৃতিও। শিশুকালটা এক ঝটকায় মনের ভেতর হুমড়ি খেয়ে পড়ল এসে। মমকে মনে পড়ল। অাহা। মম। অকালে মরল সে। মেহেরবানুর বড় কাছের ছিল। খেলার সাথী। মা চুলায় বাঁধাকপি ভাজছে, ভাজতে ভাজতে প্রায় অাচার। নামানোর খানিক অাগে ধনিয়া পাতা কুচি ছেড়ে দিল, দারুণ গন্ধে সারা বাড়ি ম ম। চুলার পাশে মম। তার প্লেটে ধোঁয়া ওঠা ভাত আর জিভে জল অানা সেই বাঁধাকপি ভাজি, মম খাচ্ছে, গরম ভাত মুখে দিয়ে মুখটা সরু করে গরম সরাচ্ছে, স্পষ্ট দেখতে পেল মেহেরবানু। মম’র সাথে কথাও বলল দু চারটে। মৃত্যুর পর, ওখানে কি বাঁধাকপি ভাজি পাওয়া যায়? প্রশ্নটা মমকে করল মেহেরবানু। মম উত্তর দিল না অবশ্য। সে তখনও মুখে পোরা গরমভাতের গরম তাড়াতে ব্যস্ত। বিরক্ত মেহেরবানু নিজের মনে বকল অগত্যা খানিকক্ষণ। মৃত্যুর পরের ওখানটাতে, ঐ জীবনটাতে সত্যিই যদি বাঁধাকপি ভাজি খাওয়ার সুযোগ না থাকে, তাহলে শুধু শুধু মারা যাওয়ার কোনো মানে হয় না, ওখানে তার পোষাবে না কোনো মতেই। মাথা নেড়ে নিজের মনেই ঘোষণা করল সে। ততক্ষণে মম কেটে পড়েছে। বাঁধাকপি ভাজির ম ম গন্ধসমেত মেহেরবানু মা-ও। মেহেরবানুর নিজের রান্না ততক্ষণে শেষ। চুলায় জল ঢেলে অাগুন নেভাল সে, সব গুছিয়ে রেখে অায়েশ করে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেল ভরপেট। তারপর শুয়ে পড়ল প্লাটফর্মে তার নিজের নির্দিষ্ট জায়গাটাতে। তেল চিটচিটে কাঁথাটা জড়িয়ে নিল গায়ে। বেশ ঠান্ডা পড়ছে অাজকাল। কেমন শীত শীত লাগে রাত নামলে। কাঁথাটা ভালোমতন গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল মেহেরবানু। চোখ বুঁজল। ভাবনারা ঝাঁপিয়ে পড়ল এসে। সেই যে ও বাড়ি থেকে পালিয়েছে মেহেরবানু, অার ও তল্লাট মাড়ায়নি সে। ভয়ে ভয়ে এড়িয়ে গেছে ওদিকটা। যা ধকল গেছে কদিন তার বুড়ো হাড়ে, বাপরে! এই বয়সে তিনবেলা দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, নরম বিছানা বালিশ, পরিষ্কার কাপড়-চোপড়, না চাইতেই হাতের কাছে নিত্যকার সব জিনিস হাজির, কাঁহাতক সহ্য হয় আর! না বাপু, ওসব চাই না মেহেরবানুর,একদম না। বরং এইখানে, এই খোলা অাকাশের নিচে তেল চিটচিটে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঠ্যাং দোলানো, মাঝে মাঝে ট্রেনের পুঁউউউ শব্দ, পিঠের নিচের মাটির অদ্ভুত ছন্দময় দুলুনি, লোকজনের চিৎকার, চেঁচামেচি, অশ্রাব্য বকুনি, এসবই ভালো তার। এসব থাকলে মনে হয় বেঁচে আছে সে, বেশ অাছে। না থাকলে মনে হয়, নেই, ধরাধামে অার নেই মেহেরবানু। অগত্যা পালিয়ে বেঁচেছে সে। কণার কবল থেকে এ বারের মত ছাড়া পেয়ে এই খোলা জীবনটার প্রতি তার প্রেম বেড়ে গেছে ঢেরগুণ। না জানি কণা কতটা রেগে অাছে তার ওপর। তার বাপ বক্কর অালী অার মা বেনুর ওপর না জানি কত চোটপাট করেছে সে মেহেরবানুর পালিয়ে অাসায়। করুকগে। যা খুশি করুকগে তারা। প্রায় দম বন্ধ হয়ে মরতেই বসেছিল মেহেরবানু। অার ক দিন ওখানে অমন বন্দী থাকলে দম বন্ধ হয়ে নির্ঘাত মারা পড়ত মেহেরবানু। অত ফুটানি পোষায় না তার, এই বরং ভালো, এই একবেলা খাওয়া, বাকি দু বেলা নাই, এতেই বেশ থাকে সে, বেশ অাছে। কিন্তু মুশকিল হল, তার বজ্জাত মত বক্কর অালীকে না দেখলে বড় হুজ্জত করে তার সাথে, তাকে টেনেটুনে ওদিকে নিয়ে যেতে চায় শুধুই, অার কণাকে না দেখলেও কেমন হা পিত্যেশ করতে থাকে সে, যে মেহেরবানু তখন বাধ্য হয় ওদিকে যেতে, বক্কর অালীর অার একমাত্র নাতনীর চাঁদবদন দেখতে অতঃপর সে হাজির হয় ও পাড়ায়। কিন্তু এবার ওদিকে গেলে কপালে বহুত খারাবি অাছে তার। কণা পইপই করে বলে গেছিল, ও বাড়ি থেকে যেন ভুলেও বের না হয় মেহেরবানু, ভুলেও যেন ও বাড়ি ছেড়ে একপা দূরে না যায় সে। অথচ মেহেরবানু পালিয়ে এসেছে ও বাড়ি ছেড়ে। যা রাগি নাতনীটা তার। কণাকে দেখে ও বাড়ির সবাই ডরায়। অথচ সে কিনা পালিয়ে এসেছে তার কথা না রেখে! না বাপু, সহজে অার ও তল্লাট মাড়াচ্ছে না মেহেরবানু! কিন্তু খোঁপা করার ক্লিপটা! ওটা তো কণার জন্যই কিনেছে মেহেরবানু, কণারও যে তার মতোই একমাথা চুল, হাঁটু ছুঁইছঁই প্রায়! ক্লিপটা কী করে দেবে সে! কণার কাছে কীভাবে পৌঁছবে সেটা! ভেবে সারা হয় মেহেরবানু। কিছুতেই ঘুম আসে না তার।
ক্রমশ…