সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ৬)

বেনু মশলাঘর

ডাক্তা‌রের অ‌পেক্ষায় ব‌সে থাক‌তে থাক‌তে বির‌ক্তির শেষ সীমায় পৌঁ‌ছে গেল বেনু। শরী‌রের প্রায় অসাড় ডানপাশ নি‌য়ে এই ব‌সে থাকা নরকযন্ত্রণা ম‌নে হয় তার। মা‌ঝে মা‌ঝে ই‌চ্ছে ক‌রে নি‌জের এই প্রায় অ‌কে‌জো শরীরটা‌কে করাত দি‌য়ে চি‌রে দু ভাগ ক‌রে ফে‌লে ডানপাশটা‌ শেয়াল কুত্তা দি‌য়ে খাওয়া‌য়। বা‌লের জীবন! জীব‌নের গু‌ষ্ঠি কিলায় বেনু। ই‌চ্ছেম‌তো নড়াচড়া, ই‌চ্ছেম‌তো চলা‌ফেরার সুখটুকু পর্যন্ত নাই যে জীব‌নে, সে জীবন দি‌য়ে কোন বাল ছিঁড়ব অা‌মি, ও ‌হে খোদাতালা অামার? -কপাল চাপ‌ড়ে কথাগু‌লো প্রায়ই ব‌লে বেনু, অাকা‌শের দি‌কে তা‌কি‌য়ে। য‌দিও কো‌নো‌দিনই তার ‘খোদাতালা’‌কে এ‌হেন প্রশ্নে বিচ‌লিত হ‌য়ে কো‌নো জবাব দি‌তে দেখা যায়‌নি অাজ অব‌দি। ত‌বে বেনুর এ খে‌দো‌ক্তি‌তে কম্পাউন্ডার কাম এ‌সি‌স্ট‌্যান্ট ছে‌লেটা‌কে খা‌নিকটা চঞ্চল হ‌য়ে উঠ‌তে দেখা গেল। সাম‌নে রাখা রংচটা ল‌্যান্ড‌ফো‌নের নাম্বার টি‌পে কা‌নের কা‌ছে ধ‌রে কিছুক্ষণ অ‌পেক্ষা করল সে, রি‌সিভ হ‌তেই নিচুস্ব‌রে কথা বলল কারও সা‌থে, দূর থে‌কে কথাগু‌লো স্পষ্ট শুন‌তে পে‌ল না বেনু। কথা শেষ ক‌রে বেনুর দি‌কে তা‌কি‌য়ে হাসল ছে‌লেটা। মু‌খে সান্ত্বনার ভ‌ঙ্গি ফু‌টি‌য়ে বলল, স‌্যার বের হই‌ছে অাপা, প‌থে। অাই‌সে যা‌বে‌নে এক্ষু‌নি। অা‌র ইকটু ধৈর্য রা‌খেন।
অগত‌্যা ন‌ড়ে চ‌ড়ে বসল অা‌রেকটু বেনু। চেম্বা‌রের বাই‌রে রো‌গির গাদাগা‌দি ভীড়। একবার চেয়ার ছাড়‌লে সহ‌জে অার বসার জায়গা মিল‌বে না। ও‌দি‌কে জোর বাথরুম পে‌য়ে‌ছে তার। হা‌জী বক্কর অালী‌কে ট্যেরা চো‌খে দেখল একবার বেনু। একম‌নে টি‌ভি‌তে টক শো দেখ‌ছে সে। এত ভীড়, চিৎকার, গরম, দমবন্ধ প‌রি‌বেশ, কো‌নো‌দি‌কে হুঁশ নাই লোকটার। দে‌খে হঠাৎ হিং‌সে হল বেনুর। মানুষ এত নি‌র্লিপ্ত কী ক‌রে হয় নি‌জের পা‌রিপা‌র্শ্বিকতা সম্প‌র্কে! মৃদু ধাক্কা দিল বেনু, ডাকল। চম‌কে তাকাল হাজী সা‌হেব, চো‌খে প্রশ্ন।
বাথরু‌মে যাব। -‌ঘোষণা দিল বেনু। মুখ‌-চোখ লাল, গর‌মে, ঘা‌মে, অ‌তিষ্ঠ সে, শরীরটাও ধকল নি‌তে অস্বীকার কর‌ছে, বি‌দ্রোহ কর‌ছে অাজ।
তো যাও, সমস‌্যা কী? -সরল প্রশ্ন হাজীর।
বাল গজায় নাই? সমস‌্যা কী বো‌ঝো না? সিট ছাই‌ড়ে উঠ‌লি সিট পাব অার? সিট দখ‌লে রাখ, অা‌মি যা‌চ্চি। -ব‌লে অসার শরীরটা‌কে প্রায় টে‌নে-হিঁচ‌ড়ে নি‌য়ে টয়‌লেটের দি‌কে এ‌গোল বেনু। পৌঁছে মেজাজ খিঁচ‌ড়ে গেল অা‌রও। এখা‌নেও ভীড়। চারজ‌নের পর সি‌রিয়াল মিলল তার। টয়‌লেট থে‌কে বে‌রি‌য়ে সোজা কম্পাউন্ডার কাম এ‌সিস্ট‌্যান্ট ছে‌লেটার কা‌ছে গেল সে, পার্স হাত‌ড়ে পঞ্চাশ টাকার কড়ক‌ড়ে একটা নোট তার হা‌তের ভেতর গুঁ‌জে দি‌য়ে বলল, অামা‌রে একটু তাড়াতা‌ড়ি ঢুক‌তে দে বাপ, শইলডা খারাপ লাগ‌তে‌চে। অামার মিয়া কণাও ডাক্তা‌রি পড়‌তে‌চে, থাড ইয়ার চল‌তে‌চে উ‌য়ে‌ার।
নোটটা চো‌খের পল‌কে প‌্যা‌ন্টের প‌কে‌টে চালান ক‌রে দি‌য়ে ছে‌লেটা অাকর্ণ হাসল অাবার। মা‌ছি তাড়া‌নোর ভ‌ঙ্গি ক‌রে বলল, যান তো অা‌ন্টি, যান। স‌্যার অাস‌লি প‌রে অামি অাপ‌নেক সগ‌লের অা‌গে ডাক‌পো‌নে। কণাক অা‌মি চি‌নি, ‌মিয়াডা খুপই ভা‌লো।
সি‌টে এ‌সে বস‌তে না বস‌তেই চেম্বা‌রে ঢুকল ডাক্তার। রো‌গি‌দের ভেতর চাপা একটা স্বস্তি ছ‌ড়ি‌য়ে পড়ল এতক্ষ‌ণে। কম্পাউন্ডার বেনুর নাম ধ‌রে ডাকল, ফাইলপত্র গু‌ছি‌য়ে রে‌খে চেম্বা‌রের সাম‌নের চেয়া‌রে বস‌তে বলল ইশারায়। বসল বেনু। মফস্বল শহ‌রে অাজকাল ঢাকা থে‌কে এ‌কেক বিষ‌য়ের বি‌শেষজ্ঞ ডাক্তা‌রেরা এ‌কেক‌দিন অা‌সে, পালা ক‌রে। সে কার‌ণে ভীড়টাও বে‌শি। বেনু‌কে সবার অা‌গে ডাকায় ঈর্ষার চো‌খে তার দি‌কে তাকাল অ‌নে‌কে, কেউ কেউ অাপ‌ত্তিও তুলল, প‌রে এ‌সে অা‌গে কী ক‌রে সি‌রিয়াল পায়, তারা অা‌গে এ‌সে কেন অা‌গে সি‌রিয়াল পা‌চ্ছে না, প্রশ্ন তুলল স‌রো‌ষে। তা‌দের কথায় জল ঢে‌লে দি‌য়ে কম্পাউন্ডার কাম এ‌সিস্ট‌্যান্ট ছে‌লেটা বলল, থা‌মেন থা‌মেন। খা‌লি খা‌লি ঝা‌মেলা পাকান ক‌্যা? উনি গতকালই সি‌রিয়াল ‌দি‌য়ে রাখছে অামার কা‌ছে, এক নাম্বার সি‌রিয়াল উনার।
-ব‌লে, বেনুর দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল, যান অা‌ন্টি, ভিত‌রে যান অাপ‌নে, স‌্যা‌রে ডাকতে‌ছে।
ততক্ষ‌ণে টে‌বি‌লের কো‌ণার বেলটা বে‌জে উ‌ঠে‌ছে তারস্ব‌রে।
রু‌টিন চেকঅাপ বেনুর। ডাক্তার বরাবরই দে‌খে মন দি‌য়ে, খুঁ‌টিনা‌টি প্রশ্ন ক‌রে, বুঝ‌তে চেষ্টা ক‌রে বেনুর শরী‌রের উন্ন‌তি বা অবন‌তি, সে মা‌ফিক ওষুধ দেয়, পরামর্শও। বেনুর মে‌য়ে হবু ডাক্তার, কথাটা জে‌নে খা‌নিকটা বাড়‌তি গুরুত্বও দেয় তা‌কে, বেনু তাই প্রতিবারই স্মরণ ক‌রি‌য়ে দেয় কথাটা ডাক্তার‌কে, কম্পাউন্ডারটা‌কেও। বেনুর মে‌য়েও ডাক্তার হ‌বে বছর দু‌য়েক বা‌দে, কথাটা পৃ‌থিবীময় ঢ‌্যারা পি‌টি‌য়ে বল‌তে পার‌লে ত‌বে খা‌নিকটা শান্তি পেত সে। সেটা অাপাতত সম্ভব না হওয়ায়, হা‌তের নাগা‌লে পাওয়া মানুষগু‌লো‌কেই সু‌যোগ পে‌লে যতটা সম্ভব জানায় সে।
অাপ‌নি ক‌ি কো‌নো কার‌ণে বে‌শি চিন্তা কর‌ছেন অাজকাল? এবার তো অাপনার রেসপন্স তুলনামূলকভা‌বে খারাপ। এমন হ‌লে তো সুস্থ হ‌তে বে‌শি সময় লাগ‌বে অাপনার। ব‌্যায়ামগু‌লো ঠিকম‌তো কর‌ছেন না? অার ওষুধগু‌লো? খা‌চ্ছেন?
অ‌ভি‌যোগ অার শাসন মি‌শি‌য়ে কথাগু‌লো বলল ডাক্তার। বেনু থমকাল। ব‌্যায়ামগু‌লো ঠিকম‌তো করা হয় না স‌ত্যি, বি‌শেষ ক‌রে বা‌ড়ি‌তে কণা না থাক‌লে করাই হয় না প্রায়। কিন্তু ওষুধ সে খায় নিয়মম‌তোই। অার চিন্তা! তার কি অার কো‌নো মা-বাপ অা‌ছে! করব না বল‌লেই কি না ক‌রে থাকা যায়! কো‌ত্থে‌কে যে বেহায়া চিন্তাগু‌লো বেহুদা এ‌সে জায়গা দখল ক‌রে নেয় বেনুর! যতই সে ঝেঁ‌টি‌য়ে বিদায় কর‌তে চায়, চিন্তাগু‌লো ততই এ‌সে অাছ‌ড়ে প‌ড়ে ম‌নের উ‌ঠো‌নে। অার এত যে বয়স হল, শরীর প্রায় কব‌রে সেঁ‌ধো‌বে ব‌লে বায়না জু‌ড়ে দি‌য়ে‌ছে সেই ক‌বে থে‌কে, তবু হারামজাদা টোটন অার তার চিন্তাগু‌লো এক‌তিল জায়গা ছাড়‌ছে না মন থে‌কে। এর সা‌থে অারও অারও চিন্তাগু‌লো তা‌কে গি‌লে ফেল‌ছে ক্রমশ।
চেম্বার থে‌কে ব‌্যাজার মু‌খে বেরি‌য়ে হাজী বক্কর অালীর পেছন পেছন রিক্সায় উঠল বেনু। বাতা‌সে শী‌তের অা‌মেজ। কেমন একটু শীত-শীত লাগল। সন্ধ‌্যার অাবছা অন্ধকা‌রে কুয়াশা যেন পেখম মে‌ল‌তে শুরু ক‌রে‌ছে চু‌পিসা‌রে। ওড়নাটা গা‌য়ে জ‌ড়ি‌য়ে নিল বেনু ভা‌লো ক‌রে। ব‌্যা‌গের ভেতর ফোনটা বে‌জে উঠল তখনই। বের ক‌রেই দেখেই ত্রস্তে রি‌সিভ করল সে, অা‌গেও বে‌জে‌ছে অ‌নেকবার, মিসড কল উ‌ঠে অা‌ছে, ডাক্তা‌রের চেম্বা‌রে থাকায় খেয়াল ক‌রে‌নি একদম।
কোথায় থা‌কো? ফোনটাও ধর‌তে পা‌রো না? অামার কত টেনশন হয় বো‌ঝো?
একঝু‌ড়ি প্রশ্ন ভে‌সে এল ওপাশ থে‌কে ফোনটা রি‌সিভ করার সা‌থে সা‌থেই। বিরক্ত হল বেনু। সকাল থে‌কে এম‌নি‌তেই মেজাজটা খারাপ ছিল তার, সা‌থে পাল্লা দি‌য়ে খারাপ ছিল শরীর, কণার ফো‌নে তার সা‌থে এবার যোগ হল বির‌ক্তি। তি‌নের কক‌টে‌লে ক্লান্ত‌বোধ করল বেনু। ফোনটা হাজী বক্কর অালীর দি‌কে বা‌ড়ি‌য়ে দি‌তে দি‌তে ক্লান্ত, ক্ষুব্ধস্ব‌রে বলল, ‌নে, তোর অাব্ব‌ার সা‌থে কথা ক।
বা‌পের সা‌থে কী কথা বলল কণা, সেস‌বে তেমন কান দিল না বেনু। শরীরটা ভীষণই খারাপ লাগ‌ছে তার, ব‌মি ব‌মি পা‌চ্ছে। ই‌চ্ছে কর‌ছে এখা‌নেই নে‌মে হড়হড় ক‌রে ব‌মি ক‌রে সে, তারপর শু‌য়ে প‌ড়ে রাস্তার পা‌শের খোলা জায়গাটা‌তে। কেউ বো‌ঝে না তা‌কে। কেউ না। নি‌জের বাপ-মা বো‌ঝে‌নি তা‌কে, গ‌ছি‌য়ে দি‌য়ে গে‌ছে হাজী বক্কর অালীর ম‌তো এক অপদার্থ লো‌কের হা‌তে, যে এক‌চুল বো‌ঝে না তা‌কে, যার জন‌্য চিতা জ্বলল অাজীবন বু‌কের ভেতর সেই টোটন হারামজাদা বো‌ঝেনি তা‌কে, ফূ‌র্তি কর‌ছে কোন এক কৃষ্ণাঙ্গ মাগী নি‌য়ে, এমন‌কি নি‌জের যে না‌ড়ি ছেঁড়া মে‌য়ে কণা, সে পর্যন্ত বো‌ঝে না তা‌কে। তাহ‌লে এই বা‌লের জীবন দি‌য়ে কী কর‌বে সে! কেনই বা সে এত ক‌ষ্টে ব‌য়ে বেড়া‌বে এই প্রায় অসাড়, পঙ্গু শরীর! বরং মৃত‌্যুই ভা‌লো। সব না বোঝাবু‌ঝির অবসান, সব অসুস্থতার সমাধান।
বা‌ড়ি ফি‌রে সোজা বাথরুমে ঢুকল বেনু। ব‌মি করল হড়হ‌ড়ি‌য়ে। রা‌তের পা‌নি‌তে বেশ শীত নে‌মে গে‌ছে। গোসল করল তবু সময় নি‌য়ে। লাইট অফ ক‌রে শু‌য়ে থাকল অ‌নেকক্ষণ। মাথা ভারী। জ্বর অাস‌ছে সম্ভবত। কিছু খে‌য়ে ওষুধ খে‌তে হ‌বে। জোর ক‌রে উঠল বিছানা থে‌কে। কা‌জের মে‌য়েটা অা‌সে‌নি অাজ। রান্নাঘ‌রে গি‌য়ে নি‌জেই খাবার অানল টে‌বি‌লে। হাজী সা‌হেব নামা‌জে ব‌সে‌ছে, তা‌কে ডাকল না বেনু, ব‌সল টে‌বি‌লে। খা‌বে, হঠাৎ ম‌নে হল, সকাল থে‌কে মে‌হেরবানুর সাড়াশব্দ অা‌সে‌নি অাজ। প্রতি‌দিন টে‌বি‌লে খাবার ঢে‌কে রে‌খে মশলাঘ‌রে চ‌লে যায় বেনু, মে‌হেরবানু খে‌য়ে নেয় একফাঁ‌কে, অাজ তার খাবারটাও তেমনই ঢাকা প‌ড়ে অা‌ছে টে‌বি‌লে। অগত‌্যা খাওয়া বাদ দি‌য়ে কণার ঘ‌রের দি‌কে এ‌গোল বেনু। চিন্তার ভাঁজ পড়ল কপা‌লে।
শরীর খারাপ হল না‌কি বু‌ড়ির? -‌বিড়‌বিড় করল অাপন ম‌নে। কণার ঘ‌রে লাইট জ্বল‌তেই চমকাল বেনু। নেই। পা‌খি উ‌ড়ে গে‌ছে। অালনায় মে‌হেরবানুর ‌কো‌নো কাপড় নেই, হা‌পিস হ‌য়ে গে‌ছে সব। পা‌লি‌য়ে‌ছে মে‌হেরবানু। প্রমাদ গুণল বেনু। কণা যে কী বল‌বে তা‌কে অাল্লাহ জা‌নে!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।