কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে এস মিঞা ওমরান (পর্ব – ১)

মাছ

রায়বাহাদুর পুর।
তখনকার সময় একজন হিন্দু জমিদার ছিল এখানে। তিনিই গ্রামটি গড়ে তুলেন।তাই তার নামানুসারে গ্রামের নাম রাখা হয়।গ্রামটি ছিল এক সময় হিন্দু অধ্যসিত।
এখনো তার স্মৃতি বুকে ধরে আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি মন্দির। বন্য লতাপাতায় ঘিরে আছে তার চার দেয়াল। চৈত্র মাসের সূর্যের প্রচন্ড তাপে যেমন জমিন ফেটে যায়, ঠিক তেমনি ফেটে আছে তার চার দেয়াল। কিন্তু পরবর্তীতে তার উল্টো চিত্র। গ্রামটি হয়ে যায় মুসলিম অধ্যসিত।বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে তারা ভারতে পাড়ি জমায়। যখন হিন্দু-মুসলিম ডাঙ্গা লাগে তখন কিছু এলিট হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়।
তারপর বেশি চলে যায় যখন পাকিস্তান ভারত ভাগ হয় । থেকে যায় হাতে গোনা কয়েকটি হিন্দু পরিবার। তাও আবার আজ কাল খুব আতংকের মধ্যে দিয়ে দিন পার করে। কখন যে কি হয়।দেশের মধ্যে চলছে চাপা ক্ষোভ। বাঙালীরা তারা তাদের ন্যায্য অধিকার চায়। এ চাপা ক্ষোভ যখন ফুশে উঠবে আর বহন করার শক্তি থাকবে না।তখন তা পরিণত হয় বিপ্লবে। বিপ্লব থেকে শুরু হয় স্বাধীকার আন্দোলনের যুদ্ধ।
অবশেষে তাই হলো। বাঙালীরা যখন দেখল মিছিল মিটিং করে কোন সুফল পাচ্ছে না।তখনই ডাক দেয় যুদ্ধে। আসে চূড়ান্ত ঘোষণা। তখন একজন মুসলিম কৃষক বলে, মনে করছিলাম পাকিস্তান হয়ে থাকব।তাঁরাও মুসলমান আমরাও মুসলমান। মুসলমান আর মুসলমান ভাই, ভাই।
কিন্তু তা আর হলনা।তাদের আচরণ দেখে মনে হয় বাঙালীরা কোন মানুষ না।সব হায়ান-জানোয়ার।আমরা জমিতে শস্য উৎপাদন করি আর তারা এসে নিয়ে যাবে।
সমুদ্রের গাঙচিলের মতো থাবা দিয়ে। তা আর হবে না।
হয়তো অধিকার ফিরে পাব।আর না হয় মরব।
বুঝছ কেশব বাবু, বলে তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে।
তোমরা ত চাষাবাদ কর না। তাই তোমরা বুঝবে না।এটার মায়া যে কেমন। সারা বছর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলাই।তারপর সে ফসলের ন্যায্য হিস্যা পাবো না।
তাই কি হয়।
যুদ্ধে কথা শোনে কেশব বাবু ভয়সন্তপ্ত হয়ে যায়। আতংকে তার চেহারা লাল হয়ে যায়। এমনিতে তার গায়ের রং লালচে বর্নের ।
তারপর ভয়ে ভয়ে বলে।
যুদ্ধ।
যুদ্ধ মানে লাশ,অত্যাচার,নিপীড়ন। কথাগুলো বলতে গিয়ে তার সমস্ত মুখমণ্ডল কেমন যেন ফেকাসে হয়ে যায়। এমন সময় একজন দৌড়ে এসে বলে। কেশব বাবু তুমি এখনো কথা বল।এদিকে বাজারে পাঞ্জাবিরা এসেছে। কয়েকটি দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়।
প্রথমে আগুন দেয় বশর মাষ্টারের মুদি দোকানে। কে বা কারা তাদেরকে বলেছে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধেদেরকে খাদ্য জোগান দেয়। আর মাষ্টার সাবকে ধরে নিয়ে গেছে। কারা বলছে তাও সে জানে।তবু সে ভয়ে তাদের নাম নেয় না।যখন সে বাজারের দিকে যায় তখন সে তাদেরকে এখানে কথা বলতে দেখে যায়। শোনা মাত্র সে ভয়ে আঁতকে উঠল। কথা শেষ না দিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ে। আর দ্রুত পায়ে পথ চলে। বাড়িতে ফিরে গিয়ে সবাইকে দ্রুত তাড়া দেয়। ছেলে বুড়ো সবাই এক সাথে বলে উঠে।
ও…ভগবান, তুমি রক্ষা কর।তার স্ত্রী মেয়েকে আরো বেশি তাড়া করে। বাড়ির সবাইকে নিয়ে একটা বাগানের মধ্যে গিয়ে লুকায়।ঝোপঝাড়ে ভরা। এক সময় সাপ-বিচ্ছুর ভয়ে কেউ সেখানে যেত না।এখন সেটা অনেকের আশ্রয়স্থল হয়েছে। রাত বিরাত সেখানে লুকিয়ে থাকে পাক হানাদারদের ভয়ে। মাঝে মাঝে পাকিস্তানি মেলিটারিরা জিপ গাড়ি নিয়ে টহল দিয়ে যায়। সাথে তাদের এখানকার দোসররাও থাকে। রাজাকার নুরা হল তাদের প্রধান। সে হানাদার বাহিনীকে সব চিনিয়ে দেয়।
এটা হলো হিন্দু বাড়ি।
এটা মুক্তিযুদ্ধের বাড়ি। এটা বলতে গিয়ে মুখকে একটু বিকৃতি করে বলে।
উনারা মুক্তিযুদ্ধা। দেশকে ভাগ করতে চায়।
স্বাধীনতা আনবে।
চাটুকারিতা করে হানাদারদের কে খুশি করার জন্য রাজাকার নুরা বিড়বিড় করে বলে। কত বড় মুনাফিকের দল। যাদের খেয়ে পরে শরীরে রক্ত -মাংস বানিয়েছে। আবার তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
অস্ত্র ধরে।
কত বড় দেশকে টুকরো করতে চায় বিধর্মীদের কথা ধরে। একটু মুখখানি পিছন দিকে ফিরে শব্দ করে সাগরেদদেরকে নির্দেশ করে।
শুয়োরের বাচ্চাদের কে ছাড়বে না।যেখানে দেখতে পাও সাথে সাথে গুলি করবে। ওরা বেঈমান। এটা পাকিস্তান। পাকিস্তানিই থাকবে।
তারপর নুরা রাজাকার শাল টিং ধরে।
পাকিস্তান…
জিন্দাবাদ। পিছন হইতে তার সাগরেদরা সবাই সমস্বরে আওয়াজ দিয়ে উঠে। এভাবে কয়েক বার বলার পর। মিলিটারি অফিসার হাত তুলে তাদেরকে ধন্যবাদ জানায়।
এখানে হানাদারদের চেয়ে মানুষকে বেশি নির্যাতন করে তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী। বিশেষ করে যে সব পরিবারে সুন্দরী মেয়ে মানুষ ছিল।
হোক সে মেয়ে কিংবা মহিলা।
হিন্দু কি মুসলিম। সবাই একটা আতঙ্কে মধ্যে থাকতো।
কি কেশব বাবু…
কি অবস্থা? একদিন পথিমধ্যে তার সাথে দেখা হয় নুরা রাজাকারের।
দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র কর নাতো? নুরা রাজাকার জিজ্ঞেস করে। যদি সুস্থ সুন্দরভাবে বসবাস করতে চাও তাহলে দেশ বিরোধী কোন কাজে লিপ্ত হয়ো না।তাকে হুমকি দিয়ে কথাটা বলে। আবার পরক্ষণে বলে।
ও…আমি ত ভুলে গেছি। ভারত ত আবার তোমাদের মা-বাবা। তারা যা বলবে তোমরা তাই শুনবে। তোমাদেরকে বলে কোন লাভ নেই।আর দাঁতে দাঁতে কটকট করে বলে, তার সাথে আবার কিছু মুসলমান ছেলেপেলে দল বেঁধেছে। তারপর দম্ভ করে বলে।
কিছু হবে না। এটা পাকিস্তান। পাকিস্তানই থাকবে।
যুদ্ধ টা শেষ হোক। ত সব শালাকে দেশদ্রোহী মামলায় ফাঁসিতে টাঙ্গাব।আঙ্গুলকে উপর দিকে তুলে কেশব বাবুকে দেখায়।ফাঁসির নমুনা। সে ছুপ করে রয়।কোন কথা বলে না।শুধু শুনে যায়। বললে যদি আবার মারধর করে। এ ভয়ে। যাক।
অনেক কথা ত হল।নুরা রাজাকার বলে।
এবার আসল কথায় আসি।
মাশাল্লাহ..। মেয়েত একখান জন্ম দিলে।
নাম রাখছ ছবি। দেখতেও একেবারে হুর-পরীর ন্যায়।দৃষ্টি লেগে থাকে। চোখ সরে না।মনে হয় যেন একটা জ্বলজ্বল আগুনের কয়লা। প্রতিবারত পূজোতে ভগবানের চরনে পাঁঠা বলি দাও।তাকে ভোগ দিয়ে আসো।লাভত হয় না।
এবার আমার চরনে ছবিকে বলিদান কর।তাকে ভোগ দিয়ে এসো।তাহলে তোমাদেরকে আর কেউ কোন ক্ষতি করবে না।
তখন কেশব বাবু ভয়ে ভয়ে বলে। বাবা, ছবি ত কোলকাতায় চলে গেছে। বলতে গিয়ে তার গলার মাঝখানে যেন আঁটকে যাচ্ছেছিল কথাগুলো ।কে যেন তার গলা চিপটে ধরে।
কেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বাড়িতে দেখলাম। আবার কখন গেলো।
দেশের গন্ডগোল দেখে তার মামা এসে তাকে নিয়ে যায়।
সঙ্গে সঙ্গে নুরা রাজাকার জবাব দেয়।
তার মা ত আছে।
কেশব বাবু একেবারে কোনঠাসা হয়ে যায়। কিভাবে এখান থেকে কেটে পড়বে আঁকুপাঁকু করতে ছিল। হঠাৎ পিছন হইতে তার সাগরেদ একজন বলে উঠে।
বস।
এদের পুকুরে অনেক বড় বড় মাছ আছে।
তাই নাকি। খুব উৎসাহ নিয়ে বলে নুরা রাজাকার ।
তাহলে ত একদিন ধরতে হয়।
বাড়িতে ফিরে গিয়ে কেশব বাবু তার স্ত্রী গীতা দেবীর কাছে সব খুলে বলে। সব শোনার পর তার স্ত্রী খুব ভয় পেয়ে যায়। তখন সে প্রস্তাব দেয়।আমরা এখান থেকে চলে যায়।
কোথায় যাবে?কেশব বাবু জিজ্ঞেস করে।
কলকাতায়।
কেশব বাবু একটু বিব্রতবোধ করল।এটা আমার বাপ- দাদার ভিটা। এ মাটির নিচে তাদের স্বর্গ নিবাস হয়েছে। বল।কিভাবে ছেড়ে যাই।তারপর কেশব বাবু মনে মনে কি যানি কিছুক্ষণ সাতপাঁচ ভাবলো। তারপরে বলে, তোমরা যাও।তোমাদেরকে আমি আগিয়ে দিয়ে আসবো।
তুমি যাবে না?তার স্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করে।
না।আমি এখানে থাকব।
তাহলে আমরাও যাব না।তার স্ত্রী- মেয়ে বেঁকে বসে। তখন তাদেরকে সে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু তারা কিছুতে রাজি হয় না। কিছুক্ষণের জন্য একেবারে শান্ত পরিবেশ নেমে আসে। কারো মুখে কোন কথা নেই। যে যার মতো। কেশব বাবু বসে আছে দোরগোড়ায়। তার স্ত্রী ঘরদোর পরিস্কার করছে। আর ছবি কোনদিকে চলে গেছে। হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কেশব বাবু। তারপর তার স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলে। মাটির মমতা যে কি, দূরে না গেলে তা টের করা যায় না।আমি একবার চলে গেছিলাম। সেখানে স্হায়ী বসবাস করব বলে। কিন্তু পারি নাই। আবার ফিরে আসছি এ দেশে।
তখনি দোরগোড়ায় হতে এক লাফে নেমে খামছি মেরে এক মুঠ মাটি নিয়ে তার দিকে চেয়ে চেয়ে বলতে থাকে।
এ মাটি তুই কি?তোর প্রতি এত মায়া কেন।
কেন তোকে ছাড়তে পারি না।

চলবে….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।