প্রতিদিন ত টাকা হারাও।
কি লাভ হয়।
একদিকে ঘুমহীন। অন্যদিকে টাকা হারাচ্ছ । যা কামাই কর সবে ত জুয়া খেলে হারাচ্ছ। খবর নিয়েছ, বউ-বাচ্চা কেমন আছে বাড়িতে।
বাড়ির কথা বলার সাথে সাথে হাফিজ ঝিম ধরে যায়। কি জানি বলতে গিয়ে আর বলে না।তার চোখ মুখ কেমন যেন মলিন হয়ে যায়।
আজগর আলী তাকে অনুরোধ করে, এটা ছাড়তে পার না।
চেষ্টাত করি।কিন্তু পারিনা। খেলার নেশা উঠলে আর বসে থাকতে পারিনা।
গতবছর একবার তোমার বউ এসে এখানে কান্নাকাটি করে গেল। তুমি বাড়িতে কোন টাকা পয়সা দাওনি। তোমার দেনা পরিশোধ করার জন্য ঋণ নিয়েছিল। সেই ঋণের টাকার জন্য সমিতির লোকজন বাড়িতে এসে শোর চিৎকার করে।
সমিতির টাকা পরিশোধ হইছে?
না।এখন কিছু টাকা রয়েছে।
কত টাকা নিয়েছিলে?
চল্লিশ হাজার টাকা।
দেনা করলে কেন?
টাকা নিয়েছিলাম বাজারে কাঁচা মালের ব্যবসা করার জন্য। চৌমুহনী হতে চালানও করেছিলাম।যে দরে কিনেছিলাম কিন্তু বাজারে এসে দেখি সেই দর আর নাই। বাজার দর পড়ে গেছে। অনেক টাকা ওখানে লোকসান হয়েছে। মতি ব্যাপারী কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলাম। পরে সেই টাকা দেওনের জন্য ঋণ করেছি। মতি ব্যাপারীর কথা শোনে আজগর আলী আঁতকে উঠল। ও তো সুদের শ্রেষ্ঠ মহাজন।
যাক।এখন বউ-বাচ্চার মুখের দিকে চেয়ে জুয়া খেলা ছেড়ে দাও।আজগর আলী তাকে অনুরোধ করে।
হাতেগোনা কয়েকটি রাত ছাড়া প্রায় প্রতিরাতে খেলা হয়।অনেক সময় মাঝিরাও লেবারদের সাথে খেলতে বসে। পুরো মৌসুম জুড়ে যা কামাই করে তার চেয়েও বেশি দেনা হয়ে বাড়ি ফিরে। অনেকে এ দেনা শোধ করতে গিয়ে মাঝির কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেয়। আগামী মৌসুমের জন্য আগাম বিক্রি হয়ে যায়। মাঝিরা থাকে উৎপেতে।কখন কে,কোন ফাঁদে পড়ে। তখন তারা সুযোগ গ্রহণ করবে।পুরো দিন আজগর আলী তাকে বুঝালো। কিন্তু সন্ধ্যা সে আবার জুয়া খেলতে বসে। তাকে খেলতে দেখে সে কিছুক্ষণ আপসোস করল।পরে তাকে অন্তরে শত ধিক নিয়ে বলে।
ছি..হাফিজ।
আমি তোমাকে না বুঝিয়ে যদি একটা চতুষ্পদ জন্তুকে বুঝাইতাম, সে আমার কথা শুনত।তোমার সংসার চলে শত জোড়াতালি (অথাৎ খুব কষ্ট করে) দিয়ে। আর তুমি এখানে জুয়া খেলে টাকা নষ্ট কর।তোমাকে বোঝানো আমার দরকার ছিল না। বুঝিয়েছি কারণ আমিও লেবার, তুমিও লেবার দুজনেই দরিদ্র। আমাদের বেদন মাঝি বুঝবেনা। এ কথা বলে অনেক ক্ষোভ নিয়ে আজগর আলী তার বিছানা পত্র প্রস্তুত করে শুয়ে পড়ে।
পরের দিন খুব সকালে তাহের মাঝি আসে। দীর্ঘ একসপ্তাহ পর।এসে প্রথমে অফিসে ঢুকে উৎপাদন খাতা নিয়ে দেখে। দুই একদিন ছাড়া বাকি সব দিনই ইট বানানো কম হয়।সে অফিস থেকে বাহির হয়ে ভাটার কাছে গিয়ে লেবারদের গালিগালাজ করতে থাকে। উৎপাদন কেন কম হল।
মাঝে মধ্যে কেউ কেউ তার গাল-মন্দের প্রতিবাদ করে উত্তর দে।তখন সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে হাতের কাছে যা পায় তা নিয়ে তাকে মারার জন্য উৎদত হয়।আমি কি কাউকে টাকা কম দিয়েছি। কেউ মাগনা আসে নাই।তবু কেন কাজ কম হল।
কিছুক্ষণ সবাইকে বকতে বকতে আবার অফিসে দিকে যায়। কেরানিকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে উৎপাদন খাতায় ঐ কয়েক দিনের উৎপাদন বরাবর করে নে।ইটখোলা দুই জন ইউনুস কাজ করে। একজন মাটি নেওয়ার কাজ করে আরেক জন কেরানীগিরি করে। মাঝি যখন তাকে প্রস্তাব করে তখন সে থ হয়ে রয়।রাজি হচ্ছে না। কারণ সে এর আগে আর কখনো ইটের ভাটায় কাজ করে নাই। আধ একটু পড়াশোনা জানে তাই তারে কেরানী কাজে আনা হয়।কিভাবে ইটের হিসাব চুরি করতে হয় সে জানে না। তাই মনের ভেতরে বিষম ভয়।মৌসুম শেষে যখন হিসাব টানা হবে। কত লাখ ইট বানানো হল।
কত লাখ বিক্রি হল।তখন যদি হিসেবে না মিলে। তাহের মাঝি তাকে অভয় দিয়ে বলে। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ।এটা কোন কঠিন কাজ না।যখন উৎপাদন হিসাব না মিলবে। বলবে কালবৈশাখী ঝড়ের সময় অনেক কাঁচা মাল নষ্ট হয়ে যায়।
এভাবে আস্তে আস্তে কেরানী ইউনুস চালাকচতুর হয়ে উঠে। বিভিন্ন মাঝিদের কাছ থেকে উপরি কামাই করতে শিখেছে। এর অর্ধেক সে নেয় আর অর্ধেকটা ম্যানেজারকে দে।
মাঝি এবং কোম্পানির মধ্যে একটা চুক্তিনামা হয় এবার মৌসুমে তাকে এত লাখ ইট উৎপাদন করে দিতে হবে। আর নির্দিষ্ট চুক্তির বেশি করতে পারলে ঐ মাঝিকে কোম্পানির পক্ষ হইতে বোনাস দেওয়া হয়। লাখ প্রতি টাকার একটা অংক থাকে। তাই বোনাস পাওয়ার জন্য মাঝিরা লেবারদের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে। মাঝি এবং কোম্পানির মধ্যে যে চুক্তি হয় তা লেবারদের বলা হয় না। তাদেরকে বলা হয় আরো বাড়িয়ে। বোনাসের আশায়।
হাফিজ কি বুঝছ? মাঝি আমাদের গালিগালাজ করতে করতে এখন অফিসে টুকছে।
হাফিজের সরল উক্তি। এখন কেরানীকে কিছু টাকা ধরিয়ে আর উৎপাদন খাতায় বরাবর হয়ে যাবে। সে বড় নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর আপসোস করে বলে আগে আগে বোনাস পেলে মাঝিরা খুশি হয়ে লেবারদের এটা-সেটা কিনে দিত।
এখন কিছুই দে না।বোনাস পায় কিনা তা-ও বলে না। কিছু দেওয়ার ভয়ে।