আমাদের জেলায় করোণা সংক্রমণের হার এখন একটু কেন ভালোই উঁচুর দিকে। রাজ্যের মধ্যে আমরাই পয়লা নম্বরে। তাই জেলা প্রশাসন বাধ্য হয়ে বেশ কিছু কনটেনমেন্ট জোন বাড়াল। অনেকেই থোড়াই কেয়ার হলেও, আমরা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কে মেনে নিয়েছি। প্রয়োজন ছাড়া বেরোচ্ছিনা অযথা তাই।
আজ কি জানি, মাথার মধ্যে শ্রীমদ্ভগবদগীতা র বিষাদ যোগ এর কথা ঘুরঘুর করছে। হ্যাঁ, সত্যিই তো বিষাদও একটা যোগ। পরমের সাথে একাত্মতার। এই যেমন এক হতভাগ্য পিতা তার মেয়ের স্মৃতি কে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্যই আজ কোটি কোটি টাকার মালিক।
মৃত্যুর পর মেয়ের স্মৃতি কে বাঁচিয়ে রাখতে কোম্পানি খুললেন বাবা, বাড়ি বাড়ি ওয়াশিং পাউডার বিক্রি করে ২৫০০০ কোটি টাকার মালিক। ওয়াশিং পাউডার আজকালকার দিনে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে পড়ে। এটা জানলে অবাক হতে হয়, এই ব্যবসার মধ্যে দিয়ে এক বাবা তাঁর মেয়েকে চির অমর করেছেন।
কয়েক বছর আগে টেলিভিশনের পর্দায় একটা বিজ্ঞাপন আসত ওয়াশিং পাউডারের। ছোটো-বড় সকলেই সেই গান গুনগুনিয়েছে সেই সময়ে। “দুধ সি সাফেদি নিরমা সে আয়ে। রঙ্গিন কপড়া ভি খিল খিল যায়ে। সবকো পসন্দ নিরমা, ওয়াশিং পাউডার নিরমা”। হ্যাঁ আমরা কথা বলছি নিরমা ওয়াশিং পাউডারের ব্যপারে। এই বিজ্ঞাপনটিতে একটি মেয়েকে দেখা যেত। অনেকেই হয়তো জানেন, যারা জানেন না তাঁদের বলে রাখি মেয়েটি ছিল নিরুপমা।
যার নামে “নিরমা ওয়াশিং পাউডার” এর ব্যবসা। আসলে নিরুপমা যখন ছোটো ছিল স্কুল থেকে ফেরার সময় এক পথ দুর্ঘটনায় মারা যায়। করসান ভাই ও তাঁর পরিবারের ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। করসান ভাই তাঁর মেয়েকে ভীষণ ভালো বাসতেন। মেয়ের এই ভাবে চলে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছিলেন না।
এরপর তিনি মেয়ের নামে শুরু করেন “নিরমা” ওয়াশিং পাউডারের ব্যবসা। মেয়ের স্মৃতি বজায় রাখতে পাউডারের প্যাকেটে মেয়ের ছবি প্রিন্ট করান। ১৯৬৯ সালে এই ব্যবসার শুরু হয়। এই ব্যবসা শুরু করেন গুজরাটের করসান ভাই পটেল।
এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করা মোটেও সহজ ছিল না। করসান ভাই সাইকেল চালিয়ে একটি সাবান তৈরির কারখানায় কাজ করতে যেতেন। দিনের শেষে কারখানার ফেলে দেওয়া ধুলো সাবান গুঁড়ো সাথে নিয়ে আসতেন তিনি। আশেপাশের বাড়িতে বিক্রি করার চেষ্টা করতেন এই পাউডার। সেই সময়ে গুড়ো পাউডার বাজারে লঞ্চ করেছিল। কিন্তু দাম ছিল ১৫ টাকা কেজি। অপরদিকে করসান ভাই “নিরমা ওয়াশিং পাউডার” মাত্র সাড়ে তিন টাকা কেজিতে বিক্রি করতেন।
মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষদের এই পাউডার ভালো লাগতে শুরু করে।
ব্যবসা বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে নিজেই একটি কারখানা গড়ে তোলেন করসান ভাই। আজ যে কারখানায় প্রায় ১৮০০০ লোক কর্মরত। ৭০০০০ কোটির বেশি টার্নওভার এই কোম্পানির।
করসান ভাই বেশির ভাগ গুজরাতির মতো চাকরি না করে নিজের ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারিবারিক অবস্থার জন্য তাঁকে একটি সাবান তৈরির কারখানার ল্যাবে অ্যাসিসটেন্ট এর চাকরি করতে হয়। এরপর তিনি গুজরাট সরকারের খনন ও ভূবিজ্ঞান বিভাগে চাকরি পেয়ে যান।
১৯৯৫ সালে তিনি আহমেদাবাদে নিরমা ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ২০০৩ সালে ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট এবং নিরমা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি স্থাপন করেন। আজ সময়ের কাছে তা যে এক দৃষ্টান্তবাহী কার্যকরণী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
□
সত্যি বলতে কি, এমনিতে আমরা সারাদিন চরকিবাজি করে বেড়াই শহর জুড়ে। সুযোগ পেলে ঢুঁ মেরে আসি সারাটা জেলা। সেই আমাদের বন্দিদশা মানা যে কতটা কষ্টকর, তা ছাড়া গরু বেঁধে রাখলে যা হয় সেই অবস্থা।
প্রতিটা ভালোর পেছনে যেমন একটা হলেও মন্দ থাকে, প্রতিটা মন্দের পেছনেও বোধহয় তেমন করেই কিছু ভালোও থাকে।
পেপার কাটিং জমানো আমাদের সময়কার বহুজনের মতই আমারও অভ্যেস অনেকদিনের। দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের পর কি করি, পুরোনো ফাইল থেকে পেপার কাটিং গুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ এইসময় পত্রিকায় ২০১৮ সালে প্রকাশিত একটা স্টোরি পেলাম। অতনু বিশ্বাস লিখেছেন, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ এর ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে। ছোটবেলায় স্কুলের মাস্টারমশাই একদিন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ সম্পর্কে বলেছিলেন- আজ থেকে একশ বছর আগে যে মানুষটা অসীম কে বাঁধতে পেরেছিলেন সীমায়! একজন বিশ্বমানের ভারতীয়। কি এক অজানা মাদকতায় চোখ বুলোতে শুরু করলাম, লেখাটিতে …
কেমব্রিজ, অক্টোবর ১৯১৩। এক বাঙালি কবি নোবেল পাবেন একমাস পরেই। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পাশ করে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ নামে বছর কুড়ির এক ঝকঝকে বাঙালি তরুণ সেখানে গিয়েছে পড়তে। ডাকসাইটে অঙ্কবিদ হার্ডি আবার আদর করে ডেকে নিয়ে গিয়েছেন মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের এক করণিককে। প্রশান্তর চাইতে বছর চারেকের বড়। ভবিষ্যৎকাল তাঁকে জানবে ‘দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি’ হিসেবেই। লাজুক এবং শান্ত স্বভাবের রামানুজনের সঙ্গেও সখ্য গড়ে ওঠে প্রশান্তর। রামানুজনের কাছ থেকে প্রশান্ত জানেন ‘শূন্য’-কে হিন্দু দর্শনের নির্গুণ-ব্রহ্মের প্রতীক হিসাবে, ‘ইনফিনিটি’ বা ‘অসীম’-কে সমস্ত সম্ভাবনার সামগ্রিকতার সঙ্গে এক করে দেখতে, আর অন্য সকল সংখ্যাকে এই দুইয়ের গুণফল হিসেবে ভাবতে। ভবিষ্যতে অবশ্য দেশ ও জাতির উন্নয়নের সঙ্গে সংখ্যাকে সম্পৃক্ত করার মধ্যেই পূর্ণতা পাবে প্রশান্তচন্দ্রর উত্তরাধিকার।
প্রশান্তচন্দ্র বিজ্ঞানী। ভারতের রাশিবিজ্ঞানের ভগীরথ। তাঁর রাশিবিজ্ঞানের শিক্ষা অবশ্য একেবারেই একলব্যের মতো। গুরুহীন। মহাযুদ্ধের জন্যে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার জাহাজ দেরি করছিল ছাড়তে। সে সময়ে লন্ডনের কিংস কলেজের গ্রন্থাগারে এক টিউটর তাঁকে ধরিয়ে দেন কার্ল পিয়ার্সনের ‘বায়োমেট্রিকা’। ন’খণ্ডের বইটি কিনে নিয়ে জাহাজে উঠে পড়লেন প্রশান্ত। সেই তো শুরু। দেশ আর সমাজের কল্যাণে ভাগীরথীর প্রবাহ-নির্দেশ চলবে পরবর্তী আধ শতাব্দীর বেশি।
তাঁর গবেষক-সত্তা ছাপিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এক অ্যাকাডেমিক নেতা, এক সুদক্ষ প্রশাসক, এক দূরদর্শী জহুরি। একসঙ্গে। যা তৈরি করে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট বা আইএসআই। সেই সঙ্গে গড়ে তোলে ভারতের স্ট্যাটিস্টিক্যাল পদ্ধতি-প্রকরণ, আন্তর্জাতিক মহলে সমীহ-জাগানো এক ঝাঁক উজ্জ্বল গবেষক, আর এ দেশে দীর্ঘস্থায়ী এক বিশ্বপর্যায়ের স্ট্যাটিস্টিক্যাল লেগ্যাসি, যার সুফল ভোগ করে চলেছি আমরাও। আমার কাছে প্রশান্তচন্দ্রের এই দ্বিতীয় সত্তাটাই মহত্তর। জাতির জীবনে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান। এটাই তাঁকে স্মরণ করাবে দীর্ঘদিন। তাঁর দু’শো বছরও ঢাকঢোল পিটিয়ে উদযাপন হবে এর জন্যেই।
ব্যক্তি প্রশান্তকে আমরা যখন পর্যালোচনা করব, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর অনাবিল নিবিড় যোগসূত্রকে আনতেই হবে আলোচনায়। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরাজি অনুবাদ-সহ লন্ডনে যান, ১৯১২ সালে, সেখানে উপস্থিত সুকুমার রায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো নবীন প্রজন্মের বাঙালি যুবকরা। রদেনস্টাইনের বাড়িতে এদের একাধিক জমায়েতের বিবরণ রয়েছে। তারপর, প্রশান্তর সঙ্গে রবীন্দ্রের যোগসূত্র সময়ের সঙ্গে দৃঢ় হয়েছে মাত্র। ১৯১৯-এ নোবেলজয়ী কবি চিঠি লিখলেন লর্ড চেমসফোর্ডকে, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। তখনও প্রশান্ত কবির পাশে। দুইয়ের দশক জুড়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক বিদেশ সফরে প্রশান্তচন্দ্র তাঁর সঙ্গী এবং সচিব। কবির জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তেও দেখি প্রশান্ত ও তাঁর স্ত্রী রাণীর প্রতি রবি-কবির ‘দিনের অন্তে বিরল ভাষার আশীর্বাণী’, যাতে লেগে রয়েছে ‘রবির স্নেহের স্পর্শ’ । মহলানবিশ দম্পতির সঙ্গে এক বিরল আত্মিক সম্পর্কে জড়িয়ে থেকেছে কবীন্দ্রর জীবনের উত্তর-পর্ব। আর সেই সংযোগ প্রশান্তর জীবন পথেও জোগান দিয়েছে এক অনাবিল আলোর স্নিগ্ধ দিশা। নিঃসন্দেহে।
রাশিবিজ্ঞানের হাঁটি-হাঁটি-পা-পা-র দিনে, তার গড়ে ওঠা অনেকটাই তথ্য এবং সংখ্যা-নির্ভর গবেষণার ফসল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফলের পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণের জন্যে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল সাহায্য চাইলেন চব্বিশ বছরের তরুণ প্রশান্তর। ১৯১৭-তে। সেটাই ভারতে রাশিবিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রথম আধুনিক কাজের প্রস্তাবনা। বছর তিনেক পরে জুলজিক্যাল অ্যান্ড অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভের তৎকালীন অধিকর্তার কাছ থেকে পাওয়া কলকাতার কিছু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রশান্ত খোঁজার চেষ্টা করেন এদের সঙ্গে বাংলার কোন জাতির বেশি মিল– হিন্দু না মুসলমান। এ বিষয়ে পরবর্তী দেড় দশকের গবেষণা ক্রমে পরিণতি দেয় ‘মহলানবিশ ডি-স্কোয়ার্ড স্ট্যাটিসটিক’-এর। বিজ্ঞানী মহলানবিশ আজও সবচেয়ে বেশি পরিচিত এর জন্যে। আন্তর্জাতিক মহলে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে মহলানবিশ প্রতিষ্ঠা করেন স্ট্যাটিস্টিক্যাল ল্যাবরেটরি, যার গণ্ডির মধ্যেই রেজিস্টার্ড সোসাইটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের, ১৯৩১ সালে। আইএসআই-এর লোগো-তে রয়েছে এক বিশাল বটবৃক্ষ। ভারতের রাশিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আইএসআই-ও যেন তেমনই। লোগোতে সংস্কৃতে লেখা ‘ভিন্নেষ্বৈক্যস্য দর্শনম্’। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলে, এক অনন্য মডেলে ভারতে গড়ে উঠেছে রাশিবিজ্ঞানের সংস্কৃতি। একেবারে নিজস্ব। একে সৃষ্টি করেছেন, বহু যত্নে লালন করেছেন অধ্যাপক মহলানবিশ।
দু’বছর বাদেই রাশিবিজ্ঞানের ভারতীয় জার্নাল ‘সংখ্যা’-র স্থাপনা। প্রথম খণ্ডের সম্পাদকীয়তে অথর্ববেদ, অমরকোষ আর গীতার উল্লেখ করে মহলানবিশ বর্ণনা করেন ‘সংখ্যা’-র দ্বৈত-অর্থ—‘নিখুঁত জ্ঞান’ এবং ‘অঙ্ক’ (নাম্বার)। সংখ্যা এবং তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তব সম্পর্কে নিখুঁত জ্ঞান অর্জনই রাশিবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য। সে সময়ে এরকম জার্নাল শুরু করাটা এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত। জাতির বিজ্ঞান-চেতনায় সে এক বিপ্লব!
প্রশান্তচন্দ্র উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁরই ফসল। জীবনের নানা বিষয় আর সমস্যা থেকেই গড়ে ওঠে তাঁর রাশিবিজ্ঞানের ধারণা, তত্ত্ব, এবং ব্যবহার। নৃতত্ত্ব, ভাষা চর্চা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বড় নমুনা জরিপ, প্ল্যানিং, কৃষি, জাতীয় আয়, তথ্যপ্রযুক্তি, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, সমাজবিদ্যা, জেনেটিক্স– কী নয়! রাশিবিজ্ঞান তাঁর কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো এক প্রয়োগবিদ্যা, যা গণিত থেকে তত্ত্ব ধার করেও হয়ে ওঠে এক স্বতন্ত্র বিজ্ঞান।
প্রশান্তচন্দ্র রাশিবিজ্ঞানের দর্শনের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান ও সমাজ চেতনার অনুষঙ্গ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র আর আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী-তে পরিসংখ্যানের অনাবিল প্রয়োগ দেখেছেন প্রশান্তচন্দ্র। তিনি সঠিক পরিসংখ্যানগত চিন্তাধারার সূত্র খুঁজে পান চতুর্থ শতাব্দীর জৈন দার্শনিক ভদ্রবাহুর যুক্তির বিন্যাসের মধ্যেও।
মহলানবিশ পরিচালনা করেছেন প্রচুর বড়মাপের নমুনা সমীক্ষা। সেই অভিজ্ঞতাই হয়তো ভবিষ্যতে এনএসএসও-এর জন্ম দেয়। জাতীয় পরিকল্পনায় মহলানবিশের অবদান যুগান্তকারী। সেই কবে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের প্ল্যানিং কমিটি বানিয়েছিলেন জওহরলালকে চেয়ারম্যান করে। নেহরু প্রশান্তচন্দ্রকে অনুরোধ করেন রিপোর্টের পরিসংখ্যানগত অংশটুকু লেখার জন্যে। নেহরুর সঙ্গে মহলানবিশের এই সুসম্পর্ক পরবর্তীকালে প্রবাহিত হয়েছে সদ্য-স্বাধীন নবীন রাষ্ট্রের পরিকল্পনার দিক-নির্দেশে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপকার প্রশান্তচন্দ্র। তাঁর দুই-সেক্টর আর চার-সেক্টর মডেল কেউ পছন্দ করেছে, কেউ বা করেছে সমালোচনা। এই মডেলে কিন্তু প্রশান্তর সোশ্যালিস্ট চিন্তাধারার ছাপ স্পষ্ট।
অন্তর্জাল-হীন সে যুগে বিজ্ঞান-চেতনা বিস্তারে কনফারেন্সের প্রভাব অনুভব করে ১৯৩৮-এ ভারতে রাশিবিজ্ঞানের প্রথম কনফারেন্সের আয়োজন করেন মহলানবিশ। কলকাতায়। চার বছর পরে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় গণিত এবং রাশিবিজ্ঞান। প্রশান্তচন্দ্রের উদ্যোগেই। তার তিন বছর পরে রাশিবিজ্ঞানের আলাদা অধ্যায়। (অবশ্য দেড় দশকের বেশি হল সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা রাশিবিজ্ঞানের আলাদা অধ্যায়কে উঠিয়ে দিতে পেরেছেন সায়েন্স কংগ্রেস থেকে!)
আইএসআই-এর মতো রাশিবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠানে জীববিদ্যা, ভূবিদ্যার মত বিভাগ স্থাপন করলেন মহলানবিশ। আজ আলাদা বিষয়ের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণা-কালচারের ঢল পৃথিবীময়। সেই কবে বিভিন্ন বিষয়ের বিজ্ঞানীদের এক ছাতার তলায় এনে রাশিবিজ্ঞানের বিকাশই হয়তো উদ্দেশ্য ছিল মহলানবিশের। আইএসআই-এর ভূবিদ্যা বিভাগের এক যুগান্তকারী সাফল্য ১৯৬১-তে– গোদাবরী উপত্যকায় খনন করে ১৬০ মিলিয়ন বছর আগেকার ডাইনোসরের কঙ্কালের জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া। ডাইনোসরটির পা ছিল বেশ বড়, আর সেটা রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী। তাই এর নাম দেওয়া হয় ‘বড়পাসরাস টেগোরি’। আজও আইএসআই-এর অন্যতম প্রধান দর্শনীয় জিনিস ডাইনোসরটি।
প্রশান্তচন্দ্র ছিলেন এক স্বপ্নদর্শী নেতা। স্বপ্নের বিকাশে এবং সে প্রয়োজনে বাস্তবের ডানা ছড়াতে তিনি যুগের পথিকৃৎ। জাতিকে তা এগিয়ে দেয় কয়েক কদম। যেমন, ছ’দশক আগেই উন্নত গণনার প্রয়োজনে আইএসআই আমদানি করে ফেলল ভারতের প্রথম কম্পিউটার।
সে যুগে রাশিবিজ্ঞান ছিল এক নতুন গবেষণা-ক্ষেত্র। মহলানবিশ তাকে সম্পৃক্ত করলেন দেশের উন্নতি আর প্রগতির সঙ্গে। এ এক অনন্য কৃতিত্ব। সে জন্যে চাই সাহস, অদম্য জেদ, এক ভবিষ্যৎ দৃষ্টি। আর অবশ্যই অ্যাডভেঞ্চারের মানসিকতা। সঙ্গে দৃঢ় দুর্দমনীয় ব্যক্তিসত্তা। রাল্ফ ওয়াল্ডো এমার্সন না বলেছিলেন যে একটা প্রতিষ্ঠান আসলে এক ব্যক্তির দীর্ঘ ছায়া? ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের চাইতে এ কথার বেশি প্রযোজ্য উদাহরণ খুঁজে পাচ্ছি না ভারতে।
মহলানবিশকে পদ্মভূষণ দেওয়া হয়েছিল ১৯৬৮-তে, ‘বিজ্ঞান এবং দেশের সেবায় অবদানের জন্যে’। বিজ্ঞান-সাধনা আর দেশসেবা বোধ করি সম্পৃক্ত হয়েছিল মহলানবিশের জীবনব্যাপী প্রয়াসের মধ্যে। দুইয়ের দশকে রাশিবিজ্ঞানের সাহায্যে উড়িষ্যার বন্যার কারণ নির্ণয় কিংবা তিনের দশকে বাংলার পাটশস্যের পরিমাণ নিরূপণে যার সূত্রপাত, ভারতে এক পরিণত রাশিবিজ্ঞানের কালচার তৈরি করার মধ্যে তার চূড়ান্ত পরিণতি। মানবকল্যাণে এবং জাতির পরিকল্পনা নির্দেশনে যা সাহায্য করে যেতে পারবে যুগের পর যুগ ধরে। এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে যে, ১৯৫০-এর পুনা সায়েন্স কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মহলানবিশের বক্তৃতার শিরোনামই ছিল– “হোয়াই স্ট্যাটিস্টিক্স?” প্রশ্নটার আসল উত্তর লুকিয়ে আছে, তাঁর সারা জীবনের সাধনায়।
□
প্রকাশ ব্যানার্জির কথাগুলো এখনও কেমন যেন আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। সত্যিই তো, আমরা জাতীয় সংগীত কে বিস্মরণের পথে হাঁটছি না কি, পরিকল্পিত ভাবে? আপনি একশ জন ভারতীয় কে জিজ্ঞেস করুন, আমাদের ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত কি? শতকরা পঁচাশি জন উত্তর দেবেন- ‘জন গণ মন…’! উচ্চারিত হবেনা ‘বন্দেমাতরম’।
হয়তো বঙ্কিম-বিদ্বেষের মূল কারণ ‘শিক্ষিত সমাজ’-এর জ্ঞানের দীনতা এবং অজ্ঞানতা। উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই ‘বঙ্কিম-বিদ্বেষ’ ছড়ানো হয়েছে, যাতে ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রের মর্যাদাহানি করা সম্ভব হয়। ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমা এঁটে তাঁর দুর্লভ সাহিত্য-শক্তিকে বিড়ম্বিত করার এতটাই চেষ্টা হয়েছে, যে আজও তিনি যুগোপযোগী সম্মান পান নি। বঙ্কিমের লেখনিতে যতটুকু নিন্দা বা প্রশংসা আছে, দুইই ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে করা হয়েছে; কোনো আবেগ সেখানে স্থান পায়নি। বঙ্কিম সবসময় ‘বুদ্ধিজীবীর সততা রক্ষা’ করেছেন, অধিকারের সীমা কখনোই লঙ্ঘন করেন নি। তাই সংকীর্ণতা কখনও কলুষিত করতে পারে না তাঁর সাহিত্যকে।
বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমানদের কিছু কিছু বর্বরোচিত কাজের নিন্দা করেছেন। তার মানেই তা মুসলমান বিদ্বেষ নয়। কাজী নজরুলও করেছিলেন, তাঁকে তাই ‘কাফের’ বলা হয়েছিল। পরে তাঁকেই মহাকবি আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এখন, ইসলাম আর মুসলমান কি সমার্থক? তা তো নয়। মুসলমানদের নিষ্ঠুর হত্যালীলাকে নিন্দা করলেই ইসলামকে নিন্দা করা হবে কেন? তিনি কি কোনো মুসলমান পয়গম্বরের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, তবে?
বঙ্কিমের উপন্যাসে মুসলমানদের শৌর্যবীর্যের কথাও তো আছে। তাঁর ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে তিনি লিখেছেন, “কোনো পাঠক না মনে করেন যে, হিন্দু মুসলমানের কোনো প্রকার তারতম্য নির্দেশ করা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য। হিন্দু হলেই ভাল হয় না, মুসলমান হইলেই মন্দ হয় না। ভালমন্দ উভয়ের মধ্যে তুল্যরূপেই আছে।… ইহাও সত্য নহে, সকল মুসলমান রাজা সকল হিন্দু রাজা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অনেক স্থলে মুসলমানই হিন্দু অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ; অনেক স্থলে হিন্দু রাজা মুসলমান অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য গুণের সহিত যাহার ধর্ম আছে — হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, সেই শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য গুণ থাকিতেও যাহার ধর্ম নাই — হিন্দু হউক, মুসলমান হউক — সেই নিকৃষ্ট…।” এরপর কী বলবেন?
অনেকে আবার এও বলেন বঙ্কিমচন্দ্র ‘ইতিহাস বিকৃতি’ করেছেন। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের প্রেক্ষিতে বঙ্কিম ঔরঙ্গজেবকে যেমন ভাবে চিত্রিত করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে নাকি তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলা যায়। বঙ্কিমের অপরাধ হল, তিনি উপন্যাসে চঞ্চলকুমারীকে দিয়ে ঔরঙ্গজেবের ছবি পদদলিত করেছেন, আর তাতেই নাকি বঙ্কিমের মুসলমান-বিদ্বেষ ঠিকরে পড়েছে। যাঁরা ইতিহাস সচেতন তাঁরা জানেন, ঔরঙ্গজেবের সাম্প্রদায়িক ‘জিজিয়া কর’ পুনঃপ্রবর্তন হিন্দুরা খুশি মনে নিতে পারেনি কখনও। ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধে ছিল। ইতিহাস তাকে সমর্থন করে। তাহলে চঞ্চলকুমারী কি তাদের প্রতিনিধি নয়, যারা ঔরঙ্গজেবকে ঘৃণা করত? তাহলে বঙ্কিম কোথায় ইতিহাস বিকৃতি করলেন আর কিভাবেই বা সাম্প্রদায়িক হলেন?
বঙ্কিম তাঁর ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস রচনার জন্য ঐতিহাসিক প্রামাণ্য পুস্তকই বিবেচনা করেছেন, যেগুলি নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। যেমন প্রিঙ্কেল কেনেডির ‘A History of the Great Mughals’, জেমস্ টডের ‘The Annals and antiquities of Rajasthan’ প্রভৃতি। তাই তার রচনায় যদি ইতিহাস বিকৃতি ঘটে, তার দায়ভার সাহেব ঐতিহাসিকদেরও। বঙ্কিম যদি তাঁর সাহিত্য রচনায় সমকালীন সময়ের মেজাজকে, ইতিহাসকে সম্পৃক্ত করতে চান, তবে তা কি ‘সাম্প্রদায়িক’ পদবাচ্য হতে পারে ? বরং বলা ভাল, তাঁর রচনা ইতিহাসকে যথার্থ মর্যাদায় স্থাপিত করেছে। তিনি ইতিহাসের ব্যবহারিক প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। কেউ বলতে পারবেন না, তিনি সত্যকে ছাপিয়ে কল্পনার পক্ষীরাজ ঘোড়ায় পাড়ি দিয়েছেন।
বঙ্কিম ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে যে রায়তদের দুর্দশার চিত্র দেখান, সেখানে ‘রামা কৈবর্ত’ আর ‘হাসিম শেখ’ আলাদাভাবে হিন্দু কিংবা মুসলমান নন। তারা কৃষকদের একটি শ্রেণী, প্রতীক চরিত্র। তারা অসহায়, অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত। যারা তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে গাল দেন, তারা বরং ভাবুন, ‘ভাবা প্র্যাকটিস করুন’ মার্কসবাদী দীক্ষায় দীক্ষিত না হয়েও বঙ্কিম কিভাবে বাংলায় সাম্যবাদের বীজ বপন করে গেছেন। মনে রাখবেন, ‘সাম্য’ নামে তাঁর একটি প্রবন্ধও আছে। আর একটি কথা জানাই, যে উপন্যাসের জন্যও তিনি বিধর্মীদের দ্বারা ‘সাম্প্রদায়িক’ পদবাচ্য, সেই ‘সীতারাম’ উপন্যাসে সীতারামের হিন্দু রাজ্যের নাম ‘মহম্মদপুর’। কী করে তা হল? কারণ হিন্দু সম্রাট হিন্দু-মুসলমান উভয়কে নিয়েই চলতে চান। আর তার বিপরীতটা?
তাছাড়া, সমকালীন পরিবেষ্টনে অর্থাৎ উনিশ শতকে হিন্দু-স্বপ্নের প্রসার ও প্রচার শুধু স্বাভাবিক ছিল তাই নয়, প্রায় অনিবার্যই ছিল। উনিশ শতকে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে এক বড় রকমের ব্যবধান ফুটে উঠেছিল। কারণ ব্রিটিশ শাসনের প্রথমাবস্থায় মুসলমানেরা রাজশক্তির সঙ্গে প্রবল বিরোধিতা করেছিল আর হিন্দুরা করেছিল প্রাণঢালা মিতালি। মুসলমানদের বিরূপতা আর রাজশক্তির অপ্রসন্নতা যুক্ত হয়ে তার লব্ধি বলে একদা প্রাধান্য-প্রবল উদ্ধত-গর্বিত মুসলমান আম-দরবার থেকে হারিয়ে গেল। পক্ষান্তরে মঞ্চে আসর জাঁকিয়ে বসল দীর্ঘদিনের অবহেলিত, বঞ্চিত, কোণঠাসা হিন্দুর দল। ঐতিহাসিক কারণেই উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রধান অধিবাসী হয়ে উঠল নবজাগরণে উদ্বুদ্ধ হিন্দু-সমাজ। তাই দেখা যায়, এই সময়ের সকল প্রথিতযশা হিন্দু বিদ্বজ্জন ও সুধীমণ্ডলী হিন্দুত্বের নব জাগরণের স্বপ্ন দেখেছেন এবং স্বপ্নকে রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন।
বঙ্কিম-সমসাময়িক বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে ধর্মের স্থান ছিল। সমাজে ধর্মীয় পরিচিতি অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য ছিল। হিন্দু বলে, মুসলমান বলে, খ্রিস্টান বলে নিজেদের পরিচয় দেওয়াকে কেউই আপত্তিকর মনে করেন নি। তাই উনিশ শতকে হিন্দু সমাজের কোনো প্রখ্যাত ব্যক্তিই হিন্দু-নবজাগরণের স্বপ্ন না দেখে পারেন নি। রামমোহন, বিদ্যাসাগরও বাদ ছিলেন না। তবে হিন্দুত্বের জন্য বঙ্কিমকে আলাদা করে দায়ী করা হবে কেন? হ্যাঁ, বঙ্কিম হিন্দুধর্মের গৌরব প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেটাকে ঠিক হিন্দুয়ানার প্রতিষ্ঠা বলা ভুল। সেটাকে বলা ভাল নয় কি, লুপ্ত চৈতন্যের পুনরুদ্ধার!
প্রকাশ ব্যানার্জি তারপর আর কিছু বলেননি, ভারমুখে উঠে গিয়েছিলেন আড্ডা ছেড়ে।আমার স্পষ্ট মনে আছে। তাঁর এই আন্তরিক দেশপ্রেম কে আমি কুর্নিশ করি।
□
পেঁয়াজের মত শল্কত্যাগ করতে করতেই বুঝি আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক বিস্তার। প্রতিদিন কত কি যে শিখি নতুন করে। আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বলতে জানতাম, মাউন্ট এভারেস্ট কেই। প্রশ্ন হয়নি কখনও হিসেবটা কোথা থেকে হচ্ছে! বরং একজন বাঙালির এই ৮৮৪৮ মিটারের মধ্যে যুক্ত থাকায়, বেশ আত্মশ্লাঘা অনুভূত হত কৈশোরের দিনগুলোয়।
১৮৫২ সালের কোনো একদিনের কথা। মধ্যাহ্নভোজের পর ‘দ্য গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সার্ভে’র বড়সাহেব দিনের বাদবাকি সময়ের কাজগুলো সেরে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঠিক তখন হাতে একটি ফাইল নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন এক তরুণ। এই তরুণ এসে দাবি করলো সে নাকি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ আবিষ্কার করে ফেলেছে। বড় সাহেব বড়সড় চমকই খেলেন। পরে অবশ্য সারা বিশ্বই চমকে গিয়েছিল এই তরুণের আবিষ্কারে। তার নাম রাধানাথ শিকদার। আমরা অনেকেই ভুলে গিয়েছি তাকে। মেধাবী এই ব্যক্তিটি জীবদ্দশাতেও ছিলেন বড্ড উপেক্ষিত।
১৮১৩ সালের অক্টোবরে জোড়াসাঁকোর শিকদার পাড়ায় এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে রাধানাথ জন্মেছিলেন। বাবা ছিলেন তিতুরাম শিকদার। শিকদারেরা মুসলিম শাসনের প্রাক্কাল থেকে প্রধানত শান্তিরক্ষক হিসেবে কাজ করতো। বংশ পরম্পরায় এ কাজ করার কারণে তাদের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চা অনেক কমে এসেছিল। কিন্তু তারপরেও বাবার তত্ত্বাবধানে রাধানাথের প্রাথমিক শিক্ষায় ঘাটতি হয়নি। রাধানাথ প্রথমে গ্রামের পাঠশালায় এবং পরে কমল বসুর স্কুলে ভর্তি হন। ১৮২৪ সালে হিন্দু কলেজ (বর্তমান প্রেসিডেন্সি কলেজ)-এ। সে সময় তিনি যে টাকা বৃত্তি হিসেবে পেতেন তার বড় একটা অংশ দিয়ে বই কিনে ফেলতেন। পারিবারিক অবস্থা ভালো না থাকায় অনেক সময় পড়ালেখাতে মন দিতে পারতেন না। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন- “কলেজে একমনে পড়িতে পাইতাম না, একবার পড়ার কথা মনে পড়িত, পরক্ষণেই বাটিতে ফিরিয়া যাইয়া কি খাইব, মা বুঝি এখনও কিছু খান নাই, এই সকল ভাবনা মনে উত্থিত হইয়া পড়ার ব্যাঘাত ঘটিত।”
কলেজে পড়াকালীন সময় থেকেই তিনি গণিত চর্চায় অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। সে সময়ের ভারতবর্ষের স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে তিনি ছিলেন একজন যিনি স্যার আইজ্যাক নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ পড়েছিলেন এবং চর্চা করেছিলেন। ছাত্রাবস্থায় রাধানাথ গ্যালিলিও, টাইকো ব্রাহে, জোহানেস কেপলার, শ্রীধর আচার্য এবং ভাস্করাচার্যের বৈজ্ঞানিক লেখা পড়েন। হেলেনিক গণিতবিদ থেলিস, আর্কিমিডিস এবং ইরাটোথেনিসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি বক্রতলীয় ত্রিকোণমিতি অধ্যয়ন করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের প্রতিও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি তাঁর অসাধারণ মেধার সাক্ষ্য স্বরূপ বেশ কয়েকটি ক্লাসে ডবল প্রমোশন লাভ করেন। কলেজে পড়াকালীন সময়েই তার রচিত দুটি বৃত্তের উপর স্পর্শক রেখা (Tangent) অঙ্কন করার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেন এবং তার প্রবন্ধ Gleanings in Science (Vol. III, 1831) সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।
দুর্দান্ত ইংরেজি পারতেন। একবার কলকাতার টাউন হলে শেক্সপিয়রের ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ থেকে পাঠ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। গ্রিক এবং লাতিন ভাষাতেও দক্ষতা ছিল। সর্বস্তরে বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি ইংরেজি ভাষায় রচিত বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করার উদ্যোগ নেন। তখনো বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু হয়নি। এর কিছুকাল পর তার বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস রচনা করেন।
সব ছাত্রছাত্রীই একপর্যায়ে তাদের মানসিক উৎকর্ষ সাধন এবং মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষক কিংবা পথপ্রদর্শক দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাধানাথও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তাঁর শিক্ষক ডিরোজিও দ্বারা। ডিরোজিও ছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের (বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ) উন্মুক্ত বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার অগ্রদূত। জন্মসূত্রে বাঙালি না হলেও বাঙালিদের সঙ্গে মনে প্রাণে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। একাধারে শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক এই মানুষটি তার বৈদ্যগ্ধতা আর বৌদ্ধিক উৎকর্ষে উদ্যমী হয়ে সমাজ সংস্কারের কাজে নেমেছিলেন। যখন তিনি শিক্ষকতা শুরু করলেন, তাঁর সান্নিধ্যে থাকা প্রাণোচ্ছল তরুণেরা তাঁর প্রভাবে প্রভাবিত হতে শুরু করলো। তার অন্যতম ফসল ছিলেন আমাদের রাধানাথ শিকদার।
আরেকজন মানুষ দ্বারা রাধানাথ প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন শিক্ষক মিস্টার টাইটলার। তার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে রাধানাথ বলেছেন,
“কলেজের সকল শিক্ষক অপেক্ষা টাইটলার সাহেবের শিক্ষাপ্রণালী অতি উত্তম। তিনি প্রশ্নচ্ছলে শিক্ষা দিতেন। … শেষ তিন বৎসর আমি রস ও টাইটলার সাহেবের বক্তৃতা শ্রবণ করি। ১৮৩০ খৃঃ অব্দে টাইটলার সাহেবের নিকট গণিত শাস্ত্র শিক্ষা করি। এই বৎসর হইতে উচ্চ গণিতের শিক্ষা আরম্ভ হয়। এই বৎসর ইঁহার নিকট নিউটনের প্রিন্সিপিয়া (Newton’s Principia) গ্রন্থের প্রথম ভাগ অধ্যয়ন করি। পর বৎসর সাহেবের বক্তৃতা শ্রবণ ও বাটিতে নিজে চেষ্টা করিয়া উচ্চ গণিতের কতক কতক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করি।”
দারিদ্র্যের কষাঘাতে যখন রাধানাথ কলেজ ছাড়লেন তখন তার একটি চাকরির বড্ড দরকার ছিল। তখন যোগ দিলেন ‘দ্য গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সার্ভে’র কলকাতা অফিসে গণণাকারী হিসেবে। প্রতি মাসে মাইনে পেতেন মাত্র তিরিশ টাকা। এ পদে নিযুক্ত হওয়া প্রথম ভারতীয় ছিলেন রাধানাথ শিকদার। সে সময় দ্য গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সার্ভেতে একটি পদের জন্য সুপারিশ করেন সার্ভেয়র জেনারেল জর্জ এভারেস্টকে। জেনারেল এভারেস্টের তখন গোলকীয় ত্রিকোণমিতি এবং বক্র জ্যামিতিতে দক্ষ একজন গণিতবিদ প্রয়োজন। কারণ এভারেস্টের মূল কাজ ছিল দক্ষিণ ভারত থেকে নেপাল পর্যন্ত যে দ্রাঘিমাংশীয় চাপ রয়েছে তার সঠিক পরিমাপ বের করা। ফলে ঐ অংশের জিওয়েড (Geoid)-এর আকার অনুমান করা যায়।
টাইটলার সাহেবের সুপারিশে তাই রাধানাথকে জর্জ এভারেস্ট লুফে নিলেন। ১৮৩২ সালের ১৫ অক্টোবর রাধানাথ কাজে নিযুক্ত হয়ে চলে গেলেন ভূপালের সেরোঞ্জ বেইজ লাইনে (Serunge Base Line)। সেখানে গিয়ে তিনি জিওডেটিক প্রসেস এর উপর বিশদ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি নিজের আগ্রহেই গণিতের বিভিন্ন বই অধ্যয়ন ও গণিত চর্চা করতে থাকে।
ব্যারোমিটারের সাথে যুক্ত থাকা ধাতব স্কেলের তাপজনিত প্রসারণ এবং ব্যবহৃত পারদের প্রসারণজনিত পরিমাপের ত্রুটি সার্ভের পরিমাপে বিচ্যুতি ঘটায়। এই বিচ্যুতি বাতিলের জন্য যে সূত্র ইউরোপে ব্যবহৃত হতো তা রাধানাথ জানতেন না। তাই তিনি নিজের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ও অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে শূন্য ডিগ্রিতে ব্যারোমিটারের পাঠ নির্ণয়ের সূত্র উদ্ভাবন করেন। এই সূত্র সম্বলিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধটি পরে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল জার্নালে প্রকাশিত হয়। শুধু তা-ই নয়, সার্ভে চলাকালীন সময়ে রাধানাথের হাত ধরে প্রচলিত অনেক নিয়ম কানুনই কয়েক দশক ধরে জরিপের কাজে প্রচলিত হতে থাকে। এই ব্যাপারগুলোতে রাধানাথের পদার্থবিজ্ঞানেও অসাধারণ দক্ষতার ব্যাপারটি ফুটে ওঠে।
গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানে এরকম দক্ষ ব্যক্তিকে এভারেস্ট নিংড়ে নিতে চেয়েছিলেন। তাই ১৮৩৭-এ যখন রাধানাথ ডেপুটি কালেক্টর পদে যেতে চাইলেন তখন এভারেস্ট রাধানাথকে সুপারিশ পত্র তো দিলেনই না বরং তাকে আটকে রাখলেন। আর ব্যবস্থা করলেন তিনি যেন ইংরেজ সরকারের অন্য কোনো দফতরে কাজ না পান। কারণ রাধানাথ শুধুমাত্র যে মেধাবী ও দক্ষতাসম্পন্ন গণিতবিদ ছিলেন তা-ই নয়, তিনি ছিলেন সুঠাম দেহ ও দৃঢ় শারীরিক গঠনের অধিকারী। তার উপর ছিলেন বেশ বলবান ও সাহসী। কথা ও কাজে মিল ছিল। মুখে যা বলতেন তা করে দেখাতেন। কাউকে ভয় পেতেন না যেমন, তেমনি কারও মুখাপেক্ষীও ছিলেন না। সার্ভের কাজে যে প্রচুর শ্রম দরকার হতো, রাধানাথের পক্ষে তা করতে তেমন সমস্যা হতো না। রাধানাথের সাহায্য নিয়ে এভারেস্ট হায়দ্রাবাদের বিদর থেকে মুসৌরির ব্যানোগ পর্যন্ত প্রায় ৮৭০ মাইল দূরত্বের গ্রেট আর্কটি জরিপ করে ফেলেন।
সার্ভেয়র জেনারেল এভারেস্টের মুখ থেকে কারো প্রশংসা খুব কমই শোনা যেত। কিন্তু রাধানাথ ছিলেন এর ব্যতিক্রম। ১৮৩৮ সালে তিনি রাধানাথ সম্বন্ধে বলেছিলেন, ভারতে এ দেশের বা ইউরোপের এমন কেউ নেই যিনি রাধানাথের সঙ্গে তুলনীয়। এভারেস্ট মনে করতেন, গণিতে তাঁর সমকক্ষ বিশ্বেই খুব কম আছে। রাধানাথের উপর এভারেস্ট এতটাই নির্ভর করতেন যে বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য রাধানাথকে ছুটি দিতেও তিনি চাইতেন না, বরং এভারেস্ট চাইতেন তাঁর বাবাই এসে যেন রাধানাথের সঙ্গে দেখা করেন। এ প্রসঙ্গে ১৮৪১ সালের ৩ জুলাই দেরাদুন থেকে রাধানাথের বাবা তিতুরামকে লেখা এভারেস্টের একটি চিঠি ছিল–”I wish I could have persuaded you to come to Dehra Dun for not only it would have given me the greatest pleasure to show you personally how much I honour you for having such a son as Radhanath, but you yourself have, I am sure, been infinitely gratified at witnessing the high esteem in which he is held by his superiors and equals.”
১৮৪৩ সালে এভারেস্ট চাকরি থেকে অবসর নিলেন। তার স্থলে তখন নিযুক্ত হলেন কর্ণেল এন্ড্রু ওয়া (Col. Andrew Scott Waugh)। তিনিও রাধানাথের কার্যক্রমে বেজায় খুশি। আর এভারেস্টের মতোই রাধানাথকে অন্য কোথাও কাজ করতে দিতে নারাজ। ১৮৫০ সালে রাধানাথ যখন কলকাতায় বদলির দরখাস্ত করলেন, তখন তিনি তাতেও বাগড়া দিলেন। রাধানাথকে তার দফতরে রেখে দেয়ার জন্যে তিনি রাধানাথের মাইনে আরো বাড়িয়ে দিলেন। রাধানাথের কাজ সম্বন্ধে তৎকালীন আর্যদর্শন পত্রিকা লিখেছিল-
“যখন রাধানাথ এই বিভাগে প্রবিষ্ট হন তখন জরিপ করিবার অনেক প্রথা অনাবিষ্কৃত ছিল। দেশের অবস্থাও অতি অল্পই জানা ছিল। যে যে কারণে গণনা ভুল হইত সে সকলও অজ্ঞাত ছিল। সে আমলে জরিপ করিতে যে কত কষ্ট সহ্য করিতে হইত তাহা কর্ণেল এভারেষ্টের সুবৃহৎ গ্রন্থে বিশেষ করিয়া লেখা আছে। বরফ, হিম, জল, কাদা, বৃষ্টি ভোগ করিয়াও রাত্রি জাগরণ করিয়া প্রফুল্ল চিত্তে কয়জন লোক কাজ করিতে পারে!”
প্রায় বিশ বছর পর রাধানাথ যখন কলকাতায় বদলি হয়ে এলেন তখন তিনি প্রধান গণনাকারী আর পাশাপাশি খনিতত্ত্ব বিভাগের সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করা শুরু করলেন। এর কিছুকাল পরে কর্ণেল ওয়ার নির্দেশে রাধানাথ হিমালয়ের বরফে ঢাকা কিছু পর্বতশৃংগের উচ্চতা মাপার কাজ শুরু করলেন। তখনকার সময় নাম না দেয়া হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গগুলো সূচিত হলো রোমান সংখ্যা দিয়ে। এরকম একটা শৃঙ্গ ছিল পিক ফিফটিন (Peak XV)। রাধানাথের নেয়া প্রায় ছয়টি রিডিং প্রমাণ করলো, পিক ফিফটিনের উচ্চতা ২৯,০১৭ ফুট, যা পুরনো মাপ অনুযায়ী উচ্চতম পর্বতশৃংগ কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়েও বেশি উঁচু।
এই পিক ফিফটিনের রিডিং নেয়ার জন্য রাধানাথের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বায়ুমণ্ডলে আলোর প্রতিসরণের জন্য বিচ্যুতি এড়াতে প্রয়োজনীয় সংশোধন নির্ণয় করা। এ সংশোধন নির্ণয় করে রাধানাথ পিক ফিফটিনের উচ্চতা নির্ণয় করে মূল কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এরপরই সেই দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল যে দৃশ্যের অবতারণা লেখার একদম শুরুতে করা হয়েছে। এরপর বড় সাহেব কর্ণেল ওয়া নিজে তথ্যটি যাচাই করে জনসমক্ষে স্বীকৃতি দিলেন, এই পিক ফিফটিনই হল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পর্বতশৃঙ্গ। কিন্তু এর নাম কী হবে ? এভারেস্ট যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন তিনি স্থানীয় এলাকার মানুষের মুখের নাম অনুযায়ী পর্বতশৃঙ্গের নাম প্রস্তাব করতেন। এভাবেই কাঞ্চনজঙ্ঘা, নন্দাদেবী ইত্যাদি নাম প্রচলিত হয়েছে। কিন্তু এই পিক ফিফটিনের নাম নিয়ে ঝামেলা হলো। কারণ পিক ফিফটিন নেপাল আর তিব্বতের মাঝে অবস্থিত, দুই দেশে এর নাম দুই রকম। তখন কর্ণেল ওয়া নিজের পুরনো প্রভুকে একজন বাধ্য ভৃত্যের মতো খুশি করতে চাইলেন। তিনি রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটিকে একটি চিঠি লিখে পিক ফিফটিনকে ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ নামের প্রস্তাব জানালেন। যে শৃঙ্গ আবিষ্কার বা পরিমাপে এভারেস্টের কোনো ভূমিকাই ছিল না তার নাম হয়ে গেল মাউন্ট এভারেস্ট। রাধানাথ রয়ে গেলেন উপেক্ষিত।
মানুষটিকে কোনো কালেই সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকার স্বীকৃতি দিতে চায়নি। বারংবার সার্ভে থেকে সরে যেতে চাইলেও তাঁকে কর্মচারী হিসেবেই রাখা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে তাকে প্রশংসা করা হয়েছে। মাইনে বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তার প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করাই এর মূল কারণ।
একটি বড় উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ১৯০৪ সালে নেচার সাময়িকীতে সিডনি জেরাল্ড বারার্ডের নিবন্ধ ‘মাউন্ট এভারেস্ট: দ্য স্টোরি অব আ লং কনট্রোভার্সি’তে। সেখানে এ প্রসঙ্গে মাত্র একটি বাক্য আছে। তিনি লিখেছেন- ১৮৫২ সাল নাগাদ কলকাতার দফতরে কর্মরত প্রধান গণক, দেরাদুনে অবস্থানরত সার্ভেয়র জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়াকে জানালেন, ‘আ পিক ডেজিগনেটেড ‘XV’ হ্যাড বিন ফাউন্ড টু বি হায়ার দ্যান এনি আদার হিদারটু মেজারড ইন দি ওয়ার্ল্ড’। এই প্রধান গণকটি নিশ্চিত রাধানাথ শিকদার। ওদিকে ভারতে সার্ভের ইতিহাসের আকরগ্রন্থ, রেজিনাল্ড হেনরি ফিলিমোর-এর হিস্টোরিক্যাল রেকর্ডস অব দ্য সার্ভে অব ইন্ডিয়ার পঞ্চম খণ্ডে (১৯৬৪) রাধানাথের নাম করে জানানো হচ্ছে, এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা গণনায় তার হাত নেই, কাজ চলেছিল দেরাদুনে, কিন্তু তিনি ততদিনে কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছেন। এই দুয়ের মধ্যে কোনটা সত্যি??? আবার যে রেকর্ড নেয়া হয়েছিল সেটাও তো ওই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর হাতেই করা। সেটাকেও বা কতটুকু নির্ভরযোগ্য বলে ধরা যায়?
জরিপের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বই ‘ম্যানুয়াল অব সার্ভেয়িং ফর ইন্ডিয়া’ প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালে। এর প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে ঠিকই রাধানাথের অবদানের কিয়দংশ ছিল। কিন্তু থ্যুলিয়ার কর্তৃক তৃতীয় সংস্করণ থেকে তার অবদানটুকু রেখে স্বীকৃতি লোপাট করে দেওয়া হয়।
আর এদিকে আমরাই বা ক’জন মনে রেখেছি তাকে? শুধু রাধানাথের গণিতের জ্ঞান ও অন্যান্য অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে জার্মানীর ব্যাভেরিয়ান শাখার বিখ্যাত ‘ফিলোসফিক্যাস সোসাইটি’ তাকে তাদের সদস্য নির্বাচিত করে। সে সময়ের ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এ সম্মান লাভ করেছিলেন।
রাধানাথ ছিলেন অত্যন্ত সমাজ সচেতন মানুষ। ১৮৬২ সালে অবসর গ্রহণের পর তার বন্ধু প্যারিচাঁদ মিত্রের সাথে মিলে ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। হিন্দু ধর্মে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি বরাবরই সরব ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। ১৮৪৩ সালে ম্যাজিস্ট্রেট ভ্যান্সিটার্টের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এই ম্যাজিস্ট্রেট তার বিভাগে কর্মরত চাকরিজীবীদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করাতেন এবং তারা আপত্তি জানালে তাদেরকে চাবুক মারতেন। এই অমানবিক কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাধানাথ ইংরেজদের সাথে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন। ২০০ টাকা পরে জরিমানাও দিতে হয়েছিল তাকে।
রাধানাথ সর্বদা নিজের কাজেই ডুবে থাকতেন। অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়, তার অসাধারণ গাণিতিক প্রতিভা যদি কেবলমাত্র সার্ভের জট না খুলতে ব্যবহৃত হয়ে অন্য গবেষণার কাজে নিযুক্ত হতো, হয়তো বিশ্ব আরো পরিণত ও প্রজ্ঞাবান একজন গণিতবিদ পেতো। বস্তুতই রাধানাথের সমকক্ষ মেধা সারা বিশ্বে অতুলনীয় ছিল। অকৃতদার এই মানুষটির কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। তিনি কোনোদিন বিয়ে করেননি। কিন্তু বাচ্চাদের তিনি বড্ড ভালোবাসতেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি গঙ্গার ধারে চন্দননগরে বাড়িতে এসে ওঠেন। ১৮৭০ সালের ১৭ মে আধুনিক ভারতের এই প্রথম বৈজ্ঞানিক গণিতবিদ মৃত্যুবরণ করেন।
ভারতের ইতিহাসে কোন সরকারই এই মহান দেশপ্রেমিক ও যুগশ্রেষ্ঠ মানুষটির স্বীকৃতি আদায়ের ব্যাপারে কখনও কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক মানচিত্রেও না।
ক্রমশ
(কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায়ের জাত্যাভিমানে আঘাত বা আরোপ- এ লেখনীর বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য নয়। যে কোনো প্রকার সাযুজ্য আকস্মিক কিংবা দৃশ্যপট নির্মাণে সংবন্ধিত।)