ছোটগল্পে সুরভী হাসনীন

কানামাছি মিথ্যা কানামাছিসত্য

(১)
আজ তরুকে দেখতে এসে ছেলেপক্ষ অরুকে পছন্দ করে গেছে। সন্ধ্যা থেকে বাড়ির পরিবেশ থমথমে। রাতের ভাত খেতে রাজিয়া অনেক বার ডেকেছে অরুকে। রাজিয়া নিজেও অস্বস্তিতে আছে। জামশেদ সাহেবের বুকের চাপ ব্যাথাটা বাড়ছে। জিভের নিচে স্প্রে দিয়ে শুয়েছেন । সিংকের ওপর একগাদা এঁটো বাসন জমা। কাজের মেয়েটা আসবে বলেও আসেনি। অন্যদিন অরু তরু ধুয়ে ফেলে। হাড়ি ধুতে গিয়ে দু’বোন হাসিতে কুটকুটি হয়ে যায়।
আপা, এই পাতিলটা রোশনা খালা। মুখের দিকটা পাতলা, নিচে টেপ খাওয়া। মানে মুখ পাতলা, পেটে কথা থাকেনা।
হু, তুই সব জানিস।
আর এই কড়াইটা দেখো, কেমন সোজা, উপরটা ঝকঝকে, কিন্তু সমান, পানি দে আর তেল দে, গুয়ের মত পেটের ভেতর নিয়ে রাখবে,  তোর মত। হিহিহি।
আম্মা, এদিক আসেন, আপনার ছোট মেয়ে আমাকে গু বলছে। বিচার করেন, আজকে যদি বিচার না করেন, কালকে থেকে এ বাসায় আর ভাত খাবোনা।
খাস না, ভালই হবে। তোর ভাগের মাছটা আমি খাবো। দুধের। সরটা খাবো। প্লিজ আপা তুই সন্যাস ব্রত নে।
অন্য সময় রাজিয়া রাগে গজগজ করেন। তবে দুই মেয়ের খুনশুটি তার ভালো লাগে। রেগে গেলে তরু তাকে আপনি করে ডাকে। তখন মেয়েকে পর মনে হয়। আজকে একা একা সিংকে জমা বসন ধুতে গিয়ে চোখের জল মুছে নিলেন আঁচল দিয়ে। তরু কখন এসে পেছনে দাড়িয়েছে দেখতে পাননি।
মা , সরোতো । আমি ধুচ্ছি বিশ্রামে যাও । আব্বাকে দেখো গিয়ে। মানুষটা ঠিক মত খায়নি। তোমাকে চা করে দেই এক কাপ। মাথা ধরেছে নিশ্চয়ই।
ঘাড় ঘুরিয়ে তরুকে দেখে রাগে ফেটে পড়লেন রাজিয়া।
বেহায়া মেয়ে, একটার পর একটা ছেলের সামনে বসছিস, উঠছিস। কেউ পছন্দ করেনা। ধিঙ্গী মেয়েছেলে হয়ে থাকবি সারা জিবন? আমরা কয় দিন থাকব? শেয়াল কুকুরে টেনে খাবে পরে। অরু ও বিয়ে করে চলে যাবে। তোকে দেখবে কে?
তরু হাসি মুখে সিংক কাচাতে থাকে। অরুটা দরজা বন্ধ করে আছে কখন থেকে। এদিকটা গুছিয়ে পাগলিটাকে দেখতে হবে। খুব আশায় বুক বেঁধেছিলো নিজ থেকে। ছেলের সাথে আগে একবার নিজে দেখা করে নিয়েছিলো তরু। সব বারের অভিজ্ঞতা গুলো ওকে এই কাজটা করতে বাধ্য করেছিলো।
একটানা রিফিউজ হবার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে , দেখা করে জানিয়ে দিয়েছিলো, ছবিতে এক গাদা পাউডারে ফর্সা মেয়েটা বাস্তবে শ্যাম বর্ণের। বাঁ হাতটা ডান হাত থেকে এক ইঞ্চি ছোট। বসে থাকলে বোঝার উপায় নেই। এ বিষয়টা আগে দেখতে আসা সব ছেলেকে ও জানিয়েছে একান্ত আলাপের সময়টায়। এবার মা মাথার দিব্যি দিয়েছিলো। বিয়ের পর যেনো জানায়। নয়ত বিয়েটা এবারো ভাঙবে।
জাবের , একহারা লম্বা ফর্সা ছেলেটাকে ওর ভালো লেগেছিলো প্রথম দেখায়। সরাসরি নিজের বিষয়টা জানানোর পর জাবেরের আশ্বাসে বাসায় পরিবার নিয়ে বসা। কিন্তু অরু ঢুকতেই জাবেরের মা মত পাল্টে অরুকে পছন্দ করে বসলেন। অরুটা অবশ্য পছন্দ করার মত। মায়ের কাঠালিচাঁপা রঙে, ছোটখাটো মেয়েটা এক মাথা চুল আঁচড়ে উঠলে সাক্ষাত প্রতিমা যেন স্বর্গ থেকে এসে দাঁড়ায়।
একটা প্লেটে সাদা ভাত আর মাছ ভাজা,  লেবু নিয়ে দরজা ধাক্কা দেয় তরু। আলো নিভিয়ে অরু ঘুমিয়েছে । রাতটা ডায়রী লিখে কাটিয়ে দিয় কখন যেনো ঘুমিয়ে পরেছে। মাথায় হাত রাখতেই চোখ খুলে অরুকে পাশে বসে থাকতে দেখে তরু হেসে ফেলে।
তুই এত ভাবছিস কেনো। বাবার রিটায়ারমেন্ট এর আগে অন্তত্য একজন না হয় কমলাম। আমার বদলে তুই ।
থথসারাটা জীবন তোর চোখের দিকে তাকাতে কষ্ট হবে আমার  আপা। যে লোকটা তোকে পছন্দ করে আমাকে এসে আংটি পরায় সে মানুষ কেমন হবে বলতে পারবি? ওর মা ও কেমন রে? মানুষ না শয়তান বলতো আপা।
কথাটা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে ওঠে অরুর। খুব সকাল সকাল ছাঁদে যায় আপা। সূর্যোদয় পছন্দ করে তরু। তরু উঠে যাচ্ছে সিড়ি ভেঙে। এসব তাকে টানেনা অনেক দিন। জাগতিক সম্পর্কের হিসাব রাখতে গেলে ভালোবাসতে হয়। নতুন করে বারে বার প্রেমে পরতে হয়। মনের গহীণে কারো নামে অনির্দিষ্ট কাল ধরে জপনামা পাঠ করতে হয়। বিশ্বাসহীনতায় যেখানে অসম্মান জমে, সেখানে ভালো লাগায় ছুঁয়ে থাকা যায়। ভালোবেসে পুনরায় গ্রহণ করার মানসিকতা হারিয়ে গিয়ে ব্যাথা জমে থাকে বহু পুরাতনে।
এ বিয়ে ভেঙে দিতে হবে। যে কোন ভাবে কাজটা করতে হবে। চোখ মুছে গায়ে কাঁথা টেনে শুয়ে পড়ে অরু। বর্ষা তার শেষ জানাচ্ছে। হালকা শরতের শীতের হিম কি জমাচ্ছে মানুষের নিজকে আজকাল এই ইট কাঠের শহরে ?
সূর্যের প্রথম কিরণ যখন তরুর মুখে পড়ে, সমস্ত পৃথিবীর পূণ্য একত্রে স্নান করে দুটো ঠোঁটে। পাশের ছাদ থেকে রিয়াদ মুগ্ধ চোখে দেখে তরুকে প্রতিদিন। এত সহজ স্নিগ্ধতা নারীর মুখে কখনো দেখা হয়নি। কানাডায় ডক্টরেট করতে যাবার আগে উষসী যখন নিশ্চিত ভবিষ্যতের বাহানায় হাত ছেড়ে গিয়েছিলো, তখনও এতটা স্বচ্ছ ছিলোনা উষসীর চোখ। ঈদের ছুটিতে দেশে এসে খালার বাসায় বেড়াতে আসাটা বৃথা হয়নি রিয়াদের। বুকের মধ্যের শূন্যস্থানটা পূরণ করার মানুষ এই তিন বছরে অনেক খুজেছে । সৌন্দর্য ছিলো ঢের, সততা ছিলোনা। খালার কাছেই নাম জানা -তরু।  মেয়েটার একটা খুঁত আছে, খালা জানিয়েছিলো। সত্যিই কি এটা খুঁত। রিয়াদ ও তো ভিষণ উত্তেজনায় একটা দুটো শব্দে তোতলায়। কই, তার বায়োতে কোথাও লেখা হয়নি এই খুঁতটা। তরুকে দেখলে রিয়াদের খুব করে গুনের কবিতা মনে পড়ে।
আমি বলছিনা ভালোবাসতেই হবে,
আমি চাইকেউ আমাকে খেতে দিক।
আমি হাত পাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছিনা,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারী মুক্তি দিয়েছে স্বামী সেবার দায় থেকে।
আমি চাই কেউ একজন জিগ্গেস করুক:
আমার জল লাগবে কিনা,নুন লাগবে কিনা।
এটো বাসন,গেন্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি থ(নির্মলেন্দু গুন)
(২)
দরাজ গলায় রিয়াদের আবৃত্তি শোনে তরু রোজ। সূর্যের সাথে মিতালী তার ছোটবেলার থেকে। ইদানিং সূর্যের সাথে এক অচেনা কন্ঠস্বর যেন শতবর্ষের আকর্ষণে টানে। শিহরণ জাগে মনের ভেতর। কোথাও বাঁধা পড়তে ইচ্ছে হয়।
আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে
কিছু থাকে,
হোক না তা শ্যামল রঙ ছাই,
মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না
কিচ্ছু থাকে না,
খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই।
থ( হেলাল হাফিজ)
হাফিজের কবিতার মত করে তরু একটানা কথা বলে  নিজের সাথে। পাশের বাসার ছেলেটার মায়াবী আবৃত্তি ওকে খুব করে ভাবায়। তবুও প্রাণপণ শপথ নেয়া, জড়াবেনা কারো সাথে ।  তিরিশ তম বিসিএস প্রিলির রেজাল্টে  টিকে গেছে তরু । ভাইভা বাবদ ঘুষ দিতে না হলে সরকারী চাকুরি টা নিশ্চিত ওর। আর এর মধ্যে অরুর বিয়েটা সেরে গেলে বাবা -মা হজ্বে যাবেন। বাসায় তরু একা থাকবে, তাই কাজের খালাকেও ঠিক করে রেখেছেন রাজিয়া।
জাবের এর পরিবার এর মাঝে আরো এক দফা দেখে গেছে অরুকে। পান-চিনির তারিখ পরল এ মাসের শেষে । তরু খুব আড়াল করে রেখেছে সে সময়টা নিজেকে। অরুটা কেমন দুর্বোধ্য  হচ্ছে দিন কে দিন। জাবের এর সাথে সহজ হচ্ছে না। ফোনে কথা বলেনা, বাইরে যায় না। এমনকি জাবের বাসা থেকে বাইরে নিতে চাইলেও অরু সরাসরি জানায় , ও সিক, এখন নয়  পরে। বাবা কেমন অপরাধী মুখ করে ঘুরে বেড়ায় ঘর দুয়ার।
(৩)
সকাল থেকে জাবের টেনশনে অস্থির । রাইসার ফোনটা ওকে এলোমেলো করে দিয়েছে। অরু  মেয়েটার সব ঠিক। কেবল মিশতে আপত্তি। এজন্যই তরুকে বিয়ে করতে চাওয়া।  খুঁত সহ বিয়ে করলে সারা জীবন পায়ের নিচে রাখা যেত। মা যত ঝামেলা বাঁধালো। রাইসা অফিসের পরেও যে সময় দেয় তাতে বউটা সোসাইটি আর মায়ের জন্য দরকার ছিলো। অরু মন্দ না। নতুন কিছুর স্বাদ প্রথম প্রথম ভালো লাগে। রাইসা চৌকস খেলোয়াড়। কিন্তু মেয়েটা এখন ডিমান্ড করছে বেশি। একটা মাইকেল কোরস ব্যাগ বা নিউইউর্কের লেটেস্ট লিপস্টিক কালেকশন থেকে নতুন ডিমান্ড নিজেদের ঠিকানা। একটা ফ্ল্যাট চাই এবার।
গাড়িতে উঠে সামনের মিররে চুল ঠিক করতে গিয়ে অরুকে পেছনে একটা ছেলের সাথে বাইক থেকে নামতে দেখে অবাক হয় জাবের। ছেলেটা দারুণ স্মার্ট। শ্যামলা রঙে , কদম ছাঁট চুল সেনাবাহিনীর ইঙ্গিত দিচ্ছে। পেটানো মাসল গুলো টি শার্টের ভাঁজেও প্রকট। দাড়ানোর ভঙ্গি, পরিমিতি বোধের সু বহিঃ প্রকাশ  পদবীতে ‘কর্মকর্তা’ বলে দেয়। এই ছেলে কি করছে অরুর সাথে?
অরু মনি, একটা কাঠগোলাপ কিনে দিলে পড়বে খোঁপায়? এত সুন্দর চুল গুলোতে একটা ফুল গুজলে ক্ষতি নেই। হাত খোঁপা করে নাও তো।
মুহিব এর কথার উত্তরে পেছন ফিরেই অরু দেখে জাবের খুব দ্রুত হেঁটে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।
(৪)
পেনশন ফাইলটা হাতে নিয়ে খুব বিশ্রিভাবে দাঁত খুটাচ্ছে মালেক মিয়া। সামনে বসা মানুষটা এই মুহূর্তে অসহায়। বাকি সব ধাপ ঘুষ ছাড়া পার করে দিলেও তার সাইন ছাড়া কাজ শেষ শেষ হবেনা, পেনশনটাও আটকে যাবে জামশেদ সাহেবের।
স্যার, চা খান এক্টু। বুলবুলি কি ক্ষতি কইরা দিয়া গেল কনতো। কতগুলা বাঘ মরল। বনের ক্ষতি হইল। গাছ গুলান ন্যাড়া কইরা দিয়া গেলো মাতারীডা।
জামশেদ সাহেব মাথা তোলেন। প্রায় এক ঘন্টা হলো এই চেয়ারে বসেছেন তিনি। মালেক ছেলেটা তার বয়সে ছোট। কিন্তু বেয়াদব, অসম্ভব বেয়াদব। মনে মনে একশটা থাপ্পড় দিয়ে দিয়েছেন ওর আঁচিল ওয়ালা ডান গালটায়। এতক্ষণ পর কথা বলল, তাও ঝড় নিয়ে। গলা স্বাভাবিক করে উত্তর দিলেন,
মানুষ ও মারা গেছে মালেক। ঘড় বাড়ি ভেঙে গেছে। ক্ষয়ক্ষতি অনেক। গাছ লাগালে পাওয়া যাবে। মানুষ কোথায় পাবা?
হেহে, স্যার, মরছে তো কুত্তা বিলাই। পয়দা হইয়া যাইবো স্যার। বাঘ ভাল্লুক কি আর পয়দা হইব। কন। ওরা তো জাতীয় সম্পদ আছেল , হেহেহে। আরে স্যার বউ মরলে বউ পাওয়া যায়, কি কন?
পিয়ন দু’কাপ চা নিয়ে ঢুকতে ইশারা করে মালেক ।  ওর সামনে চা দিয়ে পিয়ন ছেলেটা চলে যায়। জামশেদ সাহেব প্রচন্ড অপমানিত বোধ করছেন। টাকাটা তার দরকার, জরুরী ভাবে দরকার। অরুর বিয়ের তারিখ এগিয়ে দিতে চান বেয়াইন সাহেবা।
খুব আদরের মেয়ে তরু। যে মেয়েটা কোনদিন কিছু চায়নি। সেই মেয়েটা নাকি বিসিএস প্রিলিতে চান্স পেয়ে বসে আছে। অথচ তিনি বা রাজিয়া কেউ জানেন না। ভাইবা বোর্ডেও উতরে গেছে। বাকি টার জন্য লাখ দুয়েক টাকা লাগবে। সারাজীবন মেয়েটা স্কলারশীপ নিয়ে পড়েছে। কই বাবা হয়ে, মেয়েকে টাকা দেবেন, তা নয়। মেয়েই টাকা দিয়েছে মাস শেষে বাবার হাতে। রাহেলার জন্য একটা জামদানী শাড়ি কিনতে গিয়ে হাত গুটিয়ে ছিলেন। মেয়েটা তিন হাজার টাকা বের করে দিলো। অজান্তে আসা চোখের পানি মুছে সামনে তাকালে জামশেদ সাহেব।
মালেক কত চাও। বলো, টাকাটা আমার এ সপ্তাহের ভেতর দরকার। বাড়িতে সম্বধ হচ্ছে। মেয়েটার চাকরীর জন্য টাকা লাগবে। একটু সাহায্য করো।
সামনে ঝুঁকে ফিসফিস করে মালেক,
স্যার আপনের কাছে কমই চাইলাম। দুই লাখের নিচে করিনা। সব কুত্তা বিলাই স্যার বুজলেন। আপনে আশি দেন। বাকি বিশ পাওনের পরে । দাওয়াত দিশেন স্যার,  আমি কলামভালো প্রেজেন্ট নিয়া যামু, হেহেহে।
চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়েন জামশেদ সাহেব। এখান থেকে বেরিয়ে তাকে হাঁটতে হবে। তারপর বাস স্ট্যান্ড । রিকসার পথটা হেঁটে যেতে হবে। ছোট ছোট কাজ গুলোতে টাকা বাঁচিয়ে চলার অভ্যাসটা করতে হবে আবার। তিনি এখন বেকার। আচ্ছা ,  বেকার জীবনের শুরুটা আর শেষে পার্থক্য কি? শুরুতে হতাশার সাথে কোথাও না কোথাও চাকরি হয়ে যাবার আশা থাকে, প্রিয়ার উত্তপ্ত ঠোঁটের স্বাদ পাওয়া সোনালী বিকেল থাকে, বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকে। পড়ন্ত বেলায় এই বেকারত্বে কি আছে? একগাদা দায়িত্ব শেষের তাড়নায়,  ভগ্ন শরীর আর সংসার চাপে,  চোখে চশমা চাপানো শুষ্ক ঠোঁটের বউ ছাড়া, যে একটা সময় প্রিয়তমা ছিলো।
সৌন্দর্য আমাকে ডেকেছিলো
প্রাচুর্য আমাকে ডেকেছিল
আমি যাইনি-
তুমি আমাকে ডাকোনি কখনো
আমি শুধু তোমারই কাছে যাবো।
(রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ)
বাসের পথে হাঁটতে গিয়ে কটা লাইন মাথায় ঘুরে জামশেদ সাহেবের। একটা সময় তার জীবনেও ছিলো। দু’হাজার টাকার মাইনে, রাজিয়ার সুতি শাড়ির সাথে দুটো হাতে মেলানো কাঁচের  চুড়ি। বিকেলে একটু দুধ -চা , সাথে বেলা বিস্কুট , পাশের মোড়ায় রাখা রুদ্র-তসলিমার কবিতার বই। তরু কবিতা ভালোবাসে। পুরোন বই গুলো ওরনার শেষ দিয়ে কি যত্ন করেই না মোছে মেয়েটা ।
(৫)
ছোট বোনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম কিনতে গিয়ে অরুর সাথে পরিচয় মুহিবের । কলা ভবন কোন দিকে জিজ্ঞেস করার জন্য ডাকতেই যেন এক রাজকন্যা ঘুরে তাকিয়েছিলো। ছুটিতে আসা ক্যাপ্টেন মুহিব, সুজুকি জিক্সার থামাতে গিয়ে নিজেই থমকে গিয়েছিলো। তারপর সেই ভবনের রাস্তাটা যেন বাকি জীবনের পথ হয়ে উঠল পরের এক ঘন্টা। অভিজাত দর্শনে একটা সামান্য পথ ফুল যার খোঁপায় উঠে নিজেই হয়ে ওঠে পূজোর নৈবদ্য, সেই মেয়েটি কি অবহেলায় ফিরিয়ে দেয় দামী শাড়ি, সোনায় মোড়া উপহার। তার থেকে এক তোড়া গোলাপ, ঢাকাই তাঁতে ছড়ানো রঙে , কাঁচ চুড়ির মায়া মুহিব, অরুকে জড়িয়েছে গোপনে , গভীরে।
আজ এসেছিলো নীলক্ষেতে একটা বইয়ের দোকানে। জন্মদিনের উপহার কি চাই জানতে চাওয়ায় ‘হুমায়ূন সমগ্র’ উত্তর অরুর। একটানে বাইক নিয়ে পেছনে রাজকন্যা বসিয়ে ছুট । ফুলের দোকানে কাঠগোলাপ দেখে দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় এলো। একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রশ্ন করে ভড়কে দিতে চেয়েছিলো অরুকে। সেখানে ভয়ার্ত অরুর মুখ দেখে পেছন ফিরে তাকাল মুহিব।
জাবের ভাই! প্লিজেন্ট সারপ্রাইজ, কি খবর বলেন। কত দিন পর দেখা।
চিনলাম না সরি।
শক্ত মুখে জাবের উত্তর দিলো। চোখ এখনো মুহিবের হাতের দিকে, যে হাতটা শক্ত করে অরু ধরেছে জাবের কে দেখেই।
ক্যাপ্টেন মুহিব। উদ্ভাস এ আপনি পড়াতেন, বুয়েট ৯৭ ব্যাচ ,ট্রিপলই। রাইট।
ওহ্, এক্স স্টুডেন্ট ! সো মাই ডিয়ার, তুমি আমার বাগদত্তা হয়ে এখানে ওর সাথে ?
নার্ভাসনেস কাটাতে  হালকা হাসি ঠোঁটের চারপাশে ঘুরলেও বুকে কাঁপ লাগে ওর মাথা ছাড়ানো,  পাঁচ এগারোর উচ্চতায় সটান সিনায় দাঁড়ানো সেনা-কর্মকর্তার পাথর চোখের সম্ভাষনে।
অরু দম ফিটে পেয়েছে বুকে। লম্বা করে একটা শ্বাস নেয় বুক ভরে। আজকে এই খবিশ লোকটাকে উচিত জবাবটা দেয়া যাবে। হালকা স্বরে জাবের কে জিজ্ঞেস করে,
আপনারা পরিচিত? ভালোই হলো। ও  আমার বয়ফ্রেন্ড। আপনাকে অনেক বার বলতে চেয়েছি। সুযোগ হয়নি। যে ছেলে বড় বোনকে দেখতে এসে ছোট বোনকে পছন্দ করে, তাকে বিয়ে কেন করুনা করাও যায় না। মা বাবার চাপে এই অসম্মানজনক বিয়েতে আমাকে এখনো পর্যন্ত চুপ থাকতে হয়েছে। বাসায় জানিয়ে দেবেন , কণে রাজি নয়। আংটি পাঠিয়ে দেবো। একটা আংটি দিয়ে মানুষ বাঁধা যায়না।
জাবের তার জীবনে এত বড় ধাক্কা এর আগে কখনো খায়নি। দেখতে সে দারুণ সুপুরুষ। ধারণা ছিলো, যে মেয়ে একবার তাকে দেখবে, তার প্রেম চাইবে বাকি জীবন। সেখানে অরুর মত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে এভাবে বলল তাকে?
জিদ চেপে গেলো জাবের এর। এভাবে অপমান মানে তার নিজের সাথে পরিবারের ও অপমান। বিয়ে এই মেয়েকেই করবে। একটা মাস। তারপর গলা ধাক্কা দিয়ে বের করবে বাড়ি থেকে। পয়সা দিলে রাত পিছু এর থেকে বেশী সরস জিনিষ মিলবে। মুহিবের চোয়ালের ফুলে ওঠা খেয়াল করে অরু। পাঞ্চ বসাবে কিনা এই ভয়ে আগে মুহিব কে বাইকে উঠতে বলে। হাত চেপে অরুকে যত্ন করে বসায় মুহিব। তারপর জাবের এর দিকে হাত বাড়ায় ।
আপনার সাথে এভাবে দেখা হবে ভাবিনি। অরুর ইচ্ছে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন আশা করি। ইবংঃ ড়ভ ষঁপশ.
অনিচ্ছা স্বত্তেও হাত ঝাকিয়ে জাবের স্থানুর মত তাকিয়ে থাকে ঝড় তুলে যাওয়া ইয়ামাহা ১৫ ভার্সন -৩ এরদিকে।
ইচ্ছে করেই আজ মুহিবের কোমড় জড়িয়ে বসেছে অরু। এতদিন এই মানুষটাকে নিজের পুরোপুরি ভাবতে চেয়েও বাবা- মা এর কথা ভেবে আড়াল করে রেখেছিলো অনুভূতির পেখমগুলো। আজ ঐ স্টুপিড লোকটা সামনে দাড়াতেই মুহিবের হাত ধরে ফেলল ও। আর একরাশ সাহস এসে ভর করল বুকে। হড়হড় করে কথা বলে বুকটা হাল্কা লাগছে অনেক দিন পর। জ্যামে বাইক থামতে একটা আমড়া কিনে মুখে দেয় । ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের বাসে দিকে তাকিয়ে বরফ জমাট হয়ে যায় মেয়েটা ।
‘বাবা’!
(৬)
ভালবাসি বাবা ভালবাসি
তোমাকে বড্ড ভালবাসি,
বহুদূরে থেকেও বাবা
তোমার কাছে আসি।
তোমাকে বাবা
তোমাকেই ভালোবাসি।
( সুরভী)
বাসায় ফিরে জামশেদ সাহেব কিছু খান নি। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। রাজিয়া একটা প্লেটে ভাত তরকারি নিয়ে গিয়ে ফিরে এসে অপেক্ষা করছে তরুর জন্য। টিউশন সেরে আসলে হয়ত মেয়েটা খাওয়াতে পারে বাবাকে। বাসার সামনে মটর সাইকেলের আওয়াজে জানালার কাছে উঠে গেলেন রাজিয়া। এ বাসাটা আর একমাস। সরকারী কর্মচারী কোয়াটার থেকে চলে যেতে হবে। মোহাম্মাদপুর এর দুই কামরার একটা বাসা ঠিক করে এসছেন। অরুর বিয়েতে ঘরের ফার্নিচার পলিশ করে আপাতত দিয়ে দেবেন। মাগরিবের আজানে মাথায় কাপড় তুলে বাসায় ফিরে অরু। বাবার  রুমে ঢুকে জামশেদ সাহেবের মাথায় হাত রাখে অরু।
জাবের ফোন করেছিলো। কাল ওরা আসবে। তুমি কোথায় কি করে বেড়াও আমি জানিনা। আমার সম্মান নিয়ে খেলো না অরু। চাইলে তোমাদের সোনার চামুচ মিখে দিয়ে রাখতে পারতাম। কখনো অসৎ পথে চলিনি। হারাম খাইনি। তোমাদের ও খাওয়াই নি।।
এক মুহূর্ত থমকে যায় অরু। বাবার জন্য খারাপ লাগছে। জীবনে এই প্রথম বাবার মুখে মুখে কথা বলে।
বাবা, এই বিয়ে না হলে কি হবে? আপার চাকরি হয়ে যাবে, আমি টিউশনি করছি। একটা পার্টটাইম চাকরি খুঁজে নেব। যে লোকটা আপাকে দেখে , সবটা জেনে আগালো, বাড়ি এসে তার আমাকে পছন্দ হয়ে গেলো। এমন মানুষের সাথে সারাজীবন সংসার করার থেকে বিয়ে না করা ভালো।
চমকে  তাকিয়ে থাকেন জামশেদ সাহেব। তার নিজের মনের ভেতর ঘুরতে থাকা কথা গুলো তার আত্মজার মুখে। কিন্তু রাজিয়াকে কি করে বোঝাবেন ? সমাজ- সংসার? বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে মুখ খোলে অরু।
ওর নাম মুহিব। ক্যাপ্টেন, বাবা সরকারী কলেজের শিক্ষক। আমার সাথে চেনাজানা বছর দুয়েক বাবা। যদি বিয়ে করতে হয় , আপার বিয়ের পর করব। আমার মতের সাথে মুহিব সমর্থন দিয়েছে। অপেক্ষা করব আমরা। জাবের কে তুমি না করে দাও। বিয়ের জন্য সামাজিকতা নয় বাবা, মানুষ দরকার হয়। সারাটা জীবন পাশে থেকে সম্মান- শ্রদ্ধায় একে অপরের হাত ধরে থাকার মানুষ। জাবের এর মধ্যে অন্যকে সম্মান দেবার চাইতে আদায় করে নেবার ইচ্ছেটাই বেশি।
বিছানা থেকে নেমে মাথা তুলে মেয়ের দিকে তাকান জামশেদ সাহেব। মেয়ে নয় সন্তান। তার দুটো যোগ্য সন্তান রয়েছে। আর চিন্তা করবেন না তিনি। বাবা হিসেবে গর্বে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন। সকালে রাজিয়াকে বোঝাতে হবে, কেবল ওকে নিয়েই ভয়। মা হয়ে দুটো মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাবার দায় নিতে পারবে তো রাজিয়া?
(৭)
হবু বেয়ানের মোটা মোটা ফর্সা হাতে পেচিয়ে থাকা সোনার রুলি দুটোর দিকে তাকাতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে রাজিয়ার। ঠিক একই রকম দুটো চুড়ি দিয়ে তাকে ঘরে তুলেছিলেন জামশেদ এর মা। সব সময় হাতে পরে থাকতেন। কত দিন গেছে জামশেদ সাহেব বকুল ফুলের মালা এনে হাতে জড়িয়ে চুমু  খেয়েছেন। সেই রুলি গুলোও অসুখের সময় বিক্রি করে হাসপাতালের বিল মিটিয়েছেন। অত শত ভেবে ই লজ্জা পেলেন রাজিয়া। বয়স হয়েছে। এসব ভাবা  মানায় না তার। সামনে মেয়ের হবু শাশুড়ি বসে আছে। সাত সকালে হুট করেই হাজির হয়েছেন বাড়িতে।।
সিমকি খান খুব বিরক্ত হয়ে আজকে এসেছেন। বিজনেস টা খান সাহেবের এক নাম্বার পথে যতটা না ভালো চলে, দুই নাম্বারে তার থেকে ফায়দা বেশী হয়। জাবের ছোট বেলা থেকে ডেসপারেট। ক্লাস এইটে একটা মেয়ের গায়ের জামায় লাল রঙ ঢেলে দিয়ে দিলো। ভালো ছাত্র আর ওর বাবার ডোনেশনে স্কুলের ফান্ড বাড়ে বলে, পার পেয়েছে। ইন্টারে পড়ার সময় তো সাথের মেয়েকে নিয়ে ঘুরে এসেছিলো সিলেট থেকে। সে কি কেলেংকারী কান্ড। থানা – পুলিশ মেয়ের বাবা, কলেজের বাকি গার্জেন,  উফ্। এখন বিয়ে দিতে গিয়েও ঝামেলা বেঁধেছে।
জাবেরের জিদ একটু কম অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে বিয়ে করবে। কিন্তু সেখানেও শর্ত জুড়েছে, খুঁত সহ হলেও চলবে। তরুকে ও পছন্দ ছিলো সিমকির।  কিন্তু অরুকে দেখে চোখ ফেরাতে পারলেন না। তার উপর তরুর হাতের খুঁতটা মনে খচখচ করছিলো। অরুকে বিয়ে করলে, অমন নিঁখুত একটা সুন্দর মেয়ের টানে জাবের হয়ত ঘরে বসবে। অফিসের মেয়েগুলো কে বাসায় নিয়ে আসে মাঝে মাঝে জাবের। ছেলেকে মেধাবী করে গড়ে তুলেছেন ঠিক কিন্তু চরিত্রের জায়গাটা পঁচে গেছে। আজকে ছেলের ভয়ে এখানে…
আপা, চেনেন নাকি এগুলো? রুলি বুঝলেন? জাবের এর বাবা বানিয়ে দিয়েছে। উনি চায় সব সময় আমি সাজগোজ করে থাকি। বয়স হয়েছে তো বলুন? এখন কি মানায়? এখন আমাদের এসব ছেলের বউ পরবে। অরু সোনায় মোড়া থাকবে, বুঝলেন তো। আমার ছেলের বউ হলে আপনার মেয়ের রাজ কপাল হবে। এমন ছেলে আর কোথা পাবেন বলেন? সবাই খোঁজে সমান সমান বংশে। তা আমার ছেলে আর শুনলো কই। জেদ, এমন মেয়ে বিয়ে করবে, যাকে ও গড়ে নিবে। অরুকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছিলাম। বুঝলেন তো! আপনার মেয়ের রাজ কপাল, বুঝলেন তো আপা। এই রুলি গুলাও ওকে দিবো। আমার অনেক আছে। মেয়েরটা আপনি একটু পরে দেখলেন, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো কি আর হবে।
রাজিয়া বেগমের কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। এমন মহিলার ঘরে মেয়ে বিয়ে দিতে মন সায় দিচ্ছে না তবু, সমাজ বদলেছে। ছেলেটা বেশ ভদ্র। তরুকেই পছন্দ করেছিলো। কিন্তু মায়ের পছন্দের উপর কিছু বলতে পারেনি। তাই রান্নাঘরে এসে রাজিয়ার হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে ওয়াদা করেছে, এর থেকেও ভালো বংশে, ভালো ছেলে খুঁজে তরুর বিয়ে দেবে। ছোট বোনজামাই না, বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করবে। রাজিয়া বেগম কেঁদে ফেলেছিলেন জাবের এর কথা শুনে। এমন সোনার টুকরো ছেলের মায়ের একটু গর্ব থাকবেই। অরু সুখী হবে।
আম্মা, আমার ধানী সবুজ শাড়িটা কই? লন্ড্রি বাড়ি আনাও নাই?  আপা পরেছিলো ঐ দিন, ঐ যে জাবের নালায়েকটা দেখতে এসছিলো। কই তুমি?
এসব কি কথা আপা? এই মেয়ে এই, আমার জাবের কে কোন সাহসে তুমি নালায়েক বললা। তোমার দেখি দেমাগে মাটিতে  পা পরে না। জাবের এর মত ছেলে লাখ টাকা দিলেও তো কিনতে পারবে না তোমার ফকিরা বাপ। খুঁতালা বোনকে গলায় ঝুলাতে চেয়েছে তোমার মা। আমার সোনার টুকরো ছেলে,  বোকা সোকা। কিছু না বুঝেই রাজি হয়ে গেছে। আরে তোমার সাত জন্মের ভাগ্য আমার বাড়ির বউ হবা। বলেছে তো জাবের আমাকে, কোথাকার কোন ছেলের কল্লা ধরে চলাফেরা করো, তোমার আবার এত তেজ। ছেলে জিদ না করলে, তোমার মত মেয়েকে বাড়ির চাকরানী ও রাখব না আমি।
আপা, কি বলেন এই সব। এই অরু, তোর হাতের আংটি কই?
আম্মা, তোমার গায়ে চামড়া আছে? নাকি মোমের পালিশ করা। ছুরি আনব? চেঁছে দেখবা, এত অপমানের পরেও আমার হাতে আংটি আছে না নাই খুঁজতেছো? এই বেটি এই ওঠ, এখনি ওঠ তুই, আর এক মিনিট তুই থাকলে তোরে খুন করে ফেলব কিন্তু। আমি তরুপা না। অত নরম মনের না আমি। আম্মার মুখের দিকে তাকায়ে বসব আর উঠব।
আপা,  মেয়ে সামলান, এই মেয়েকে জাবের বিয়ে করবে? এত বেয়াদব।
অরু, আংটি নিয়ে আয়। এনার মিষ্টির প্যাকেটে আংটি ঢুকায় দিয়ে বাইরে রেখে দে,  মা। এটা গেলে দরজা বন্ধ করে ভালো করে চার কাপ চা বানা দেখি। তোর তানপুরাটা নিয়ে আয়। অনেক দিন তোদের দুই বোনের গান শুনি না।  বিয়ে আল্লাহর হাতে। যখন হবার হবে, না হলো হবে না। তবু এই খাড়ুস বজ্জাত মহিলার জিদ্দি ছেলের গলায় তোরে আমি ঝুলাবো নারে মা।
চেঁচামেচিতে জামশেদ সাহেব, তরু ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। খুব অবাক হয়ে স্ত্রীকে দেখছেন তিনি। তরু বেশ কয় বার ওড়না দিয়ে চোখ মুছে ফেলেছে। আম্মার এই রূপটা তাদের দুবোনের বিয়ের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস, জাবের অরুটাকে পছন্দ করেছিলো। অত গুলো কথা অরুর পক্ষেই বলা সম্ভব। মনে মনে বোনটাকে আদর দিয়ে অরু আর তরু পাশাপাশি দাঁড়ায়। এবার নিশ্চিত,  ভালো কিছু দেবেন উপর ওয়ালা। শত দুঃখের পর নিরবিচ্ছিন্ন সুখ আসে, কথাটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে শুকরিয়া জানায় তরু তাঁর দরবারে। জামশেদ সাহেব অলক্ষে একই দুয়া করেছেন। তার হয়ত টাকা নেই। সামাজিক মর্যাদায় বিশাল কেউ নন। তার সন্তানেরা তার মাথা উঁচু করে দিয়েছে সবসময়। পিতা মাতা হিসেবে আজ সার্থক তারা।
(৮)
বৃষ্টি আসুক, উঠুক তুমুল বাতাস।
তার কথা, তার মুখ ধুয়ে দিয়ে যাক।
বেদনার গাছটির একই ধড়ে দশ মাথা।
মনের ক্ষতে রয়ে যাক গাঁথা।
আগুন পারেনি মেটাতে সে দ্বিধা,
কলঙ্কমোচন বনবাসে বাঁধা।।
( ফুয়াদ স্বনম)
সন্ধ্যের মুখে ঝমঝম আকাশ ভাঙা মেঘ তুফান। দৌড়ে রিক্সা ধরতে গিয়ে রিয়াদ খেয়াল করে রিকসায় উঠে বসেছে তরু।পাশে ফিরতেই দেখে রিয়াদ হতবাক মুখে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে বোকার মত। রিয়াদের সম্পর্কে ওর খালা আম্মার কাছে বলে,  তরুর হাত চেয়েছেন। তরুই সময় চেয়েছে। চাকরী টা হয়ে গেলে তারপর বাকি সব কিছু ভাববে। রিয়াদ  এর মাঝে দেখা করতে বাড়ি এসেছিলো। খুব লাজুক আর ভদ্র গোছের মানুষ। অরু একগাদা হাসাহাসি করে নাস্তানাবুদ করেছে লোকটাকে। ভদ্র ভাবে বসে থেকে, যাবার সময় তরুর জন্য এক জোড়া পায়েল দিয়ে গেছে। সাত পাঁচ না ভেবেই রিয়াদকে ডেকে বসে তরু,
আসুন, ভীষণ বৃষ্টি। আমি,আপনি একদিকেই যাবো। অনেক কষ্টে এই ভাই যেতে রাজি হয়েছেন।
একছুটে রিক্সায় বসে হুড তুলে দেয় রিয়াদ । এক আকাশ মেঘে  ঢাকা যখন বাকি পৃথিবীর সব, ভেজা তেরপলে দুটো অভিন্ন মানুষের একে অপরের নির্বাক দৃষ্টি সবাক হয়ে ওঠে। ভারী অথচ শান্ত স্বরে রিয়াদ বলে যায়থ
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব–
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।।
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার।
শ্রাবণ বরিষনে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার।।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তরুর সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে। যে মানুষের অপেক্ষায় এতটা বসন্ত একলা কেটে গেছে, তাকে মিলিয়ে দিলেন সৃষ্টিকর্তা , সত্যিকারে আজ এভাবে! এ মানুষ ঠকাতে জানে না। ঠকে যায়, তার মতই। একে নির্ভয়ে মন দেয়া যায়। ঘরে বাঁধা পরতে চায় এ পুরুষ, একে ভালোবাসা যায়। যে পুরুষ একবুক ভালোবাসা নিয়ে বসে আছে কেবল দুটো মসৃণ কোমল হাতের আশায় , তাকে নিরদ্বিধায় বলা যায় – “ভালোবাসি” । রিয়াদের বাড়ানো হাত ধরে তরু হুড খোলে রিকসার। দুটো মানুষের শুভক্ষণে লজ্জা ফেলে জড়তা জড়ানো কন্ঠে একত্রে বলে যায়থ
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়–
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।।
দুটো মানব -মানবীর জীবনে ফিরে আসা শরৎ দিনে বৃষ্টি যেন সৃষ্টিকর্তার অবিশ্রান্ত করুণা হয়ে ঝড়তে থাকে। মুহিবের মায়ের ফোনটা রাজিয়ার বুকের পাথর নামিয়ে দেয়। সত্য মেনে সৎ পথে চলা গুটি কয়েক মানুষ আজ অবারিত সুখে ভাসবে।  অরুর বুকের ভালোবাসার ঝড়ে ধরাসায়ী মুহিব রওয়ানা দেবে দেশমাত্রিকা রক্ষার। প্রতিজ্ঞায়।
বুক পকেটে একটা কাঠগোলাপ কারো শরীরের গন্ধে, চুলের মায়ায় ভালোবাসার কথা বলে যাবে। আর বৃষ্টি !! সে কবিতা হয়ে, গান হয়ে ঝড়ুক তরুর আকাশে। বহুদিন পর আর অকাল শ্রাবণ শেষে উঠুক না হয় একটা পূর্ণিমা চাঁদ তাদের আকাশ জুড়ে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।