প্রবাসী মেলবন্ধনে সিফাত হালিম (ভিয়েনা, অষ্ট্রিয়া)

খন্ড কাব্য *চব্বিশ ঘণ্টা*

সে একা ঘন্টার বেশি চলন্ত ট্রেনের একটা কামরায়,
আসনে বসে বসে ঘুমাচ্ছিল,
ভাবছিল, জুড়ছিল, ভাঙছিল, চোখ মেলছিল,
আবার বুজে আসছিল আপনিই।
তার বুকে মাথায় অহরহ যন্ত্রণা,
চোখে জ্বালা, মন অস্হির।
কাশিটা বেদম বেড়েছে,
চোখ বন্ধ রেখেও সে ঘুমাতে পারে না।
এইমাত্র আরেকজন উঠে এসে বসলো, মুখোমুখি আসন।
একেবারে পরিচিত গায়ের গন্ধ অকস্মাৎ,
স্নায়ুর মধ্য বিস্ফোরণ।
অনেক সময় আশ্চর্য রকমের যেন,
অস্বাভাবিক ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়।
যেভাবে সক্কলে চলন্ত গাড়ির অপরিচিত সহযাত্রী,
একজন আরেকজনকে দেখে, তাকায়,
সেও সেইভাবে শান্ত চোখে দেখে।
ঢিমে আলোর নীচে টকটকা গোলাপী ফর্সা,
সুন্দর মুখখানিতে কিছু বয়সের আঁচড়,
ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে আজও।
ঝটকা লেগে সে নড়েচড়ে উঠলো।
ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণীর কুপে,
নামে ফাটাফাটি দ্বিতীয় শ্রেণী, অবস্হা তথৈবৈচ।
অধিকাংশ বগিতে কাঠের সীট আছে,
উপরের গদি নেই।
মাথার ওপরকার পাখা ঘুরেনা,
এখানে যা টিমটিম করে জ্বলছে আলো,
পাশের বগিতে বুঝি আলো নেই, অন্ধকার।
দু’বগির মাঝখানে একটাই বাথরুম,
অপরিষ্কার নোংরা,
কখনই পরিমাণ মতো জল আসেনা।
আসনে বসতে না বসতেই নবাগতা কথা বললো অস্ফুট,
—-আজ ট্রেনের গতি বড়ো দ্রুত। একটু হলেই ফসকে গেছিল আর কি।
সে তড়িঘড়ি জবাব দিল,
—–দূরপাল্লা হিসেবে গতি ঠিক আছে।
আমাদের সময়টা এখন এমনই দ্রুত গড়ায়।
সেইসঙ্গে অনভ্যাস, ঘড়ির কাঁটা সঠিক দেখতে ভুল করার।
নবাগতা সঙ্কোচে বললো,
—–হু, তা হতে পারে । বয়স একেবারে ফ্যালনা না।
—–হতে পারে নয়, তাই হয়েছে। বয়স লোকের শত্রু। তোমার লেন্সটা পুরনো, বদলানো দরকার।
অনেক দিনের আন্তরিক সখ্যতা, এরকম একসঙ্গে হেসে উঠলো দুজনে।
মুখদুটো পরিষ্কার দেখায় না,
দুই বুড়ো বুড়ি, বয়স ভারির দিকে,
দুজনেরি চোখে পুরু লেন্সের চশমা।
পূর্ব পরিচিত ডঙে দুজনার কথার আদান প্রদান শুরু হয় ।
—-এই ট্রেনের বগি জুড়ে সর্বক্ষণ থাকে, শ্রমিক আর কুলিকামিনীদের বিশাল জনসমুদ্র। তাতে নারী পুরুষের প্রভেদ বোঝা গেলেও কে শ্রমিক আর কে সাহেব বেছে আলাদা করা অসম্ভব। গ্যেটে বাত, কোমর হাঁটু পিঠের ব্যথা নিয়ে প্রায়ই প্যাসেঞ্জারি করি, ভিড়ভাট্টা টপকে ইঞ্চি ইঞ্চি ঠেলেঠুলে যাওবা দাঁড়াবার জায়গা পাই। কিন্তু বসা যায় কিভাবে ? বয়স্কা আর মহিলা বলে দুই একজন সমীহ করে সীট ছেড়ে দেয়।
—– হ্যাঁ । তার উপরে সুন্দরী বলে কথা। তুমি এই বয়সেও তেমন আছো। কোনো পরিবর্তন হয়নি । আকস্মিক তোমায় দেখে খুব ভালো লাগলো। আছো কেমন?
বুড়ি আনমনা, শুনলো না?
—–বড়ো ট্রেন। গাড়িতে চড়ে আজকের মতো এরকম উজাড় দৃশ্য দেখব, অবাক কান্ড। গোটা পঞ্চাশেক প্যাসেঞ্জার বলে মনেহলো। কিংবা তার চাইতে কম। হঠাৎ এমন যাত্রীর আকাল কেন? ওইদিকে কারখানার বোধহয় ধর্মঘট। জানলেন শুনলেন কিছু?
——শিল্পাঞ্চলে লকআউট, ধর্মঘট মালিক শ্রমিকের প্রাত্যহিক রুটিন। হরহামেশা দাবিদাওয়া নিয়ে মাথামোটা শ্রমিকেরা যা করে। আজকেও তাই। বন্ধ ঘোষণা দিয়ে পিকেটিং শুরু করেছে। শ্রমিকস্রোত ঠেকাতে পুলিশও জোর সাঁতার কাটছে দেখে এলাম পিছনে।
—— হুঁ, তা যা বলেছেন। আপনি তবে অনেকক্ষণ।
—–এই নিয়ে দুইবার শুধলাম, তুমি ভালো আছো? শরীর গতিক ঠিক আছে?
—–ভালোই তো,,,, আর থাকা, না থাকার চাইতে অনেক বেশি টিকে যাচ্ছি। ও মশাই, আপনার ব্যাপারটা কি বলুন তো, হঠাৎ এইসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন? তুমি তুমি করে ডাকছেন? সঙ্কোচ হয়না। আপনিই বা কে?
—–আপনি আপনি করে কি মন ভরে? পরিচয় দেব। হাতে সময় আছে, দীর্ঘ অবসর। তুমি সর্বাঙ্গ সুন্দরী একলা সহযাত্রী । সমস্ত মানুষ থেকে আলাদা।
বয়সী শীতের দেহ মন। বেপরোয়া উষ্ণ রোমান্টিক হয়ে ওঠে।
—–বুঝলুম কাব্য রসিক। কাব্যিক কথাবার্তা বলেন। যাহোক, এখানে আরও কিছুক্ষণ আছেন নিশ্চয়ই? আমি অনেক দূরের পথে যাবো, গন্তব্য শেষের স্টেশন।
তা ধরেন ঠিক ঠিক চব্বিশ ঘন্টার পথ। আপনার?
——দেখো দেখি কি চমৎকার, যাকে বলে শুভযোগ। আমিও একই দিকের যাত্রী, যাত্রা বিরতিও একখানে। তোমার কয়েক স্টেশন আগ দিয়ে উঠেছি। গাড়িতে হলো ঘন্টা তিন । অপূর্ণতার জ্বালা জুড়োতে ছুটছিলাম।
—-একা একা পাক্কা চব্বিশ ঘন্টার লম্বা ভ্রমণ। কতকক্ষণ মুখ বুজে থাকি। কি করা যায় বলুন তো ?
—–একা ভ্রমণের মধ্যে আনন্দ লুকানো আছে। একটুক্ষণ একাই যাঁরা চলেছেন তাঁরাই বলবেন কথাটা।
—–উঁহু আমার কাছে মোটেও তা না।
—–আমি পারছি কি করে?
—–আমি বাপু বিপরীত। কথা ছাড়া থাকতে পারিনে। দেখুন না কেমন বকবক করি।
—-সে তোমার বিশেষত্ব। কথা শুনতে আমার আপত্তি নেই বরং ভালো লাগছে। বুকের মধ্যে মৃত্যু। একেকদিন একেকরকম সাধ হয়। সে যাক, অনেককাল মুক্ত স্বাধীন বসে হাসি-ঠাট্টা, গল্প হয় না। এক কামরায় বসেছি। চলো গল্পগুজব করতে করতে এগোই।
—-যাক বাঁচালেন। আপনি তবে রাগী কিংবা রাশভারি নন। আশাকরি আমাদের সময়টা ভালোই কাটবে।
—- তুমি,,,,, তুমি করে বলো। যখন দুইজন একই পথের পথিক। এইযা আমার এখনও নামটাই বলা হয়নি। আর নাম না জানলে কথা বা গল্প করতে মজা নেই তেমন। আমি,,,,,,
—-না বাবা না। এইমাত্র আলাপ। ফট করে অল্পে অচেনা কাউকে তুমি বা নাম ধরে ডাকার অনভ্যাস আছে। নাম জেনে কথা খরচার দরকার কি? শুধু গল্প করেন ।
বুড়ো নিরাশ হয় । মনেমনে ভাবে, কী বেওকুফ। আমায় এখনও চিনলো না।
—— কিন্তু আমি বললাম ।
—–ডাকতে পারেন। সেটা আপনার অভ্যাস, বুঝ, দয়া বা কৃপা। তাছাড়া বয়স আনুমানিক আমার কিছু কমই হবে।
—–বুঝ, দয়া ও কৃপা এইসব বাদেও কথা বলা যায় শ্রুতি।
—–বাহবা ম্যাজিক নাকি? আমার নাম জানেন?
বুড়ো উচ্ছ্বাস করে,
——তোমার স্যুটকেসের গায় পরিস্কার অক্ষরে নামটা লেখা রয়েছে। অমনি মনেহলো নাম শ্রুতি হবে। আন্দাজে ঢিল ছোড়া। লেগে গেছে। আজকে আমার দিন ভালো।
—– আপনি খুবই অসুস্থ ? লক্ষ্য করছি অনবরত কাঁশছেন। এভাবের শরীর নিয়ে এতো দূরের পথে ভ্রমণ,,,, একেবারেই অনুচিত। ঠিক হয়নি।
—–কী করব ? যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।
—–একলা বেরুলেন যে। কাউকে আনেননি সঙ্গে?
—– প্রয়োজনটা ব্যাক্তিগত। বেশি দূরের পথ তো না। একদিনের ভ্রমণ । আর বুকটাতে কষ্ট ব্যথা অনেকদিনের পুরনো।
—– বুকের মধ্যে কিসের ব্যথা ? ডাক্তার করান না কেন?
—–এ ব্যথা উপশম করা ডাক্তারের কর্ম না।
—–বিয়ে করেননি?
—–তেমন ইচ্ছে হয়নি কখনো।
—–স্ত্রী না থাকলে কি যত্ন হয়? কেউ বলেনা?
——প্রথম ভালোবাসা ভোরের ফোটা প্রথম ফুলের মতো। রৌদ্র ওঠার আগেই ঝরে পড়ে। একজনকে মনে ধরেছিল, ভালোবাসলাম। তারপরে আর সময় পাইনি।
—–গ্রেট। গল্পের প্লট খুঁজে পাওয়া গেল। জীবন একটা নদী। প্রেম নদীর নৌকা। যার যৌবন হচ্ছে জোয়ারের জল। যৌবনে প্রেমের নৌকা বায়নি এমন লোক কম আছে। আসুন যেতে যেতে গল্পটা করা যাক। সময় কেটে যাবে ।
—- সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় এসে গেলে। বিষয়টা ঠিক করো?
—–আপনার অতীত। আমাদের প্রত্যেকের নেপথ্যে একটা অতীত থাকে। একদিন বয়স যখন কম ছিল। আপনার যৌবনের সেইসব শ্রেষ্ঠ দিন। যুবক জীবনের ভালোলাগা ভালোবাসার গল্প।
—–কথাটা আসলে সেইদিন সত্য নয়। আজকেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠদিন। কে বলবে প্রথম, তুমি?
—–বোকা গবেটরা প্রেমে পড়ে । আমার সেই দিনগুলোর কথা এখন আর মনে নেই।
—– মনে নেই না মনে করতে চাওনা?
—– আমাদের যুগে ঐসব ভাবাই যেত না। মনেমনে হয়ে থাকলে হয়েছিল একটা। আর মেয়েদের মুখে প্রকাশ,,,,,, ক্ষমা করবেন। বিরাট অপারগতা। তার চেয়ে আপনার কথা শোনান। কেন বাঁধা পড়লেন না?
—– অন্ধকার রাত কেউ কাছে রাখতে চায়না। ঠেলে দেয়। তোমার দুইহাত ভর্তি অঢেল দয়া। কি বুঝ দেখো, তুমি শুনতে চাইছো। যা বললে ততটাই আমার জন্য ঢের। আমি বলবো।
——সে আপনাকে ভালোবাসেনি?
—–হু, তা হতে পারে। তবে আমি বাসতাম। প্রত্যাখ্যাত হবার ভয় ছিল।
—–ওহ্হো একতরফা প্রেম।
—–সেটাই তো দুঃখ। দু’তরফার সুযোগ কোথায়? ও আমার বুকের ভাবনার কথা জানলোই না ।
—–ইন্টারেস্টিং। আপনি অনেক মজার লোক। এই বয়সেও মজা করে কথা বলছেন। এরকম ভালোবাসা হয়?
—-হয়তো। আমার সেটাই হয়েছিল। তাইতো ওর টানে ঝটিতে ট্রেনে চেপে বসলাম । তোমাকে বলা হয়নি। লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে আমি ওর কাছেই যাচ্ছি। কতকাল টানবো বেহায়া যৌবনের দায়। ভালোবাসি কথাটা এবারে বলব।
—–তাই নাকি? এতখানি আকর্ষণ?
—— আরও শুনলে অবাক হবে। বছর ত্রিশ আগের ও বিবাহিতা। অবস্থাপন্ন ঘর, স্বামী বর্তমান। ছেলেপুলে ভরা সংসার।
—–সে বিবাহিতা?
—–হ্যাঁ।
—– অনেক জটিল রহস্যময় কাহিনী আপনার মশাই। আবার সেই বয়সের কথা বলতে হয়। পড়ন্ত বয়সী কোনো মেয়ের আপনার কথা শুনতে ভালো লাগবে? উপভোগ সম্ভব?
—— শুনবে,,,, শুনবে,,,,,, ইতোমধ্যেই শুনতে শুরু করেছে।
—–কিভাবে? পাগল টাগল নন তো। আমাদের আশেপাশে কেউই নেই।
—– পাখা কেটে ওড়ার চেষ্টা করা বৃথা।
—– আপনার সাহস অনেক বেশি। আত্মীয় কুটুম্বের সম্পর্কে নেই। ওই বাড়িতে লোকজন আপনাকে চেনে না। পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে শাস্তি দিল। হেস্তনেস্ত করতে যা – তা আখ্যা দিয়ে বসতে পারে ।
—–দিলে দেবে। সেটা লোকের ব্যাপার।
—–ধরুন স্বয়ং সেই যদি আপনাকে না চেনে? গোল বাঁধিয়ে দেয়? সবার সামনে অধিকারহীন আলাপ। ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিল তখন?
——নিশ্চয়ই ব্যথা পাবো। ও আমায় চিনলো না। কিন্তু ঘেন্না করবার উপায় নেই ওর।
—-সে কি? কেন? আপনার কাহিনীতে চমক আছে। অতি রোমাঞ্চকর।
—– ঘেন্না পাবার মতো কোনো কাজ করেছি এই পর্যন্ত। অভুক্ত সমর্থ একটা পুরুষ, সামনে একটা সুন্দরী রমনী। একা একা একান্ত দুজন। অন্ধকার কুপেতে একলা । কোনরকম প্রস্তাব,,,,, বাজে কাজ,,,,, জোর করে অসভ্য খুঁনসুটি করেছি? চিৎকার করে ডাকলেও কেউই এখানে আসবে না যখন।
—–না তা করেননি। তবে কোথাকার কোন শ্রুতিকে টেনে আমার মধ্যে গুলিয়ে স্ফুর্তি আরম্ভ করলেন। আমি আর সে এক হলাম?
—–সেই একই কথা। পুরুষের রক্তে বদদোষ। শরীর জন্মায় প্রেম নিয়ে। কে বা কি দেখেনা। ও তোমার বয়সের সুন্দরী রমনী। তোমার মতই কপালে লাল টিপ পরে। লাল টিপে ওকে অসাধারণ দেখায়। আমি জ্বলে উঠি।
—–আপনি বড্ড ভাবের রসে মজেছেন। এইই আমি টিপ খুললাম ।
—– তোমাকে দেখে খিদেটা বাড়লো। নিশুতি মাঝরাত। ধরো ওকে মনে করে অঘটন একটা কোনপ্রকারে ঘটিয়ে দেই যদি? সামান্য কিছু পেলে আমার হবে।
—–আরে ছিঃ এসব কি বলছেন। আবোল তাবোল খিস্তি খেউড়।
—–ছিঃ, বলো বলো। উত্তেজনা আর অভিমান অভিব্যক্তি তোমার পাতলা ঠোঁটে ভালো ফোটে। বাতাসের দোলায় দুলে উঠলো। সবই যদি’র কথা ।
—–যদি’র কথা নদীতে ভেসে যাক। আপনার সঙ্গে গোঁড়াতেই ভুল হয়েছে কথা বলা।
—–তোমায় আঘাত করলাম?
—–না। তবে শঙ্কা ছিল। এখন ঠিক আছি। এমন অদ্ভুত কাহিনী জীবনে শুনিনি। অবিশ্বাস্য ।
——বোধহয় তাই। এরই জন্য বলতে চাইনা।
—–আমি শুনতে চাই। আপনার বেনিফিট কি?
—–নিজেকে আবিষ্কার করার সাধনা। আমি খুবই নিরীহ পরিচ্ছন্ন ভদ্রলোক। আমার কোথাও কুটো ময়লা নেই। অন্ততঃ পরিচিতরা তাই জানেন। আমি তোমাকে জোর করে ধরে আনিনি। তুমি যদি অন্য কোথাও বসতে তাহলে কি আমার কথা শুনতে পেতে। আমি স্বাভাবিক কথা বললাম । তোমার কি ক্ষতি? আপত্তি খোঁজো।
——রাগ করলেন?
——তোমাকে কেন বলব?
—–আহা। যার কপালে যেখানে বসার আছে, সে সেখানেই বসবে। আমি আমার সীটে বসে আছি। আপনি নিজেই অনেকখানি অস্বাভাবিক মতের লোক। বোধহয় মাথাতে কোনো সমস্যা আছে। ওই সমস্ত পাগলের মত বকবেন না । আপনি কোনো পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসছেন কি?
—–তোমার এই কথাটা তাজা সত্যি। পালিয়ে এসছি। আমি পাবনার পাগল। একনাগাড়ে ত্রিশ বছর জেগে কাটালাম।
—–ও মাগো, পাগল। আমার গা শিউরে উঠলো। আপনি তবে ভয়ানক লোক। আমি প্রথমে এমনটাই আশঙ্কা করেছিলাম। উস্কোখুস্কো কাঁধছাড়া চুল, মুখে আকামানো দাঁড়ি গোঁফ, পরনে ধুলোমলিন শার্ট প্যান্ট, চটের ঝোলা সঙ্গে। দেখতে একদম পাগল ।
—– এতক্ষণে বুঝলে। পাগলদের সঙ্গে মিশে থাকতে থাকতে আর মানুষ নেই। তবে সেরকম ভয় পাবার কিছু নেই। আমি তোমাকে আটকাবো না। একসঙ্গে বেশ কয়েক ঘন্টা কাটলো।আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। তারপর তো দুজন দুদিকে। মানে আমরা যে যার পথে। তাছাড়া এই বগির সাথেই গার্ডের ঘর। পুলিশের লোকও আছে। আমি ইতোপূর্বে দেখে নিয়েছি। পাগলামি বা খারাপ কিছু দেখলে আমাকে ধরিয়ে দিতে পারো। সহজ সমাধান। আশ্বস্ত হও।
——আশ্বাস দিলেন। আপনি যাই বলুন, ভীষণ ভয় পেয়ে গেছি। এখনও আমার খুব খারাপ লাগছে।
—–আমি তাহলে পাশের ওই বগিতে গিয়ে বসিগে।
বুড়োটা যেতে উদ্যত হয়।
বুড়ি শেষটায় আর্তনাদ করে বললো, না না আপনি যাবেন না দয়া করে। কথাটা বলে ফেললাম। ভালো মন্দ যাহোক মানুষ তো। একলা একটা কামরায় আমাকে ফেলে যাবেন না । ভয়ে আমি মারা যাবো।
—– এইই বসলাম।
—–আমি খুব খুশি।
—–কারণ?
—–কথা রাখলেন।
—–তুমি যেন নিশ্চিত হয়ে আছো ও আমাকে ঘেন্না করবে? আদৌ কি তাই?
—–কথাটা মনে রেখেছেন।
—–আমি পাগল সুতরাং,,,, ।
——ঘাট মানছি, বোঝার ভুল। চেহারার হাল যা , এইভাবে কেউ পথে ঘাটে বেরোয়?
——আহ্হা তুমি বলোই না । ওই কথা তুলে তোমাকে আর দাগা দেবনা।
—–আপনি বললেন ওর ঘর আছে। মন ও দেহ ভাগাভাগির একটা মানুষ আছে। হয়তো সহায় সম্পদের মালিক। কোনদিকে অভাব বোধ নাই। তাই ভাবলাম।
—–অতোশতো কি, শোনা কথা। ওকে দেখে আমারও একখানা ঘর বাঁধতে সাধ হয়েছে। মনেহয় নিজের সবকিছুকে অংশী করবার মনের মতো একজন সঙ্গীনি পাশে থাকুক।
——সেই প্রয়োজন মেটাবেন আরেকটা ঘর ভেঙে ?
—— চুপ করো। আমার মাথায় খুন চেপে থাকে। কিছুতেই শান্তি পাইনা। তাই বলে অধর্ম। তোবা। তোবা।
——এইমাত্র শুনলাম। যে কোনো কারণে আপনার উগ্র বদমেজাজ। মাথা গরম করে ফেলেন। একেকবার একেক রকমের প্রলাপ বলছেন। যা বলবেন মাথা ঠান্ডা করে বলেন।
——মাথা ঠান্ডা রাখতে চাই, হচ্ছে না। এই মুহূর্তে এতো কাছে পেয়ে,,,,,,সব অপ্রত্যাশিত ঘটছে। অপ্রত্যাশিত যোগাযোগ। কাকতালীয় সবকিছুই ঘটে চলেছে । চুম্বকের মত আমার মন প্রাণ আত্মাকে টানছে। যেন এবার সত্যি সত্যি মাথায় গন্ডগোল দেখা দিল । আমি পাগল হয়ে যাবো।
—–স্টেশনে নেমে প্রথমেই তিব্বত কঁদুর তেল ভালো করে ঘষে, মাথায় শীতল জল ঢালবেন।
——ধন্যবাদ। তুমি বরাবর মাস্টারনি মার্কা উপদেশ, শাসন দিতে শিখেছ।
——এইতো সেইদিন। কত তক্তা কেটে ছেটে, বাঁকা লোহা পিটিয়ে পিটিয়ে এই হাতে বাক্স বানালাম।
—–তখন ভয় ছিল না?
—– তুচ্ছ ব্যাপার।
—–কলেজের চাকরি, ভালোই তো। ছাড়লে কেন?
—— একঘেয়ে ধরাবাঁধা নিয়মে মন বাঁধা থাকতে চায় না।
——তোমার লেখাযোখা? উপন্যাস কবিতা ভালো লিখতে। বাদ দিলে?
——সংসার সামলাতে যা হিমশিম খাই। বিশেষ বিশেষ সংখ্যাগুলোয় দিই।
তারপর দুজনে কিছুটা চুপচাপ।
বুড়িটা বেশি চিন্তা মগ্ন।
বুড়ো মৃদু হাসে।
—–হঠাৎ চুপ মারলে যে, কথা বলো।
—–এতক্ষণে অনেক কথা বলে ফেললাম। কি বলার?
—–ম্যাডাম, গল্পের অল্প কিছু আছে এখনও। বাকিটা শুনতে চাওনা।
—–চাইতো। আপনি শিক্ষিত, বিদ্যে কিছু পেটে আছে বলে মনেহচ্ছে।
—–হ্যাঁ, তা আছে। কি বলতে চাও?
——এই নিয়ে সমাজে ঢোল পড়বে । সমাজ কি মেনে নেবে পরস্ত্রীর এইরকম অপমান অপদস্থ ?
—–সমাজ। সমাজ। সমাজ। এই ই দেখো কপালের গভীর ক্ষত। তোমার সমাজের মিথ্যা আর ষড়যন্ত্রের উপহার। সমাজ কি বলবে এতো জানা। সমাজের ভয়ে, অভিভাবকের চাপে পড়ে কত জীবন অকালে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সমাজ খবর রাখে কোনো। না কারোর প্রতিদান দেয়। আমি সমাজকে মানিনা। তার জন্য যা সইতে হয়, আমি সইবো। তুমিও সহ্য করো।
—–এ্যাঃ আমি সহ্য করব মানে কি? আবার পাগলামি শুরু করলেন,,,,,
—–কথার কথা বললাম। ভয় পেলে?
—–ওরকম কথার কথা বলবেন না। ভেতরে তিক্ততা গুলিয়ে উঠলো যেন। দেওয়ালও কান পাতে। আমার কাছের কেউ শুনলে কলঙ্ক রটবে। ভেবে কথা বলেন।
—–পুরনো অভিজ্ঞতা আছে কোনো, আহুদা ভয় পাও? এখানে কেউ নাই। হাজারটা ডাকেও কারোর সাড়া আসবেনা। চেষ্টা করে দেখো। সত্যি করে বলছি, হলুদ সংকেত ঝলসে উঠেছে চোখে। এই শেষের ক্ষণ। একপা এগুতে প্রাণ বেরিয়ে যায় । এই মুহূর্তে ভাবাভাবির সময় অত্যন্ত কম। এই আমার মাথার দিব্যি,,,,,,। না থাক, তোমার মাথা ছুঁয়ে বলি,,,,,,
—–এই না, না আমায় ছোঁবেন না বলছি। কাছাকাছি না বসে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে বসেন। ।
—–বেশ। সামান্যতে চটে উঠলে? সেও অমনি ছিল।
—–আচ্ছা শুরু করেন, ওই বাড়িতে যাওয়ার আর কি উদ্দেশ্য আছে?
—–কিচ্ছু না। ওকে সামনে বসিয়ে দেখবো শুধু। মোটে চব্বিশ ঘণ্টা আটকে রেখে গান গাবো।
—–আশ্চর্য কথা। ভারি অদ্ভুত লাগলো। কিছু নেবেন না অথচ আটকে রাখবেন। শুধুমাত্র গান শুনাতে। এ কি রকম উদ্ভট উদ্দেশ্য যেন। তা কি গান শোনাবেন?
—– তুমি যেন আকাশ থেকে লাফালে? আমাদের কত গান আছে। শুরুর থেকে গাইছি। শুনতে পাওনি,,,,, আমি এতো যে তোমায় ভালোবেসেছি,,,,।
—–মানবেন্দ্র মুখার্জি।
—–সেইরকম মেধাবী ছিলে তুমি। এখনও তাই। বহু গানের কন্ঠশিল্পীর নাম মুখস্থ রাখতে পারো। “তুমি আজ কতো দূরে,,,, সোনার মেয়ে গো” ,,,,,,,।
—–শুনলুম। গলা বেশ। গান যাঁরা করেন তাঁরা কোমল স্বভাবের ভালো মানুষ হন। আপনি বিপরীত। একজনের স্ত্রীকে আটকে রেখে গান শুনাবেন। ব্যাপারটা মন্দ ও বিপজ্জনক। আপনি বিপদে পড়বেন।
—–পড়লে পড়ব। গা করিনা।
—-সত্যই আমার চিন্তা রয়েছে। । নিজের উপরে কি সর্বনাশ ডেকে আনছেন। এতো বড় কঠিন সিদ্ধান্ত কেউ কারো জন্য নেয় না।
——আঃ এতো উতলা হচ্ছো কেন।
——আমার আশঙ্কা হচ্ছে, দেশে আইন আছে।
——এদেশে আইন আছে প্রয়োগ নাই। সব চলে সিস্টেমে। আমি সিস্টেম জানি। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা ধরে দেখার জন্য ওকে আটক থাকতে হবে। আমি আটকে রাখবোই।
——আপনি প্রচুর অর্থবিত্তের অধিকারী। সম্পদ ও সর্বদিকে ক্ষমতা আছে যথেষ্ট।জানিনা, আপনি এমন কি বা কিছু।
—–আমি হালকা পিদিম। চোখ ধাঁধানো ওর শহর। কড়া আলোর রোশনাই চতুর্দিকে । শুনেছি ওর কর্তা ব্যাক্তিটি ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার। ক্ষমতা আর দাপট দুইই করায়ত্ত। তার ভয়ে বাঘে ছাগলে একঘাটে জল খায়। সক্কলে মানে।
—–এতো খবর সংগ্রহ করলেন কি উপায়ে? আপনার কথা শুনে নিজেরও একটা পাগল পাগল দশা। আমার সব জট পাকালো। মনেহচ্ছে আমাকেই উল্লেখ করেছেন। যদিও ক্ষেত্রবিশেষ।
ধীরে ধীরে বুড়ির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কে এই বুড়ো? আমি কি সত্যি তার পরিচিতা। সত্যি কি শ্রুতি নামের মেয়েটার সঙ্গে ওর চেহারার মিল আছে। নাকি বুড়োর মনের ভ্রম।
বুড়ো অকস্মাৎ শুধলো, তুমি আচানক পলায়নন্মুখ হলে? তোমার কর্তা বুঝি পুলিশের লোক? নামের সঙ্গেও মিল । অথবা ধরো তুমিই সেই শ্রুতি। তোমাকেই বললাম ,,,। তাহলে যাত্রা শুভ। সোনায় সোহাগা আমি।
—–তাইতো এসব আমি কেন ভাবছি? আপনি,,,, আমাকে অনুগমন,,,,,,মতিভ্রম নয় তো কি? আমাকেই বা বলবেন কেন? আরে ও মশাই আমার লুকানো ছাপানো কোনো ঘটনা নাই। ট্রেনে উঠে আমাদের পরিচয় হলো। আমি আপনার শ্রুতি হতে যাবো কোন দুঃখে?
—–সে তো জানিই। আমরা বাইরের চোখে শান্ত যে নদী দেখি তার গভীরে কত কি ঘটনা রটনা লুকানো তলানো থাকে।
বুড়ো বিদ্রুপ হাসে।
—–খুব ভালো কথা। নদীর নীচের ঘটনা। এত সহজেই বিশ্লেষণ হয়ে গেল।
—–কষ্ট পেলে কি করব বলো। আসল কারণ নদীও স্বচ্ছন্দে নারীর উপমা।
—–আমার আর কি কষ্ট। আর থাকলেই বা আপনার কি? আপনার সব অনেক অন্যরকম। সুবিধা অসুবিধা কোনো কিছু বিবেচনা না করে ঠিক এভাবে কাউকে আঘাত করা অন্যায়। মনে করেন না আপনি অপরাধী?
——অন্যায় না করে অপরাধ। বুঝলাম না।
——বুঝলে বুঝপাতা, না বুঝলে তেজপাতা। আপনার হয়েছে সেই দশা। একজনের পিছনে আমাকে জড়িয়ে যে সমস্ত আলোচনা সমালোচনা হলো তাতে আপনার অপরাধ ধরা হয়। আপনার উদ্যোগ আয়োজন ছিল ভয় প্রদর্শন । মানহানির মামলা সাজানো যেতে পারে। আপনি অসভ্য স্বার্থপর। শাস্তি হওয়া উচিত।
—–বোকার স্বর্গে বাস করো। হাসবো না কাদবো।
—–যেমন?
——হাঃ হাঃ হাঃ। সবটাই গল্পচ্ছলে অর্থহীন এক কাহিনী। সংসারে কিছু মানুষ থাকে, সততার করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সারাজীবনেও অন্যায় করেনি। তাদের কাছে এমন প্রশ্ন জবাব অবান্তর। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা ধরে একজনকে দেখতে চাওয়া, গান শুনানো বৈ সন্ত্রাসী কার্য তো না। এই মুহূর্তে যেমন আমরা দুজন। এইটা অপরাধ সাব্যস্ত করবে কোন আদালতে। যতটুকু মনেপড়ে, বইতে এই রকমের আলাপের আইনী কোনো শাস্তির কথা লেখা নেই। যদিও থাকে, আমি প্রমাণ সাপেক্ষ পাগল। আমার সবকথায় প্রলাপ মাত্র । গারদের সণদ দেখাতে পারব। ধরতে ছুঁইতে পারবে না।
—–সুচতুর । আপনি আইনের ছাত্র। নামটা বলেন?
—–যখন চিনলে না, নাম দিয়ে কি হয়। একসময় বলতে চেয়েছি, শুনলে না।
—–হঠাৎ চেনা চেনা লাগে। এমন অস্হির বোধ করছি কেন? আসলে আপনি কে বলুন তো সঠিক।
—–জীবন জমিনে কতকিছু দাফন করে চলতে হয় লোককে। আমি তাদেরই একজন। পরিচয়টা নেবে?
——না থাক, কি দরকার। আমি জেনেই বা কি করব? পথের আলাপ পথে শেষ হয়ে যাবে । পরিচয় দেওয়া নেওয়া হবে অনর্থক । এইরে, আপনি আবারও খুব কাঁশছেন,,,,,,। দেহের এই অবস্থা,,,,,,, কিছু অসুধপত্র আনেননি?
——দেহের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে।
——তবে বসে না থেকে চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে পড়ুন। দেখবেন আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে আসবে ।
—–বুকের মাঝে কিছু কষ্ট থাকা ভালো।
—–তার চাইতে আরও ভালো হতো যদি পরের স্টেশনে নেমে যান।
——তোমার কথায় আমি নামব কেন? রীতিমতন ফুল টিকিট কেটে উঠেছি। চব্বিশ ঘণ্টা আমি নেবই।
——আপনার অসম্ভব কষ্ট । কেন এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন?
——কষ্ট। কই, আমার তো কোনো কষ্ট হয় না।
—–আপনি রেগে গেলেন। এ অবস্থায় আপনাকে আমি একলা ছেড়ে দিই কি করে? মানে আমি বুঝাতে চেয়েছিলাম আমরা দুজনেই নামবো। এখানে আমার পরিচিত ডাক্তার আছেন। আপনাকে দেখিয়ে ফিরতি ট্রেন ধরিয়ে দিয়ে তবে আমি যাবো।
——যাবে বৈকি। জগতে থাকার জন্য কেউ আসে না। তুমি আর কি করবে? তোমার পথে নিশ্চিন্ত মনে চলে যেও। আর হ্যাঁ, আমার সঙ্গে গেলে তোমার কলঙ্ক হবে না?
——কথাটা এ অব্দি মনে রেখেছেন। একটু আধটু কারো কাজে লাগলে কলঙ্ক হয় না। ধন্য মনেহয়। ডাক্তার দেখালে সত্যি খুশি হবো। এছাড়া আমার বাড়ি আপনার গন্তব্যের ঠিকানায়। আপনাকে আরও যে কোনো সহযোগিতা করতে চাই। ওকে যা বলতে হয় লিখে দিলে পৌঁছে দিতাম।
——আমি তোমার সাহায্য নেব কেন?
——আহা সাহায্য না। সহযাত্রীর প্রতি সহানুভূতি।
——ওকে আমার খবর দিতে পারবে?
——পারব বলে বললাম। আপনি কেন চিন্তা করছেন? এবার আপনার বিবেচনা।
——তোমার বদান্যতা, ঔদার্যতা মনে থাকবে। স্বপ্নেও ভাবিনি ট্রেনে চড়ে এতসুখে সময় কাটাবো। অনেক কিছু পেলাম।
——কি এমন সুখ? আপনি কাঁদছেন, কি হলো মশাই?
——মানুষের জীবনে মর্মান্তিক দুঃখের মতো মর্মান্তিক সুখও কম নেই। আর সুখের উপলব্ধি নিয়ে মানুষ কান্না করে।
——আমি কি সান্ত্বনা দেব। কি করবেন বলুন?
——আমার জন্য দূর্ভোগ পোহাবে?
——কি দূর্ভোগ সহ্য করলাম? এখানে নামলে আপনার কোনো লোকসান হতোনা।মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করেন। স্টেশন এসে গেল। আসুন নেমে যাই।
—–ব্যস্ত হচ্ছো। রাতটুকু কাটাতে পারলেই পৌঁছে যেতাম।
——আপনাকে কিছুতেই নামানো যাবেনা? সেখানেই যাবেন?
——না। আমার বোধহয় শেষপর্যন্ত যাওয়া হলো না।
——কেন যাবেন না? এতদূর এসে তাকে না দেখেই ফিরে যাবেন?
—— আঃ কার জন্য এতো ব্যাকুল হয়ে উঠেছ? দেখছো না চেয়ে আমার শেষের সময়। অনেক বছর আগে শেষ ঘুমিয়েছি । এক্ষণে আমি নিশ্চিন্ত ঘুমাবো। এইখানে আমার সংকেত হয়ে গেছে। চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে প্রায় মিনিট কুড়ি বাকি। ঘড়ি ধরে দেখো। হিসাবটা ঠিকই ছিল। কিন্তু,,,,,, যাকগে,,,,, । ভাগ্য সদয় হলে একবার দেখা পাবো। কিছু কথা বলার ছিল,,,,, বলবো। অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে আমাদের দেখা হয়েছে। কথা হয়ে গেল। আজকে আমি প্রাণভরে আনন্দ বোধ করছি। আমি শেষটাই ওর কাছাকাছি ছিলাম। সেইদিন ওকে অপেক্ষায় রেখে ভালোবাসি কথাটা বলব বলে বেরিয়েছিলাম পথে। সমাজ আমার কপাল ফাটিয়ে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দিল অযৌক্তিক। ঐদিন খতম করে দিলে আমি ক্লোজ হয়ে যেতাম। তা না, দিল মিথ্যে সাজায় আরও ত্রিশবছর। ত্রিশটা বছর ওহ্ খোদা ত্রিশবছর। আরেক জনম। আমার ঘুম হয়নি। অনেক কষ্ট চেষ্টার পরে পালিয়ে এসছি। ওকে দেখবার লোভ। দূর্বলতা গলা টিপে ছিল। ঠিকানা জোগাড় করলাম। শুনেছি এই লাইনে যায় আসে। ও এখন অনেক দূরের মানুষ। তদুপরি খুব ইচ্ছা করছিল শেষবার ওকে দেখার। একনজর দেখেই ফিরে আসব। ওর দেখা মিলে গেল। কিছুটা হলেও তো বোধগম্য হয়েছে, আমি অপেক্ষা করেছি। আমার ভালোবাসারা অপেক্ষা করে। আর কোনো চাওয়া নেই। আমি কত সুখী। কত পূর্ণ । আজ আমার ভালো দিন। অনেক কিছু পেলাম। অনেক কিছুই দিলে মন জ্যোৎস্না,,,,,,,,,, ।
কথাগুলো বলে বুড়ো সীটের গায়ে ঠেস দিয়ে চক্ষু মুদে নিল।
মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত জড়তা ত্যাগ করে বুড়িটা চঞ্চল হয়ে ওঠে । কথাটা ভালো করে শোনার জন্য বুড়োর হাত চেপে ধরলো।
—–কি নাম বললেন, মন জ্যোৎস্না,,,,,, আপনি,,,, তুমি আসলে কে,,,,, অলোক? অবশ্যই তুমি অলোক। এতক্ষণে চিনলাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য আমি তোমাকে বিন্দুমাত্র জানতে পারিনি। তুমি তার খেয়াল করেছ। অমনি অভিমান হলো। এভার কখনও কাটবে না। আমি নাহয় চিনলাম না। আমার কাছে এসেও পরিচয় দিলেনা। কিসের বাঁধা ছিল। হাতদুটো ধরে একবার *মন জ্যোৎস্না* বলে ডাক দিতে। এখন এতো কাছে আমি। একবার নাম ধরে ডেকে ওঠো। একবার হলেও কথা বলি,,,,,,,
বুড়ো ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে বুড়ি নিজের গায়ের চাদরখানা খুলে পরম মমতায় বুড়োর গায়ে দিল।
তারপর একা একা বকা ধরলো, অলোক শেষটা শুনবে না। অন্ততঃ এখন তো তুমি শান্ত। বিশেষভাবে কৃপা করে যখন দেখা দিলে। তুমি ভালোবাসো কথাটা জানলে, না বলার সাধ্য ছিল না। সর্বস্ব দিতাম তখুনি। সেদিন একা একা অপেক্ষায় ক্লান্ত, ভগ্নমন নিয়ে সন্দেহ ঘোচেনা। অবিশ্বাসের জোর দলামুচ থেকেছে। তুমি পালিয়ে গেছ শুনলাম। মেনে নিতে গিয়েও মিলাতে পারিনি। আজকে সব শোধবোধ হয়ে গেল। এইমাত্র তোমায় এতো কাছে পেয়ে আমি সুখী। তুমিও সুখে থাকো।
ট্রেনটা চলছে হিসহিসিয়ে। বাতাসে ঝিক ঝিক,,,,,ঝিক ঝিক শব্দ। সামনে তখনও কয়েকটি স্টেশন পড়ে। ট্রেনের হুঁইশেল, ঝাঁকানিতেও বুড়োর ঘুম ভাঙছে না। পথের মানুষ দেখেও বুড়ি এলোমেলো বিচলিত হলো না। দূর দিগন্তেও হারিয়ে গেলনা। তখনও মুখ নীচু করে বুড়োর ঠান্ডা হাত ধরে বসে আছে।
রাত্রি গড়িয়ে সকাল নামলো। দেখতে দেখতে শেষের স্টেশনে পৌঁছেছে অতিকায় যান্তবটা। চারিদিকে হৈ হল্লা। চৌকিদার, ফেরিওয়ালা, মুটের হাঁকডাক। বগিতে দুটি দেহ। কেউই টের পায়নি। ট্রেনের শেষ যাত্রীটিও চলে গেছে ভেবে গার্ডের বাঁশি বাজলো। বড়ো ঝাঁটা হাতে উঠে এলো ঝাঁড়পোছের দুই ঝাঁড়ুদার। ঝপঝপিয়ে আওয়াজ তুলে তারা ঐ মাথা থেকে ঝাঁড়ু দিতে দিতে এগিয়ে আসছে ।
বুড়োর ঘুম ভাঙলো না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।