“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় সুদীপ ঘোষাল

নিশিভূতের খপ্পরে

তখন বর্ষাকাল। ভরা শ্রাবণ। আমরা তখন বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার বন্ধু ছিল অনেক। তার মধ্যে সর্দার ছিলো বিশু। অলকের বাড়ি তার কোমডাঙ্গা গ্রামে। স্কুলে যত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো তার প্রধান দায়ীত্বে থাকত আমাদের দলের প্রধান বিশু। আর কান টানলেই মাথা আসে। হাত বাড়ালেই বন্ধুদল হাজির। বিশু মানেই আমরা সবাই। আমাদের বন্ধুরা এই পরোপকারী নির্ভিক নেতার ভক্ত।
স্কুলে ঠিক হলো এবার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠান হবে সন্ধ্যাবেলায়। নাটক,আবৃত্তি,গান সব হবে। হষ্টেলের ছেলেরা বললো,বিশুদা তোমাকে থাকতে হবেই।বিশু বন্ধুদের কথা ভেবে বললো,আমাদের বাড়ি অনেকদূর।প্রায় চার ক্রোশ দূরে।হেঁটে আমরা যাওয়া আসা করি
দিনেরবেলা বলে সম্ভব।রাতে আসতে পারব কি? দেখি।
মাষ্টারমশাই বললেন,বিশু তুমি আর তোমার দলবল থাকবে। তোমাদের ছাড়া অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রয়োজনে রাতটা হষ্টেলে কাটাবে।
বিশু বললো,তাই হবে স্যর। অসুবিধা হবে না।
তারপর চলে এলো ২৫শে শ্রাবণ। স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী। বলা হলো সকলের বাড়িতে। দুপুরে ঘুমিয়ে নিলাম সবাই।তারপর সকলকে সঙ্গে করে বিশু চললো স্কুলে।কোমডাঙ্গার অলক চলে এলো আমাদের সঙ্গে। আলপথে হেঁটে চলে এলাম কাঙরা গাবা। সেখানে একটা কাঁদর।তার পাশে একটা ঝুড়ি নামা বটগাছ।দিনের বেলাতেই জায়গাটা অন্ধকার। বিশু বললো আমরা রাতে ফিরবো। তোরা হষ্টেলে থেকে যেতে পারিস। আমি বললাম,না আমরা সবাই বাড়ি ফিরবো। বিশু বললো,তাই হবে।
তারপর দিনে কাঁদর পেরিয়ে চলে এলাম হেঁটে স্কুলে। তারপর কাজ শুরু হলো। বিশু ঘোষকের ভূমিকায়।বড় সুন্দর অনুষ্ঠান পরিচালনা করে বিশু। প্রথমে লীলা উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করলো,আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে”। তার পর সভাপতি নির্বাচন।প্রদীপ প্রজ্জ্বলন,প্রধান অতিথি বরণ হলো।সকলে স্থপতির গলায় মালা দিলেন। তাঁর সম্বন্ধে দু চার কথা বললেন।
আমি বললাম,সভাপতি নির্বাচন আগে করলে হত না। বিশু বললো,জানি সব জানি। তবে কি জানিস,আমার প্রিয় স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে কবিগুরুর গান আগে শুনলাম। বাংলার মাষ্টারমশাই বললেন,তুই বিশু যাই করিস আমাদের ভালো লাগে। চালিয়ে যা।তারপর নাটক হতে হতে রাত দশটা বেজে গেলো।বিশু তাড়াতাড়ি স্যারের হাতে দায়ীত্ব দিয়ে আমাদের কাছে চলে এলো। হষ্টেলে খাওয়া হলো। তারপর বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্য।বৃষ্টি পড়ছে অঝোর ধারায়। ছাতা মাথায় চার্জার আর হ্যারিকেন আলো হাতে।টর্চও আছে।
আমরা দুটো হ্যারিকেন এনেছিলাম।রতন বললো,বিশু হ্যারিকেন দুটো জ্বালিয়ে নি। বিশু বললো,অনেকটা পথ। দুটো হ্যারিকেন একসাথে জ্বালাস না। একটা হলেই হবে। আমি সামনে থাকবো। আর সাপ খোপ আছে। সবাই পা ফেলবি পরিষ্কার জায়গায়। আল রাস্তা। কাদামাখা হয়ে গেছে পা, সকলের।
তারপর বিশু সামনে আর আমরা পিছনে। বেশ দ্রুত হাঁটছি,সামলে আমরা। খিড়কি পুকুর,বটতলার মাঠ,তেমাথার মাঠ পেরিয়ে আমরা চলে এলাম কাঙরা গাবায়। এখানে একটা কাঁদর আছে। ছোটো নদীর মত। এবার পার হতে হবে। আমরা গামছা পড়ছি এমন সময় দেখলাম অলক প্যান্ট জামা পরেই জলে নামছে। বিশু বললো,অলক তুই সাঁতার জানিস না। পাকামি করিস না।
বিশু ছুটে গিয়ে অলককে ধরতে গেলো আর সঙ্গে সঙ্গেই এক বিকট হাসি অলকের মুখে। যে অলক সাত চড়ে, রা কাড়ে না সেই অলক ভূতুড়ে হাসি হাসতে হাসতে কাঁদরের জলের উপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি বললাম,বিশু অলক কই? বিশু বললো,এই কাঙরা গাবায় ভূত আছে। এসব তার কাসাজি। শুনে রতন ও আমি বু বু করতে লাগলাম ভয়ে। বিশু বললো,চল ওপাড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই। আমরা কাঁপতে কাঁপতে জল পার হয়ে ছুটে চলে গেলাম অনেক দূরে। বিশু বললো,হ্যারিকেন দুটো ফেলে এসেছি। চল নিয়ে আসি। আমরা বললাম,বিশু তোর পায়ে পড়ি বাড়ি চল। হ্যারিকেন চুলোয় যাক।
তারপর বিশু ও আমরা অলকের বাড়ি গেলাম। বাড়ি যেতেই ওর বাবা বাইরে এলেন। বিশু বললো,কাকু অলক ফিরেছে। কাকু বললেন,না তো।সে কোথায় গেলো। বিশু সব ঘটনা খুলে বললো।কাকু বললেন,চলো আমরা সবাই থানায় যাই। সেখানে একটা খবর দেওয়া দরকার। আমি জানি কাঙরা গাবায় তেনারা থাকেন। রাতে তোমাদের যাওয়া ঠিক হয় নাই গো।
থানায় মেজবাবু সব শুনে বললেন,কাল সকাল অবধি অপেক্ষা করুন। দেখা যাক লাশ পেলেই সব বোঝা যাবে।
বিশু বললো,ও মরে নি। হাওয়ায় উড়ে গেছে। মেজবাবু বললেন,ঠিক আছে। সব কথাই শুনে রাখলাম। দেখা যাক এটা নিশি ভূতের কাজ কি না?
থানা থেকে বেড়িয়ে আমরা সবাই অলকের বাড়িতে থাকলাম আর বিশু চলে গেলো তার নিজের কাজে।ও বললো,সকালবেলা আমি আপনার বাড়ি চলে আসবো কাকু। আপনি চিন্তা করবেন না। নিশি ভূত কাউকে প্রাণে মারে না।
এই বলে সে চলে গেলো ডোম পাড়ার বুড়িমার কাছে।
কাকু বললেন,বিশু ঠিক বলেছে। আমার অলক ঠিক ফিরে আসবে।
তখন কোনো মোবাইল ছিলো না। ল্যান্ড ফোন দু একটা বাড়িতে ছিলো। বিশু সকলের বাড়ি গিয়ে বলেছিলো,ওরা সবাই অলকের বাড়িতে আছে।কাল দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ করেছেন কাকু।বিকেলে সবাই চলে আসবে।
আমরা সবাই রাত জেগে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। অলকের বাবা লিকার চা করে খাওয়ালেন। ধীরে ধীরে পূব আকাশে সূর্য উঠলো।সব ভয় সরে গিয়ে আলো ফুটে উঠলো।
সবাই আমরা উৎকন্ঠা নিয়ে বসে আছি। কখন আসবে বিশু। ঠিক সকাল দশটায় পুলিশের গাড়ি চলে এলো গ্রামে। আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম পুলিশের গাড়ি থেকে নামছে অলক। এর মধ্যে বিশুও হন্ত দন্ত হয়ে আমাদের কাছে এসে বললো,যাক কাকু, অলক এসে গেছে। মেজবাবু কাকুকে বললেন,এটাই আপনার ছেলে অলক তো?
—- হ্যাঁ স্যার।
—-আমাদের থানার আশেপাশে ঘুরতে দেখে ওকে নিয়ে এলাম। আমাদের স্থির বিশ্বাস ছিলো এটা অলক। ওর মুখে সব কিছু শুনলে বুঝতে পারবেন ওর সমস্যা। যাই হোক, আমরা আসি।
পুলিশের গাড়ি চলে গেলো। প্রায় দুঘন্টা হলো অলক ঘুমিয়ে আছে। দুপুর একটায় ওর ঘুম ভাঙ্গলো।বিশু জিজ্ঞাসা করলো,তোর কি হয়েছিলো বল তো অলক?
অলক বলতে শুরু করলো তার অলৌকিক কাহিনী।
সে বললো,আমরা সবাই যখন কাঙরা গাবায় কাঁদর পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই আমাকে খনা গলায় নিশি ভূতটা বললো,কি রে তোর বাড়ি গিয়ে ডাকলাম। সাড়া পেলুম না। তাই গন্ধ পেয়ে এখানে এলাম। চল আমার সঙ্গে তোকে হাওড়া ব্রীজ দেখিয়ে আনি। আমি বললাম,এই রাতে বন্ধুদের ছেড়ে আমি হাওড়া যাবো না। নিশিটা বললো,যা বলবো শুনবি।তা না হলে উঁচু থেকে ফেলে দেবো।আমি আর ভয়ে কথা বলিনি। নিশি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো হাওড়া ব্রীজে। আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। তারপর যখন নিশিটা আমাকে নিচে নামালো তখন জ্ঞান এলো। নিশি বললো,কেমন লাগছে। কি খাবি বল। তারপর আবার বললো,গঙ্গার জলে সাঁতা কাটবি নাকি?
আমি বললাম,আমি সাঁতার জানি না।
নিশি বললো,আমি থাকলে ওসব কিছু দরকার হয় না। এই বলে আমাকে ওপর থেকে গঙ্গার বুকে ঝুপ করে ফেলে দিলো।তারপর জামাটা মুঠো করে পুুতুলের মত তুলে নিয়ে ওপরে এলো।আমি ভাবলাম, আমার জীবনের শেষ দিন আজকে। নিশি মনের কথা জানতে পেরে বললো,আমরা প্রাণে মারি না কাউকে। শুধু ঘুরে বেড়াই।কাজ করি। তারপর দিনের আলো ফুটতেই নিশিটা পালিয়ে গেলো।
আমি দেখলাম একজন ভদ্রলোক আমার হাতে একশো টাকা দিলেন। তিনি বললেন,তোমাকে দেখে তো ভালো ছেলে মনল হচ্চে।তা তুমি এখানে কেন?
আমি বললাম, আপনি বিশ্বাস করবেন না আমার কথা। আমাকে নিশি ভূতে এখানে এনেছে।
ভদ্রলোক বললেন,আমি বিশ্বাস করি। তুমি সাবধানে যাবে।
আমি বললাম,আমাকে কাটোয়ার ট্রেনে চাপিয়ে দেবেন।
ভদ্রলোক বললেন,নিশ্চয়। ভোর চারটে পাঁচের ট্রেনটা পাবে চলো।
আমি তার সাথে চলে গেলাম। তিনি বললেন,মর্নিং ওয়াকে এই পথেই আমার আসা যাওয়া। তাই তোমার সঙ্গে দেখা হলো। যাও আর কোথাও নাববে না। সোজা বাড়ি চলে যাও।
অলক বললো,বুঝলাম অনেক ভালো লোক কলকাতায় আছেন। তারপর ট্রেন থামলো থানার কাছের স্টেশনে। সেখান থেকেই পুলিশ আমাকে ধরে আর এখানে নিয়ে আসে।
অলক আবার বললো,আমি আরও একটু ঘুমোবো। কাকু বললেন,ভাত খেয়ে নে। অলক বললো,পরে খাবো।
অলক খেলো না বলে বিশু ও আমরা না খেয়ে চলে এলাম।কাকু আর জোর করেন নি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।