সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ২৪)

তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন

৩৬
পিসেমশাই বললেন, ইতিহাসে পড়েছি এই গল্পটা। ইতিহাস মিছে কথা বলে না।
রতন ফোড়ং কাটলো, ফিস ফাস কথা কয় পুরোনো দেওয়ালে। আমি বললাম, চুপ কর না…
তারপর পিসেমশাই মুখে এককুচি কি একটা নিলেন। ওটা কাউকে বলেন না। তারপর শুরু করলেন কাহিনী।
কালীঘাট পার্কের পিছনে নির্জন ফাটক দিয়ে ঢুকলে বিরাট সমাধিস্থল দেখা যায়।টিপু সুলতানের আত্মীয়দের সমাধিস্থল রয়েছে। টিপু সুলতান জাহাজে করে ফরাসি অস্ত্রশস্ত্র আনিয়েছিলেন।শেরালিঙ্গট্রমের যুদ্ধে টিপু মারা যান। ব্রিটিশ সৈন্য অনেক বেশি থাকার জন্য টিপু যুদ্ধে হেরেছিলেন। টিপুর দুই ছেলে আনোয়ার শাহ্ আর গোলাম মহম্মদ শাহ শিক্ষিত ও রুচিবান মুসলমান ছিলেন।
কলকাতার সতীশ মুখার্জি রোডের আশেপাশে এক বিরাট জনবসতি গড়ে উঠেছে। অফিসের কাজে বিকেলবেলা আমি আর অজয় একটা লজে ঘর ভাড়া করে থাকলাম। আজকের রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে তারপর আগামীকাল অফিসের কাজ সারা যাবে। এই মনে করে আমরা হোটেল থেকে বিরিয়ানি আনালাম। অজয়ের খুব প্রিয়।
খাওয়া দাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে ঠিক রাত বারোটার সময় অফিসের ফাইল রেডি করে আমরা শুতে গেলাম।আমার আজকে ঘুমোতে ইচ্ছে হলো না। এক স্বর্গীয় চাঁদের আলোয় আজকের রাতটা আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ আমি দেখলাম সমাধিস্থলের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আলখাল্লা পরিহিত এক মূর্তি। আজ সন্ধ্যাবেলায় লজের দারোয়ান বলছিলো,রাতে শুয়ে পড়বেন বাবু। এদিকে বারান্দায় আসার প্রয়োজন নেই।
তারপর আমি অজয়কে ডেকে তুললাম। অজয় বললো,এ নিশ্চয় গোলাম মহম্মদ শাহের অতৃপ্ত আত্মা। চারদিকে বট, অশ্বত্থের ঝুরি নেমেছে। আমাদের ভয় লাগছে না তবু হাড়ের ভিতর দিয়ে একটা ঠান্ডা অনুভূতি খেলে চলেছে।
আমরা দুজনে একবার এক প্রত্যন্ত গ্রামের পোড়ো বাড়িতে দু রাত কাটিয়েছি। ভ্রমণ আমাদের রক্তে মিশে আছে। সুযোগ পেলেই অফিসের কাজে হোক কিংবা ছুটিতে আমরা ঘুরতে চলে যাই বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। এই বাংলার বাতাসে মিশে রয়েছে ঐতিহাসিক অনেক কান্ড যা খুঁজলে এক মহাভারতের আকার নেবে।সেখানে আমরা এই আল্খাল্লা পরিহিত সুলতানের সাজ দেখেছিলাম। হয়ত এর সঙ্গে তার কোথাও মিল আছে।
খোঁজ নিয়ে জানলাম টিপু সুলতান একবার শিকারে এসে এই জঙ্গলে আস্তানা গেড়ে এই বিরাট সৌধ তৈরি করেছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে গ্রাম। গ্রামের সমস্ত সুযোগ সুবিধা সুলতানের দয়ায় হয়েছিলো।রাস্তাঘাট,হাট,মাঠ সর্বত্র এক উন্নয়নের জোয়ার ছিলো। তারপর কালক্রমে এই পুরোনো বাড়ি ভগ্নাবশেষে পরিণত হয়েছে।আমি আর অজয়পেরে ধীরে কবরের আশেপাশে ঘুরতে লাগলো।তারপর নর্তকি এলো,গান,বাজনা হলো।জানলা খুলে আমরা দুজনেই অই দৃশ্য দেখে ভয়ে কম্পমান,এই যুগে নবাব এলো কোথা থেকে। হঠাৎ কি করে গজিয়ে উঠলো নৃত্যশালা। ভয়ে আমরা দুজনেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। সকালে উঠে দেখলাম, ফাঁকা জায়গা। কোথাও কিছু নেই। তাহলে এটা নিশ্চয় কোনো ভূতের কারসাজি। অই মাঠের কাছে বয়স্ক লোকদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম,এখনও নবাব প্রতি রাতে নৃত্য আর সংগীতের মেহফিল বসান নিয়মিত।
পিসেমশাই আবার বলতে শুরু করলেন, পাড়ায় একটা সুন্দরী মেয়ে ঘুরে বেড়ায় কয়েকদিন ধরেই। এত সুন্দরী মেয়ে এপাড়ায় আছে বলে তো মনে হয় না। রমেন বলল, চায়ের দোকানে চা পান করতে করতে। তার বন্ধু বিমান একটু নারীঘেঁষা পুরুষ। সে বলল, আহা মেয়েটাকে বিছানায় কেমন মানাবে বল তো? মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি রাজি। যাব তোমার সঙ্গে। রমেন বলল, এত দূর থেকে আপনি কি করে কথা শুনলেন।মেয়েটি বলল, আমি শুনতে পেলাম। তাই বললাম। বিমান বলল, আমিও রাজি। চল আমার সঙ্গে।
রমেন বলল, যাস না। জানি না শুনি না। মেয়েটাকে নিয়ে তুই চললি বিছানায়? বিমান একা। অকৃতদার সে। বাড়ি ফাঁকা। বেশ আয়েস করে বলল, চল সুন্দরী তোমার কোন অভাব রাখব না।রমেন পরের দিন রাতে বিমানের বাড়ি গেল। বিমান চায়ের দোকানে আসে নি। হয়ত সুন্দরীর পাল্লায় পরে সব ভুলে গেছে।
রমেন বিমানের বাড়ি ঢোকার আগেই একটা বাদুড় ডানা ঝটপট করে বেরিয়ে গেল বিমানের বাড়ি থেকে। সে দেখল, বিছানায় বিমানের রক্তাক্ত দেহটা পড়ে। পুলিশকে ফোন করল সে। পুলিশ এসে দেখল, বিমানের ঘাড়ের কাছে দুটো দাঁতের দাগ। গলার নলিতে কামড়ে কে যেন নলি ছিঁড়ে নিয়েছে।
সুন্দরী মেয়েটা গুরুগুরু করে আজও বেড়াচ্ছে। রমেন দেখল চায়ের দোকানে পাশে এসে বসে দশবার দাঁত বের করে হাসছে।
রমেনেরর সন্দেহ হলো এই মেয়েটাকে বিমান নিয়ে গিয়েছিলো। অথচ বিমানের রক্তাক্ত দেহ বিছানায় পড়ার সময় তাকে তো দেখা যায়নি।সুন্দরী মেয়েটি সোম কে বলল, যাবে নাকি তুমি বিমানের মত?
রমেন ছুটে পালাতে চাইলো। কিন্তু ছুটতে পারল না। পা দুটো যেন আঠার মত আটকে গেছে।রমেনের বিরক্তিকর মুখ দেখে মেয়েটি আর কিছু বলল না। সে আরেক জনকে বললো যাবে আমার সঙ্গে। সোম ভাবল, মেয়েরা এত নির্লজ্জ হতে পারে? কেউ ভাবতে পারিনি। তবু সেই ছেলেটি বলল,হ্যাঁ যাব। সুন্দরী বলল, আমি রাতে দেহ ব্যবসা করি। লজ্জা করলে হবে বলো নাগর?
সোম আহ্লাদিত হল। সে বলল, আমার গাড়ি আছে পার্কিং জোনে। চল গাড়ির ভিতরে যাই।আবার সকাল হলে সোমের রক্তমাখা দেহ পরে থাকতে দেখল সবাই। রমেন থানায় ফোন করে বলল, সোম একটা মেয়ের সঙ্গে রাতে ছিল। মেয়েটিই খুনী মনে হয়।আজ রাতে পুলিশ সদলবলে চায়ের দোকানে বসল সিভিল ড্রেসে। রমেনের কাছে মেয়েটি এল। সে রমেনকে বলল,এবার তোমার পালা। চল আমার সঙ্গে।রমেন কাঁপতে শুরু করল। পুলিশ সক্রিয় হল। মেয়েটিকে ধরে নিয়ে চলে গেল থানায়। রাতে বন্দি হল সে।
পরের দিন সকালে আই সি দেখলেন, গারদের মেঝেয় পড়ে আছে একটা মরা বাদুড়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।