ক্যাফে ধারাবাহিকে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ১২)

ঝিঁ ঝিঁ পোকার আলো

১৬

কে জাগো রে…কথিত বিশ্বাস যে এই রাতে যে জেগে দেবীর সাধনা করেন তিনি ধনপতি হন।

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী কোজাগরী শব্দটি এসেছে ‘কো জাগর্তি’ থেকে, যার অর্থ ‘কে জেগে আছো’৷ ভক্তমনে বিশ্বাস যে এই পূর্ণিমার রাতে নাকি দেবী লক্ষ্মী স্বয়ং মর্ত্যলোকে পরিক্রমায় বেরোন৷ তিনি দেখেন তাঁকে আরাধনার রাতে সারা রাত কেউ জেগে আছে কিনা। তাই ভক্তিপূর্ণ চিত্তে লক্ষ্মীপুজো করার পরে প্রথমে বালক, বৃদ্ধ ও শিশুদের খাবার গ্রহণ করাতে হয়। আজও ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীকে পাওয়ার জন্য গৃহস্থেরা সারারাত ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালান। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন বাংলার প্রতিটি ঘর মুখরিত হয়ে ওঠে শঙ্খধ্বনিতে৷

 

 

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু।সেই অনুসারে, শারদ পূর্ণিমায় দেবী লক্ষ্মী তাঁর বাহন পেঁচার উপর বসে পৃথিবী দর্শন করতে আসেন। প্রথা অনুসারে, অনেকে শারদ পূর্ণিমায় বাড়ির ছাদে পায়েস রাখেন কারণ এই দিনে চাঁদকে বিশেষভাবে পূজা করা হয় এবং তার আলোতে পায়েস রাখার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। শারদ পূর্ণিমা অনেক নামেও পরিচিত। শারদীয় পূর্ণিমাকে কোজাগরী পূর্ণিমাও বলা হয়, তবে কেন এটি বলা হয় তা জেনে নেওয়া যাক।

শারদ পূর্ণিমা কোজাগরী পূর্ণিমা, রাস পূর্ণিমা, লক্ষ্মী পূজা এবং কৌমুদী ব্রত নামেও পরিচিত। ‘কোজাগরী’ শব্দের অর্থ ‘জেগে থাকা’। এই উৎসব ঘিরে রয়েছে লোককথা।
এক হিন্দু ধর্মের রাজা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন, যার কারণে রাজার সম্পদ কমতে শুরু করে। রাজার উদ্বেগ ও কষ্ট দেখে রাণী উপবাস পালন করেন। এরপর সারা রাত জেগে লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করেন । তখন দেবী লক্ষ্মী দেবীর পূজা ও উপবাসে অত্যন্ত প্রসন্ন হন এবং তাঁর স্বামী অর্থাৎ রাজাকে আশীর্বাদ করেন, যাতে তাঁর রাজ্যে ধন-সম্পদ বা সমৃদ্ধির কোনও অভাব না হয়। এর কারণেও অনেকে শারদীয় পূর্ণিমার রাতে জাগরণ করেন।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, শারদ পূর্ণিমার দিনে সাগর মন্থনের সময় দেবী লক্ষ্মী সাগর থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এর কারণেও এই পূজার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কোজাগরী পূর্ণিমার জন্য, অনেক ঋষিরাও বিশ্বাস করেন যে এই রাতের চাঁদের জ্যোৎস্নার আশ্চর্যজনক নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে এবং এটি মন ও আত্মার জন্য উপকারী।
আসুন জেনে নেওয়া যাক যে কিছু এলাকায় নববিবাহিত মহিলা এবং অবিবাহিত মেয়েরাও এই পূজায় উপবাস রাখেন। এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে এই দিনে পুজো করলে সুখ-সমৃদ্ধির পাশাপাশি গৃহে সদাচারী স্বামীও পাওয়া যায়। হে হরিপ্রিয়ে, তুমি সকল প্রাণীকে বরদান করিয়া থাক, তোমাকে প্রণাম করি। যাহারা তোমার শরণাগত হয়, তাহাদের যে গতি, তোমার পূজার ফলে আমারও যেন সেই গতি হয়।’

বর্তমানে গৃহস্থের সুবিধের জন্যই হোক বা পুজারীর স্বল্পতার জন্য, লক্ষ্মী পূজা (বারোমাসী পূজা বাদে) হয় সকাল থেকেই। কিন্তু কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার প্রকৃষ্ট সময় প্রদোষকাল। অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে দু ঘণ্টা পর্যন্ত যে সময়। সকাল অবধি তিথি থাকলেও সেই প্রদোষেই পূজা বিহিত। কিন্তু আগেরদিন রাত্রি থেকে পরদিন প্রদোষ পর্যন্ত তিথি থাকলে পরদিন প্রদোষেই পূজা করা বিধেয়। আবার আগেরদিন রাতে তিথি থাকলেও যদি পরদিন প্রদোষে তিথি না থাকে তাহলে আগেরদিন প্রদোষেই পূজা করা কর্তব্য।

কোজাগরী লক্ষ্মীপূজাতে দেখা যায় জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক আচার অনুষ্ঠান। এখনও ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবারে পাঁচালি পাঠ করে তার আরাধনা করা হয়। উপচারে ফল মিষ্টি ছাড়াও থাকে । আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা ধরনের তাৎপর্য। কোনও কোনও পরিবারে পূজায় মোট ১৪টি পাত্রে উপচার রাখা হয়। কলাপাতা দিয়ে সাজানো হয় পূজা স্থানটিকে। পূজার উপকরণ এবং আচার অনুষ্ঠান দেখে অনুমান করা যায় এর নেপথ্যে থাকা কৃষি সমাজের প্রভাব। কিছু কিছু জায়গায় লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে মেলা বসে। কোথাও বা নৌকাবাইচও অনুষ্ঠিত হয়।

বলা হয়, ‘যার কিছু নেই সে পাওয়ার আশায় জাগে, আর ‘যার আছে, না হারানোর আশায় জাগে। আর সারারাত জেগে লক্ষ্মীর আরাধনা করাই এই পূজার বিশেষ আচার। কথিত আছে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন দেবী রাত্রে খোঁজ নেন – কে জেগে আছেন? যে জেগে ধ্যান করে, লক্ষ্মী তাকে ধন সম্পদ দান করেন ।

“নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী ।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।