গল্পে স্নেহদিয়া গৌরী

প্রেমের নেশা

উত্তরী জানলা নিয়ে সোনালী আলো ছিটকে পড়ল সুবীরের চোখে।বসন্তের এই মায়াবী রোদটাই কড়া হলেও তীক্ষ্ণ নয়। সুবীর ঘুম থেকে উঠে দেখল ৯ টা বেজে গেছে।ইশ্,আজ অফিস যেতে বেশ দেরি হয়ে যাবে ওর।কলকাতায় চাকরি করতে এসে একটা দু কামরার ঘরে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকে ও।ওর সাথে নিখিল বলে এক অবাঙালি ছেলে থাকে।সে ভোরে উঠে রোজ ওকে ডেকে দেয়।দুদিন সে নেই বলেই সুবীর হাবুডুবু অবস্থা।এমত অবস্থায় অ‍্যালার্ম তো দিতেই পারত,তবে মনে থাকলে তো!তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে দরজা খুলতেই গেটের বাইরে একটা কাগজের টুকরো পড়ে থাকতে দেখল।এই এক জ্বালা বটে!গোছানো হতে সে পারল না।হয়তো অফিসের কোনো কাগজপত্র বেরিয়ে এসেছে ভেবেই না দেখে পকেটে চালান করে দিল সুবীর।ও একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ম‍্যানেজিং ডিরেক্টর মিস্টার আগরওয়ালের নীচে কাজ করে।পোস্ট হিসেবে বলতে হয় ডিরেক্টরের সেক্রেটারী পদে বহাল ও।দৌড়ে বাসে উঠে একটু ভেতরে ঢুকে দাঁড়ালো ও।রোজ একটু হেঁটে দমদম স্টেশনের সামনে থেকে বাস ধরে,ফাঁকা পায় একটু।তবে আজ সেই সময় তো ছিলই না,বরং মোড় থেকেও ধরতে দৌড়ে হাঁফ ধরে গেছে ওর।হাঁফ ধরেছে তা বুঝতে পারলেও পিঠের ব‍্যাগটা সামনে টেনে আনতে পারছিল না ভিড়ে।তখন হঠাৎ করেই সুপ্রীতি জলের বোতল এগিয়ে দিল ওর দিকে।

“তা একা থাকো এই কলকাতায়।একটা গাড়ি কেনার সামর্থ্য আছে তোমার।কিনবে কবে?”

বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে থাকলে পরের অহেতুক খবরদারিগুলোতেও আনন্দ লাগে। সুবীর ভালো লাগে সুপ্রীতির এই অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে বলা কথাগুলো।মাঝে মাঝে ভাবে ও যদি নিজেও পারত এমন সহজ পাহাড়ি উচ্ছ্বল ঝর্ণার মতো গতি ধারণ করতে!একটু জল খেয়ে স্বাভাবিক হল ও।

“আরে মোটা হয়ে যাব তো।সারাদিনই ঐ হিমশীতল ঘরে বসে বসে চালানি মাছের মতো ভ‍্যাপসা গন্ধ ধরে যায় শরীরে।এটুকু ভীড়,ঠেলাঠেলিতে কোথাও একটা গতিশীলতা অনুভব করি,কোথাও বেশ একটা দ্রুতগতির জীবন।”

“মানে বলছো রোমাঞ্চের ভীষণ অভাব জীবনে!একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি খোঁজো তাই তো?”

“হুম,মাঝে মাঝে মনে হয় বেশ হত যদি দুরন্ত এক জীবন পেতাম!ছুটছি,কেন ছুটছি জানি না,তবুও ছুটতাম,কিছু একটা খুঁজতাম আর কি!”

এ.পি.সি রোড আসতেই সুপ্রীতি নেমে গেছে।টাকা বের করতে গিয়ে সুবীর খেয়াল করল ওর পকেটে ঐ কাগজটা কোনো বিল বা অফিসের কাগজ নয়,ওটা একটা প্রেমপত্র।মাথায় বাজ পড়লেও ও এত অবাক হত না!সাদামাটা মধ‍্যমগোত্রীয় চেহারা,চোখে গোল চশমা,চুলটা এতটাই বেয়াদপ যে জেল দিয়েও তাকে ঠিক করা যায় না….এসব দেখে কোনো মেয়ে প্রেমে পড়তে পারে এটা অবিশ্বাস্য ওর কাছে।ভীড়ে আর পড়া হয়নি লেখাটা।সারাদিন অফিসেও ফাঁকা পেল না একটুও।তাছাড়া যখন তখন যে কোনো কলিগ মুখ বাড়ালেই বিপদ ভেবে উচাটনটুকু মনে পুষে রাখল।বাড়ি ফিরেই কাগজটা খুলল।পত্র ঠিক না,একটা কবিতার মতো গদ‍্য একটা চিঠি।
উলটে পালটে যতবারই পড়ুক এ নিপাট প্রেম নিবেদন ছাড়া আর কিছুই নয়।এ বাড়িতে এ চিঠি আর কার জন্য আসতে পারেই বা! নিখিল অবাঙালি মানুষ,তার জন্য নিশ্চয়ই কেউ বাংলাতে চিঠি!হতেও পারে বা,হয়তো কলকাতায় এসে কোনো প্রেম-টেম করছে সে, তাছাড়া সুপুরুষ বলতে মেয়েরা ঠিক যেমন চায় আজকাল নিখিল অনেকটাই তেমন।তখনকার মতো চিঠিটা ভুলে গেল।

অফিসে ফাইলের মাঝে আবার দুদিন পর রহস‍্যময়ীর চিঠি পেল সুবীর।আশেপাশে কেউ নেই দেখে নিয়ে ঝটপট খুলে ফেলল।

আহা!কি যে বিপদে পড়েছে সে তা আর কেউ না জানুক সে ভালোই টের পাচ্ছে।কে বা এই রহস্যময়ী!কবিতার পর ধাঁধা,এবার না জানি কি আসবে আবার ভেবেই সুবীরের বুক ছলাৎ ছলাৎ করছে।নিখিল তাকে জানিয়ে দিয়েছে এসব তার জন্য আসছে না।তবে বাকি কেবল সুবীর।রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকল ও।কলকাতায় এসে গোনা কতক মেয়েকে চিনেছে ও।ওর বাড়িওয়ালা বৌদিটার নজরটা কেমন জানো লাগে ওর!ও খুব একটা পাত্তা দেয়না।তবে বাড়ি অবধি ঠিক ছিল,অফিসে কি করেই বা সেই চিঠি তার জন্য আসবে তাহলে!তবে বৌদি নয়,তাছাড়া সে এতটা দুঃসাহস দেখাবে না আশা করছে সুবীর।তাহলে কি অফিসে মেয়েদের মধ্যে কেউ!ওর সাথে কথাবার্তা আছে এমন মাত্র তিনজন,তানিয়া দি তো বেশ বড়,দিদি দিদি করে সম্মান করে ও।বীথি প্রায় সমবয়সী,তবে চলন-বলন বুঝিয়ে দেয় ও বেশ নাক উঁচু মেয়ে।ঐ মাল্টিপ্লেক্স,দামি রেস্তোরাঁ এদের পছন্দ হলেও কবিতা বিষয়টা ক‍্যারেক্টরে অ‍্যাডজাস্ট হচ্ছে না।আর থাকল তৃষা,সে সদ‍্য ডিভোর্সী হলেও একা হাতে মেয়ে সংসার সামলাচ্ছে,এককথায় অলরাউন্ডার।প্রেমে বিয়েতে আঘাত পেয়ে সেপারেশন,সে কি এসব ছেলেমানুষী​ করতে পারে নাকি!ভাবতে ভাবতেই বাস ধরল।সুপ্রীতি নিজেই পাশে এসে বসল ওর।

“কি ব‍্যাপার!কার চিন্তায় বিভোর,কে সেই মনচোর!”

“ইশশশশ্,আমি তোমাকে দেখিইনি আসলে”।

“হুম,সে তো দেখলামই।”

সুপ্রীতির সাথে বাসেই আলাপ ওর।ও যা মুখচোরা তাতে অচেনা কারো সাথে বন্ধুত্ব করার ক্ষমতা ওর থাকেনি।সেদিন বাসে ভুল করে ধাক্কা লেগে গিয়েছিল সুবীরের সাথে একটা মেয়ের।মেয়েটা আবার ফেমিনিজম তুলে সে কি ভাষণ দিল।যাক গে যাক,মেয়েদের এই দিকটা সুবীর বোঝার চেষ্টা করে বলেই প্রথমে চুপচাপ শুনছিল মেয়েটার কটুক্তি।তাতে হিতে বিপরীত হল।তখন সুপ্রীতি না এলে ওকে মারধোর দিয়ে প‍্যাসেঞ্জাররা বাস থেকেই নামিয়ে দিত।বলেছিল,”আমি দেখেছি উনি কিছুই করেননি।আপনারা নিজের কাজে মন দিন তো।”সেদিন প্রথম সুপ্রীতিই কথা শুরু করেছিল।

“কি ক‍্যাবলাকান্ত আপনি হে!যা খুশি বলে গেল পাগলি মেয়েটা আর আপনি কিনা বোকার মতো….”

আরও বকেছিল সুপ্রীতি।তবে ওর বেশ ভালোই লেগেছিল আর কি।তাই চুপচাপ শুনেছিল।সেই থেকে জায়গা থাকলে ওরা পাশাপাশি বসে,কথা বলে একটু আধটু।

সুবীরের হঠাৎ মনে হল তবে কি সুপ্রীতি!হতেই পারে তো,ও বাংলায় মাস্টার্স করেছে।তাও সুবীর অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়েই থাকল।মুখ দিয়ে কিছুই বলল না।কেউ যেন ওর গলার উপরেই চেপে বসেছে জোর করে।

“এই তুমি কি একদম বোকা! কিছু বোঝো না তাই না?”

“মানে ঐ চিরকূটে প্রেম…..”

“এত কনফিউশনের কি আছে!মানে কটা মেয়েকে চেনো তুমি?ডুবে ডুবে জল খাও তাই তো!”

“আরে,ব‍্যাপারটা তা নয়,ইয়ে মানে…”

“বোঝো!আবার মানে টানের কি দরকার!এটা আমার জন্য তেমন বড় ব‍্যাপার ছিল না।আজ ভ‍্যালেন্টাইনস ডে কিন্তু,আমার স্টপ আসতে পাঁচ মিনিট,ঐটুকুই সময়।”

সুবীরের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।সত‍্যিই তবে সুপ্রীতি ওকে!তবে ও কি করবে!কি বলবে!

সুবীর চুপ করেই থাকল।সুপ্রীতি রেগে নেমেই গেল। সুবীর পিছন পিছন নেমে পড়ল।পেছন থেকে ডাকল, সুপ্রীতি…সুপ্রীতি….

ও কিছুতেই শুনছে না।শেষমেশ বুকে সাহস সঞ্চয় করে হাত ধরে টানলো।সুপ্রীতি দাঁড়িয়ে পড়েছে। সুবীর আবার চুপ।

“বলো!কি হলো!”

“না,মানে আমি পারি না কবিতা,ধাঁধা,আমি এক্কেবারে গাধা।”

সুপ্রীতি হেসে উঠল।

“যা পারো তাই বলো”

“ইয়ে মা…নে…আমি বাবা-মাকে আসতে বলছি,তোমার বাড়ি যাবে ওরা।আগেই গাড়ি কিনতে যাব কাল।একটা ছোটো ফ্ল্যাট নেব আমাদের দুজনের জন্য।ছোটো বাচ্চার জন্য একটা আলাদা বাড়ি থাকবে।”

“এটা কি ছিল?প্রপোজ!”

“ঐ আর কি,মানে আমিও তোমাকে…….”

“ভালবাসো?তাই তো!”

সুবীর মাথা নাড়ালো।সুপ্রীতি মাঝরাস্তায় ওকে জড়িয়ে ধরেছে।ও বুঝলো সুপ্রীতির শরীরী গন্ধে ওর চেতনা লোপ পাচ্ছে,মাথাটা ঝিমঝিম করছে,হাত-পা অবশ হয়ে গেছে।ও আজ প্রথম নেশা করেছে। ভালোবাসার নেশা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।