গল্পবাজে সুদীপ ঘোষাল – ১

নবপ্রেমিক

প্রচন্ড স্রোতে নদীতীর ভেঙ্গে কপালকুন্ডলা ডুবে গেলেন।নবকুমার নদীর জলে লাফ দিলেন। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করে নবকুমার, কপালকুন্ডলাকে পেলেন না। স্রোতের তোড়ে দুটি দেহ দুদিকে ভেসে গেলো। তারপর নবকুমার কাটোয়া ঘাটে একটা বাঁশের ধাক্কায় অচৈতন্য হয়ে পরে রইলো।আর কপাল কুন্ডলা কুন্তিঘাটে নদীতীরে পাথরের ধাক্কায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইলো। কাটোয়া ঘাটে মনা বায়েন স্নান করতে এসে দেখলো, এই কি ছোটোবেলায় হারিয়ে যাওয়া আমার ছেলে।এই গঙ্গায় স্নান করতে এসেই ছোটোবেলায় তার ছেলে হারিয়ে গেছিলো।মন জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো,হে ঈশ্বর তোমার অসীম করুণা। তুমি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছো।মনা একটা ভ্যানে চাপিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে এলো।মনার স্ত্রী মায়ের যত্নে সারিয়ে তুললো ছেলেকে। মনা বললো,আমরা নতুন করে আবার আমাদের ছেলেকে ফিরে পেলাম, তাই এই ছেলের নাম দিলাম নবকুমার।ছেলেটি বললো,আমার নাম দিলেন নবকুমার।আমি কে কোথা থেকে এলাম? মনা বললো,তুমি আমাদের ছেলে। নবকুমার বললো,আমার কিছুই মনে পড়ছে না। আমি আপনার ছেলে।আমার মা কোথায়। মাকে জড়িয়ে ধরে নবকুমারের কান্না। মাথায় প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে সে ভুলে গেছে পূর্ব কাহিনী।
এদিকে কপালকুন্ডলারও স্মৃতি হারিয়ে গেছে পাথরের ধাক্কায়। এক জমিদার স্নান করতে এসে উদ্ধার করলেন তাকে। দেখলেন এ তো এখানে থাকলে বিপদ হবে।লোকজনদের বললেন,একে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তোলো।অনেক কাজের মেয়ের মধ্যে এ বেঁচে থাকবে।বাড়িতে সুস্থ হলে মেয়েটিকে সবাই তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলো কিন্তু সে কিছুই বলতে পারলো না। তাই গিন্নিমা তার নাম দিলেন পিউ।সে মেয়ের মতই থাকবে আর যতটা পারবে বাড়ির কাজ করবে।তাছাড়া পিউ লেখাপড়াও শিখতে শুরু করলো।

শুরু হলো তাদের নতুন জীবন। দুবছর কেটে গেলো তাদের। তারপর এলো শরৎকাল। এক কাজের লোকের সাথে পিউ এসেছে ঢোলের খোঁজে।কাটোয়ার বায়েনপাড়ায় তারা পেয়ে গেলো নবকুমার বায়েনকে।তাকে নিয়ে চলে এলো কুন্তিঘাট।

বৃষ্টি পড়ছে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি। সহজে থামার নয়। আলপথে হেঁটে আসছে পিউ। তার পিছনে ঢোল কাঁধে নবকুমার বায়েন। নবকুমার নিজের বুদ্ধিতে ঢোল বাজানো শিখেছে। এবার সে জমিদার বাড়ি কুন্তিঘাটে যাচ্ছে পুজোর সময়।

পিউ স্লিপ খেতে খেতে কাদা মাড়িয়ে চলেছে। এত পিছল যে,এক পা এগোলে দু পা পিছিয়ে যাচ্ছে। পিউ বললো,আপনি আমার হাত ধরুণ।আমি পড়ে যাচ্ছি।সঙ্গের বুড়ো লোকটা পিছলে পড়েছে কাদায়।সে বলছে,পিউ তোরা চল।আমি চান করে যাচ্ছি।

নবকুমার বললো,পুজো আছে, ওখানে বাজাতে চললাম। ওরা লোক ভালো।

—— নিশ্চয়।আমাকে একটু হেল্প করুন প্লিজ। আমি পরে যাবো কাদায়।
—– ঠিক আছে,হাতটা দিন।
——আপনার নাম কি?
——- নবকুমার বায়েন।

নবকুমার নাম বলবে কি করে। কষ্ট করে কাঁপতে কাঁপতে বললো। শরীরে শিহরণ খেলে গেলো নরম হাতের ছোঁয়ায়। কোথাও ভীষণ শব্দে বজ্রপাত হলো। পিউ ভয়ে নবকুমারকে জড়িয়ে ধরলো। খুব খারাপ লাগছে নবকুমারের। তবু নিয়ন্ত্রিত মন। মহাপুরুষের মতো।

পিউ বললো,সরি,কিছু মনে করবেন না। বাজ পড়লেই ভয়ে আমি নিজের লোককে জড়িয়ে ধরি। আপনি আমার নিজের লোকের মতো বিশ্বস্ত। আপনার বাড়ি কোন গ্রামে। একটু চেনা চেনা লাগছে।
নবকুমার বললো,আমার বাড়ি অনেক দূর। কাটোয়া গ্রামে। তবে অফ সিজনেগঙ্গা নদীতে মাছ ধরতে আসি।তবে অনেকদিন থেকে নানা জায়গায় ঘোরঘুরি করি। আপনাকেও বেশ চেনা চেনা লাগছে। অনেকদিন পরে এদিকে এলাম তো। তাই হয়তো চিনতে পারছি না।

কথা বলতে বলতে দুজনেই চলে এলো গ্রামের কাছাকাছি। বৃষ্টি,ঝড়ে অনেক বড়ো বড়ো গাছ উল্টে পরে আছে। গ্রামে ঢুকেই ঢালাই রাস্তা। এবার পিউ বললো বাড়ি আসুন।জল খেয়ে যাবেন।
—— না না,এখন না।দেরি হলে ঘোষ মশাই বকবেন।মন্দীরে যাই।
—- ঠিক আছে, যাবার দিন কথা হবে কিন্তু।
—- ঠিক আছে দিদিমণি।

তারপর মন্দিরের পাশেই ঢুলির ঘর। মেঝেতে খড় আর সতরঞ্চি বিছানো। নবকুমার ঢোল নামিয়ে প্রথমে ঢোলটা মুছলো। ঢোলের সঙ্গে কথা বলছে, খুব ভিজে গেলি রে। এখন আওয়াজ বেরোলে হয়। তা না হলে বাবুরা বকবে। কাঁসিটা মুছতে মুছতে বললো,কাউকে বাজাতে দিয়ে দোবো। এখন আর কাউকে কাঁসি বাজাতে এনে পরতা হয় না। আলাদা কোনো টাকা নাই।

তারপর নিজের মাথা মুছলে। গা,হাত, পা সব মুছলো। গামছা দিয়ে ঢোলটা হাওয়া করতে লাগলো। বলছে,শুকো বাবা তাড়াতাড়ি শুকো। শুকনো হলেই আওয়াজ বেরোবে। বাবা,তবেই পয়সা মিলবে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।