বিচ্ছু দুটি যে গ্রামে প্রথম আসলো সেই গ্রামটা পর্তুগিজ জাহাজ ঘাঁটির বিপরীত গ্রাম,নাম শামুকপোতা। হ্যাঁ এই শামুকপোতা গ্রামই হলো ব্রিটিশদের কলোনি ,টালিনালা এখানেই শেষ হয়েছে আর পড়েছে ফেলে আসা সুন্দরবনের মাঝখানে বিদ্যাধরীতে। আর এই গ্রামের বিপরীতে মানে নদীর বিপরীত গ্রাম হলো তাড়দা গ্রাম,হুম ওটাই পর্তুগিজ কলোনি।
বিচ্ছু দুটো বইতে পড়ে এক মাঝবয়সি চায়ের দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলো এখানে মানে এই তাড়দা গ্রামে পর্তুগিজ জাহাজ ঘাঁটিটা কোথায় কাকা? আর তার বিপরীত গ্রাম শামুকপোতা ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ! দোকানদার যেন আকাশ থেকে পড়লো! বাপের জন্মেও শোনেনি এমন কিছু তাদের গ্রামে ছিল কিনা!
এর পর সাবির সুবীর দুই বিচ্ছু মতলব করলো ।তাড়দা গ্রামের বাজারে ওরা বেড়াবে।এই গ্রাম দুটি সোনারপুর স্টেশন থেকে বড়জোর আট /দশ কিলোমিটার হবে । ওদের উদেশ্য বাজারে বেড়ানো নয় মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই সেই পর্তুগিজ জাহাজ ঘাঁটির সন্ধান। অনেক লোকের সাথে কথা বলে কেউ বলতেই পারলনা। কেউ জানেন ও না এমন কোনো ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই তাড়দা গ্রামে।
কাছেই আছে প্রতাপনগর গ্রাম।যখন আকবর বাংলায় অভিযান করেন সেই সময় বাঙ্গলার সুলতান ছিলেন দাউদ খান কার্নানি,ও তার ছেলে সুলেমান কার্নানি। এদেরই কর্মচারী ছিলেন প্রতাপাদিত্য। পরে সুযোগ বুঝে দাউদ খান কার্নানিকে সাহায্য না করেই অপেক্ষাকৃত নির্জন প্রাক্তন সুন্দরবন যশোরে প্রতাপাদিত্য রাজ্য স্থাপন করেন। এই প্রতাপনগর গ্রাম তারই স্মৃতি বহন করে।
সুবীর বললো ওদের পড়ার ব্যাচ এর বন্ধু বি. ডি. মেমোরিয়াল স্কুলে পড়ে। ওটা প্রতাপগড়। দিব্যেন্দুকাকা বলেছিল ওটাও প্রতাপাদিত্যের স্মৃতি বহন করে। সাবির বললো , তুই দিব্যেন্দু কাকার কাছে থেকে শুনিসনি কামালগাজীর কাছে যে পেপসি কারখানা আছে, পেপসির বোতলের গায়ে দেখবি লেখা আছে ফর্তাবাদ থেকে তৈরি। ওই ফর্তাবাদ হলো মুঘলদের দুর্গ। একদিন ওখানে যাওয়া হবে। সুবীর বললো তুই থাম তো! আগে পর্তুগিজ দুর্গ খুঁজে বের করি তার পর না হয় মুঘল দুর্গ খুঁজে বের করবখন। এটাই পাচ্ছি না। আবার অন্য একটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস! কেউ জানে না! শুধু বই এর পাতায় রয়েছে। আবার এরকম ধরনের বই সব জায়গায় পাওয়া যায়না। আবার দিব্যেন্দুকাকা টিংকুমামার মত লোকজন ও নেই। যারা ব্যাপারটা জানে। চারদিকেই ত দেখছি ধু ধু বাদা! দূরে গরু ছাগল চরছে। এখন কোথায় তুই পর্তুগিজ জাহাজঘাঁটি খুঁজে বার করবি!
সাবির বললো চল বাজারে ।সেখানে একটা দোকানে এক বুড়ো জিলিপি ভাজছিল, ওর দোকান থেকে গরম গরম জিলিপি কিনলো দুজন। জাহাজ ঘাঁটি ফাঁটি যখন পেলাম না এই জিলিপি খেয়ে মনটা খুশ করে চল বাড়িতে চলে যাই। লাস্ট চান্স। এই বুড়োরা ছাড়া কেউ পর্তুগিজ জাহাজ ঘাঁটির কথা কেউ বলতে পারবে না বোধ হয়। ওরা জিলিপির দোকানের বুড়োর কাছে জানতে চাইলো। আচ্ছা দাদু এখানে পর্তুগিজ জাহাজ ঘাঁটি ছিল বহুকাল আগে আপনি কি এ ব্যাপারে কিছু জানেন? এই দাদু ও যেনো আকাশ থেকে পড়লো। তবে আশেপাশের পুরাতন মন্দিরের সন্ধান দিলেন।
দুই বিচ্ছু জিলিপি কিনে প্ল্যান করলো রাস্তায় কোনো ফাঁকা জায়গা পড়লে তখন খাওয়া হবে। বিচ্ছু দুটো ব্যর্থ মন নিয়েই ফিরে আসছে। ওরা প্ল্যান করলো একটু বেশি ঘুরপাক খাওয়ার জন্য চম্পাহাটির মেন রোড ধরে ফের সাউথ গড়িয়া/ বেনিয়াবৌ গ্রামে ফিরে আসবে।
খালপাড়ে একটু ফাঁকা জায়গায় ওরা গেলো নিরিবিলিতে জিলিপি খাওয়ার জন্য।ওরা জানতনা এই খাল ই এককালে ছিল বিদ্যাধরী নদী। জায়গাটা বেশ নির্জন। চারপাশ ঝোপঝাড়ে ভরা।জায়গাটা বাঁশের বেড়া দেওয়া। শুধু একটা উঁচু জায়গায় একটা বটগাছ। ওই জায়গাটা একটু পরিষ্কার মত।গ্রামের লোকজন ওখানে ঘট, সুতো বেঁধে রেখেছে সংস্কারবশত। ওরা বটগাছ তলায় বসে বসে জিলিপি খাবে বলে গেছে।
ওরা জানত না এই জায়গাটা আসলে একটা পরিত্যক্ত শ্মশান , তেমনই জানতনা এই খালটাই ছিল এককালে বিদ্যাধরী নদী! এক শতাব্দী আগে তখন আশেপাশের গ্রামের সবে পত্তন হয়েছে। শ্মশান বলে নির্দিষ্ট জায়গাও ছিল না। বিদ্যাধরীর তীরে ফাঁকা জায়গা পেলেই লোকে মড়া পুড়িয়ে আসতো। তবে কলেরার সময় যখন গাঁ উজাড় হয়ে যেত। এখানেই শয়ে শয়ে মড়া পড়ানো হতো। তবে তারও আগে যখন এটাই ছিল ঘোর সুন্দরবন। এটা ছিল ডাকাতকালীর আস্তানা। ঠিক যেমনটা ছিল কলকাতার কালীঘাট। কালীঘাট তখন ডাকাতদের আস্তানা। আর কালীঘাট তখন জঙ্গলের মধ্যে! ভবানীপুর থেকে মানুষজন নৌকা চড়ে দিনের বেলা এসে দিনের বেলায় ফিরে যেত। পাছে ডাকাতের সাথে যাতে দেখা হয়ে যায় সেই ভয়ে।
বিদ্যাধরীর এই পরিত্যক্ত শ্মশান ছিল তার থেকেও জঙ্গলের আরো গভীরে আরো বেশি ডাকাতের উৎপাতের জায়গা আর আরো বেশি ভয়ংকর! এখানে আশেপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। উচু জায়গায় যেখানে বটগাছ সেখান থেকে একটু দূরে একটা লতাপাতার ফাঁকে আছে একটা ছোট্ট কুটির। হ্যাঁ ওখানেই থাকে একটা কাপালিক! নির্দিষ্ট দিন ছাড়া এখানে ঢোকা কঠোরভাবে নিষেধ! আর এখানে সাবির সুবীর দুই বিচ্ছু কিচ্ছু না জেনেই ঢুকেছে শুধু নিরিবিলিতে জিলিপি খাওয়ার জন্য!