গল্পের জোনাকিতে স্মরজিৎ দত্ত

শ্মশান পাড়ের বাঁশবন
শান্তিপুরের ছোট্ট একটি গ্রাম। তারই পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে অজানা নদীর ধারা। এই গ্রামেরই পূর্বদিকে একটি শ্মশান তার পাশে বাঁশবন। এই বাঁশবন আর শ্মশান নিয়ে অনেক অদ্ভুত প্রচলিত কাহিনী আছে।
এই গ্রামেরই একজন নরেন কাকা। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকার বয়স এখনো ১৪ বাকি। শ্মশানের পাশ দিয়েই তাকে প্রতিদিন ফিরতে হয় বাড়ি। সেদিনও শ্মশানের পাশ দিয়েই বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে বহুদিন তিনি দেখেছেন শ্মশানে লাশ জ্বলতে। কিন্তু সেদিন তার এক অদ্ভুত অনুভূতি ঘটলো। হঠাৎ দেখলেন শ্মশানে একটা জ্বলন্ত শব দাউদাউ করে জ্বলছে । অথচ তার চারপাশে কেউ নেই। নরেন কেন জানি বিব্রত হয়ে পরলো। দ্বীকবিদিক না ভেবে ছুটতে শুরু করল সে। কিন্তু বাদ সাধলেন তার পেছনের কর্কশ কোলাহল। মনে হলো কেউ বলছে “ফিরে আয়, ফিরে আয়…… আমায় সঙ্গ দে”। নরেন যথেষ্ট সাহসীও ছিল অথচ সেই সাহসী নরেনের রক্তহীম হয়ে আসলো।
শ্মশানের পাশেই ছিল একটা বাঁশ বন। যার গা ঘেঁষে কুলুকুলু শব্দে বয়ে চলেছে একটি সরু খাল। এই গ্রামের প্রায় অনেকেই শুনেছে সন্ধ্যা হলেই ওই বাঁশবনের ভেতর থেকে একটা গোঙানির শব্দ । প্রবাদ আছে কেউ কেউ নাকি দেখেছে এক বৃদ্ধাকে সাদা শাড়ি পড়ে এপার থেকে আকাশ পথে ভাসতে ভাসতে খালের ওপারে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলে বাঁশবনের ফাঁকে কখনো কখনো জ্বলজ্বল করা তার দুটি লাল চোখ।
বহু বছর আগে এই গ্রামে চন্ডী নামে এক বিধবা ছিল। যেকোনো কারণেই হোক গ্রামে সে পরিচিত ছিল ডাইনি নামে। একদিন সে নিজেই নিরুপায় হয়ে আগুন দিয়ে শ্মশানে আত্মাহুতি দিয়েছিল। শোনা যায় তখন থেকেই তার আত্মা এই বাঁশবনে ঘোরাফেরা করে। আর তাকেই নাকি দেখা যায় মাঝে মধ্যে।
এই গ্রামেরই ছেলে পটলা। কিশোর বয়স দামাল ছেলে। এ পারা ওপারা মাতিয়ে বেড়ায় । একদিন ওই সন্ধ্যায় বাঁশবনের দিকে গিয়েছিল, পরের দিন পিকনিকের জন্য জ্বালানি কাঠ কুড়োতে। শোনা যায় সে নাকি আর ফিরে আসেনি। কিন্তু তার মা বলেছিল রাতের বেলা বাড়ির জানালার বাইরে সে পটলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। সে নাকি নিথর চোখে তাকিয়ে ছিল তাদের বাড়ির দিকে । কাঁদতে চাইছিল, কিন্তু মুখে তার কোন শব্দ নেই। মা ছুটে গিয়ে পাগলের মত ডেকেছিল বার কয়। পটলা, পটলা, কিন্তু পটলাকে দেখা যায়নি। শুধু একটা গোঙানির আওয়াজ অনেকক্ষণ শোনা গেছে। আর শেষে সেই আওয়াজ মিলিয়ে গেছে ওই বাঁশবনে।
এ পাড়ায় খুব সামান্য গুটিকয় ছেলেমেয়েই কলেজের দোরগোড়ায় গিয়েছে। তারই মধ্যে রতন। গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে শহরের মেলবন্ধনের দরুন তার একটা অন্যরকম সাহস তৈরি হয়েছে। রতনও শুনেছে এইসব ঘটনা। কিন্তু তেমনভাবে সে বিশ্বাস করতে রাজি হয়নি । একদিন সে তার গুটিকয় বন্ধু বান্ধব নিয়ে ক্যামেরা টর্চ ইত্যাদির সাথে করে প্রবেশ করে সেই বাঁশবনে। ঘন্টাখানেক কিছু ঘটেনি। তখন ঠিক রাত বারোটা, হঠাৎই তাদের নজরে পড়ে গাছের ডালে যেন ঝুলতে দেখা যাচ্ছে একটা নারী। তার চুল কোমর পর্যন্ত। চোখ দুটি লাল আর তার জিহ্বা মুখের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। রতনের সাথে অন্যান্য বন্ধুবান্ধবরা সে সময় পালালেও রতন দৌড়ে পালিয়ে যায়নি। পালিয়ে যায়নি ঠিক, তবে সেদিনের পর থেকে সে আর স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না।
পাড়ার মাতব্বরেরা ভাবতে থাকে, এর সমাধান কি আছে ? স্থানীয় এক পুরোহিত , তাকে পুরোহিত বলা ভুল বরং বলা যেতে পারে, গ্রামের পরিচিত তান্ত্রিক। নাম তার শিবচরন মুখোপাধ্যায়। তিনি সব শুনে বললেন, এটি একটি শুদ্ধ আত্মার অভিশাপ। যাগযোগ্য আর মন্ত্র বলেই এর উপশম সম্ভব। যথারীতি তার প্রস্তুতিও চলল । তিনরাত যজ্ঞ চলেছিল শ্মশানে। তৃতীয় রাতেই হঠাৎ এক হৃদয়বিদারক কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তারপর কি ঘটেছিল তার প্রত্যক্ষ কেউ না করলেও পরের দিন দেখা গেল ঠাকুরমশায়ের শরীর দগ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে কিন্তু তার চোখ দুটি নেই।
সেদিন দুপুরবেলা আচমকা আকাশ মেঘে ঢেকে গেল। একটা ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, তাতে তিনজন শিক্ষক । স্কুলে তেমন ছাত্র সংখ্যা সেদিন ছিল না পাঁচ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে চলছিল ক্লাস। হঠাৎ ক্লাসরুমের জানলা খুলে গেল। একটা ছোট্ট মেয়ে ঢুকে পড়ল ক্লাসের ভেতরে । একটা পচা লাশের গন্ধ চারিদিক ভরে গেল। মেয়েটির চুল ভেজা, দেখতে একটা অদ্ভুত আকারের। একটা শব্দ যেন ভেসে এলো কোথাও থেকে । “আমি ফিরে এসেছি……..ছি….ছি”। কিন্তু তারপর হঠাৎই ধোয়ার মত মিলিয়ে গেল।
সেদিন পূর্ণিমার রাত । গ্রামের লোকজন হঠাৎ শুনতে পায় শ্মশান ঘাট থেকে বাজনার আওয়াজ আসছে। তাতে যেমন আছে ঢাক, আছে কাঁসর , ঘন্টা ইত্যাদি। যেমন শোনা যায় কখনো কখনো বয়স্ক বা বৃদ্ধ লোক মারা গেলে এমন ঢাকা, কাশর ঘন্টার আওয়াজ। যা নিয়ে অনেকেই আসে। সবাই তাইই ভেবেছিল। কিন্তু সকালে গিয়ে দেখা যায় শ্মশানে তেমন কোন ছায়াও নেই । অথচ সারা জায়গা জুড়ে ছড়ানো আছে ফুল; পুড়ে যাওয়া কাঠের টুকরো; আর শ্মশান চাতালে দেখা গেল তাজা রক্তের দাগ। সেই রাতেই একজন কুমারী মেয়ে হারিয়ে যায়। তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
রণবীর পাল গ্রামের মৃৎশিল্পী । তার কুমোরটুলি বাঁশবনের সংলগ্ন এলাকাতেই। গ্রামের গুটিকয় দুর্গাপুজোয় তারই তৈরি মূর্তি শোভা পায় এদিক সেদিক। মহালয়ার সকাল নিয়ম মেনেই সেই মৃৎশিল্পী প্রতিমার চোখ অংকন করেন। হঠাৎই রণবীর পাল চোখ আকবার সময় হঠাৎ দেখে ফেলেন; বাঁশবনের দিক থেকে কারা যেন তাকিয়ে আছে তার সেই আঁকার দিকে। সেই রাতেই ওই সময়ে যে মূর্তির চোখ অঙ্কন করা হয়েছিল; সেই প্রতিমার চোখ বেয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়ছে। আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পরে রণবীর পাল। হঠাৎই নজরে আসে প্রতিমার চোখ দুটি ফাঁকা। আর সেই ফাঁকা চোখের মাঝে দুটি রক্ত চক্ষু তার দিকে তাকিয়ে আছে।
এই গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী, ধনীও বটে, রমেন মল্লিক। তারই বড় ছেলে সুশোভন । তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল এক অজানা অচেনা একটি মেয়ে। অনেক বাধা বিপত্তির পর সেই মেয়ের সাথেই তার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের সেই রাতে বাসর ঘর থেকে হঠাৎ ভয়ানক চিৎকার। পরদিন সকালে দেখা যায় বিছানায় পড়ে আছে সুশোভনের নিথর দেহ। আর সেই নববধূ, তার কোন খোঁজ নেই। আর সেই রাতেই বাঁশবনে উড়তে দেখা যায় সেই নববধূর শাড়ি।
শোনা যায় চুরির শব্দ, নুপুরের আওয়াজ।
গ্রামে এমনিই প্রচলন আছে রাতে কেউ ডাকলে সাড়া না দেবার। গ্রামের এক বৃদ্ধার নাম লতা বুড়ি। বুড়ি বলতেন প্রতি অমাবস্যায় তার স্বামী নাকি এসে তার পাশে বসে, শুধু তাই নয় তাকে নাকি বলে; ” এসো আমার সঙ্গে। আমি একা আছি গো; কেউ দেখতে পাবে না”। এমন ডাকে একবার বৃদ্ধা সত্যি হেঁটে চলে যান সেই বাঁশ বনের দিকে । বৃদ্ধা আর ফেরেননি। বনের মুখে প্রবেশের দ্বারে একটা পদচিহ্ন দেখা গিয়েছিল। সেখানে ছিল যেমন রক্তের ছোঁপ, তেমনি ছিল পুড়ে যাওয়া শাড়ির টুকরো।
এ গ্রামের লোক এমন দেখে অভ্যস্ত । সন্ধ্যা নামলেই শ্মশানের আকাশে দেখা যায় লাল আলো । প্রথমে তার গাড়ত্য লাল , শেষে ধীরে ধীরে সেই লালাভো মিলিয়ে যায়। সেই আলো যখন দেখা যায় তখন গ্রামের যত কুকুর তারা হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। আবার অনেক সময় তার সাথে ধুনোর গন্ধও পাওয়া যায়। সাধারণত মৃতদেহের সৎকারের সময়ে ব্যবহার করা হয় তেমন ধুনোর । অথচ শ্মশানে কোন মরা থাকে না।
শান্তিপুরের এই গ্রামের, এই অদ্ভুত ঘটনা সাংবাদিকদের কানেও পৌঁছিয়েছিল। এক সাংবাদিক পুরো ঘটনা তদন্ত করে তার পূর্ণাঙ্গ একটা বিবরণ তাদের কাগজে ছাপিয়েছিল। ঘটনাটি একটু ব্যতিক্রম ছিল। একটা পূর্ণাঙ্গ পরিবারকে একসাথে দাহ করা হয়েছিল। যদিও পরে জানা যায় সেটা ছিল হত্যাকাণ্ড। সেই পরিবারের আত্মা আশ্রয় নিয়েছিল বাঁশবনের ছায়ায়। যে সাংবাদিক তার তদন্ত করেছিল, তার তথ্য বা ঘটনা সংবাদমাধ্যমের অশ্রুধারা। সেই নারীর পেছনে ছিল জ্বলন্ত আগুন।
পুজোর সময় গ্রামে যাত্রা পালা হবে এটা একটা সাধারণ ঘটনা। বাঁশবনের কাছেই একটা বড় মাঠ ছিল। সেখানেই যাত্রা দলের সমাগম হত। বেশ ক’দিন ধরে চলতো যাত্রাপালা। এবছর তরুণ অপেরার যাত্রাপালা ছিল “মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি”। রাত বাড়ার সাথে সাথে পালাও বেশ জমেছিল। হঠাৎ এক অভিনেত্রী চিৎকার করে বলে ওঠে “ওই যে ও এসেছে, ওই যে এসেছে; আমাকে নিতে।”তারপরেই সে জ্ঞান হারায়। তারপর আর তার জ্ঞান ফেরেনি; আর মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি যাত্রাপালাও হয়নি আর।
নিঃশব্দে গ্রামের মানুষ আজও অবাক হয়ে থাকে।
রোজ এর মত শান্তিপুরের সে গ্রাম আজও সন্ধ্যায় থমকে যায়। তেমন কথাবার্তা কেউ কারো সাথে করে না। কেউ হাসে না। কেবলই চারপাশে একটা অদৃশ্য কারো উপস্থিতি বোধ হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, থেকে থেকে বাঁশবনের থেকে একটা লম্বা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ ধেয়ে আসছে। তার সাথে দুঃখ আর রাগ মিশিয়ে কেবলই কাঁদার একটা শব্দ ভেসে আসে।
শান্তিপুরের সেই নদীর ধারে চাপাডাঙ্গা গ্রাম । আজও বেঁচে আছে বটে । এ ঘটনার সুরাহা আজও হয়নি। আজও এখানকার মানুষ বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ পায়। একটা চাপা ভয়, কান্নার আওয়াজ, বাঁশবনের থেকে সেই আওয়াজ পাওয়া যায় একটানা। আর একটা ছায়া এখনো যেন কাউকে টেনে নিতে চায়। সেই বাঁশবনে এমন হয় কেন তা আজও কেউ জানে না। আর কাউকে আবার নতুন করে টেনে নিয়েছে কিনা তারও সত্যতা যাচাই করার সাহস জাগেনি। গ্রামের মানুষ বাঁশবনকে শেষ করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয় বারবার। তাই সূর্য ডোবার পর বড়রা যেমন সেই বাঁশবন থেকে নিজেদেরকে একটু স্বতন্ত্র বজায় রেখে চলে; তেমনি শিশু বা ছোটদেরকে তারাই বলে, তাকিও না ঐদিকে। কেউ ডাকলে সারাও দিও না । সে ডাকে সাড়া দিলে আর ফেরা হয় না।