সম্পাদকীয়

ভাষার আদর্শ
ডিবেট, বিতর্ক সভা একটি বিষয় শেখায় আমাদের, আপাতদৃষ্টিতে দেখা কোন ঘটনার দুটি দিক অবশ্যই রয়েছে। সেই দুটি দিককেই তুলে ধরতে হবে, কিন্তু প্রতিপক্ষ বক্তার প্রতি সম্মান রেখে। যুক্তি দিয়ে বলতে হবে পক্ষে বা বিপক্ষে। পক্ষে মানেই ঠিক আর বিপক্ষ মানেই ভুল তা নয়। আর এজন্যই পক্ষে ও বিপক্ষে সমসংখ্যক বক্তা থাকে। কিন্তু আজকাল দেখেছি কোন বিষয় সহজেই ট্রেন্ড হয়ে যায়। তখন অধিকাংশ মানুষ যেদিকে যায়, প্রায় গোটা সমাজ সেটাকেই ঠিক বলে মেনে নেয়। তাই আমার এসব ক্ষেত্রে বিপক্ষে নিজেকে রাখতে পছন্দ হয়। সদ্য একটি বিষয় নিয়ে খুব শোরগোল হচ্ছে, তা হলো একজন বঙ্গ অভিনেতার বাংলা ভাষাকে অপমানের কথা। এই বিষয়ে বলার আগে বলে রাখি আমি কোনদিন সেই বিশিষ্ট অভিনেতার ভক্ত ছিলাম না। আর দ্বিতীয়তঃ আমাদের মহান বাংলাভাষার মান-সম্মান এত ঠুনকো নয় যে তা কোন এক চুনোপুঁটির কথায় ভেঙে যাবে। এবারে প্রসঙ্গে আসি। আমাদের ছোট থেকে কিছু আদর্শে বড় করা হয়। এই আদর্শ গুলো আমাদের উদার হতে শেখায়, মানুষের অসুবিধা বুঝতে শেখায়, কট্টরপন্থী হতে শেখায় না। সকলকে আপন করতে শেখায়, ভেদাভেদ শেখায় না। আর এই আদর্শ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শিক্ষিত সমাজে। বাংলা ভারতের শিক্ষিত অনুসরণযোগ্য মানুষদের পীঠস্থান। তাই অনায়াসেই বাঙালির মধ্যে সেই আদর্শ বিরাজমান। ভাষার প্রশ্নে তাই সরকারি ভাষার প্রশ্নে সবার সুবিধার্থে ইংরেজিকে বেছে নিয়েছিল বাংলার অধিকাংশ। তাছাড়া ইর্ষান্বিত হয়ে সে সময়ে বাংলাকে সাথ দেয়নি অসমীয়া, ওড়িয়া ও কিছু বিহারী ভাষাভাষীরা। যদি ঐক্য থাকতো তবে হয়তো ঐক্যবদ্ধ হিন্দি ভাষা গোষ্ঠীকে আমরা হারাতে পারতাম। সে যাই হোক, এখন যখন নানা ভাষার দেশ ভারতে একটি সংযোগ রক্ষাকারী ভাষা দরকার, তখন সুবিধা অনুযায়ী ইংরেজি ও হিন্দিকে ব্যবহার করা যেতেই পারে। এবারে আসি একটি বিশেষ আদর্শের কথায়, যা কিনা আমি শুধুমাত্র বাঙালিদের মধ্যে দেখেছি। তা হলো যখন একটি গ্রুপে একজন হলেও ভিন্নভাষীর মানুষ রয়েছেন, তখন তাঁর সম্মানে ও তাঁর বোঝার সুবিধার্থে হিন্দি অথবা ইংরেজিতে কথা বলা। অথচ আমি অন্য যেকোনো ভাষার মানুষের ক্ষেত্রে দেখেছি তারা ইচ্ছাকৃত অপমান করতেই যেন নিজেদের ভাষায় কথা বলে। এমনকি বাংলারই এক উপভাষার ক্ষেত্রে দেখেছি তারা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করলেও একজন বাঙালিকে অপমান করতেই সেই উপভাষায় কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হ্যাঁ ওই অভিনেতার পাশে যারা বসেছিলেন, তারা অনেকেই বাঙালি ছিলেন না, সে কারণেই বাংলার আদর্শ থেকেই তিনি ইংরেজি বা হিন্দিতে বলতে বলেছিলেন। কিন্তু আজকাল তো হুজুগের যুগ। অতএব একটি আদর্শ আজ ভিলেন। এভাবে প্রচুর আদর্শ ভিলেন হয়ে যাচ্ছে আজকের যুগে। আমাদের ধর্মের উদারতা নামক আদর্শকে আমরা ভুলেছি, আমাদের ভাষার উদারতা নামক আদর্শকে আমরা ভুলেছি। ধীরে ধীরে আমরা একটা আদর্শহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছি। কিছু মানুষ আবার অযথাই ইংরেজি বলে। হয়তো সেখানে সবাই সমভাষাভাষীর তবুও ইংরেজি চলে আসে। সেটা হলো নিজের ভাষাকে অপমান। যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই ঘটনায় গেল গেল রব তুলেছেন, তাঁরাই কিন্তু নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন ইংরেজি মিডিয়ামে। যেখানে ইংরেজি ও হিন্দি শেখানো হয়। বাংলা ভাষা নৈব নৈব চ। তাঁদের মুখে এই প্রতিবাদ মানায় না।
যদি ফিরে যাই আদিম যুগে… মানুষের কোন ভাষা নেই, আকার ইঙ্গিতে চলছে মনের ভাব প্রকাশ। ধীরে ধীরে ভাষা সৃষ্টি হলো, তৈরি হলো ভাষাগত বিভেদ। এরচেয়ে তো পশুরা অনেক ভালো। আমাদের Indian Pariah Dog এর ভাষা বোঝে German Shepherd, Siberian Husky এর ভাষা বোঝে Labrador Retriever. এশিয়ান হাতির ভাষা বোঝে আফ্রিকার হাতি, এক শৃঙ্গ গণ্ডারের ভাষা বোঝে দুই শৃঙ্গ গণ্ডার। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ভাষা বোঝে সাইবেরিয়ান বাঘ আর গিরের সিংহের ভাষা বোঝে সেরেংগেটির সিংহ। অথচ, পড়শী রাজ্যের ভাষাও আমরা বুঝি না। সুবিধার্থে নিজের ভাষা ও অন্যের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ইংরেজি বা হিন্দিকে সংযোগী ভাষা হিসেবে বেছে নিলে হয়ে যেতে পারেন ভিলেন। দক্ষিণ ভারতে হলে হয়ে যেতে পারেন খুন। আহঃ এর নাম সভ্যতা… অথচ কোন ভাষা না যেনেও উদ্ভিদ প্রতিযোগিতা করে, সহযোগিতা করে, মিথোজীবিতা করে… বর্বর মানুষের অস্তিত্ব না থাকলে এক নিমেষে পুরো পৃথিবীকে সবুজে মুড়ে দিয়ে পৃথিবীর সকল অসুখ সারিয়ে তুলতে পারে। উদ্ভিদ হলে এসবের পাশাপাশি কুঠারাঘাতও সহ্য করতে হয়, কারণ বর্বর মানুষ রয়েছে। তবুও উদ্ভিদ হতে হবে। কিছু মানুষ আদর্শকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে, তবুও আদর্শকে নিয়েই বাঁচতে হবে। নিজেদের স্বার্থে, পুরো পৃথিবীর স্বার্থে।
সায়ন্তন ধর