আজকের লেখায় সুস্মিতা ধর

সবার উপরে মানুষ সত্য

বাংলা মধ্যযুগের এক কবি বড়ু চণ্ডীদাস উচ্চারণ করেছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী —-” সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ” মানুষে মানুষে সম্প্রীতির মূলমন্ত্র তো এটাই। তবুও ধর্মের দোহাই দিয়ে, জাতের দোহাই দিয়ে , মানুষে মানুষে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বিভেদ যখন তখন।

গত ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবরের ঘটনা। দুর্গাপুজোর মহা অষ্টমীর দিন বুধবার ভোরে কুমিল্লা শহরের নানুয়াদীঘির একটি পুজোমন্ডপে কোরআন পাওয়া যায়। পরে একদল লোক কোরআন শরিফের অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই পুজোমন্ডপে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এই ঘটনার জের ধরে সেদিনই চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে কিছু মন্দিরে হামলা চালানো হয়। সহিংসতার সময় পুলিশ গুলি চালালে পাঁচজন নিহত হয়। আহত হয় আরো বেশ কয়েকজন। সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কুমিল্লা, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, রংপুরের পীরগন্জ ছাড়াও কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও গাজীপুর সহ কয়েকটি জায়গায় হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী ১৯শে অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৭২টি মামলা হয়েছে সারা দেশে। ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয়েছে ৪৫০ জনকে।

এ তো গেল ঘটনার বিবরণ। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কি শুধু হিন্দুদের আহত করা হয়েছে ? বিষয়টি কি সেরকম? মনে তো হয় না। কারণ বাংলাদেশের বেশিরভাগ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ আহত হয়েছেন, ক্ষুব্ধ হয়েছেন এই ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনায়। তবে কেন ঘটলো এমন ঘটনা? বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার পুজোমন্ডপে পালিত হয় শারদীয় দুর্গোৎসব। গত এক দশকের চিত্র লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে এ ধরনের ঘটনা প্রকৃতপক্ষে কোনোখানেই তেমনভাবে ঘটেনি। তাহলে কি নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এটি কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্ত?

তা না হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে এমন অমানবিক ঘটনা কেন? ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের হিন্দু — মুসলমান, বৌদ্ধ – খ্রিস্টান, বাঙালি – অবাঙালি সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল মহান – মুক্তিযুদ্ধে। দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির। অনাদিকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ বসবাস করছে এক হয়ে এ দেশে। মাঝে মাঝেই অবশ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিংবা সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার একসময় বাংলার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিস্থিতি অনেকটাই গিয়েছিল বদলে।

১৯৭২ সাল। রচিত হল স্বাধীন বাংলার সংবিধান। বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করল একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে সবসময় অবস্থান করবে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় একটি কথাই বলেন। সেটি হল — ” ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। ” তাই তো আবহমান কাল ধরে মুসলিমদের ঈদের উৎসব, আবার হিন্দুদের দুর্গোৎসব বাংলাদেশে উদযাপিত হয়ে আসছে সর্বজনীন উৎসব হিসেবে। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ কখনোই নিজেকে হিন্দু – বৌদ্ধ – মুসলিম – খ্রিস্টান হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। সবাই বলতে চায় আমরা বাংলাদেশি, আমরা বাঙালি। আর এটাই বাংলার মানুষের হৃদয়ের চাওয়া,অন্তরের কথা।

তবুও ঘটে গেল অনভিপ্রেত ঘটনা। শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে যেভাবে বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, প্রতিমা, বাড়িঘর ভাঙা হল আবার কোথাও কোথাও শারীরিকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্যাতিত করা হল তা কি কোনো কুচক্রী মহলের চিন্তার ফসল নয়? তারা চেষ্টা করেছিল আরও ব্যাপকভাবে বিষয়টিকে বাংলাদেশের সব জেলায় ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপে কুচক্রী মহলের এই চেষ্টা ব্যার্থ হয়।

একটি কথা কিন্তু এখানে বলতেই হচ্ছে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত হয়নি সত্য কথা। কিন্তু এটাও তো সত্য যে প্রশাসন বা রাস্ট্রের একার পক্ষে সমগ্র দেশের শান্তি সম্প্রীতি সবসময় বজায় রাখা সম্ভব নয়। প্রশাসন বা রাস্ট্র তখনই সফল হবে যখন আপনি, আমি সবাই আরও একটু বেশি সহিষ্ণু হব, হব আরও বেশি বিবেকবান, হব সঠিক বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন। বোধহয় সময় এসেছে এটি নিয়ে ভাববার । কারণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার দায়িত্ব আমার আপনার সকলের। প্রশাসনের শক্তি দিয়ে মানুষের মনের ভেতরের পৈশাচিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আর এই শক্তিকে যতদিন আমরা নিয়ন্ত্রিত করতে না পারব, যতদিন গুজবে কান দেওয়া আমাদের বন্ধ না হবে, ততদিন এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেই চলবে।

ধর্ম আমাদের কি শিক্ষা দেয়? ধর্ম শিক্ষা দেয় উদারতা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা,আর সহিষ্ণুতা। পৃথিবীর সকল ধর্মের মূল কথা এক — মৈত্রী, শান্তি আর সম্প্রীতি। তবুও ঘটে চলে ধর্মের নামে হানাহানি – মারামারি – কাটাকাটি। ধর্মান্ধ উগ্রপন্থি। এদের কোনো দেশ নেই, কোনো জাত নেই, কোনো৷ বর্ণ নেই। এরা সবসময়ই চায় দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে, চায় ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশকে অস্থির করে তুলতে, চায় জল ঘোলা করে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে।

বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গড়তে চেয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক ধারনার, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের মামনীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই বোধকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের মুক্তমনা মুসলিম ভাই – বোনেরা, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর প্রগতিশীল চিন্তা – চেতনার মানুষ, সর্বোপরি দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কি চায়? চায় বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, চায় শেখ হাসিনার শান্তি – সম্প্রীতির বাংলাদেশ। মুষ্টিমেয় কিছু স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহলের ক্ষুদ্র স্বার্থ সিদ্ধির জন্য কি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অধরা থেকে যাবে? অবশ্যই না। রাস্ট্রের সাথে বাংলার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ এক হয়ে স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহলের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাভূত করবে। সকলের কন্ঠে উচ্চারিত হবে মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ সেই বানী
“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। “

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।