গল্পেসল্পে সুবল দত্ত – ১

জুভিনাইল

১.

‘আমি কেবল পায়ের শব্দ শুনি/শিকলের শব্দ শুনি/আজ নূপুরের ধ্বনি শুনব/শিকলপরা পায়ে নূপুর পরালে নূপুর বাজবে তো?

(নির্মল হালদার)

 

চামড়া ফেটে রক্ত ঝরলেও আজকাল তেমন আর দর্দ করেনা। হাড় ফাটুক রক্ত ঝরুক চোখ থেকে জল তো ঝরেই না, বরং আগুন যাতে না ঝরে তার জন্য মার খাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করেই থাকে সে। বাপুজি বলেছে ওইরকম ফাঁকা আগুনে কিছু হবেনা উল্টে নিজেই পুড়ে যাবি। বাপুজি বলে গেছে মার খাবি তো শক্ত হবি। মার না খেলে কি করে বুঝবি তোর ভিতরে তুইই রয়েছিস? মার খেলে তবেই প্রতিপক্ষকে চিনবি সে কত ক্ষমতাবান শয়তান। বাপুজি মরার আগে একটা বিদ্যে শিখিয়ে দিয়ে গেছে। বলে গেছে তোর সাথে ভালো মন্দ যাইহোক না কেন, ফাঁকা দেওয়ালের সামনে বসবি, দেওয়ালে হাত বোলাবি আর চোখ না ঝাপটে চুপচাপ একটুক তাকিয়েই থাকবি। তোর রাগরস হায়নিঃশ্বাস দুঃখ কষ্ট অভাব অনুযোগ সব সব দেওয়ালকে মনে মনে দিয়ে দিবি। তারপর দেখবি দেহেমনে কোনো যাতনাই থাকবে না। সব পিছলে বেরিয়ে যাবে। মনকে অনবরত স্নান করা রে রামু। মনই তোর পরম বন্ধু।

ডানপাশে কাত্‍ হয়ে গড়িয়ে কোনমতে উঠে দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসতে অনেকটা সময় লাগল রামুর। পিঠের শিরদাঁড়া থেকে থেকে শিরশির করে উঠছে। কী জানি। রুলের বাড়িতে হাড় ভেঙ্গেছে কিনা। তার উপরে বেরহম জাড়। লোহার গরাদের ভিতর দিয়ে বিষসম নির্দয় শীতপ্রবাহ অবাধে ঢুকছে উন্মুক্ত কারাগারে। একটাই কম্বল। আদ্দেকটা পেড়ে শোওয়া আর আদ্দেক ঢাকা নেওয়া। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয় রামু। অর্ধমৃতের মত আপাত সুখী অবোধ বাধ্য কয়েদীরা নিশ্চিন্ত নিদ্রায়। দেওয়ালের দিকে চোখ ফেরালো সে। থুতু কফ শুকিয়ে রয়েছে দেওয়ালে। আর আছে চোদ্দ পনেরো বছরের ঘন বীর্য স্খলনের চিত্রবিচিত্র দাগ। কোনো কোনোটা দেখতে যেন মানুষের মুখের আকার। যেন কথা বলবে। লিঙ্গের বক্তব্য কি এতোই বেপর্দা ভয়ানক নির্লজ্জ উন্মুক্ত ! তাও এই সংশোধনালয়ে ! কিন্তু এই দেওয়ালের সামনেই তাকে তার নিরপরাধ অত্যাচারিত মনকে সমর্পণ করতে হবে। এবং করতেই হবে। এছাড়া কোনও গতি নেই।

এক দু মাস পরপরই জেল কর্তৃপক্ষ রামুকে সেল বদল করায়। ঘনঘন স্থিতি বদল, কিন্তু রামুকে ওরা কোনো মতেই রাজি করাতে পারেনি। আবার কমপ্লেন করেও কোনো কাজ হয়নি। মুখ খুললেই ওরা হাহা করে হেসে উড়িয়ে দেয়। রামু একা আর বোকা চুপ মেরে যায়। তবে ওরা যেরকম করে রামুকে গড়েপিটে তৈরি করতে চায় সেরকমটা হচ্ছেনা বলেই হয়তো ওর উপরে এতো বাটপাড়। রামুর মাথাভর্তি কালো চুল গোল গোল রিংএর মতো ঘন কোঁকড়ানো। ফর্সা নাদুস নুদুস চেহারা। সরল বড় বড় চোখ। চোদ্দ বছর হতে চলল এখনো গোঁফ দাড়ি গজায়নি। বাপুজি বলতো ভগবান বুদ্ধের কোনো সিনেমায় কি নাটকে সিদ্ধার্থের পার্ট ভালো মানাতো তোকে। মেক আপের দরকার পড়বে না। কত শান্ত সৌম চেহারা তোর। কতো সরল তুই। তুই তো বাচ্চা, কি করে ওই জঘন্য কাজটাতে ফাঁসলি রে !

খারাপ কাজ ! জজ সাহেব পর্যন্ত বলছিল খারাপ কাজ তুইই করেছিস রামু কবুল কর ! মাথার ভিতরে তোলপাড় করে খুঁজতে থাকে রামু। কী খারাপ কাজ করেছি ? ভিতরটা ফাঁকা লাগে, বড় অভিমান হয়। ধন্দ লাগে। সত্যিই কি আমি খারাপ কাজ করেছি,নাকি ওরা আমাকে নিয়ে যে গল্পটা আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছে সেটা আমি জানতাম মিথ্যে, কিন্তু মেনে নিয়েছি? কেন? মনের ভিতরে এই খোঁজ শুরু হওয়া মাত্র সারা পরিবেশ ঝিম মেরে যায়। কখনো কখনো জেল পরিসরে মাটি কোপাতে কোপাতে থেমে যায়। হাতের কোদাল সাপের মতন পিছল হয়ে এঁকেবেঁকে হাত থেকে পিছলে যায়। চারপাশে শব্দের জগত আরো আরো মুখর হয়ে ওঠে। কাকের চিত্‍কারে সাদা কালো চকরা বকরা অসংখ্য সিভিল কোট প্যান্ট তার মাথায় চেপে বসে আর আদেশ করে কবুল কবুল কবুল কবুল। কি কি কি করতে করতে গাছের পাতা খসখস করে ঝরে পড়ে আর রামু দেখে জুভেনাইল ক্রিমিন্যাল কোর্টের হলদে জীর্ণ শমন উড়ে উড়ে পড়ছে। এই যন্ত্রনার উপশম হয় রাতে। যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, রামু উঠে বসে দেওয়ালের দিকে মুখ করে। একফালি আলো গরাদ বেয়ে দেওয়ালে পড়ে দুধ নদীর মতো। সেই নদীতে সে রাজহাঁসের মতো খেলতে থাকে। কখনো কখনো দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেওয়ালের ঐসব জল কফ রসের দাগ থেকে নিজেরই এক প্রাপ্তবয়স্ক মুখের ছবি উঠে আসে। আসল কাহিনি শুনতে চায়। বিচার চায়। বাপুজির কথা মনে করিয়ে দেয় আর গায়েব হয়ে যায়। বাপুজি বলতো তোর মাথার ভিতরে হংস হয়ে আছিস তুই নিজে। তাকে তুই পবিত্র রাখ রামু। যা হয়েছে যা হচ্ছে সব ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে।

দেওয়ালের সামনে তন্ময় হয়ে বসেছিল রামু। সারা গায়ে হাড় ফাটা ব্যথা। তবু একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। গারদের বাইরে টহলদারি সিপাহির খৈনী পেটার শব্দে চমক ভাঙল। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো পাশে শুয়ে থাকা ইয়াসিনের মুখে পড়ছে। মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছে। নরম রেশমের মতো গোঁফ দাড়ি কিন্তু কেমন বাচ্চা বাচ্চা মুখ। রামুর মনে পড়ল গতরাতে ও বলছিল একা থাকলেই মাকে মনে পড়ে। অনেক বড় পর্যন্ত মাএর দুধ খেয়েছে। তবু খুব চেষ্টা করেও মায়ের দুধ খাওয়ার স্মৃতি মনে করতে পারে না। মনে পড়েনা বলে নাকি ওর কান্না পায়। রামু হাত বাড়িয়ে ইয়াসিনের মুখ থেকে গড়ানো লালা পুঁছে দিল। ভেজা ঠোঁটের স্পর্শে একটা মর্মভেদী স্মৃতির ঢেউ ঝাঁ করে রামুর সামনের দেওয়ালে যেন ফুটে উঠল। দেওয়াল চিত্রে উন্মুক্ত খোলা দুই স্তন থেকে দুধধারা গড়িয়ে পড়ছে। রামুর একহাত ইয়াসিনের হাঁ খোলা ঠোঁটে আর এক হাত দেওয়ালে। দুহাতে মুছে দিতে চাইছে স্মৃতি ধারা। যতই মুছে দিচ্ছে ততই যেন উপচে পড়ছে…।

এই ঘরের আটজনের মধ্যে রামু আর ইয়াসিন ছাড়া বাকি সবাই তিনচারজন জেল পুলিশের নোংরা খেলার শিকার। জেলার সাহেব জুভিনাইল ম্যাজিষ্ট্রেট এমনকি সুইপারটা পর্যন্ত সব জানে কিন্তু কেউ গরজ করে না। কারোর কোনও বিকার নেই। উঁচু উঁচু রক্তরঙের দুর্ভেদ্য কারা প্রাচীরের ভিতর খোলা ময়দানের কোনায় ভাদুরে কুকুরের মত অবাধ বেশরম বিকৃত যৌনশোষণক্রিয়া। শুধু ওরাই নয়, বাইরের দু চারজনও জেলের ভিতরে ঢোকে আর ওই লাচার বাচ্চা কয়েদিগুলোকে বাধ্য করে। রামুকে ওরা লাইনে আনতে অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেন যে ওরা পারেনি তা রামুও বুঝতে পারেনা। কেবল যখন তখন মার। প্রচণ্ড মার। বাপুজি বলেছিল আইনে আছে বাপ মাকে মাঝে মাঝে দেখা করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু কই? কেউ দেখা করতে আসে বলে মনে হয় না। তাহলে তো বাইরে কথাটা ছড়িয়ে পড়তো !

ইয়াসিনকে ওরা ছেড়ে দিয়েছে কিছু বলেনা কারণ ওর যে সুন্নত ! ইয়াসিন এখানে দিন পাঁচেক আগে এসেছে। রেল পুলিশের হাতফেরতা। পকেট মারে ব্যাগ চুরি করে ব্যাগে ব্লেড চালিয়ে নিখুঁত ভাবে বার করে নেয় দামী জিনিসপত্র। তার পাশে বিছানা নেওয়া ইয়াসিনকে প্রথম দিনেই জিজ্ঞেস করতে ও বলেছে আমি আই লাভ ইউ করেছিলাম। মানে,করতাম। কারো পিছন পকেটে বা ব্যাগে ব্লেড দিয়ে লম্বা করে চিরে আই লিখি তাবাদে ব্লেড টেনে এল করে দিই আর সটাক সে ব্লেড উপরে তুলে দিলেই ইউ হয়ে যায়। ব্যাস ইলু ইলু। পর্দা তুলে মাল খালাস! পিটি গ্রাউন্ডে রামু শুনেছে ও নাকি কারোর সাথেই খুব একটা কথা বলেনা, কিন্তু ও এত অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ট হল কিকরে রামুই বুঝতে পারেনা সেটা। ইয়াসিন টাঁড় মানভূইঁয়া দেহাত থেকে এসেছে। শুরু দিনেই সেলে ঢুকে রামুর কাঁধে হাত রেখে গ্রামফকিরের গান চেঁচিয়ে গেয়ে উঠল, ‘ডাঁড়ার উপর হাঁড়া রে এ এ এ /হাঁড়ার উপর বদবদি আর তার উপরে সঁকসঁকি/তার উপরে আছে রে ভাই ঝিল/আর ঝিলের উপর চলে রে ভাই হাঁস বারোমাস’।

রামু ভাবে বিভোর হয়ে গেল। এযে বাপুজির আরেক রূপ ! এর গানে তো একই কথা ! মানুষের পাদুটোর উপরে পেট, পেটের উপরে বুক, বুকের ভিতরে বদবদ করছে হৃদয়। তার উপরে নাক সঁকসঁক করে শ্বাস নিচ্ছে। তার উপরে ঝিলের মত চোখ ভর্তি জল। তার উপরে মাথার ভিতর ভালোবাসার হংস, বাপুজি তো ওই কথাই বলে গেছে !

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।