সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ১৪)

ক্ষণিক বসন্ত

চন্দ্রকোষ

ভিউ বাক্সের ওপর আলোকিত পর্দায় কালো প্লেটগুলো বারবার মিলিয়ে দেখছিল ডাঃ চন্দ্রকোষ পাটিল। গেল এক বছর ধরে এই ঘরে বসেই অসহায়ের মতো সে ওই প্লেটগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই আন্তর্জাতিক মানের স্নায়ু গবেষণাকেন্দ্রের একজন তরুণ অধ্যাপক হবার পরেও তার নিজেকে অত্যন্ত অসহায় লাগে। প্লেটগুলি মুম্বাই পুলিশের একজন উদীয়মান অফিসার দুর্গা রেশ্মি উন্নিথানের মাথার ছবি। মেয়েটি গেল পাঁচ ছয় মাস শারীরিক অসুস্থতার কারণেই আর কাজে যেতে পারছে না। ওষুধ চলছে চন্দ্রকোষের নির্দেশ মতোই। তবু ফল হচ্ছে না তেমন। দিন দিন মেয়েটির দুটি হাত আর পা কাঠির মতো শুকনো হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই মেয়েটি একসময় একজন প্রতিভাময়ী নর্তকী ছিল।ভরতনাট্যমে তার পারদর্শিতার কথা সে প্রথম শুনেছে তার সহকর্মী চিকিৎসক মালশ্রী আইয়ারের কাছে। মালশ্রী তার সমবয়সী। মালশ্রীর স্বামী পুলিশ বিভাগে থাকায় তার কাছ থেকেই প্রথম সে জানতে পারে দুর্গার কথা। তার কিছু দিন আগেই মোটর নিউরন ডিজিজের ওপর তার একটি গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক মহলে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ফলত দুর্গা সেই থেকে তার তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসাধীন ছিল।
ছবিতে দুর্গার মস্তিষ্কের সামনির দিকের অংশ আর টেম্পোরাল অংশে ক্ষয় স্পষ্ট। এতো দ্রুত এতোটা অবক্ষয় অপ্রত্যাশিতই ছিল। এভাবে চলতে থাকলে চিরদিনের জন্য নাচ বা চাকরির কাজই নয়, চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলবে মেয়েটা। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান যেন ঠিক এই মুহূর্তেই চন্দ্রকোষের যাবতীয় অধ্যাবসায় ও সাধনার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যা যা পথ্য প্রয়োগ সম্ভব ছিল, সমস্তকিছু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বার পরেও আলোকিত পর্দার উপর কালো প্লেটগুলোতে তেমষ কোনও উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। দুর্গা গেল পাঁচ ছয় মাস এই হাসপাতালেরই পাশে রোগীদের জন্য তৈরি আবাসিক একটি ঘরে রয়েছে। প্রতিদিন তার চিকিৎসংষ্ক্রান্ত প্রয়োজনীয় উন্নতি বা অবনতির কথা নিশ্চুপ হয়ে মাথা নীচু করে শুনে চলে যায় মেয়েটির এক বান্ধবী। গিরিজা না কী যেন নাম। কোনও কোনও দিন তাকে চন্দ্রকোষের নতুন কিছুই বলবার থাকে না। তবু সে আসে। একইরকম নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে শোনে সবকিছু। যেন সে এক অপরাধী। তাকে কোনও গুরুতর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। দুর্গার প্রধান কেয়ারগিভারও এই মেয়েটিই। কেয়ারগিভাররা এইসব ক্ষেত্রে নিভন্ত প্রদীপের মতো হয়। তারা নিভে গেলে রোগীর আরোগ্যের আশাও নিভে যায়। অথচ প্রদীপের পলতে জ্বলতেই থাকে। জ্বলতে জ্বলতে একসময় তেল ঘি, সব ফুরিয়ে এলে পলতের বুক জ্বলে যায়। চন্দ্রকোষ গেল কয়েকমাস আপ্রাণ চেষ্টা করছে যাতে এই গিরিজা নামক প্রদীপের সলতেটা সম্পূর্ণ জ্বলে না যায়। অথচ আজ। নতুন করে পরীক্ষা করা এই এম আর আই প্লেটগুলো সাইকেডেলিক সঙ্গীতের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। আজও আরও একবার তেমনই এক দিন যখন তার গিরিজাকে দুর্গার ব্যাপারে নতুন কিছুই বলার নেই। অথচ গেল দু ঘন্টা ধরে মেয়েটা বসে আছে বাইরে। অপেক্ষা করছে। কী বলবে তাকে চন্দ্রকোষ?

অন্যদিনের মতোই টেবিলের অপর প্রান্তে জড়সড় হয়ে বসেছিল গিরিজা। চন্দ্রকোষ জানত, নিজে থেকে মেয়েটা একটা কথাও বলবে না। বয়সে সে গিরিজার থেকে অনেকটাই বড়। কিন্তু এই কয়েকমাসের সংগ্রামের পর মেয়েটির চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, বয়সের আসল বৃদ্ধি শরীরে নয়, মনের ভিতর হয়। মেয়েটির চোখের ভিতর যেন এক অসীম ধৈর্য বশ করে বসেছে। তাকে টলানো কঠিন। তাই নিঃশব্দতা কাটিয়ে চন্দ্রকোষই কথোকথন শুরু করল।
-আজ কেমন আছে তোমার বন্ধু?
গিরিজা মাথা নাড়ল নিঃশব্দে। তার দুই চোখে টলটল করছে জল। তার মুখভঙ্গীর ভাষা একথা স্পষ্ট করছে যে দুর্গার শারীরিক অবনতি ঘটেছে আরও।
-নিজে থেকে খেতে পাচ্ছে?
এবারেও গিরিজা মাথা নেড়ে ঘাড় মুড়ে বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে কেটে গেলে চন্দ্রকোষ তার টেবিলের ওপর পড়ে থাকা দুর্গার নাচের ছবিগুলো দেখতে থাকে। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র নিয়ে মাঝখানে পড়াশোনা করছিল চন্দ্রকোষ। তার প্রয়োগ বিভিন্ন স্নায়ুরোগে কতোটা সম্ভব জানার জন্য একটি গবেষণাপত্রও লিখেছিল। যদিও তা আন্তর্জাতিক মহলে উচ্চপ্রশংসিত হলেও স্থানীয় মহলে বেশ সমালোচিত হয়। অনেকের ধারণা হয়, লেখাটি ব্যক্তিগত পক্ষপাতদুষ্ট। সেখানে বৈজ্ঞানিক উপাদান সেখানে কম। ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রের চার অঙ্গ অবন্তী, পাঞ্চালী, অর্ধমাগধী ও দাক্ষিণাত্য। দুর্গা ফোটোতে দাক্ষিণাত্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখেমুখের ঔজ্জ্বল্য তার মনের ভিতরের সঙ্গীতকে আশপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। কে বলবে সে আসলে একজন জাঁদরেল পুলিশ অফিসার ছিল। ‘ছিল’ কারণ এসব আজ অতীত। এইসব ভাবতে ভাবতেই গিরিজা ভাঙা ভাঙা কনড়ে প্রশ্ন করে।
-ইয়াভুদে ভারাভাসে ইল্লা? আর কি কোনও আশাই নেই?
ঠিক এই প্রশ্নর সম্মুখিন হবার ভয়ে এতক্ষণ গুটিয়ে ছিল চন্দ্রকোষ।
-আমাদের ইনস্টিটিউট দেশের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ট হলেও তার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তুমি কি ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে চাও?
চন্দ্রকোষের কথার উত্তরে গিরিজা খানিকক্ষণ তার দুই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু। সেই চোখে জলের সরোবর ভেদ করে পুকুরের গর্ভে যেন অস্তিত্বরক্ষার মৎসঅবতার জলকেলি করে চলেছে। এই চোখ চন্দ্রকোষ যেন কোথায় দেখেছে। খুব চেনা চেনা। কোনও নাটমন্দিরের মূরাতির ভিতর কী? এই চোখ কেন তাকে বারবার গীতগোবিন্দর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে! গিরিজার নিস্তব্ধতা তাকে বুঝিয়ে দিল, সেই দুর্গার শেষ আশ্রয়। জীবনে সমস্ত পুঁজি বাজি মেয়েটা সবকিছু ছেড়ে যোগিনী রাধারাণীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আরোগ্যের সন্ধানে। কিন্তু তার যে বুক জ্বলতে শুরু করেছে। তাকে ছাই হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। চন্দ্রকোষ তাই নিজের বলা করা নিজেই ফিরিয়ে নেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে সমূহ সংকটের থেকে সরিয়ে নিল বাইরে থেকে ভেসে আসা একটি কোলাহলের শব্দ। রেডিওলজির ঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। হন্তদন্ত হয়ে এক সিস্টার তাকে খবর দিল।
-স্যার। এমারজেন্সি। প্লিজ কাম।
গিরিজাকে হাত জোর করে ভরসা রাখতে বলে চন্দ্রকোষ বেরিয়ে এল ঘর থেকে। কিন্তু সে কার ওপর ভরসা রাখার কথা বলল তখন, সে কথা সে নিজেও হয়তো জানত না। কারণ সে তো ঈশ্বরবিশ্বাসী নয়। তবে কি বিজ্ঞান? না ক্যালক্যুলাসের অসঙ্গতির মতোই কোন ‘কিউ’ ফ্যাক্টর। কে জানে!

এম আর আইএর তেজস্ক্রিয় চিহ্ন আঁকা ঘরটির ঠিক পাশেই ইইজি করার ঘর। ছটফটানি আর ব্যস্ততার আওয়াজ সেখান থেকেই আসছিল। চন্দ্রকোষ ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল বছর পনেরোর একটি ছেলে টেবিলের উপর শুয়ে আছে। হাসপাতালের চার পাঁচজন জোর করে তার হাত পা আপ্রাণ আটকে রাখার চেষ্টা করেও পারছে না। ছেলেটি তখন অচৈতন্য। তার মুখের কোণা দিয়ে ফেনা আর রক্তমাখা গাঁজলা বেরিয়ে আসছে। এই ছেলেটিকে আগে কখনও দেখেনি সে। হয়তো গতকাল রাতেই ভর্তি হয়েছে। ছেলেটির এই অবস্থা দেখেই চন্দ্রকোষ বুঝতে পারল ছেলেটির ফিট হচ্ছে। বিছানার এক পাশে অসহায় মধ্যবয়স্ক এক দম্পতি দাঁড়িয়ে। তাদের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রকোষ সহজেই অনুমান করতে পারল এরা ছেলেটির আপনজন। যে সিস্টারটি দৌড়ে এসেছিল তাকে চন্দ্রকোষ ইতিমধ্যে কোনও ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল। সিস্টার দিদিমণি মাথা নেড়ে জানাল, দেওয়া হয়েছে। কাজ হচ্ছে না।
ছেলেটির অবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটছে। ঠিক সেই সময় ছেলেটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষমানুষটি অবশেষে কাঁদতে কাঁদতে তার পা জড়িয়ে ধরল। লোকটির নাম আভোগী মিশ্র। তিনি ছেলেটির বাবা। ওড়িশার দেনকানালের বাসিন্দা। তাঁর আবেদন তার ছেলের কাছে একবার তাকে যেতে দেওয়া হোক। প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে চন্দ্রকোষ সম্মতি দিল। অ্যানেস্থেটিক টিম কে আসতে বলা হয়েছে। গলায় এখনই টিউব পরাতে হবে। কিন্তু এইভাবে চলতে থাকলে ‘স্ট্যাটাস এপিলেপটিকাস’ হবার সম্ভাবনা প্রবল। সেসময় রোগীর বাড়ির লোক আরও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বেন হয়তো। অনুমতি পেয়ে আভোগী মিশ্র তার সুতির ফতুয়া পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটি ইয়ারফোন বের করে ছেলেটির কানে গুঁজে দিলেন। কয়েক সেকেণ্ড যেতে না যেতেই ছেলেটি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে উঠল। সকলকে অবাক করে এরপর তার দেহে মৃগীরোগের সমস্ত চিহ্ন লুপ্ত হয়ে গেল। পুরো ঘটনাটিতে বেশ হিস্মিত হল চন্দ্রকোষ। তবু ভিতরের বিহ্বলতাকে প্রশমিত করে সে প্রসিডিওরে মন দিতে বলল সকলকে। তারপর হয়ে গেলে নিজের চেম্বারে আসতে বলল সকলকে।
চেম্বারে ফিরে এসে চন্দ্রকোষ দেখল গিরিজা আর সেখানে নেই। আপাতত রাউণ্ড শুরু করতে আরও ঘন্টাখানেক। এই সময়ের ভিতর কয়েকটা জরুরি ফোন সারতে হবে। ঘরে তার আপনজন বলতে পক্ষাঘাতগ্রস্থ মা আর তার কেয়ারগিভার। সেই ফোন সারার পরেপরেই চন্দ্রকোষ দেখল মালশ্রী তাকে গতকাল গভীর রাতে দুটো ভয়েসকল করেছে। সে ধরতে পারেনি। একটা মেসেজও ছেড়ে গেছে সে। কল করতে বলেছে সুযোগ পেলেই। ফোনটা করতেই ওপার থেকে কান্নার শব্দ ভেসে এল। সেইসব কথোপকথনকে বাংলা করলে এমন দাঁড়াবে।
-আবার ঝগড়া করেছিস বরের সঙ্গে?
-নাহ। এটা হচ্ছে না রে।
-কী হচ্ছে না?
-আমি পারছি না আর। অ্যাডজাস্ট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।
-কী হয়েছে শুনি? আবার কোনও গুজব শুনতে পেলি?
-গুজব নয় চন্দ্র। সত্যি। ফ্যাক্ট। কৌশিকের সম্বন্ধে রটে যাওয়া ঘটনাগুলো গুজব নয়। ও সত্যিই একটা পারভার্ট। মেয়েমানুষের শরীর ছাড়া ও কিছুই বোঝে না। আমি কী পেলাম বল? একবার মা হতে চেয়েছিলাম। সেটাও কি পেলাম?
-ওকে ওকে। চিল। শোন। আজ রাতে কী করছিস?
-কিছুই না। আজ ডিউটি অফ করেছি। ভাল্লাগছে না।
-বেশ। আজ রাতে তাহলে আমি যাচ্ছি তোর ওখানে।
-না। তুই আসবি না। আমি যাব।
-ওকে। আর…
-বল।
-হুট করে কিছু করিস না মালো। তুই আবার ড্রিঙ্ক করেছিস বুঝতে পারছি।
-গলা শুনেই সব বুঝে যাস। খুব বড় ডাক্তার হয়েছিস দেখছি। হ্যাঁ করেছি। বেশ করেছি। আসব। রাতে।
-আয়।
ততক্ষণে টেবিলের ওইপারে ছেলেটির বাবা ও মা এসে বসেছে। ছেলেটির নাম বসন্ত। বাবা স্থানীয় একটি স্কুলের ইংরাজি শিক্ষক। মা মধুমাধবী মিশ্র গান শেখান। ওড়িশার প্রাচীন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত।চন্দ্রকোষের মনের ভিতর ওই ইয়ারফোনের ঘটনাটা নিয়ে কৌতূহল বাড়ছিল ক্রমশ। এই দম্পতি কন্নড় জানে না। আর তার নিজের ওড়িয়াতে তেমন দখল নেই। ফলত কথোপকথন চলতে থাকল ইংরাজিতেই। আভোগী জানালেন গেল একবছর ছেলের এই বিষম ফিট রোগটির মোকাবিলা করতে গিয়ে তিনি এক অদ্ভুত পথ্য আবিষ্কার করেছেন। যে গানটি তিনি ইয়ারফোনে তখন তাকে শোনালেন, সেটি একটি প্রাচীন ওড়িশার ধ্রুবপদ। বসন্ত ছোট থেকেই মনোবিকারগ্রস্থ। স্বাভাবিকের মতো তার মনের বিকাশ ঘটেনি। এপিলেপ্সির পর সেই বিকাশ আরও বেশি করে ব্যাহত হচ্ছিল। প্রথমে কটক, তারপর মুম্বাইসহ নানা জায়গায় ঘুরে শেষমেশ তাঁরা এখানে ছেলেকে আনতে বাধ্য হয়েছেন। কোনও হাসপাতালই তার এই মৃগীরোগ সারাতে পারছে না। একমাত্র ধ্রুবপদে মধুমাধবী বা কলাবতী বেজে উঠলে বসন্ত শান্ত হয়। কেস হিস্ট্রি শুনতে শুনতে ভিতরভিতর শিহরিত হচ্ছিল চন্দ্রকোষ। এমন একটি কেসের অপেক্ষা সে কতো বছর কতো যুগ ধরে করেছে। সঙ্গীত ও মনোবিজ্ঞান নিয়ে যে অতন্ত্র সেতু, সেই সেতু অটুট রাখতে একসময় সে বহু গবেষণাপত্র লিখেছিল। পত্রগুলি বিদেশের নানান বিশ্ববিদ্যালয় লুফে নিলেও তার নিছের প্রতিষ্ঠানের লোকজন তাকে মেনে নেয়নি। ইয়ার্কি মশকরা ঠাট্টা, সবকিছু সইতে হয়েছে তাকে। তারপর সেও ভিতরভিতর ঝিমিয়ে পড়েছে। বসন্তর এই ঘটনাটি আবার তাকে সঙ্গীতের সেই অবলুপ্ত পথের দিকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন।
গোটা দিন কেটে গেল ব্যস্ততায়। সেখানে বসন্তর ঘটনাটি চন্দ্রকোষের সঙ্গে থেকে গেল এতটুকু চন্দনসুবাসের মতোই। দিন শেষে কোয়ার্টারে ফিরে এসে কেয়ারগিভারকে চলে যেতে বলল সে। বাকি রাত সে মাকে দেখে রাখবে। মাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবার পর সে ভেবেছিল বসন্তর ঘটনাটি একটা বিচ্ছিন্ন কেসফাইল হয়ে তার জীবনে রয়ে যাবে। কিন্তু সামান্য ভাবতেই সে বুঝল, চন্দনের সেই সুবাস তখনও তাকে ছেড়ে যায়নি। পুরনো ফাইলগুলো বের করতে করতেই বেল বেজে উঠল। দরজার বাইরে মালশ্রী আইয়ার। একটা টুকটুকে লাল গাউন পরে চন্দনগন্ধর মতোই দাঁড়িয়ে আছে যেন।
-আয়। মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে?
-হয়েছে।
বলেই মালশ্রী একগুচ্ছ পুষ্পবৃষ্টির মতো আচ্ছন্ন করে জরিয়ে ধরল চন্দ্রকোষকে। তারপর তার অধর হঠাৎ খুব জোরেই নিবিষ্ট হয়ে গেল চন্দ্রকোষে। চন্দ্রকোষ হঠাৎ এই মুহূর্তর জন্য প্রস্তুত ছিল না। চুম্বনের সময় সে মালশ্রীর মুখের ভিতর সেই গন্ধটা পেল। মালশ্রী ড্রিঙ্ক করেছে। মালশ্রীর বিয়েটা একটা নাগরদোলার মতো গুরে চলেছে বেশ কিছুদিন। তার বর কৌশিককে ঘিরে নানান মেয়ের কেচ্ছা বাজারে গিজগিজ করছে। চন্দ্রকোষ জানে, ঘর থেকে জোর করে বিয়েটা না দিলে মালশ্রী হয়তো তাকেই বিয়ে করত। ভিতরভিতর সে তাকে ভালোবাসে। সেও কি বাসে? কে জানে! তবে এটুকু সে জানে যে এই মুহূর্তে তার আর কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করছে না। মালশ্রী মদ্যপভাবে চন্দ্রকোষকে ভিতরঘরে নিয়ে চলল।
-আজ রাতটা এখানেই থাকব। রাজি।
চন্দ্রকোষ কিছু বলে না। এই মুহূর্তে তার মতামত সিদ্ধান্তক্ষমতা আপাতত গ্রাস করে নিয়েছে মালশ্রী। সে বাধা দিল না। মালশ্রী তার পাপড়িগুলো একে একে যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খুলে রাখল বিছানায়। তারপর চাঁদের উজানে যেন আকণ্ঠ ডুব দিয়ে ভেসে উঠল। ক্রমাগত এক একটি চৌপদী যেন এক একটির লহরার মতো বেজে উঠছিল। ফিসফিস করে সে চন্দ্রকোষের কানে বলল।
-ভালোবাসিস তো। সব বুঝি। পালাবি আমাকে নিয়ে?
-কোথায়?
-থিরুমালাই পেরিয়ে আরবসাগর পেরিয়ে? আমাকে বাঁচিয়ে তোল চন্দ্র। আমি মরে যাচ্ছি।
-আর ডিনার?
-আরও চাই। আর কতো খাবি বদমাইশ।
-কোথায় পালাব?
-বলব। কাল। কথা আছে।
চন্দ্রকোষ ইডলি রেখেছিল। মালশ্রী খেল না। আলুথালু বেশেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার বর এখন স্পেশাল মিশনে দিল্লিতে। পালালেই তো হয়। কিন্তু কোথায় পালাবে? জিমা প্যান্ট গলিয়ে দরজা ভিজিয়ে চন্দ্রকোষ কোয়ার্টারের বাইরের উঠোনে এসে বসল অবশেষে। এখানে রাতের বেলা এক অদ্ভুত নীরবতা থাকে। প্রতিটি কোয়ার্টারলাগোয়া বেশ কিছুটা বাগান। তারপর রাস্তা। সেই রাস্তার প্রতিটি চৌমাথা যেন একইরকমের দেখতে। তার যেকোনও একটিতে বসে সাধনা সেরে ফেলা চলে। চন্দ্রকোষ অনুভব করল তার সমস্ত শরীরে মালশ্রী লেগে থাকবার পরেও মনের কোথাও চোরাশ্রুতির মতোই বসন্ত জেগে রয়েছে তখনও। মনে মনে ঠিক করে নেয় সে। সে পালাবে। মালশ্রীকে এইভাবে মরতে দেবে না সে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল পড়ার টেবিলের উপরেই কে জানে। ঘুমটা ভাঙাল মালশ্রীই। এককাপ তরতাজা চা। মালশ্রী তৈরি হয়ে নিয়েছে কখন। এখান থেকেই হাসপাতাল চলে যাবে।গতকাল রাতের উদ্দাম ঘূর্ণির চিহ্ন আপাতত তার ঠোঁটের কোণায় সামান্য লেগে আছে। খুব সহজভাবেই চন্দ্রকোষ তাকে বসতে বলল। তারপর বসন্তর কথা বলল। সমস্তটুকু শুনে খানিকটা ভেবে মালশ্রী বলল।
-কন্নড়সঙ্গীতে আটবছর তালিম নিয়েছিলাম জানিস। গুরুজি বলত সেখানে একটা স্বর একটা রাগ। সব যেন কাজ আর কারণে লিপ্ত।
-কীরকম?
-তোকে কাল রাতে বলেছিলাম মনে আছে? কথা আছে?
-বলেছিলিস তো। এখন বল।
-সাইরাকিউস ইউনিভারসিটি একটা স্পেশাল প্রোজেক্ট করছে মিউজিক থেরাপির ওপর। প্রচুর স্টাইপেন। তোর আর আমার যা কোয়ালিফিকেশন, হেসেখেলে হয়ে যাবে। যাবি?
চন্দ্রকোষ ভাবে। এদেশে তার থেকে যাবার একমাত্র কারণ হল মা। সে চলে গেলে মায়ের রক্ষণাবেক্ষণের ভার কে নেবে?
-তুই চিন্তা করিস না। সময় নিয়ে ভাব। এই বসন্ত মিশ্রর কেসটা একটা ইউনিক কেস। তুই পেপারটা লেখ। কাকিমাকে আমরা সঙ্গে করে নিয়ে যাবো। ওদেশে ওনার চিকিৎসা আরও ভালোই হবে। কী?
-আর তোর বিয়েটা? কৌশিক?
-ওটা আমি আর রাখব না। কাল রাতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আইনগত কাজ সেরে নিতে অসুবিধে হবে না।
-আর আমার করা ইডলিগুলো কে খাবে?
-দুজনে।

হাসতে হাসতে চন্দ্রকোষ লক্ষ্য করে তার গবেষণার ফাইলগুলো যেন হঠাৎ প্রাণ পেয়ে তিরিতিরি করে কাঁপছে। সেই কম্পন চুম্বনের ক্ষত আর রুদ্রবীণার ঝঙ্কারের মতো।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।