সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব – ১২)

স্রোতের কথা

পর্ব ১২

কে তুমি !!!?????

” সবই তো শুনলে দিয়া…প্লিজ কিছু বলো…”
“সার্সী…এই বড় ট্রলি ব্যাগ টাতে তোর সব ড্রেসেস্ আর তোর বই, ল্যাপটপ্, তোর ক্যামেরা আর দরকারি জিনিসপত্র সব রেখেছি…আর যদি কিছু নিতে হয়…এখনি নিয়ে নে…কালই কিন্তু যাওয়া..এরপর কিছু না কিছু ঠিক ভুলে যাবি।”
“দিয়া প্লিজ্ …এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে সঅঅব কিছু খুলে বললাম তারপর থেকে প্রতিদিন বলেই চলেছি……তাও তোমার কোনো রিআ্যাকশন্ নেই!!??!!!… অদ্ভুত তো… তুমি বুঝতে পারছো?? আমি আসলে কি?? দিয়া দিয়া আমি একটা ভ্যাম্পায়ার…রক্ত খাওয়া ভ্যাম্পায়ার… দেওয়ালে হেঁটে বেড়ানো ডাইনিবুড়ি…দিয়া তুমি বুঝতে পারছো…??? আমি রক্ত খেয়েছি দিয়া…”
আমি হাত দিয়ে চোখ টা মুছে নিলাম…
” আর শোন্ , এই যে ডাফল্ ব্যাগ টা… এর মধ্যে আমার তৈরি করা হেয়ার অয়েল,শ্যাম্পু অনেক গুলো ফেস ক্রীম , আমার বানানো তোর ফেভারিট কিছু চকোলেট ছাড়াও আরো কয়েকটা বিশেষ জিনিস আছে , খুলে দেখে বুঝতে না পারলে আমায় জিজ্ঞেস করে নিবি…”
ধুত্তোর্…. নিকুচি করেছে বিশেষ জিনিসের…দিয়া কি পাগল হয়ে গেল..??? আমার সব কিছু শোনার পরও এমন ভাব করে জিনিস গোছাচ্ছে, আমি যেন বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি… হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে গেল খুব…দিয়া মনে হয় ঠিক বুঝতে পারছেনা কত টা সিরিয়াস্ ব্যাপার টা….দিয়া কে একটু বোঝানো যাক….
আমি উঠে দাঁড়ালাম… দেওয়ালের কাছে গিয়ে…মিরান্ডা ম্যাম যেমন জোরে জোরে বলেছিলেন
তেমনি করে মনে মনে চিৎকার করে বললাম… আমি দেওয়ালে উঠবো উঠবো উঠবো….
মূহুর্তের মধ্যে যেন বাতাসে ভেসে আমি দেওয়াল বেয়ে বেয়ে উঠতে লাগলাম…প্রায় ছাদের কাছে পৌঁছে গিয়ে দিয়ার দিকে ফিরে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম…
“এই যে…এবার দেখো…এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমি আসলে কি??…
“সার্সী তুই যখন অতটা উঠেই ছিস… আর একটু উঠে শ্যান্ডেলিয়ার টা একটু সোজা করে দে তো… অনেক দিন ধরে কয়েকটা লাইট একটু বেঁকে রয়েছে… ”
উফফ্ দিম্মা তুমি আমাকে পাগল করে দেবে… তোমার কি কিছুতেই কিছু যায় আসে না??”
কোথায় দিম্মা অবাক হবে….তা না দিম্মার রিআ্যাকশন্ দেখে আমিই অবাক হয়ে যাচ্ছি….
বেজার মুখে লাইটগুলো ঠিক করে, দেওয়াল বেয়ে বেয়ে নীচে নেমে এলাম…
দিম্মা ব্যাগ গোছানো শেষ করে ব্যাগ গুলো একপাশে সরিয়ে রেখে আমার সামনে ভালো করে বসলো… খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো……
“বল্ আমার থেকে তুই কি শুনতে চাইছিস….তুই ভ্যাম্পায়ার… তুই উইচ…আর আমার তোকে ভয় পাওয়া উচিত….. খুব টেনশন করা উচিত…তাই তো??”
” ভয় পাওয়ার কথা আমি বলিনি…” অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ধরা গলায় আমি বললাম…
“কিন্তু আমার সঙ্গে যে অদ্ভুত ব্যাপার গুলো হচ্ছে …সেটা নিয়ে তোমার তো একটা মতামত থাকবে নাকি? সেটাই জানতে চাইছিলাম…”
“আমার কি স্পেশাল মতামত থাকতে পারে…গর্ব হওয়া ছাড়া??”
গর্ব !!!!!! দিম্মা বলে কি???!!!!!
“অবাক হওয়ার মত কি বললাম?? আমার নাতনী আমার আদরের… আমার প্রাণের সার্সীর স্পেশাল এবিলিটি আছে….এতে তো আমার গর্ব হওয়ার ই কথা…তাই না…??”
” দিম্মা তুমি বোধহয় গুলিয়ে ফেলছো, আমি কোনো দেবী টেবী নই…একজন ভ্যাম্পায়ার… আমার এবিলিটি স্পেশাল কিন্তু নেগেটিভ… আমি শৌনকের রক্ত খেতে গেছিলাম…”
” কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাসনি তো?? নিজেকে কন্ট্রোল করে নিতে পেরেছিস তো??…….শোন সার্সী…কারোর যদি কোনো স্পেশাল এবিলিটি থাকে তো সেটা শুধু স্পেশাল ই হয়…এখন সেটা নেগেটিভ না পজিটিভ হবে সেটা নির্ভর করে সে সেটা… মানে সেই স্পেশাল এবিলিটি টা কিভাবে ব্যবহার করছে তার উপরে…আর এখনো পর্যন্ত আমি তো তোর সুপার পাওয়ার পজিটিভ ই দেখছি… তুই যে শুধু শৌনকের ক্ষেত্রে নিজেকে সামলাতে পেরেছিস তাই নয়…. তুই তোর এবিলিটি দিয়ে তোর প্রিন্সি ম্যামের ব্যথাও সারিয়ে দিয়েছিস…আর এখন আবার আমার প্রিয় শ্যান্ডেলিয়ার লাইট গুলোও ঠিক করে দিলি…..” দিম্মার ঠোঁট গম্ভীর… কিন্তু চোখের কোণে দুস্টু হাসির ঝিলিক।
” আমাদের ইন্ডিয়ায় একজন সুপার গডেস্ আছেন…যার ছবি আমার বেডরুমে আছে,তুই দেখেছিস…”মহাকালী”….যিনি এই কসমসের সব শক্তির উৎস…..তা তিনি ও কিন্তু ডেমনদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে রক্ত খেয়েছেন….”
আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে না পেরে চুপ করে তাকিয়ে রইলাম
” সার্সী…সবসময় আমরা যা চাইবো…যেভাবে চাইবো…তা হয় না রে… কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হয়…আমাদের ওয়ার্স্ট থেকেও বেস্ট টা খুঁজে নিতে হয়…আর আমি যদি কখনো নেগেটিভিটি কে প্রশ্রয় না দিই… তাহলে নেগেটিভিটি কখন পজিটিভিটি হয়ে যাবে আমরা বুঝতেও পারবো না…”
আমি দৌড়ে এসে দিম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম….
“দিয়া আমি যদি ইসপ্যামা তে না যাই…তাহলে কি হবে?? আমার তোমাকে ছেড়ে একদম যেতে ইচ্ছে করছে না… খুব ভয় করছে…প্লিজ প্লিজ দিয়া… তুমি তো আমার গার্ডিয়ান… তুমি একটু ওদের বলো না গো…”
” তা হয় না সার্সী….” দিম্মা আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল… আমার অবাক প্রশ্ন ভরা চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো…
” তোর একটা জিনিস জানার এখন সময় হয়েছে…তুই নিশ্চয় এখন বুঝে গেছিস…তুই আর পাঁচজনের মতো নয়…তুই স্পেশাল… তেমনি তোর শরীরও কিছুটা স্পেশাল এবং যে কোনো সময় তোর শরীরের ভিতরে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটবে… এবং সেটা হয়তো এখনই শুরু হয়ে গেছে…..যখন এই চেঞ্জ খুব দ্রুত ভাবে হওয়া শুরু হবে….তখন যদি এই ব্যাপারে যারা সব কিছু জানেন বা সেই মুহূর্তে কি কি করতে হবে সেটা বোঝেন…. তাঁরা তোকে গাইড না করেন…..তোর কাছে না থাকেন…. তাহলে অনেক বড় অঘটন ঘটতে পারে…তুই অসম্ভব কষ্ট পাবি…এমন‌কি তোর মৃত্যু ও হতে পারে ….আর আমি সেটা কখনোই হতে দিতে পারি না…. তাই ইসপ্যামায় যাওয়া…সেখানে থাকা….সেখানকার লাইফস্টাইল….ট্রেনিং , তোর দরকার আছে সোনা..”
আমি কিছু ক্ষণ অবাক চোখে দিম্মার দিকে তাকিয়ে রইলাম…
“জানি না দিয়া তুমি এতসব জানলে কি করে..
কিন্তু আমি অলরেডি অনেক কষ্ট পাচ্ছি দিয়া…
তোমাকে , শৌনক কে, চেনা পরিচিত পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্টের চেয়ে আমার শারিরীক কষ্ট পেয়ে মরে যাওয়াও ভালো…”
দিম্মা রাগ রাগ গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল…..তার আগেই…
” আ্যাহেম্ আ্যহেম্…ইয়ে মানে স্যরি কাল আসতে পারি নি ”
দরজায় দেবলীনা বসুমল্লিক আবির্ভূতা হয়েছেন
” স্যরি স্রোত… ইয়ে মানে সার্…”
উফফ্!!!…. এখনি এনাকে আসতে হোলো…!!!
আমি দিম্মার দিকে তাকালাম
” দিয়া আমি একটু বেরোচ্ছি…ফিরে এসে বাকিটা প্যাক করবো..”
“সার্সী… তুমি ইসপ্যামা তে সিলেক্টেড হয়েছো…ভালো তো… মানে খুবই ভালো.. মানে আমি প্রাউড্… তুমি আমার মেয়ে.. আসলে… আমি…”
আমি দিম্মার দিকে তাকালাম… আমার ভিতর টা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিলো…
“দিয়া… আমি চাই না তুমি ছাড়া আমাকে আর কেউ সার্সী বলে ডাকে….আর হ্যাঁ…. আমি আজকে তোমার সাথে ডিনার করতে চাই….. শুধু তোমার সাথে… তোমার সাথে আমার কয়েকটা ইম্পর্ট্যান্ট আর কনফিডেন্সিয়াল কথা আছে…যেটা শুধু তোমার সাথেই বলতে হবে… আমি একটু বেরোচ্ছি…ডিনারের আগেই ফিরে আসবো তার মধ্যে তুমি একটু একা একা ফ্রী হয়ে থেকো প্লিজ্…”
আমি স্তম্ভিত দেবলীনা বসুমল্লিক কে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম… কিন্তু পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আড়চোখে দেখলাম….মামমাম্ বেশ রোগা হয়ে গেছে…যাক গে্ আমার তাতে কি….
দিয়ার বাড়ির পশ্চিম দিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলেই আমার প্রিয় জায়গা টা…এই জায়গাটা এত সুন্দর যে আর কি বলবো….যেন আমি ছাড়া আর কেউ কোনোদিন এখানে পা দেয়নি….চার দিকে কত যে নাম না জানা ফুলের গাছ ….বড় বড় গাছ একটা সুন্দর নীল জলের লেক কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে….
আমি চুপ করে গিয়ে লেকটার পাশে বসে পড়লাম…
আমার এই ঘেঁটে যাওয়া জীবন টা নিয়ে বেঁচে থেকেই বা কি হবে !!!! কেন কেন??? সবসময় আমিই বা কেন?? ভাবতে ভাবতে আমার শরীর থেকে যেন আগুন বেরোতে শুরু করলো… রাগ… নিজের প্রতি ঘৃণা… সব মিলিয়ে একটা অসহ্য কষ্ট আমার ভিতরে পাক খেতে শুরু করলো… আমি চীৎকার করে কেঁদে উঠলাম… পাগলের মতো মুঠো মুঠো সবুজ ঘাস ছিঁড়তে লাগলাম…তারপর মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলাম…. আমার সারা শরীর কান্নার দমকে কাঁপছিলো… ‌‌
কতক্ষন এভাবে ছিলাম জানিনা…. হঠাৎ সম্বিত ফিরলো একটা খিলখিল্ হাসির আওয়াজে…চমকে উঠে মুখ তুলে দেখি…একটা মেয়ে…. অদ্ভুত একটা মেয়ে….
অদ্ভুত বললাম….কারণ আজ অবদি এরকম মেয়ে আমি কোনোদিন দেখিনি…
মেয়েটা কালো….. অনেকটা ব্রাজিলিয়ানদের…(না কি রেড ইন্ডিয়ানদের মতো) মতো কালো…. কিন্তু চামড়ার নীচ থেকে কি এক অপার্থিব অপূর্ব জ্যোতি বেরিয়ে আসছে….পরণে এক লাল আর সাদার কম্বিনেশনের ড্রেস পরা….এটাকে শাড়ি বলে… আমি জানি…দিম্মার অনেক গুলো আছে……কালো কুচকুচে এক রাশ কার্লি চুল প্রায় পায়ের গোড়ালি ছুঁয়েছে… অপূর্ব টানা টানা চোখ…আর মুখ…যেন মনে হয় তাকিয়েই থাকি তাকিয়েই থাকি…..মেয়েটি ঝকঝকে দাঁত বের করে হেসেই চলেছে….আর সেই ঝকঝকে সাদা দাঁতের ফাঁক দিয়ে লাল টুকটুকে জিভ টা উঁকি মারছে ….আমি মেয়েটার দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইলাম… হঠাৎ মনে হলো এই মুখ টা যেন আমার যুগ যুগ ধরে কত চেনা…কত আপন… আমার ভিতর টা কিরকম যেন অস্থির করছিল… কেমন যেন মনে হচ্ছিল মেয়েটাকে মা মা বলে জোরে জোরে ডেকে উঠি… খুব ইচ্ছে করছিল মেয়েটার পায়ে মাথাটা একটু রাখি… একটু ঐ সুন্দর অদ্ভুত লাল বর্ডার দেওয়া পায়ে মাথাটা একটু রাখি…
তাহলেই সব কিছু খারাপ ভালো হয়ে যাবে….
“বাব্বাহ্….কি রাগ গো তোমার….”
এত মধুর কারো কন্ঠস্বর হতে পারে!!!!! মেয়েটা আমার কাছে এগিয়ে এল… আমি এক অপূর্ব গন্ধ পেলাম… ( অনেক টা লোটাস্ ফ্লাওয়ারের মতো…দিম্মা ক্রিমে দেয়….ইন্ডিয়া থেকে আনায়…)
“শোনো স্রোত…. শুধু নিজের কথা ভেবো না…. তোমার থেকে আরো কষ্টে অনেকে আছে… তোমার এখন অনেক কাজ…তোমাকে আমার হয়ে অনেকের জন্য অনেক কিছু করতে হবে….. অনেক বিপদ সামনে…তোমায় লড়তে হবে তো… আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি… অনেক দিন ধরে… তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসো…এসো…এসো…”
একটা বিদ্যুতের চমক… সারা পৃথিবী যেন আলোকিত হয়ে উঠলো…আর হাসতে হাসতে বিদ্যুতের চেয়েও চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল একটা আলোর রেখা হয়ে মিলিয়ে গেল সেই অদ্ভুত আলোয় গড়া কালো মেয়ে… ‌

আমার সমস্ত চেতনা বিলুপ্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে সবুজ ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়লাম আমি…

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।