সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ২০)

জন্ম কলকাতায়(২৭ নভেম্বর ১৯৮০)।কিন্তু তার কলকাতায় বসবাস প্রায় নেই।কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।সেখান থেকেই হয়তো ইন্ধন পেয়ে বেড়ে ওঠে তার লেখালিখির জগত।প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আকাশপালক "(পাঠক)।এর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শিকারতত্ত্ব(আদম), আড়বাঁশির ডাক(দাঁড়াবার জায়গা), জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার(পাঠক), কানাই নাটশালা(পাঠক),বহিরাগত(আকাশ) ।কবিতাথেরাপি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।এই বিষয়ে তার নিজস্ব প্রবন্ধসংকলন "ষষ্ঠাংশবৃত্তি"(আদম)।কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও গল্প লিখতে ভালোবাসেন।প্রথম উপন্যাস "কাকতাড়ুয়া"।আশুদা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশিত "নৈর্ব্যক্তিক"(অভিযান)।'মরণকূপ' গোয়েন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় অভিযান,যদিও তার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে সে একেবারেই স্বতন্ত্র।এই সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস 'সাহেববাঁধ রহস্য '(চিন্তা)।সম্পাদিত পত্রিকা "শামিয়ানা "। নেশা মনোরোগ গবেষণা,সঙ্গীত,অঙ্কন ও ভ্রমণ ।

বিন্দু ডট কম

সব প্রজাপতির পরাগে রুচি থাকে না।পরাগ আসলে প্রোটিন।সব প্রজাপতি হেলিকোনায়িনি গোত্রভুক্ত হয় না।প্রাণীর বিষ্ঠা,পাখির মূত্র অথবা পতঙ্গের মৃতদেহ অনেক প্রজাপতির কাছে প্রোটিন আর লবণের প্রধান উৎস হয়ে ওঠে।এসব কথা তরুলতা এতোদিন জানতো না।জানতো না কারণ ঠিক এতোটা অসহায়তা এর আগে কখনও তার বুকের ওপর চেপে বসেনি।তরুলতা আরও জেনেছে সম্প্রতি।লবণ প্রয়োজন স্ত্রী প্রজাপতির।সে লবণ তার প্রয়োজন ডিম্বাণু ধারণের জন্য। সেই লবণ সে পায় পুরুষ প্রজাপতির কাছে।মিলনের সময়। গতরাতে তরুলতা যেমন পেয়েছে অখিলেশের কাছে।কিন্তু সেই লবণে তিক্ততা বেশি ছিল,লবণ কম।তার জিহ্বা বিস্বাদ লাগছে,শরীর অবসন্ন লাগছে,দুই চোখ নিষ্প্রভ লাগছে আজ।
তরুলতা আজ থেকে বন্দিনী।তার দুই কবজিতে অদৃশ্য বেড়ি পরানো।গতরাতে সেই বেড়ি আদর করে পরিয়ে দিয়েছে তার দোসর।অখিলেশ।তার সঙ্গীতাকে ফোন করে জানাবার উপায় নেই।বাবা মা।এমনকি ভাই!!কী করে জানাবে?তার যে হাতদুটো শিকলে বাঁধা।হিসহিস করে অখিলেশ বুঝিয়ে দিয়েছে।
-তুমি সাপের গর্তে পা দিয়ে ফেলেছো তরুলতা।সমরজিৎ জেনে গেছে।তুমি পালাতে পারবে না তরুলতা।তোমার সামনে আর কোনও পথ নেই।
পথ নেই তরুলতার।সব পথের সামনে বোর্ড রাখা।’প্রবেশ নিষেধ’।তার ফোন করবার উপায় নেই আজ।তার ফোনটা অখিলেশ কেড়ে নিজের কাছে রেখেছে।এটা অন্যায় জেনেও তার কিছুই করার নেই।সমরজিৎ দলুই গতরাতে তাকে তার বাগানবাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছিল।বাগানবাড়িটা আসলে যে একজন লেপিডপটেরিস্টের প্রজাপতিখাতা,সেকথা তরুলতা জানে।অখিলেশ তাকে নিয়ে যেতে দেয়নি।তরুলতার কি এর জন্য অখিলেশের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত?নাকি সে তাকে ভয় পাবে!সে বলেছে আজ থেকে যতোদিন সে ট্রান্সফার না হচ্ছে, এক জোড়া চোখ তাকে সবসময় ফলো করবে।বাড়ির ভিতর।বাড়ির বাইরেও।সকালে শুকনো মুখে ঘর থেকে বের হতেই সে কথা বুঝতে পারছিল তরুলতা।তার বাড়ির সামনে একটা টোটো তার জন্য অপেক্ষা করছে।বেলদায় এতোদিন আসবার পর একদিনও এই ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেনি।টোটোটা তার জন্যই অপেক্ষা করছে।সে চড়ে বসতেই কোনও কথা না বলে টোটো চলতে শুরু করলো।তরুলতা বলতে গেল।টোটোড্রাইভার আঙুলের ইশারায় জানালো সে তরুলতার গন্তব্যস্থল জানে।ড্রাইভারটির অর্ধেক মুখ মুখোশের আড়ালে ঢাকা।চোখদুটো একঝলক দেখতে পেল তরুলতা।সে চোখ ভয়ঙ্কর। সে চোখ রাতের অন্ধকারে জ্বলজ্বল করা চোখ।
টোটোটি তার ব্যাঙ্কের সামনে এসে তাকে নামিয়ে দিল।তরুলতা নাবতে নাবতে ফিসফিস শুনতে পেল।ড্রাইভারটি এই প্রথম কথা বলছে।
-ছুটির পর এখানেই অপেক্ষা করবেন।আমি নিতে আসবো।একলা কোথাও যাবেন না।চারপাশে খুব বিপদ।
ব্যাঙ্কের থেকে বেলদা থানা বেশ খানিকটা দূরে।অখিলেশের নজর এড়িয়ে সেখানে যাওয়া অসম্ভব।একমাত্র সাহায্য করতে পারে ব্যাঙ্কের দারোয়ান করম সিং।তার হাতে কী সকলের নজর এড়িয়ে একটা চিরকুট গুঁজে দেবে সে।তরুলতার আশার সেই শেষ প্রদীপটি অবশ্য কয়েক মুহূর্ত পরেই নিভে গেল।ব্যাঙ্কের মেইন গেটে এসে সে আবিষ্কার করলো,ব্যাঙ্কের দারোয়ান বদলে গেছে।করম সিংএর জায়গায় একটি নতুন ছোকরা ছেলে বসে রয়েছে।দেখে মনে হচ্ছে স্থানীয়।তবে কি করম সিংকে বদলি করে দিল অখিলেশ!
ব্যাঙ্কের ভিতর সকলের মুখ কেমন থমথমে মনে হলো তরুলতার।একঝলক সে ঋতবানকে দেখতে পেল।ঘাঁড় গুঁজে সে ফাইল ঘেঁটে চলেছে।ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অখিলেশের ঘর তালা ঝোলানো।কাঁচের দরজার ভিতরে লেখা ‘আউট’।অর্থাৎ অখিলেশ আজ আসবে না।কিন্তু গতকাল সারারাত তো সে তরুলতার সঙ্গেই ছিল।ব্যাঙ্কের ফোন ট্যাপ করা আছে।সে কথা অখিলেশ আগেই জানিয়েছে।এমনকি ব্যাঙ্কের সিসিটিভি গুলোও অখিলেশ মোবাইল খুললেই দেখতে পয়।তাই এখন সে কী করছে,কার সঙ্গে কথা বলছে,সব দেখতে পাচ্ছে অখিলেশ।তরুলতার কান্না পাচ্ছিল।তার মনে হচ্ছিল শালবনের জঙ্গলে সে হারিয়ে গেছে।ব্যাঙ্কের মধ্যে একটা ঝলমলে মুখ দেখতে পেল তরুলতা।সে মুখ বৈশাখীর।গায়ে পড়ে সেই কথা বলতে এল।
-দিদি।তোমার শরীর খারাপ?
-কৈ না তো!
-জানো।আমার ছুটিটা গতকাল ইমেইলে মঞ্জুর করে দিয়েছেন ম্যানেজারবাবু।কাল দেশের বাড়ি চলে যাচ্ছি।আমাদের ম্যানেজার স্যার খুব ভালো মানুষ।তাই না তরুলতাদি?
-বাহ।খুব খুশির খবর।তরুলতা এটুকুই বলে।অখিলেশ সম্পর্কে একসময় সেও এমনটাই ভাবতো।গত কয়েকদিনের সমীকরণ তার সেই সিদ্ধান্ত বদল করে দিতে পেরেছে।
-তোমাদের সকলকে মিস করবো।
-আমিও।আচ্ছা বৈশাখী।আমাকে ঝট করে একটা কথা বলতে পারবে?
-বলো না।
-করম সিংকে দেখছি না।ও কোথায়?
-ঠিক জানি না দিদি।তবে এখানে আজ এসে শুনলাম করম সিং দেশে মেয়ের কাছে গেছে।ওদের দেশে চৈতী ছট আছে।কেন গো?কিছু দরকার?
-নাহ।
যাক।অন্তত এই মেয়েটি অখিলেশের প্রজাপতিখাতা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল।আচ্ছা। ওকে চিরকূট লিখে দেওয়া যায় না?এটুকু ভেবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করল তরুলতা।মেয়েটা একটা নতুন পরাগরেণুর দিকে উড়ে যেতে চাইছে।সেখানে তরুলতা স্বার্থপরের মতো অন্তরায় সৃষ্টি করতে চায় না।
থাক নাহয়।এটুকু তো জানা গেল যে করম সিং নেই!ব্যাঙ্কের কাজে মন দিতে পাচ্ছে না সে।আজ চাপ কম।তবু ভুল হয়ে যাচ্ছিল বারবার।দুবার স্লিপে তারিখ লিখতে ভুল হলো।একবার অ্যাকাউন্ট নম্বর লিখতে গিয়ে ভুল হয়ে গেল তার।সবসময় তার মনে হলো এক জোড়া অদৃশ্য চোখ ফলো করছে তাকে।কী দরকার ছিল তার?সে তো কোনও নীতিপুলিশ নয়।চারপাশে কতোই না চোরাকারবারি চলছে।সাধারণ মানুষ কি সেসব আটকাতে পারছে?অখিলেশকে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে এই চাকরিটা ছেড়ে দেবে সে।চুকে গেল।ঈশ।যদি সত্যিই টেলিপ্যাথি থাকতো।তাহলে মন দিয়ে বার্তা পাঠিয়ে দিত তরুলতা।কাকে পাঠাতো?সঙ্গীতাকে?সে তো রাজস্থানে।কে জানে কী করছে?নাকি ভাইকে।ব্যাঙ্গালোরে।এই প্রথম তার মনে হলো ভাই শুধুই তার জীবনে সিবলিং রাইভালরি নয়।সে তার জীবনে একটা অবলম্বন। নাকি শুভব্রতকে!কী করছে সে এখন?ঈশ।শুভব্রত কী বুঝতে পারছে না সে কতো বড় বিপদের মধ্যে আছে!একবারও কি সে তার সাধের ‘দোয়াব’ ছেড়ে তার কাছে আসবে না?ভাবতে ভাবতেই দিন গড়িয়ে যায়।ব্যাঙ্কের লোন করেসপন্ডেন্ট আসরাফ ব্রাঞ্চে এসেছিল।আসরাফের সঙ্গে তেমন আলাপ নেই তার।কয়েকটা ফাইল দিয়ে চলে গেল সে।প্রথম ফাইলটার উপর নাম দেখে চমকে গেল সে।এতো ঋতবান চ্যাটার্জির ফাইল!আড়চোখে সে পাশের কিউবিকলে চোখ বোলালো।ঋতবান আগের মতোই ঘাড় গুঁজে কাজ করছে।সিসিটিভির কথা মনে পড়ে গেল তার।ওদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাবে না।বুকটা চেপে আসছে তার।মাথা ঝিমঝিম করছে।সকালে খেয়ে আসেনি সে।খিদে নেই।দুপুরেও কিছু খায়নি।ইচ্ছে করছে না।মনটা ভেঙে গেছে একেবারে।অখিলেশ এক লহমায় তাকে একলা করে দিয়েছে গতকাল।
ঋতবানের ফাইলে প্রথম পাতায় একটা মার্কার কাগজ লাগানো।প্রথমে সে ভেবেছিল কোনও অফিশিয়াল নোট।কিন্তু পরক্ষণেই তার ভুল ভেঙে গেল।ওটা মার্কার কাগজ নয়।একটা চিরকুট। সেখানে টেলিগ্রাফিক ভাষায় লেখা।
-আপনার মতো আমিও।নজরবন্দি। সাবধান।পথ নেই।চারপাশে জোঁক।সাবধান।
এ চিরকূট ঋতবান লিখেছে?তাকে নিয়েই তো সব জটিলতা!তবে কি সেও তারই মতো অসহায়।তাকেও কী কেউ পিছন থেকে ময়াল সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে!কে জানে।তরুলতা আর ভাবতে পারে না।অফিসছুটি হলে বাইরে বেরিয়েই দেখতে পায় সকালের টোটোড্রাইভারটা কথামতন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে।তরুলতা চেপে বসতেই সে তার কোয়ার্টারের দিকে ফিরে চলল।আচ্ছা। এক্ষুনি সে যদি মাঝরাস্তায় চিৎকার করে সকলকে তার এই বিপদের কথা বলে দেয়?একটা মানুষও কি এগিয়ে আসবে না তাকে সাহায্য করতে?ভাবতে ভাবতেই কোয়ার্টারে চলে আসে সে।পথে তরুলতার এতোদিনের চেনা শালগাছগুলো হঠাৎ অচেনা মনে হয়।তাদের একটি একটি করে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে মাটিতে।ভাবতে ভাবতে পথ ফুরিয়ে আসে।ঠিক যেন জীবনের পথ ।তার আর চিৎকার করা হয়না।
কোয়ার্টারে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তরুলতা।সদর দরজা ভেজানো।ভিতরে আলো জ্বলছে।তার অবর্তমানে কে ঢুকলো তার ঘরে?তবে কী তার দৈনিক পেশাদার জীবনটার মতো ব্যক্তিগত জীবনটাও বারোয়ারি হয়ে গেল?ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে চমকে ওঠে তরুলতা।সোফার ওপর পা তুলে বসে আছে অখিলেশ।তার চোখের চাহনি বদলে গেছে আমূল।তার দুই চোখ ঊর্ণনাভের মতো এগিয়ে আসছে তরুলতার দিকে।
-মন তোমার কোথায় থাকে তরুলতা?আজ বেরোবার সময় দরজা বন্ধ না করেই চলে গেলে?
-ওহ।খেয়াল করিনি।
-ব্যক্তিগত জীবনে দরজা বন্ধ করা প্রয়োজন তরুলতা।সমরজিৎ দলুইয়ের জীবন,ঋতবান চ্যাটার্জির জীবন,তোমার জীবন,আমার জীবন।খিল দেওয়াটা জরুরি।
মাথাটা আবার দপদপ করছে তরুলতার।কী চায় লোকটা তার কাছে?
-বলছি।একটু জল খাও আগে।তারপর বলছি।
ঘেন্না আর ভালোবাসার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সুতো আছে।তরুলতা সেটা পেরিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছিল।সে সুতোর অপর পারে একটা শ্বাপদ জাল নিয়ে অপেক্ষা করছে তাকে ধরবে বলে।আর তার ডানাদুটো ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ক্রমশ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।