সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ২৪)

জন্ম কলকাতায়(২৭ নভেম্বর ১৯৮০)।কিন্তু তার কলকাতায় বসবাস প্রায় নেই।কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।সেখান থেকেই হয়তো ইন্ধন পেয়ে বেড়ে ওঠে তার লেখালিখির জগত।প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আকাশপালক "(পাঠক)।এর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শিকারতত্ত্ব(আদম), আড়বাঁশির ডাক(দাঁড়াবার জায়গা), জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার(পাঠক), কানাই নাটশালা(পাঠক),বহিরাগত(আকাশ) ।কবিতাথেরাপি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।এই বিষয়ে তার নিজস্ব প্রবন্ধসংকলন "ষষ্ঠাংশবৃত্তি"(আদম)।কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও গল্প লিখতে ভালোবাসেন।প্রথম উপন্যাস "কাকতাড়ুয়া"।আশুদা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশিত "নৈর্ব্যক্তিক"(অভিযান)।'মরণকূপ' গোয়েন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় অভিযান,যদিও তার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে সে একেবারেই স্বতন্ত্র।এই সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস 'সাহেববাঁধ রহস্য '(চিন্তা)।সম্পাদিত পত্রিকা "শামিয়ানা "। নেশা মনোরোগ গবেষণা,সঙ্গীত,অঙ্কন ও ভ্রমণ ।

বিন্দু ডট কম

কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন।তরুলতা এখন এই দিনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।প্রথম প্রথম অফিসের সময়টুকু ছাড়া সে তার মোবাইলটা হাতে পেত না।এখন পায়।আজকাল নজরবন্দি থেকেও মুক্তি পেয়েছে সে।যদিও তার মনের ভিতর বারবার ভেসে আসছে অখিলেশের সেই সাবধানবাণীগুলো।তার চোখ সবখানে আছে।অবশ্য তরুলতা আজকাল আর সেসব ভাবে না।সে ভাবে শুভব্রতর কথা।তার মোবাইল ট্যাপ করা আছে।তবু সে হন্যে হয়ে শুভব্রতকে খুঁজেছে দু একদিন।পায় নি।তার ফোন বন্ধ।
একটা অ্যাকাউন্ট হয়েছে তার নামে।সেখানে তার নাম তরুলতা নয়।পিয়ালি সেন।অখিলেশ তৈরি করে দিয়েছে।সেই অ্যাকাউন্টটাতে দিনের শেষে লক্ষ লক্ষ টাকা আসে আর চলে যায়।মাঝে মাঝে সাজুন্তি প্রজাপতির শুককীটের পাথরকুচি পাতার সুরঙ্গে রেখে যাওয়া বিষ্ঠার মতো কিছু টাকা পরে থাকে পিয়ালির জন্য।প্রথম প্রথম তা হালকা সবুজ মনে হলেও পরে তা ক্রমশ কালো হয়ে ওঠে।ওটুকু তার অর্জিত শেয়ার।গ্রাম থেকে ফুসলিয়ে নিয়ে আসা ছোট্ট মেয়েকে আরব পাচার বা গরীব ভাগচাষীর কিডনি চুরি করার পর লাভের উপরি অংশ।তরুলতা সেসব স্পর্শ করে না কখনো।সে যেন এক যন্ত্র।সুরঙ্গে লুকিয়ে থাকে।আর মনের ভিতর গুমরিয়ে কাঁদে।
এই কদিনে আশপাশও বদলে গেছে খানিকটা।হঠাৎ ভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে গেছে চারদিকে।তরুলতা তার কিয়স্কের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটিকে ঠিক করে মাস্ক পরতে বলে।তরুলতার পাশের বক্সে বৈশাখীর জায়গায় কারলোন বিভাগে অস্থায়ী পদে যোগ দিয়েছে অবন্তিকা হেমব্রম।আদি বাড়ি বাঁকুড়া।তরুলতার ই বয়সী।বেশ একটা লড়াকু ভাব আছে তার চাহনিতে।ওকে দেখলে তরুলতার তার নিজের এই ব্রাঞ্চে যোগ দেবার প্রথম দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। সেই স্মৃতির সঙ্গে লুকিয়ে থাকে ভয়।তার মতোই মেয়েটা বেশ স্বাবলম্বী ও স্পষ্টবক্তা।একটা বিয়ে হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে।গ্রামের ছেলে।অবন্তিকার গায়ের রঙ শ্যামলা বলে তাকে ছেড়ে চলে গেছে।কিন্তু অবন্তিকা তাতে নুইয়ে পড়েনি।ব্যাঙ্কের পরীক্ষা দিয়ে নিজের কৃতিত্ব কায়েম করে কাজে যোগ দিয়েছে।আর ঠিক এই কারণেই কোনও একটা জায়গায় এসে তরুলতা অবন্তিকার জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনের মিল খুঁজে পায়।আর পায় বলেই তার অবন্তিকার জন্য ভিতরভিতর ভয় করে।
মেয়েটি কিন্তু বেশ মিশুকে।এই এক সপ্তাহের মধ্যেই এই ব্রাঞ্চের সকলের সঙ্গে সে বন্ধুত্ব করে নিয়েছে।এখন অতিমারীর বাজারে মানুষের তেমন গাড়ি কেনবার তাড়া নেই।তাই তার কাজের চাপ অল্পই।তরুলতার কথা সে কতোটুকু জানে কে জানে।কিন্তু রোজ সে তার সঙ্গে ভাব জমায়।আজ অবশ্য তার মুখচোখে চাপা উত্তেজনা।লাঞ্চব্রেকের সময় সে নিজে থেকেই এসে বলল,”খুব খারাপ খবর জানো।গতকাল রাতে আমার বৌদি হঠাৎ মারা গেলেন?”
তরুলতা বিস্মিত হয়।অবন্তিকার এক দাদা আছে বাঁকুড়ায়। স্কুলে পড়ায়।সদ্য বিয়ে হয়েছে তার।অবন্তিকাই বলেছে।বয়সে তার পিঠোপিঠিই হবে।এই বয়সে বিয়ের পরপরই হঠাৎ!
-কী করে?
-রান্না করছিল জানো।বাড়িতে তখন কেউ ছিল না।তোমাকে তো আগেই বলেছি,দাদা বৌদি একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে।দাদার ক্লাস অনলাইনে হচ্ছে।সেই সময়ে দাদা বাজার থেকে কয়েকটা জিনিস কিনতে বেরিয়েছিল।ফিরে এসে দেখে রান্নাঘর রক্তারক্তি। বৌদি উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে।শ্বাস প্রশ্বাস নেই।
-স্ট্রোক?
-প্রথমে তো সেইরকমটাই মনে হয়েছিল।কিন্তু পড়ে জানা গেল বৌদির জ্বর ছিল দিনপাঁচেক।দাদাকে জানায়নি।চুপিচুপি হোমিওপ্যাথি খাচ্ছিল।
-তারপর?
-তারপর আর কি?দাদা একলা হয়ে গেছে।একাএকা সৎকারটাই হতো না যদি না তার কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর বাবা মা এগিয়ে আসতো।তবে জ্বরের ব্যাপারটা জানাজানি হবার পর দাদাকে স্থানীয় মানুষ খানিকটা একঘরে করে দিয়েছে।
তরুলতা মনেমনে ভাবে।মেয়েটার কী ভয়ানক মনের জোর।এতো সাঙ্ঘাতিক একটা খবর কী অনায়াসে বলে দিতে পারলো।অবন্তিকা বলে চলে।
-জানো দিদি।ডাক্তার বলেছে বাংলার মাবৌদের নিয়ে এই এক সমস্যা। নিজের শরীরের অসুখের কথা কারোকে জানাবে না।একেবিরে শেষ মুহূর্ত অবধি চেপে রাখবে।তারপর আর কিছু করার থাকবে না।বৌদির ফুসফুসে অক্সিজেন পৌছোচ্ছে না,একথা সে কারোকে জানায়নি।জানালে দাদা তাকে এভাবে মরতে দিত না।
তরুলতা কিছু বলে না।শরীরের ফুসফুসে না হলেও মনের ফুসফুসে তারও তো অক্সিজেন কমে আসছে।ম্যানেজারের ঘরে অখিলেশ বেশ কয়েকদিন নেই।কলকাতা গেছে?কে জানে?তীর্থ বা সুচরিতার কিছু হয়েছে?সংক্রমণ?নাকি অখিলেশের অন্ধকারের কাজ তাকে টেনে নিয়েছে।কে জানে?তরুলতা জানতে চায় না।সত্যিই কি জানতে চায় না?বিচিত্র মনের অলিগলি!করম সিং এখনও ফেরেনি।অফিসের দরজায় প্রহরী বদলে যায় রোজ।একটা লোকাল সংস্থার সঙ্গে রফা করেছে ব্যাঙ্ক।আর ঋতবান?সেই বা কোথায়?অখিলেশের মতো সেও আজ এক সপ্তাহ হলো বেপাত্তা।কে জানে কোথায়?তরুলতা জানতে চায় না।কিন্তু কে জানে?না আর হ্যাঁ এর মধ্যবর্তী একটি স্তরে তরুলতা কেমন যেন একলা হয়ে যাচ্ছে।ব্যাঙ্কের অলিখিত দায়িত্বে আপাতত সেইই।অবন্তিকা এই সময়ে খানিকটা অক্সিজেন জুগিয়ে চলেছে তাকে এই যা।
দিনান্তে ব্যাঙ্কের কাজ ফুরিয়ে এলে তরুলতা ঘরফিরতি টোটো ধরে।ব্যাঙ্কের অলিখিত ভারপ্রাপ্ত এখন সেইই।অখিলেশকে কয়েকটা অফিশিয়াল মেসেজ ছাড়া কোনও কথোপকথন হয়নি তার।একটিবারের জন্যও তরুলতা জানতে চাইলো না সে কোথায় আছে।অখিলেশও জানালো না সে কথা।ঘরের দরজার তালা চাবি ঘোরাতেই তার ফোনটা কেঁপে উঠল।অখিলেশের মেসেজ।”একজনকে পাঠাচ্ছি।আমার খুব স্পেশাল এক ক্লায়েন্ট।আমি তো স্টেশনে নেই।তুমি ম্যানেজ করে নিও।তোমার ঘরের লোকেশন ওকে দেওয়া আছে।রাজেশ কানোরিয়া।ব্যাপারটা একটু ডেলিকেট।বাট তুমি পারবে তরু।লাভ ইউ।আর ট্রাস্ট ইউ।একটা ফাইল দেবে ও।তোমার কাছে রেখে দিও।আমি ফিরে নিয়ে নেব তোমার কাছ থেকে।বাই।”
ব্যাস?হয়ে গেল?নিজেকেই নিজের ঘেন্না করতে ইচ্ছে করে তার।সে কি তবে একজন শিক্ষিত বেশ্যা হয়ে গেছে?কেন আছে সে এখানে?মৃত্যুভয়?নাকি শুভব্রতর জন্য?ওরা বলেছে শুভব্রতকে ওরা নজরে রেখেছে।কী করবে সে?ভাবতে ভাবতেই রান্নাঘরে ভাত ফোটাতে বসিয়ে দেয় সে।অবন্তিকার সেই বৌদির কথা মনে পড়ে যায় তার।কে জানে কেমন দেখতে ছিল তাকে?যেমনটাই হোক।এটা তার চলে যাবার সময় ছিলনা কিছুতেই।তার বদলে আজ তরুলতার সঙ্গে এমনটা ঘটলে অনেকটাই যথাযথ হতে পারতো।ভাবতে ভাবতেই সদরে কলিংবেল বেজে উঠলো।রাজেশ কানোরিয়া?
শাড়ির আঁচলটা সামলে নিয়ে দরজা খুলতেই তরুলতার ভুল ভেঙে গেল।একজন সুদর্শন মাঝবয়সীর লম্বা যুবা অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে দরজার চৌকাঠের ওপারে দাঁড়িয়ে।বিনীতভাবেই বলল,”আপনিই তরুলতা ম্যাডাম?”
তরুলতা ঘাড় নাড়তেই লোকটি নিজের পরিচয় দিয়ে বলল,”আমি রাজেশ কানোরিয়া।অখিলেশবাবু আপনাকে এই ফাইলটা দিতে বললেন।”
-ও আচ্ছা।আসুন ভিতরে আসুন।
-না ম্যাডাম।রাত অনেক হয়েছে।আপনি ক্লান্ত।বিশ্রাম নিন।পরে অন্য কোনও দিন।
তরুলতা ইতস্তত করে।ছেলেটি কি জল মাপছে?অথচ তার চাহনি দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না।কে জানে?অখিলেশকেও তো একদিন তার এইরকমটাই মনে হয়েছিল।কী করা উচিত তার এখন?
-কিছু না খেয়ে গেলে গেরস্তের অকল্যান হবে।আপনি আসুন।
-না।ম্যাডাম।সত্যিই বলছি।কলকাতা ফিরতে হবে আমাকে।অনেকটা পথ।আজ আসি।আরেকদিন আসবো।কথা দিলাম।
দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে ফিরতেই সামান্য পোড়া গন্ধ এল তার নাকে।ঈশ।ভাতটার তলা কামড়ে গেছে।গ্যাসের আঁচটা আলতো করা উচিত ছিল তার।যাক গে।তবে যাই হোক,মনেমনে রাজেশ কানোরিয়াকে ক্ষমা করে দিল তরুলতা।সে জানে না,ভিতরভিতর এদের কীই অভিসন্ধি।কিন্তু ওপরওপর ছেলেটি তার লক্ষ্মণরেখা পার করেনি একবারও।তবে কী ভিতর ভিতর সাজুন্তি প্রজাপতির মতোই বিষিয়ে উঠেছে সে?তার আহার্যের অরুচিকর উপাদানগুলি যেন ক্রমশ তাদের আপাতনির্দোষ চরিত্র থেকে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।তার চোখজুড়ানো বিষ যেন উপছে পড়ছে চারিদিকে।ফুলের মধুর টানে নয়,একমুঠো বিষের দিকে ক্রমশ ধাবমান হচ্ছে তরুলতা।ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেঁপে ওঠে তার।অখিলেশের মেসেজ।
-গুড জব তরু।লাভ ইউ।
Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!