সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ৪১)

বিন্দু ডট কম

সোঁদা মাকড়শার জাল বেয়ে যেন হেঁটে চলেছে দুটি প্রজাপতি।তাদের জন্য কোনও লেপিডপটেরিস্টের জাল অপেক্ষা করছে না।বরং সেখানে অপেক্ষমান একটি ভগ্নপ্রায় বাবুইপাখির বাসা।বাড়িওয়ালা জগন্নাথ দত্ত  অবশ্য নেহাতই অকাব্যিক ঘুনপোকার মতো ক্লেদযুক্ত স্বরে তরুলতাদের শুভব্রতর ঘরটা কোথায় দেখিয়ে দিল।তার সমস্ত চাহনি যেন তরুলতা আর তোয়াকে মুহূর্তে নগ্ন করে লেহন করছিল।তরুলতা বিরক্তচোখে ‘আচ্ছা’ বলে উঠে যাচ্ছিল।লোকটি পিছু ডাকলো।

-শুনুন।একটা কথা।

-বলুন।

-আপনি ওনার স্ত্রী।তাই আপনাকেই বলছি।উনি তো আমাদের মানুষ বলে মনে করেন না।নিজের জগতে থাকেন।ইদানিং আবার নিজের ঘর থেকেও বের হচ্ছেন না।এদিকে পুলিশ গতকাল এসে আমাকে একগাদা প্রশ্ন করে গেল।এতো ঝক্কি পোষাচ্ছে না।

-বলুন কী করতে হবে?

-ওনাকে আপনি এখান থেকে নিয়ে যান।আমি আর এই বাড়ি ভাড়া দেব না।এমনিতেই বাড়িটার মেরামতি দরকার।একজন প্রোমোটার রেট দিয়ে গেছে।শপিং মল করবে এখানে।আমি মানবিকতার খাতিরে এই কথাটা ওনাকে বলতে পারিনি।

-কতোদিনের মধ্যে ঘর খালি করে দিতে হবে?

জগন্নাথ দত্ত এইবার মাথা চুলকান।এতো দ্রুত সমস্যা মিটে যাবে,একথা তিনি আশা করেননি।আমতা আমতা করে বলেন,’এক সপ্তাহ।’

‘ঠিক আছে’ বলে তরুলতা তোয়াকে নিয়ে বাড়িটিতে ঢুকে পড়ে।পুরনো বাড়ির খাঁড়াই সিড়ি।প্রত্যাবর্তনের প্রতিটি ধাপ ঠিক এইরকম কঠিন হয় তরুলতা সেটা জানে।এতোদিন পর শুভব্রত তাকে কী গ্রহণ করে নেবে?মেনে নেবে সব?কেমন আছে মানুষটি?আর তোয়া?

         তোয়াকে দোতলায় কোলে করে তুলে আনে গাড়ির চালক।তরুলতা হুইল চেয়ারটা নিয়ে আসে।তলপেটে মৃদু টান পড়ে।সে তেমন আমল দেয় না।ফেটে যাওয়া দোতলার চাতালের পাশেই চৌকাঠ।দরজা ভেজানো।ভিতরটা অন্ধকার।বাইরের আলো যতোটুকু কোনও মতে উত্তরদিকের জানলার ভেঙে যাওয়া শার্সি দিয়ে ঘরে প্রবিষ্ট হচ্ছে।সেই আলোয় তারা দুজন দেখতে পেল ঘরের মধ্যিখানে
মাইকেল্যাঞ্জেলোর মূর্তির মতো একটি মানুষ মুখ গুঁজে বসে আছে।বিড়বিড় করছে আপনমনে।”দাঁড়াও দাঁড়াও আমি হাঁপিয়ে উঠেছি,আর/পারছি না দৌড়তে,একটু বসতে চাই,একটু হাঁটু মুড়ে….”

-শুভ।তোমার কী হয়েছে?দেখ।কে এসেছে?দেখো?

-তরু!তরুলতা!তুমি এসেছো?এতো দেরিতে কেন এলে?সব যে শেষ হয়ে গেল?

-কিচ্ছু শেষ হয়নি শুভব্রত।আবার শুরু করবো তো আমরা।সব।নতুন করে।

-কী করে করবে।বিন্দু ছিল।বিন্দু নেই।

-দেখো কে এসেছে শুভ।তোয়া এসেছে!তোমার সঙ্গে দেখা করতে।তোমার তোয়া…

শুভব্রত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।পরমুহূর্তেই সেই চাহনি বদলে যায় অপরাধবোধে।হাত জোর করে বলে।

-আমাকে ক্ষমা করে দিন।আমি অপরাধী।

তোয়া হুইলচেয়ার চড়ে এগিয়ে আসে শুভব্রতর কাছে।তার কল্পনার স্বপ্নের দিব্যপুরুষ আজ তার সামনে করজোড়ে ক্ষমাভিক্ষা করছে।কিন্তু কেন?শুভব্রত ধড়মড় করে উঠে বিছানার দিকে যায়।তারপর তোয়ার হাতে একটা বাক্স তুলে দিয়ে বলে।

-ভেবেছিলাম ‘দোয়াব’ পত্রিকার নতুন সংখ্যার সৌজন্যকপি এভাবেই আপনার হাতে তুলে দেব।কিন্তু তা আর হলো না।

-কেন।কী হয়েছে?

-‘দোয়াব’ পত্রিকার সম্পাদক আজ মৃত।কোনও লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের মৃত্যু ঘটলে তার সঙ্গে সঙ্গে তার পত্রিকারও মৃত্যু ঘটা উচিত।না হলে তার তিলতিল করে বানানো দেউল শকুন শাল শিয়ালদের আখড়া বনে যায়।আপনার পত্রিকার সম্পাদকের মৃত্যু ঘটেছে।তাই তার পত্রিকাও আর নেই।

তোয়া অবাক হয়।

-কোথায় শেষ?কোথায় মৃত্যু?আমি তো শুধুই জীবন দেখতে পাচ্ছি শুভব্রতবাবু?

-আমার পত্রিকার সমস্ত আরকাইভ,ডিজিটাল সংস্করণ,হার্ড কপি,সব জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।ঠিক যেমন একদিন শ্রেণিহীন সমাজ গড়বার রোমান্টিক স্বপ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

-কিন্তু আপনি তো আছেন শুভব্রতবাবু।আমরাও তো আছি।তরুদিদি আছে।আবার শুরু করব নাহয়…

-সম্পাদকের ভাবনার মৃত্যু মানেই তো সম্পাদকের মৃত্যু।নয় বলুন।আমাকে তাই বিশ্রাম নিতে দিন তোয়া চ্যাটার্জি।আমাকে বিশ্রামের শাস্তি দিন।”না হয় ঠেস দিয়ে ওই বটের গুঁড়িতে এই দু চার মিনিট মাত্র/বসতে চাই কিম্বা দাঁড়াতে।একটু দম নিতে দাও,দাঁড়াও না।”

-না।বিশ্রাম আপনার নেই শুভব্রতবাবু।এই মহাজগত অগণিত বিন্দুর সমাহার।সেই বিন্দুরা না থাকলে এই মহাজাগতিক মায়াও অর্থহীন।আপনি,তরুদিদি,আমি,আমরা সকলেই এক একটি বিন্দু সেইখানে।আপনি আমার জীবনের দায়িত্ব নিয়েছেন।আমার জৈবিক মৃত্যুর পর তবেই আপনার বিশ্রাম।

শুভব্রত তাকিয়ে থাকে।তরুলতা কাঁদছে।কিন্তু তোয়া নির্মম।তাহলে আবার সব শুরু করবে কী করে সে?

-বিন্দু দিয়ে শুরু করুন শুভব্রতবাবু।চলুন আমাদের সঙ্গে।এখনই চলুন।

-কোথায়?

-দোয়াবে।চলুন।

তরুলতা বিলি কেটে দেয় শুভব্রতর চুলে।তার তলপেটের পিউপাটি নেচে ওঠে মৃদু।মনে মনে সে বলতে থাকে,”বিশ্রাম নাও শুভ।তারপর আবার শুরু করব আমরা।নতুন করে।বিন্দুদের মৃত্যু হয় না।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।