গ এ গদ্যে শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

স্মারক

বৎসরান্তের সেজে ওঠা শহর। হোটেল, পাব,রেস্তোরাঁ, শপিং মলগুলো একটু পরেই মেতে উঠবে নিজেদের উদ্ভাসিত করার খেলায়। লাল,নীল,সবুজের মোড়কে সাজানো স্ট্রিটলাইট…সে বর্ণময় ছটায় গা ভাসাবে এই প্রাণের শহর… মন ভালো করা আলোয় যাপন করবে বিনিদ্র রজনী…রাত জাগা পাখি হয়ে। বৈকালিক রাস্তায় মানুষ জনের ঢল এখন থেকেই চোখে পড়ার মতো। রংচঙয়ে টেডি বিয়ারের পোষাকে সান্তাক্লজ দাঁড়িয়ে রয়েছে এ দোকান সে দোকানে ক্রিস্টমাস ক্যারোলের শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে দেবে বলে। আর এই গোটা সাজসজ্জা, যার প্রস্তুতি শুরু হয় দিন তিন চার আগে থেকে….গোটা ছবিটাই যেন এক সিনেমার মতো করে তৈরি। ট্রেলার..সেখান থেকে মূল পর্ব…এইভাবেই বুঝি বিদায় নেয় বড়দিন…মহানগরীর বুকে,পাঁচ-তারা হোটেলের কেবিনে রঙিন জলে ডুব দেওয়া রাত্তির টুকুকে ফেলে…অবাক পৃথিবীর পানে চেয়ে থাকা দর্শনার্থীর গহনে এভাবেই বুঝি রচিত হয় রামধনুর ক্যানভাসে আঁকা অ্যাডভান্স নিউ ইয়ারের নির্মীয়মান সেতুর ভিবজিওর।
সৌদামিনী বস্ত্রালয় থেকে শাড়িটা কিনে,ঐ একই প্যাকেটে কেক এর বাক্সটা ভরে দোকানের বাইরে পা রাখতেই রাস্তার ওপারে চোখটা আটকে গেল অর্কর। অপূর্ব না…? ঠিক উল্টোহাতে জুয়েলারির শো রুমের সামনে কোট প্যান্ট, চোখে রিমলেস চশমা পরিহিত, টকটকে ফরসা,বেশ লম্বা চেহারার এক যুবক অর্কর দিকেই হাসিহাসি মুখ করে তাকিয়ে ইশারায় ডাকছে। এগিয়ে গেল অর্ক। ‘আরে এ তো ইয়ং ম্যান বনে গেছিস একেবারে…! ‘ অপূর্ব হাসে। রোদে চিকচিক করে ওঠে স্টাইলিশ হেয়ার কালার।
‘ মেরী ক্রিস্টমাস। কতদিন পর এভাবে কাছে এসে বন্ধুকে গ্রিটিংস পাঠালাম…হাউ মাচ চার্মিং আওয়ার লাইফ ইজ!’
বন্ধুকে প্রায় জড়িয়ে ধরলো অপূর্ব। ওর গায়ের একটা অদ্ভুত পারফিউম এর গন্ধ ছড়িয়ে গেল অর্কর গায়েও যেন।
‘ মেরী ক্রিস্টমাস অ্যালং উইথ অ্যাডভান্স হ্যাপি নিউ ইয়ার। তারপর, ভালো আছিস তো? তুই কিন্তু অনেকটাই….! ‘
এককালের ক্লাস ফ্রেন্ডের গায়ে হাত রেখে বললো অর্ক।
‘চেঙ্জ হয়ে গেছি বলছিস?’
‘আরে সেটা তো অনেক সাদামাটা বিশেষণ। যাতায়াতের পথে কটা মেয়ে তোর দিকে সিডাকটিভ লুক এ তাকিয়ে চলে গেল, খেয়াল করে দেখেছিস? সত্যিই… ফেসবুকে দেখা ছবি আর চাক্ষুস দেখা..দুয়ে কতটা ডিফারেন্স এখন বুঝতে পারছি।’
খুঁজে পেতে আর একটা বিয়ে করে নিই তাহলে,কি বলিস? কাঁচা বয়সের কোনো চুলবুলে হট লুক…।’
চোখ বড় বড় করে একবার আড়চোখে চারিপাশে তাকিয়ে ঠাট্টার সুরে বলে ওঠে অপূর্ব। তারপর দুজনেই হেসে ওঠে।
‘ তবে কি জানিস…’ অপূর্ব যেন এবার কিছুটা অন্যমনস্ক।
মাইকে বেজে চলেছে ‘ জিঙ্গল বেল…জিঙ্গল বেল..’। হাসির ফোয়ারা তুলে একদল আলট্রা মডার্ন পোষাকের ছেলে মেয়ে গায়ে গা লাগিয়ে সামনে দিয়ে প্রজাপতির মতো উড়ে চলে গেল। দুটো মেয়ের আঙুলের ডগায় সিগারেট। এই মূহুর্তে মহানগরীর হামেশা চিত্রের মধ্যে একটি।
অপূর্ব বলে চলে,’ওদেশে থাকতে থাকতে একটা জিনিস বেশ বুঝেছি, ওদের কাছে বেঁচে থাকার কনসেপ্ট আলাদা। তুমি বেঁচে থাকো,লাইফকে এনজয় করো তোমার মতো করে। কারণ তুমি অ্যাডাল্ট। আই ডোন্ট ইনটারফেয়ার ইন ইওর পার্ট অব লাইফ। বয়স তো একদিন হবেই। চেহারা বদলাবে। মানসিকতা বদলাবে। বাট যতদিন পারো,জীবনটাকে ক্রিস্টমাস ক্যারলের মতো উপভোগ্য,দামী, ওয়ার্ম অ্যাটমসফেয়ারিক রিদিমে বেঁধে রাখার চেষ্টা করো। এর বাইরে যা কিছু পড়ে থাকলো দ্যাট ইজ কোয়াইট ন্যাচারাল..। এখানে দাঁড়িয়ে বয়স্ক থেকে শুরু করে সদ্য যৌবনা স্তরে যে বহুমাত্রিক উচ্ছলতা লক্ষ করছি,তার সঙ্গে ইংল্যান্ডের টেমস নদীর তীরে আমার আজকের সে শহরের এই মূহুর্তের ছবিটা…. দুইয়ে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও ফ্লো অব লাইফ বলতে যা বোঝায়, তা মোটামুটি একই। এন্ড অব দ্য ডে,যে তফাতটা দুটো কালচারের মানসিক প্রভেদকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়…সেটা ডেডিকেশন,ডিভোশন, সুপিরিয়রিটির কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার প্রশ্নকে ঘিরে। এক শ্রেণির কাছে আনন্দটা আসলে সেই জায়গায় পৌঁছানোর একটা সিঁড়ি মাত্র। আর এক শ্রেণির মাঝে তা শুধু নিছকই আনন্দ। এক মুহূর্তের জীবনচর্চা। আনন্দ ফুরোলেই চোখের সামনে দেখা ঐ বয়স্ক মানুষটাই কিংবা কিশোরীটি কালকে ডিপ্রেশনের বশবর্তী হয়ে গতদিনের রঙিন জলে মুখ লুকাতে চাইবে বারবার। অন্তঃসারশূণ্য জীবন প্রবাহে এ পরিবর্তন যেমন ভেরি ন্যাচারাল…তেমনি তুই যে পরিবর্তনের কথা বলছিস, চোখে দেখে বা সময়ের বিচার করে তাকে কিন্তু কোনোভাবেই, কোনোকিছুরই সাথে মেলানো যাবে না। তোর এভাবে অকালে টাক পড়ে গেছে দেখে আজ অবাক হচ্ছি.. পাঁচ সাত বছর পর কে বলতে পারে আমারও হয়তো দেখা যাবে সেম কন্ডিশন। চেঞ্জ তো আসবেই বন্ধু। কখন আসবে,কিভাবে আসবে.. মানি বা না মানি;গড নোজ্..। নে সিগারেট ধর…।’
বিদেশি কিং সাইজ সিগারেট। রয়্যাল ব্লু কালারের রথম্যানসের প্যাকেট। ডান হাতের পর পর তিনটে আঙুলে স্ফটিকের মতো বিচ্ছুরিত তিন তিনটে আঙটির পাথর। একঝলক সেদিকে তাকাতে কলেজ জীবনের কিছু ছবি যেন চলকে উঠলো অর্কর চোখের সামনে। সেমিনার হলে মাউথপিসের সমুখে দাঁড়ানো তৃতীয় বর্ষের প্রতিশ্রুতিমাণ ছাত্র…কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, হোচিমিন দাড়িতে ট্রেডমার্ক হয়ে ওঠা অপূর্ব কেতন রায়ের সাড়া জাগানো লেকচার, কিংবা ক্লাস শেষে কফি হাউসের ক্যান্টিনে বসে সমাজতন্ত্রের চর্চা করতে করতে চা আর চারমিনারের ধোঁয়ায় আবৃত সুদূরের দিনগুলো….। মানুষের অধিকার, মর্যাদার লড়াই, সাম্যবাদের জয়যাত্রা, মেহনতী জীবনের স্লোগান …ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ গুলো সত্যিই যে ফিকে হয়ে আসছে আজ বড়….শহরের ফেস্টিভ মুখচ্ছবির রন্ধ্রে মিশে থাকা রথম্যানসের ধূসরতার আড়ালে…হলুদ, বিবর্ণ,পৃষ্ঠায় আঁকা ছবির মতো…। হারিয়ে গিয়েছে ছাত্র রাজনীতির সে দিন। পালটায়নি শুধু বক্তৃতার ছলে কথা বলার সেই পুরনো অভ্যাস। হয়তো থেকেই গিয়েছে অজান্তে। সবটুকু তো আর বদলে যেতে পারে না। একটু একটু করে মানুষ নিজেকে বদলে ফেলে। হয়তো বা বদলাতে হয়। যেমনটা বদলে ফেলতে শুরু করেছিল অপূর্ব নিজেকে। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে পা দিয়েই ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরির ডাক এলো ক্যাম্পাসিংয়ের মাধ্যমে। তখনো রক্তাক্ত রাজনীতি ওর মন প্রাণ৷ এর বাইরে আর কিছু নেই। তবু চাকরিটা ওকে নিতে হতো। কারণ ততদিনে ওর বাবা রিটায়ার করে গেছেন। সামান্য উপার্জনে চলা সংসারে চাপ আর দায়িত্ব দুটোই বেড়ে গেল একই সাথে। অপূর্বর হাজারো অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেদিন অর্কই ওকে জোড় করে রাজি করিয়েছিল চাকরিটা নিতে। কয়েক বছরের মধ্যে সেই ছেলেই একটু একটু করে রাজনীতির সংশ্রব ত্যাগ করলো, পুরনো বন্ধুত্বের সূত্র ধরে রোজকার মেলামেশা কমে এলো সময়ের অভাবে। তারপর একদিন বেটার অফার পেয়ে বিদেশ যাত্রার খবর নিয়ে এলো অপূর্ব। দশটা পাঁচটার জীবনে কলম পেশা অর্কর সেদিন মনে হয়েছিল রাজনীতির আত্নঘাতি পথ থেকে সে যে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে তার প্রিয় বন্ধুকে, এটাই ওর কাছে মস্ত বড় পাওয়া। আর আজ এতবছরের না দেখা সম্পর্কের মাঝে দাঁড়িয়ে কেন জানি না সেই অর্করই বারবার মনে হচ্ছে,ফেসবুকের কয়েক মিনিটের পৃথিবীটাকে ছেড়ে না এলে জীবনকে বোধহয় সত্যি সত্যি এভাবে দেখাই হয়ে উঠতো না তার।
মানুষ জীবন নিয়ে খেলা করে, নাকি জীবনই মানুষকে নিয়ে খেলে যায়…. জানে না অর্ক। শুধু চেনে ছাত্র জীবন থেকে ফ্লারিস করা বৃত্তের বাইরে নিজের সাদামাটা পরিসরটুকু। আর তাই ‘ চেঞ্জ তো আসবেই বন্ধু , কখন আসবে,কিভাবে আসবে…গড নোজ্।’
কথাটা যেমন মেনেও নেয়,তেমনি মনে নিতেও দ্বিধাবোধ করে না অর্ক। সে বিশ্বাস করে,
যখন সে বিয়ে করে, তখন তার মাথায় সবে টাক পড়তে শুরু করেছে। সেই টাক দেখেই নীতা যখন তাকে বিয়ে করতে পারলো, ভালোবাসতে পারলো.. তখন আর ওর মনে এ নিয়ে কোনো আফসোস নেই। আজ আর তো নেই ই।
‘এলি কবে’?
বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলো অর্ক।
‘গতকাল ইভনিং এর ফ্লাইটে। ‘
স্কুলের বন্ধু বান্ধব দের মধ্যে একমাত্র অপূর্বর সঙ্গেই যোগাযোগটা রয়ে গেছে অর্কর। সেই অপূর্ব এখন ইংল্যান্ড বাসি। সফ্টওয়্যার কোম্পানীতে চাকরীর সুবাদে চার বছর হলো ফ্যামিলি নিয়ে ওদেশে পাড়ি দিয়েছে সে। দুই বন্ধুর মধ্যে অহরহ আসা যাওয়ার দিন গুলো আজ স্বাভাবিক কারণেই কয়েক যোজন দূরে। মাঝেমধ্যে ফেসবুকের দৌলতে যোগাযোগের সুতোটা ছেঁড়েনি এই অবধি।
অর্কর কাঁধে হাত রেখে অপূর্ব বলে,’ অফিস থেকে ফিরছিস বুঝি? ‘
‘হ্যাঁ স্যাটারডে বলে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। তারপর ঐ একটু মারকেটিংয়ে… তুইও নিশ্চই…?’ অপূর্ব হাতে ঝোলানো জুয়েলারির ব্যাগটার দিকে ঈঙ্গিত করলো..’ক্রীস্টমাস গিফট…’।
কথার সাথে হাসিটুকুও যেন চলকে উঠলো ওর মুখে।
জিনিসটা কী.. জিগ্গাসা করতে গিয়েও কোথায় যেন বাধলো অর্কর। চার বছর সময়টা সম্পর্ককে হয়তো দূরে ঠেলে দিতে পারে না ; অভ্যাসে পরিবর্তন ঘটায় বৈকি।
‘এখন বাড়ি ফিরবি তো? চল আমার গাড়িতে ওঠ। ড্রপ করে দেবো।যেতে যেতে কথা হবে..’।
বললো অপূর্ব।
অর্ক ঘড়ি দেখলো। আজ দিনটা ভেরি ভেরি স্পেশাল। অপেক্ষা করে আছে একজন অধীর আগ্রহে …। ফুলের তোড়াটা কেনা হয়নি। এখানে কোথাও পাওয়া গেল না। টুনি লাইটগুলো অবিশ্যি অফিসের সামনের দোকানটা থেকে আগেই কিনে এনে যত্ম করে রেখে দিয়েছে সে।
যাই হোক, বাল্য বন্ধুর সঙ্গে অন্তত কিছুটা সময় কাটানোর স্বাদ নিতে গাড়িতে উঠে পড়লো অর্ক। ‘ বাড়ির সবাই কেমন আছে রে? ‘
গাড়ি চালাতে চালাতে জিগ্যেস করলো অপূর্ব। ‘আছে ভালোই।’
‘আর ঠাকুমা? এখনো মনে আছে যতদিন দুপুরে তোদের বাড়ি গেছি, ঠাকুমা কিছুতেই ভাত না খাইয়ে ছাড়তেন না। মাসিমা থালা-বাটিতে খাবার সব সাজিয়ে দিতেন আর ঠাকুমা বসে বসে তদারকি করতেন…। বাইগন ডেজ…।’
আগেকার সব কথা মনে আছে তোর তাহলে? আর সেই সব জীবন ভাবনা,আবেগগুলো…?
অর্কর মনে হলো এই মূহুর্তে নিজের মনের সে কথাগুলো একবার জিজ্ঞেস করলে কেমন হয় অপূর্বকে। করলো না। আবার যেন বাধলো কোথায় এসে। কি দরকার। যত্নের সম্পর্ক। যত্নেই থাক না হয়।
‘ ঠাকুর্দার মৃত্যুটা ঠাকুমা কে অনেকটা একা করে দিয়েছে রে..। সংসারে সকলকে জড়িয়ে রেখেও মানুষটা মনের দিক থেকে কোথায় যেন…। যাক গে, কবে আসছিস আমার বাড়ি সেটা আগে বল?’ জানতে চাইলো অর্ক।
‘ আসবো। তুই চলে আয় এর মধ্যে.. আমার পনেরো দিনের ছুটি… ‘।
কথাটা মনে পড়ে গেল অর্কর।
বললো, ‘ মাস চারেক আগে তোদের বাড়ি একবার গিয়েছিলাম। অফিস ফেরত হঠাৎই মনে হলো মাসিমা,মেশোমশাইয়ের সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। খারাপ লাগে। বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। দুটো মাত্র প্রাণী। বয়সকালের একাকিত্ব…।’
‘কি করবো বল। বাবা মা কে অনেক করে বলেছি…বয়স হয়েছে । এবার আমাদের সঙ্গে চলো। যতদিন মন চায় থাকবে। শুনছে কে…। ভিটে মাটির টান…অদ্ভুত সেন্টিমেন্ট।’
যে বাড়িতে জন্মকর্ম, বেড়ে ওঠা…সেই বাড়ির প্রতি ভালোবাসা অদ্ভুত সেন্টিমেন্ট হতে যাবে কেন; অর্কর মনে হলো কথাটা একবার জিজ্ঞেস করবে অপূর্বকে। করা হয়ে উঠলো না। চার বছরে বন্ধুত্বের আবেগটাই যেন এই মুহূর্তে বেশি করে অনুভব করছে সে।
‘ আজ চল না আমার বাড়িতে… জমিয়ে গল্প করবো।’
‘ওরে ব্বাবা..আজ এই স্পেশাল ডে তে! তাহলেই হয়েছে। এখন সোজা বাড়ি গিয়ে আগে এই হার আর নেকলেস খানা তার গলায় ঝুলিয়ে দেবো। তারপর কেক টেক কেটে সন্ধে হলে বাইরে বেরোনো, শপিং.., সেন্টপলস ক্যাথিড্রাল চার্চের ওদিকটা একটু ঘুরে দেখবো, একেবারে রাত্রে ডিনার সেরে তবে ফেরা…।এর অন্যথা হলেই হয়েছে আর কি.. মোটামুটি সাত দিন হাঁড়ি মুখ। কথাবার্তা সব বন্ধ…।পরশুদিন ফ্লাইট এ বসেই অর্ডার হয়ে গেছে ওখানে আমার জন্য কতটুকু সময় দাও শুনি। তোমার তো সংসার শুধু অফিস নিয়ে… সুন্দরী সব লেডি স্টাফ… আমায় আর মনে ধরবে কেন…।’
বলতে বলতে আবারো হেসে ওঠে অপূর্ব। একই সাথে অর্কও।
‘ সেই কারণেই বুঝি মন জয় করার জন্যে এমন একটা প্রেশাস আইটেম..’?
অর্কর গলায় ইয়ার্কির সুর।
‘ভাই সাকুল্যে ঐ একটিই বউ।বউ খুশ হুয়া তো সব কুছ বিলকুল ঠিক ঠাক..’। কথা শেষ হয় না অপূর্বর। কি একটা মনে পড়ে যায়। ‘ আরে কী শাড়ি কিনলি সেটা আগে বল…দোকান থেকে যখন একা একা বেরোচ্ছিলিস, দেখলাম হাতে প্যাকেট..তখনই বুঝেছি এ নির্ঘাত ক্রীস্টমাস স্পেশাল… তা হ্যাঁরে, আর কি স্পেশাল গিফট অপেক্ষা করে আছে নীতার জন্য? মানে লাস্ট নাইটের স্পেশাল মেনু যদি কিছু…। ‘
‘ কি যে বলিস!’
‘ কেন ভুল বললাম? বিশেষ একটা দিনকে সিম্বলিক ওয়েতে স্মরণীয় করে রাখা যেতেই পারে। সবই মানানসই রে ভাই, আবার সবই বেমানান, বেরঙিন। ওষ্ঠ প্রান্তের ঐ ওম,উষ্ণতা জড়ানো আঁকাটুকুই শেষমেশ রয়ে যায়….ইন মেমোরিস অব ক্রিস্টমাস…। ‘
‘ আর তুই…তোর বেলায় বুঝি…!’
চটুল রসিকতা, পাল্টা ইয়ারকির মধ্যে দিয়ে জমে ওঠে চার বছর আগের সেই আড্ডার মেজাজ যেন নতুন করে…। হঠাৎ বউবাজার ক্রসিং এ এসে বাঁদিকে দোকান গুলোর দিকে তাকাতেই চোখটা আটকে যায় অর্কর।
‘ এই দাঁড়া দাঁড়া.. একটা ফুলের বোকে কিনতে হবে…!’
অপুর্বও নামলো গাড়ি থেকে।
‘সাথী (অপূর্বর স্ত্রী) রোজ্ খুব ভালোবাসে। কয়েকটা স্টিক নিয়ে যাই..আর কিছু ঘর সাজানোর টুনি লাইট…। সাথীর ইচ্ছে ক্রীস্টমাস ইভে লন্ডনে আমাদের কটেজের মতো করে ঘরগুলো সাজিয়ে তুলবে। ঐ..ঐ তো দোকান।’
বউবাজার মোড় থেকে ফুলের তোড়া কিনে দুই বন্ধু আবার গাড়িতে উঠে পড়লো। মনটা ভালো লাগছিল অর্কর। যেমনটা চাইছিল,ঠিক সেই ফুল গুলোই পেয়ে গেছে। অপূর্বর কেনা টুনিগুলোর সঙ্গে অর্কর নিজের কেনা লাইটগুলোর ভারি অদ্ভুত মিল। কেন জানি না ওর মনে হলো, জীবনে বদলে যাওয়া অনেক কিছুর মাঝে এই মিলে যাওয়া আলোটুকুই বোধহয় এতবছর বাদে দুই বন্ধুকে আবার ঠিক একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নয়তো অদেখার আড়ালে সামনে দিয়ে চলে যেত সময় হয়তো….আকাশে টিপের মতো হয়ে আসা অপূর্বর ফ্লাইট…খোঁজ রাখতো না আর।
গাড়িটা স্টার্ট করে অপূর্ব বললো,’ আজ নীতাকে নিয়ে চলে আয় ক্যাপেচিনোতে। গ্র্যান্ডের পাশে। নাকি রিগাল এ বসে রঙিন পানীয়ের স্বাদ নিতে নিতে রাতের পার্ক স্ট্রিটের মোহময়তায় বুঁদ হয়ে থাকবি? মেয়েদের জন্য অফকোর্স জিন কিংবা হালকা পলকা বিয়ার। নীতার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই তো রে? আমার বেস্টির প্রথম দিকে এ নিয়ে কিছু কিছু অবজেকশান ছিল। ওখানে থেকে অ্যাকাসটাম্ড হয়ে গেছে। এখন মাত্রাতিরিক্ত লো টেম্পারেচারে ও জিনিস ছাড়া থাকতেই পারে না। স্পেশালি যখন কোল্ড ওয়েব চলে,তখন কেউই পারে না।’
‘ হ্যাঁ শুনেছি, ওখানে এটাই স্বাভাবিক। ‘
‘ আমি অবশ্য সবটাতেই ব্যালেন্সড। একসময় নানান ব্যাপারে প্রেজুডিস নিয়ে চলতাম। এখন আর চলি না। চলতে গেলে লেফ্টিস্ট দের মতো ওয়াশ আউট হয়ে যাবো হয়তো….যে ছবি এখানে এসে দেখছি। গলা পর্যন্ত ড্রিংক না করেও মাতাল হওয়া যায়…এই সহজ সত্যিটা যে বোঝে না, সে একদিন ওয়াশ আউট হয়ে যাবেই। কি ভাবছিস, আগের বন্ধু কেমন করে হারিয়ে গেল..তাই?’
উত্তম কুমারের কায়দায় ঠোঁটের কোণে সিগারেটটা রেখে ড্রাইভ করতে করতে আলগা হাসে অপূর্ব।
অর্কর মনে হলো, ঐ শেষ কথাটা আসলে যেন তার নিজেরই মনের কথা। কি করে পড়তে পারলো অপূর্ব? কেমন করেই বা পারলো এত সহজে বলে দিতে?
থার্ড আই? না কি কলেজ লাইফ থেকে দেখে আসা সেই প্রখর ইনটিউশান?
‘তা তো খানিকটা ভাবছিই।’
না বলে পারলো না অর্ক।
‘ আমি ভাবি না। শেষ বয়সে হিসেবের খাতা খুলতে বসলে তখন না হয় ভাবা যাবে। এখন ভাবতে শুরু করলে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এন্ড অব দ্য ডে হয়তো তোরও বাড়ি পৌঁছানো হবে না। আমারও। মাঝখান থেকে মেরী ক্রিস্টমাসের আনন্দটাই মাটি…।’
‘ কি যে বলিস!’
‘ শোন,আমি তাহলে মোবাইলে কনটাক্ট করে নেবো তোর সঙ্গে। ‘
থেমে গেল অর্ক,কি একটা ভেবে।
‘আজ হবে না রে অপূর্ব।’
‘কেন? এনি প্রোগ্রাম?’ ভুরু কোঁচকায় অপুর্ব। বন্ধুর পিঠে আলতো হাত রেখে অর্ক বলে,’ আজ নয় রে। অন্য আর এক দিন যাওয়া যাবে। আজ দিনটা সত্যিই স্পেশাল। নীতার ইচ্ছে ছিল এই শাড়ি আর ফুলগুলো নিজে পছন্দ করে কিনবে। কিন্তু আর বেড়োতে পারেনি। বাড়িতে অনুষ্ঠান। ভীষণ ব্যস্ত। তাই আমি অফিস ফেরতা ঠাকুমার জন্য এগুলো…। আজ ঠাকুমা নব্বইতে পা দিলেন। তুই এলে সত্যিই ভালোলাগতো…।’
বউ বাজারকে পেছনে ফেলে গণেশ অ্যাভিনিউয়ের দিকে টার্ণ নিল গাড়িটা। ওখানেই অর্কর বাড়ি।

গাড়ি থেকে নেমে মেন গেট টা খুলতে গিয়ে থমকে গেল অর্ক। সাথে সাথে অপূর্বও। বন্ধুর অনুরোধ রাখতে কিছুক্ষনের জন্য হলেও সে আজ না এসে পারে নি এ বাড়িতে। আর আসতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়লো ওদের। মেন গেট ছাড়িয়ে সদর দরজার বাইরে যে চেনা মানুষগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা সকলেই অর্কর পাড়া প্রতিবেশী। আজ এ বাড়িতে আমন্ত্রিত। তাহলে এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে কেন…? কারো মুখেই কোনো সাড়াশব্দ নেই যেন…। এক অজানা আশংকায় অজান্তেই অপূর্বর হাতটা চেপে ধরলো অর্ক। তারপর আসতে আসতে এগোতে লাগলো। ঘরের ভেতর থেকে একটা সুর ভেসে আসছে। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে সে সুর… স্পষ্ট হচ্ছে গানের ভাষা..। ধীর পায়ে অন্যদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো অর্ক আর অপূর্ব। দরজার পাশে খোলা জানলা। ঠাকুমার ঘর। ফরসা, পুরু লেন্সের চশমা পরিহিত শীর্ণকায় বৃদ্ধাকে ঘিরে গোল হয়ে বসে আছে বাড়ির সদস্যরা। ঠাকুমার পাশে বসে দুচোখ বন্ধ করে রবীন্দ্রসংগীতে ডুবে আছে নীতা। সামনে একটা ঝকমকে হারমোনিয়াম। এক পাশে একটা টুলের ওপর গতকাল অর্কর কিনে আনা বড়সর ক্রীস্টমাস ট্রি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে টুনিগুলো অর্কই সেট করবে বলে গেছে,বাড়ি ফিরে। তারপর কেক কাটা হবে ঠাকুমার সামনে। সেই কেকও তার ব্যাগে স্বযত্নে।
কিন্তু এই সময়টাতে দাঁড়িয়ে কোনো কথাই মাথায় ঢুকছে না অর্কর। কোনো চিন্তাও নয়। জন্মদিনের আবহে জড়িয়ে থাকা ক্রীস্টমাস ক্যারল যেন গানের সুরে রেনেসাঁসের কোন স্বপ্ন আঁকা দিনের সত্যিকারের প্রতিচ্ছবি হয়ে….!
বাইরে দাঁড়িয়ে যারা.. এই মূহুর্তে কেউই যেন চায় না দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে। তারাও যে গান শুনছে। দরজার এপাড়ে দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখতে থাকে অর্ক নিজের স্ত্রীকে…।

বন্ধুর থেকে কিছুটা দূরে জানলার একপাশে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো অপূর্ব। এখান থেকেও স্পষ্ট ভেসে আসছিল গানের কলি। ব্যাগের ভেতর থেকে সদ্য বউ বাজার মোড়ে কেনা গোলাপের তোড়াটা বের করলো অপূর্ব। খুব সুন্দর দেখতে একটা স্টিক আলাদা করে নিল। তিন বছর আগে বন্ধুর বিয়েতে আসতে পারে নি সে। আজও আসার মতো মানসিক প্রস্তুতি ছিল না কোনো। যদি না আসতো তাহলে হয়তো…।

অতিথি, অভ্যাগতরা চলে গেছে কিছুক্ষন আগে। একান্তে, নিভৃত ঘরে স্ত্রী কে কাছে ডেকে নেয় অর্ক। কেকটা বের করে প্যাকেট থেকে। তার একান্ত ভালোবাসার স্মারক। ফি বছর বড়দিনে দুটো করে কেক নিয়ে আসে অর্ক। একটা বাড়ির সকলের জন্য। আর একটা শুধুই তার প্রাণের নীতার।
‘ আমার একা একা এভাবে খেতে খুব লজ্জা করে গো। বাড়ির ওরা সকলে…।’
‘ ওদের জন্য তো রয়েছে। কিন্তু এ আমার ভালোবাসা। এ আমি আর কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারবো না।’
‘ তবু।’
‘ কোনো তবু নয়। জীবনের এই অপেক্ষমান মুহূর্তগুলো কত দামী তুমি কি জানো খুকুমনি?’ বলতে বলতে দু তিনটে ক্যান্ডেল লাইট অর্ক জ্বালিয়ে দেয় ঘরে। সেন্টার টেবিলে রাখা স্ট্রবেরি কেকটা যত্ন করে কাটতে শুরু করে।
‘ এবার হাঁ করো দেখি খুকুমণি…ছোট্ট একটা হাঁ…এই তো।’
‘ তুমিও হাঁ করো দেখি সোনামনি…।’
আদরের কেক কখন যে আদরের ভাষা তৈরি করে দেয়, নিজেরাও জানে না।
অর্ক স্ত্রী কে জড়িয়ে ধরে বাহুমূলে।
হালকা সুরে গেয়ে ওঠে… ‘ আমার মন মজেছে সেই গভীরে গোপন ভালোবাসায়…।’
খিলখিল করে বাচ্চা মেয়ের মতো হেসে ওঠে নীতা।
‘ হাসলে যে? ও, আমার গলা শুনে? কী করবো বলো….সুর যে নিজে নিজেই বেজে চলেছে আজ…সেই সুর কে এনে দিয়েছে বলো দেখি একবার?’
‘ কে?’
‘ তোমার গান।’
স্বামীর বুকে নিজের আঙুল গুলো দিয়ে খেলা করতে করতে আদুরে সলজ্জ গলায় নীতা বলে, ‘এত দাম দিয়ে হারমোনিয়ামটা কেন কিনতে গেলে গো..?’
‘বেশ করেছি..’বলে নীতার কপালের চুলগুলোয় হাত বোলাতে থাকে অর্ক।
‘ কবে থেকে ঠিক করে রেখেছি এবার হারমোনিয়াম টা কিনবই…কিছুতেই কিনতে দাও নি। গান জানো,অথচ গাও না ; এটা কেমন কথা বলো দেখি?’ ‘তাই সটান আমাকে না জানিয়েই নিয়ে চলে এলে?’ ‘ বললে তুমি থোড়াই কিনতে দিতে? তাহলে ভ্যালেনটাইন গিফট এর মজাটাই থাকতো না.. আক্ষেপ একটাই,নিজে হাতে করে নিয়ে আসতে পারলাম না জিনিসটা। ব্যাটাচ্ছেলে আগেভাগেই লোক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। ‘ ‘তুমি না খুব দুষ্টু একটা…।আমার তো গান গাইতে গিয়ে তখন কি যে নার্ভাস লাগছিল! কতদিন চর্চা নেই। সুরের যদি ভুল হয়ে যায় কোনো.. বাড়ির বড়রা সব সামনে বসে…।’ ‘আর এখন কি মনে হচ্ছে বলো শুনি?’ ‘এই আমি কিন্তু রেওয়াজ টেওয়াজ করতে পারবো না..বড্ড লজ্জা করবে..।’ ‘আবার সেই লজ্জা..?’ বলেই চপাৎ করে নীতার গালে চুমু খেতে গেল অর্ক আর ঠিক তখুনি কথাটা মনে পড়ে গেল ওর। তখন অপুর্ব প্যাকেটে মোড়া কি একটা জিনিস দিয়ে বলেছিল, লোকজন চলে গেলে সবার আড়ালে এটা খুলে দেখতে।.. ‘ ‘কী হলো?’
জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলো নীতা। স্বামীর বুকের উত্তাপ উপভোগ করছিল বেশ।
‘এক মিনিট.. ‘ বলে শো কেস এর দিকে এগিয়ে গেল অর্ক। শেল্ফের একপাশে প্যাকেটটা রেখে দিয়েছিল সে। খুলে ফেললো। আর খোলার সাথে সাথেই বেরিয়ে এলো একটা গোলাপের স্টিক। ফুলের গায়ে জড়ানো একটা ছোটো কাগজে ফাউন্টেন পেন এ বড় বড় হরফে লেখা… ‘ শ্রোতা হিসেবে সামান্য উপহার.. ‘। বেশ খানিকটা অবাক চোখে নীতা জিজ্ঞেস করলো, ‘ বাঃ, কি সুন্দর দেখতে! কে দিয়েছে? ‘
থোকা থোকা গোলাপ ফুলের মিষ্টি গন্ধ দোতলার জানালা দিয়ে আসা ফুরফুরে হাওয়ার সাথে মিশে যাচ্ছিল ক্যান্ডেল লাইটের নীলাভ দ্যুতির মতো….অন্য এক বড়দিনের রেষটুকু ছড়িয়ে।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।