সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব – ২৭)

স্রোতের কথা

পর্ব – ২৭

[ ভালোবাসা + ঝগড়া= বন্ধুত্ব ]

“সোঁতসিনি বসুমাল্লিক…ও সোঁতসিনি…ওই মেয়ে…ওরে এই মরণদশা ফ্লেজলিং… এক্ষুণি চলো প্রফেসরস্ ডেন থেকে ডাক পড়েছে…আরে এই মেয়ে…জেগে থাকলে মাইক্রোফোনে সাড়া দাও…কি ঘুম রে বাবা…সন্ধে সাতটা বেজে গেল…কঅঅখন সাঁঝ নেমেছে…ঘুমুচ্চে তো ঘুমুচ্চেই!!!”
আচমকা আওয়াজে ধড়মড়িয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম…এতটাই গভীর ঘুমে ছিলাম… প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি…আওয়াজের উৎস টা কোথায়…তারপর বুঝলাম
শুধুমাত্র ঘরের ভেতর ফ্রীজের পাশে স্ট্যান্ডে রাখা একটা পেন্সিলের মত সরু মাইক্রোফোন থেকেই যে সিনথিয়ার তীব্র গলার আওয়াজটা ভেসে আসছে তা ই নয়,তার সাথে খুবই ননইসপ্যামিক (এই কথাটা প্যামের আবিষ্কার) পদ্ধতিতে দরজার বাইরে থেকে তার উপরে দুমাদ্দুম বাড়ি মারার শব্দ একসাথে মিলেই এই শব্দকল্পদ্রুম সৃষ্টি হয়েছে।
ধড়মড়িয়ে উঠে দরজা খুলতেই….
“উফফফফ”
‌ কয়েক মূহুর্তের জন্য চোখের সামনে সব অন্ধকার… দরজার উপরে মারার বদলে সিনথিয়ার ঘুঁষি টা ঠিক আমার নাকের উপর আছড়ে পড়েছে… আর চোখে সর্ষেফুল দেখে আমি ছিটকে পড়লাম… আমার পা দুটো উপর দিকে উঠে গেল…যা তা…
সিনথিয়া গোল গোল চোখে খানিকক্ষণ ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করলো… তারপর মনে হয় “অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স” পদ্ধতি অবলম্বন করলো…
“এবারের ফ্লেজলিংগুলো‌ সব কটা একেবারে যাচ্ছেতাই…পুরো পাগল আর গাধা… এ নাকি আবার ফোর গডেসের আশীর্বাদ পাওয়া!!!ঘটে তো একটুও বুদ্ধি নেই দেখছি…ও রকম লাফিয়ে দরজা খোলার কি দরকার ছিল?..কেমন হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখো!! আমার কোনো দোষ নেই কিন্তু, হ্যাঁ আমি মানছি,দরজায় ধাক্কা দেওয়া রুল নয়… কিন্তু তাড়াতাড়ির সময় এটাই সবচেয়ে কাজে দেয়… এই মেয়ে…তুমি যদি এরপর প্রফেসরদের নালিশ করেছ… অবশ্য তুমি আর কি নালিশ করবে…যাও না প্রফেসরস্ ডেনে …বুঝবে মজা…আ্যান্টার্কটিকা ইসপ্যামায় গিয়ে থাকতে হবে এরপর থেকে…আর খালি সিলের মাংস খেতে হবে…হুঁ হুঁ বাবা…কি সাহস!! এসেই রুল ভাঙা…শয়তানি বেরোবে এইবার…”
ভয় আর আশঙ্কায় আমার আলু হয়ে যাওয়া নাকের ব্যথাও ভুলে গেলাম
“আমি ক‌্ ক্ ক্কি করেছি সিন..ইয়ে মানে ম্যাডাম সিনথিয়া??”
সিনথিয়াকে খুব খুশী খুশী দেখালো…
“আমি দেখেই বুঝেছি এই লটের সবকটা ফ্লেজলিং একের নম্বরের মিচকে বদমাইশ… আমি কিছু জানিনা বাবা,তবে কিছু করো আর না করো…আগেই বলে দিও ভুল করেছি,ক্ষমা করে দিন…তাহলে যদি খানিকটা বাঁচো…নাও নাও তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও…আর নাক টা…দূর ছাই… আমি তো আবার হিলারও না…সিলভিয়া থাকলে… যাগ্গে… নাকে একটু বরফ ঘষে তোমার ঐ ঢঙী… ঠোঁটের তলায় পিন বেঁধানো…লাল চুলো কেল্টে বন্ধুটাকেও সঙ্গে নিয়ে যাও…তাকেও অবশ্য এক্কুনি বলেই এলাম….যাও… একসাথে মিলে দু’জনে সোজা প্রফেসরস্ ডেনে চলে যাও…”
“সেটা কোথায়? ইয়ে মানে সিলভিয়া ম্যাম?”
” কাল যেখানে খাওয়াদাওয়া‌ হচ্ছিল…তার দুটো বিল্ডিং পরে…আর শোনো…হি হি হি… ওটার আর একটা নামও আছে…সাফারিং রুম…কেউ কোনো শয়তানি করলে…ওখানে ট্রায়াল হয়…আর তারপর…”
সিনথিয়া গলার কাছে হাত দিয়ে একটা এমন ভঙ্গি করলো…যে আমার নাক ব্যথার কথা আর মনেই পড়লো না…তার বদলে পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে উঠলো
সিনথিয়া চলে যেতেই আমি বাথরুমের দিকে দৌড় লাগালাম…আর বিলাসবহুল বাথরুমের বিলাসিতা আজ আর আমাকে একটুও আকর্ষণ করলো না…
কোনোক্রমে ফ্রেশ হয়ে একটা জিনস আর টি-শার্ট গলাতে গলাতেই দরজায় টোকা…আর আমি ভালো করেই জানি, দরজার বাইরে কারা…
“কি করবো আমরা স্রোত!! কেন ডেকেছে রে শুধু তোকে আর আমাকে!”
আমরা সবাই ,আমার ঘরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে…যদিও জানি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাওয়া উচিত… কিন্তু…কেউ সহজে নড়তে চাইছি না
“আমার মনে হয়, আমি জানি…কেন ডেকেছেন ওনারা ”
“সেই… তুমি আর জানবে না!! তা জানিস তো বলে ফ্যাল্ না বাবা ডাইকো…স্রোত আর মিট্টির কেমন লাগছে বল্ তো এখন…”
ডাইকো একটা নিঃশ্বাস ফেললো
“আসলে কাল স্রোত আর মিট্টি ওদের মেন্টরের পারমিশন ছাড়াই পাওয়ার ইউজ্ করেছে…যেটা ইসপ্যামার রুলের এগেইনস্টে…সেটা নিশ্চয়ই প্রফেসররা কোনোভাবে…রুলসের ব্যাপারে ইসপ্যামা ভীষন কড়া রে…”
” তা যদি বলিস্… কাল রুল আমরা সবাই ভেঙ্গেছি… সাউথের বনের দিকে যেখানে আমাদের যাওয়া বারণ ছিল…আমরা সবাই গেছি…ওরা একা কেন শাস্তি পাবে তাহলে!!!”
“সুজী ঠিক বলেছিস…” সমীর বলে উঠলো… “তাছাড়া ভ্যাম্পায়ার টীথ তো আমিও ইউজ্ করেছি…কাল যদি আমরা পাওয়ার ইউজ্ না করতাম…ঐ ভূত পেত্নী মার্কা ছেলেমেয়ে গুলোর হাত থেকে কেউ বাঁচতাম নাকি!! সেটা প্রফেসরদের আমরা খুলে বলবো…তাতেও কি ওনারা বুঝবেন না??”
“না….আমরা ওনাদের কিছুই বলবো না…তোরা একটা কথা ভুলে যাচ্ছিস, কিছু বলতে গেলেই রুকসানার কথা বলতে হবে…তখন কি সর্বনাশ হবে,কেউ জানে না কিন্তু…তার থেকে, অন্য কিছু একটা বলে আমাদের ম্যানেজ করতেই হবে”
“স্রোত তুমি কি মনে করো… ওনাদের বোকা বানানো এত সহজ!! হয়তো ওনারা অলরেডি সব জেনে গেছেন… আসার সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ জায়গায় যাওয়া… আবার মেন্টরের পারমিশন পাওয়ার আগেই সুপার পাওয়ার ইউজ করা… কি হবে…কে জানে!”
” ডাইকো…আমরা না হয় এখানকার কিছুই জানি না…কিন্তু তুই তো আগে থেকেই সব জানতিস তাই না?যে পারমিশন না নিয়ে পাওয়ার ইউজ করলে বিপদে পড়তে হতে পারে! তাই আমাদের একবারও সাবধান না করে, উল্টে নিজের পাওয়ার ইউজ্ না করে… আমাদেরকেই… বাঁচা বাঁচা করে চিৎকার করছিলি…!আর আমরা ফেঁসে গেলাম… এতোটা সেলফিশ্ তুই!!”
“মিট্টিইইই চুপ কর্ প্লিজ… এখন নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করিস্ না ” আমি মিট্টিকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।
” কেন করবো না… চোখের সামনেই তো দেখছি…বুঝছি সব্…এই নাকি বন্ধুত্ব!”
“না মিট্টি তা নয়..তোমরা আমাকে ভুল বুঝছো…”
“একদম ই ঠিক বুঝছি…আমরা না হয় জানতাম না…তুই তো জানতিস…এখানে এ সব করা বারণ! আর স্রোত….আমার বাড়ি খুবই সাধারণ রে…আমাদের অত পয়সা নেই বলে ,কেউ আমাদের পাত্তা দিতনা এতদিন….আজ আমি ইসপ্যামাতে চান্স পেয়েছি বলে আমার বাবা মা তাও সামান্য একটু মান সম্মান পেয়েছে সবার কাছে…এখন আমায় যদি এখান থেকে তাড়িয়ে দেয়!! ”
মিট্টির গলায় রাগ আর কান্না দুটোই মিলে মিশে গেল…
” আমার জন্যই এসব কিছু হলো… আমি ই সব কিছুর জন্য দায়ী…সত্যিই আমি একটা গুড ফর নাথিং… নিজের ঝামেলায় তোদের জড়িয়ে… তোদের সবাইকে বিপদে ফেললাম্… স্যরি মিট্টি …স্যরি স্রোত..” রিজ হাহাকার করে উঠলো…
” তোরা সবাই চুপ করবি?? কারোর জন্য কারোর কিচ্ছু ক্ষতি হবে না… আমি তো বলছি…মিট্টি প্লিজ্ তুই একটু মাথা ঠাণ্ডা কর্ ”
আমি মিট্টির পাশে গিয়ে ওর হাতটা শক্ত করে ধরলাম…
” রিজ্ “রূকসানা কেমন আছে‌ রে এখন?”
“কাল থেকে সেই এক রকম ই রে… এতক্ষণ হয়ে গেল…জ্ঞান ফেরেনি তো…কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না…”
রিজের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো
” একটা কথা বলবো??
ডাইকোর গলায় কষ্ট আর লজ্জা মাখামাখি….
” প্যাম, মিট্টি আর স্রোত…মানে যাদের উইচের পাওয়ার আছে…মানে, আমি বলতে চাইছি যে উইচদের হিলিং পাওয়ারও থাকে… শুধু কতগুলো টেকনিক ফলো করলে ওরা যেকোন ক্ষত‌ বা অসুখ ভালো করে দিতে পারে…
আর মিট্টি,…প্লিজ আমাকে বিশ্বাস কর্…
আমি ইচ্ছে করে সেফসাইডে থাকার জন্য যে নিজের পাওয়ার ইউজ করিনি তা নয় রে… আসলে আমরা ওয়্যারউলফ্ রা তোদের মত নই… আমাদের পাওয়ার সবসময় একরকম থাকে না…ফুল মুন বা পূর্নিমা যত এগিয়ে আসে… আমাদের পাওয়ার তত বেড়ে যায়…আর পূর্নিমাতে সেটা এতটাই বেড়ে যায়…যে আমাদের পাওয়ারের ধারেকাছে কেউ আসতে পারে না…আবার পূর্নিমা কেটে গেলে…যত অমাবস্যা বা নিউ মুন এগিয়ে আসতে থাকে আমাদের শক্তি তত কমতে থাকে রে…আর অমাবস্যা এলে আমাদের পাওয়ার একেবারে জিরো হয়ে যায়…তখন যে কেউ ইচ্ছে করলে আমাদের শেষ করে দিতে পারে… অমাবস্যার পর থেকে আবার পাওয়ার বাড়তে থাকে…আর…আর আজ থেকে সাতদিন পরেই নিউ মুন বা অমাবস্যা…তাই আমার পাওয়ারও প্রায় নেই…কাল আমার যেটুকু পাওয়ার ছিল…ঘ্রাণশক্তি ইউজ করে রুকসানা কে খুঁজে পেতেই শেষ হয়ে গেছিল রে…তাই আমি কাল আর পাওয়ার ইউজ করতে…” ডাইকো মাথাটা নীচু করে ফেললো।
আমরা কি বলবো কিছু ভেবে পেলাম না
একটু পরে মিট্টিই এগিয়ে গেল ডাইকোর দিকে …”স্যরি রে ডাইকো… একটু ভয় পেয়ে,চিন্তায় তোকে উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছি, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে…”
ডাইকো মুখ তুলে ঝলমলে হাসি হাসলো…”ধ্যূস…বন্ধুদের মধ্যে ঝামেলা না হলে কি বন্ধুত্ব জমে??” আর একটা কথা… শুধু স্রোত আর মিট্টি কে ডাকলেও আমরা সবাই ওদের সাথে প্রফেসরস্ ডেনে যাবো…হয়তো প্রথমে আমাদের ঢুকতে দেবে না…তাহলে আমরা বাইরে অপেক্ষা করবো… কিন্তু স্রোত আর মিট্টির যদি কোনো শাস্তি হয়…ওদের সেটা একা ভোগ করতে দেবোই না…সেই শাস্তি আমরা সবাই ভাগ করে নেবো…কি বলিস তোরা? জানি আমাদের এখন মেন্টরদের সাথে মিট করে ক্লাস রুটিন আর অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য ডাকা হয়েছে… কিন্তু এই ব্যাপার টা না মিটিয়ে আমরা কেউ যাচ্ছি না…প্লিজ সবাই বল্…তোরা আমার সাথে একমত কি না”
“আমরা সবাই রাজী…স্রোত আর মিট্টির সমস্যা না মিটলে আমরা কেউ কোথ্থাও যাচ্ছি না”
সুজী,প্যাম সমীর আর রিজ একসাথে দৌড়ে এল আর আমাদের জড়িয়ে ধরলো…” তারপর? আমাদের সম্মিলিত হাসি,চোখের জল আর ভালোবাসার চাপে উদ্বেগের মেঘ পালানোর পথ খুঁজতে লাগল।
আমরা সবাই একসাথে বলে উঠলাম

“Hard times will always reveal our true love and friendship…”

‌‌ ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।