কর্ণফুলির গল্প বলায় স্বপঞ্জয় চৌধুরী

রিলিফ

এখন মধ্যরাত। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। ঘন্টাখানেক আগেও খুব বৃষ্টি হয়েছে। তাই গাছের পাতা চুইয়ে চুইয়ে টিনের উপর জলের ফোটা পড়ছে, সাথে দু’একটা পাতাও খসে পড়ছে। মায়ের বুকের ভেতর আঁটসাঁটো হয়ে ঘুমিয়ে আছে আলিফ। মায়ের প্রতিরাতে চোরা জ্বর আসে। মাঝরাতে জ্বর উঠে শেষরাতে ভাটার মতো নিরালায় চুপচাপ ঘাম দিয়ে ছেড়ে যায়। জানালার ছোট ফোকড় দিয়ে হিম হিম সরু বাতাস ঘরের ভেতর ঠুকে যেন শীতের প্রহর ডেকে নিয়ে আসে।
কীসের একটা হট্টগোল শোনা যায় বাহিরে । ও সাদেক মিয়া, ও আলিফের মা, ও ছত্তর মুন্সী কই তোমরা উডো শিগরির নদীর বান ভাঙছে ও বান ভাঙছে। মাল সাবান লইয়া আশ্রয় কেন্দ্রে যাইতে হইবো। তোমাগো এত কইরা কইলো শুনলানা পুরা গেরাম ফাঁকা। আমি যাইতাছি। আমার নাওয়ে জায়গা আছে যদি যাইতে চাও তয় নাওয়ে উডো। সমিরনের বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। এই বানের জলে বছর পাঁচেক আগে ভেসে গেছে আলিফের বাপ। তাই এই বানভাঙার কথা শুনলেই সেই দুঃসহ রাতের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। সেরাতে কাউকে কোন কিছু না বলেই আগ্রাসী সাগরের উর্মিমালার মতো তেড়ে আসে বানের জল। সুনামির মতো তীব্র তেজে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘরবাড়ি, গোয়াল ঘর, গবাদি পশু। আলিফকে কোনমতে কোলে নিয়ে বড় সেগুন গাছের মাঝডালে আকড়ে ছিল সমীরন। পা পিছলে সেই বানের জলে পড়ে গিয়ে কোথায় যে ভেসে গেল আলিফের বাপ । পাঁচদিন পর হদিস পাওয়া গেল পাশের জেলার নদীতে। সমস্ত গায়েই যেন নেমে আসে লাশের ভাগার তেরো জন মানুষের লাশ করিমগঞ্জের উচা ডিবির উপর কবর দেয়া হয়। প্রতি সবে বরাতে কবরের চারকোনায় গোটা কোতক আগরবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আসে। তারপর মা ছেলে মিলে কবরের সামনে মোনাজাত করে আসে।
সাজু মিয়া আবারও হাক দিয়ে ওঠে কি হইলো আলিফের মা। সময় নাই সাদেক আর ছত্তর উঠছে নায়ে। ছাদেক আর ছত্তর সমিরনের প্রতিবেশী। সমিরন খুব তড়িঘড়ি করে একটা পুটলির মধ্যে কিছু চাল, ডাল, কাপড় ,চোপড়, ঔষধ এসব নিয়ে একটা জোর গিট্টু দেয়। আলিফ চোখ কচলে কচলে উঠে আবার মায়ের কাঁধের উপর ঘুমিয়ে পড়ে। দূর থেকে সাপের মতো। শো শো শব্দ শোনা যায়। সাদেক, ছত্তর আর সাজু মিয়া হেইহো , আল্লাহু আকবর রব করতে করতে নায়ের খোচ দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে তিন পরিবারের মোট এগারজন একটি নৌয়ে। তাই নাও এগুচ্ছে খুব কষ্টে। আর আধ মাইলের মতো বাকী দূরে গঞ্জের আশ্রয় কেন্দ্রের বাতি দেখা যায়। সমিরন মনে মনে সুরা ফাতিহা পড়তে থাকে। আলহামদুলিল্লাহির রাব্বুল আলামিন, আর রাহমানুর রাহিম।

আশ্রয় কেন্দ্রে পা ফেলানোর জায়গা নেই। যারা আগে আসতে পেরেছে তারা মাদুর পেতে শুয়ে আছে। যেন এক জীবন্ত ভাগার খানা। কেউ কেউ শহরে আত্নীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে তাই কিছু জায়গা ফাঁকা হওয়ায় উঠতে পেরেছে সমিরন। আলিফকে একটা মাদুরের উপর পাতলা কাঁথা বিছিয়ে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। পরাজিত যোদ্ধার মতো ক্লান্তি নিয়ে ফুরিয়ে যাচ্ছে রাত। আজানের সাথে কিছু মানুষ ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় জায়গা করে নামাজের জামাতে দাঁড়িয়েছে। পুটলিটা একপাশে রেখে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বসে বসেই ঝিমুতে থাকে সমিরন। সমিরনের পাশেই এক মাঝ বয়সী লোক খস করে দিয়াশলাই এ ঘষা দিয়ে একটা আকিজ বিড়ি ধরান। সমিরন বিড়ির গন্ধ থেকে বাঁচতে নাকে আঁচল চেপে ধরেন। গন্ধটা আরো উগ্র হতে থাকে হয়তো বিড়ির সাথে গাঁজাজাতীয় কিছু মেশানো হয়েছে। সমিরনের খালি পেট ধূমপান এর গন্ধে বমির মতো উগরে আসতে চায়। সে এবার মুখ খুলে। মিয়া ভাই বিড়িডা একটু দূরে যাইয়া খান। আমার ধুমার গন্ধ সইয্য অয়না। ক্যারে দূরে আমু কে মাতারি, এইডা কী তোমার বাপ দাদার ভিডা পাইছো নি। নামাজ শেষ করে এদিকে আসে ছত্তর মুন্সী। টুপিটা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে কী হইছেরে সমিরন। দেহেন্না ভাইজান এই ব্যাডা এহেনে খাড়াইয়া বিড়ি টান্তাছে, হরতে কই হরেনা। অই মিয়া তোমার বাড়ি কই। মাইয়া মানুষ দেখলেই ঘেষতে মন চায়। বিড়িখোর লোকটা কথা না বাড়িয়ে অন্যদিকে চলে যায়।
সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ায়। সবার কাছে কিছু কিছু চাল ছিল। চালগুলো একসাথে করে, ডাল আর আলু মিশিয়ে রান্না করা হয় সব্জি খিচুড়ি। এভাবে হয়তো দিন তিনেক চলা যাবে কিন্তু বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে তাকিয়ে থাকতে হবে রিলিফের দিকে। খিচুড়ি রান্না হয়েছে সবাইকে কলাপাতায় খিচুড়ি বেরে দেয়া হচ্ছে। আলিফ ক্ষুধায় মুর্ছা যাচ্ছে। দুজনের সামনে দুটো কলাপাতা পাতা আছে। সবাই লাইন ধরে বসে আছে। প্রায় পাঁচশত লোকের খাবার কম কথা নয়। চেয়ারম্যান সাহেবও ৫ বস্তা চাল দান করেছেন। গরম খিচুড়ির ভেতর হাত দিতেই হাত জ্বলে উঠে আলিফের। সমিরন তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে বাবা জুরাইয়া লোউক, তারপর খাও। বাইরে মেঘ ডাকছে চারিদিকে ঘন অন্ধকার নেমে আসে। বৃষ্টির সাথে সাথে বাড়তে থাকে পানি।

প্রায় সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেল। বন্যার পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। এদিকে সমিরনের চোরা জ্বরটা ইদানীং সময়ে অসময়ে এসে হানা দিচ্ছে। আলিফ এতটুকু ছয় বছরের ছোট বাচ্চা ওর ওপর দিয়ে কম ধকল যাচ্ছে না। বড়দের সাথে পাল্লা দিয়ে সাতরে গিয়ে নিজের ওজনের চেয়ে বেশি ওজনের রিলিফ নিয়ে আসছে। আটা, নুন, মুড়ি, কখনো পাউরুটি , চাল এসব। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বেচারার অবস্থাও খারাপ। প্রথম দিকে অবশ্য ছত্তর মুন্সী, সাদেক একটু সহযোগিতা করলেও এখন তারা নিজেরাই ইয়া নফসি, ইয়া নফসি করছে। কারো দিকে কারো নজর দেয়ার সময় নেই। আপনি বাঁচলে পরের নাম।
দিনের ভেতর পাঁচ সাতবার করে বৃষ্টি হচ্ছে। মসজিদের মাওলানা সাহেবও ঠাঁই নিয়েছেন এই আশ্রয় কেন্দ্রে। সেও তসবী গুনছে চোখ বন্ধ করে। কেউ একজন এসে খবর দেয় ত্রাণের ট্রলার আসছে। সবার ভেতরেই হৈ হৈ রব পড়ে যায়। সমিরনের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এদিকে আলিফেরও সর্দি, গায়ে হালকা জ্বর। সমিরন অচেতনের মতো পরে থাকে। আলিফ মাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে- মা ও মা, আমি কী যামু, ট্রলার আইছে, হেরা সবাই গেছে। সমিরন জ্বরাগ্রস্থ কণ্ঠে বলে- বাবা যাও, সাবধানে যাইয়ো। বেশি পারাপারির মধ্যে যাইওনা।

একটা স্বেচ্ছাসেবক দল ট্রলার নিয়ে এসেছে। ট্রলার ভর্তি ত্রাণের শুকনা খাবার। চিড়া, গুড়, আটা, এইসব। লোকজনের প্রচন্ড ভিড়। একজন সাদা টিশার্ট ও লাল ক্যাপ পড়া স্বেচ্ছাসেবক হ্যান্ডমাইক দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দাঁড়াতে বলছেন। অবশ্য কেউই দাঁড়িয়ে নেই। সবাই বুক সমান পানিতে ভেসে আছেন। যারা সাইজে ছোট তারা সাতরে সাতরে নিজেদের ব্যালেন্স টিক রাখার চেষ্টা করছেন। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ট্রলারের উপর। আলিফ এতো মানুষের ভিড়ে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলছে। সে মানুষ ঠেলে ট্রলারের সামনে যেতে পারছেনা। জোয়ান মর্দদের ধাক্কাধাক্কির তোড়ে সে যেন ডুবে যাচ্ছে। আলিফ কিছুতেই সামনে এগুতে পারেনা। দেখতে দেখতে সমস্ত ট্রলারই খালি হয়ে যাচ্ছে। আলিফ অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সামনে এগুতে পারেনি। সে খুব ক্লান্ত তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের জ্বরাগ্রস্থ ক্লান্ত মুখটি। তাকে যে ত্রাণ নিয়ে যেতেই হবে। কাল থেকে মা না খেয়ে আছে। ট্রলার ছেড়ে দেয়। সে ট্রলারের পিছনে ছুটতে থাকে। ভাই আমারে ত্রাণ দিয়া যান। আমি পাই নাই। আমার মা অসুস্থ। দেখতে দেখতে অনেক দূরে চলে যায় ট্রলারটি। নদীর স্রোত বাড়তে থাকে। আকাশে বৃষ্টির ঘনঘটা। আলিফের চোখে ক্লান্তি নেমে আসে।

দু’ঘন্টা পর। আলিফ চোখ মেলে তাকায়। সে তার মায়ের কোলে শুয়ে আছে। মা তার গালে চুমু খাচ্ছে। আমার বাপধন। আজ তুই তোর বাপের মতো ভাইসা গেলে আমি কী নিয়া বাঁচতাম। আমার মনে কু ডাকছিল তাই বইসা থাকতে পারিনাই। আর একটু হইলেতো তুই ভাইসা যাইতি। তোর মামু আইছে ঢাহা থিকা। আমরা তার লগে ঢাহা যামু। আলিফের চোখে তখনও ভাসছে ট্রলারটি ভটভট শব্দ করে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।