সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ১৪)

জন্ম কলকাতায়(২৭ নভেম্বর ১৯৮০)।কিন্তু তার কলকাতায় বসবাস প্রায় নেই।কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।সেখান থেকেই হয়তো ইন্ধন পেয়ে বেড়ে ওঠে তার লেখালিখির জগত।প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আকাশপালক "(পাঠক)।এর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শিকারতত্ত্ব(আদম), আড়বাঁশির ডাক(দাঁড়াবার জায়গা), জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার(পাঠক), কানাই নাটশালা(পাঠক),বহিরাগত(আকাশ) ।কবিতাথেরাপি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।এই বিষয়ে তার নিজস্ব প্রবন্ধসংকলন "ষষ্ঠাংশবৃত্তি"(আদম)।কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও গল্প লিখতে ভালোবাসেন।প্রথম উপন্যাস "কাকতাড়ুয়া"।আশুদা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশিত "নৈর্ব্যক্তিক"(অভিযান)।'মরণকূপ' গোয়েন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় অভিযান,যদিও তার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে সে একেবারেই স্বতন্ত্র।এই সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস 'সাহেববাঁধ রহস্য '(চিন্তা)।সম্পাদিত পত্রিকা "শামিয়ানা "। নেশা মনোরোগ গবেষণা,সঙ্গীত,অঙ্কন ও ভ্রমণ ।

বিন্দু ডট কম

তরুলতার আজ ডে অফ।মাসে টানা কাজ থাকলে এরকম কালেভদ্রে একআধটা ডে অফ মেলে বৈকি। সেই ডে অফে সকাল থেকে আজ রান্না করবার মুডে আছে সে।মুড়ি ঘন্টর জন্য কাতলার মাথা আনিয়েছে সকালের মাছওয়ালাকে বলে।এখানকার মাছ বেশির ভাগ চালানি মাছ।তবু কালেভদ্রে বিলের মাছ পাওয়া যায় সন্ধান করলে।এই মাছওয়ালার বাড়ি দাঁতনের দিকে।সেখান থেকে ভ্যানরিক্সা চালিয়ে রোজ এ পাড়ায় মাছ দিয়ে যায়। মাছের দরাদরি করবার সময় একঝলক চোখাচোখি হয়ে গেল তার বাড়িওয়ালা স্কুলমাস্টারের গিন্নির সঙ্গে। দেখামাত্র দুজনেই অপ্রস্তুত হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।অখিলেশ মাঝেমধ্যেই আসে এখানে।সে একা এলে সমস্যা ছিল না।কিন্তু সমস্যা তার সাদা গাড়িটাকে নিয়ে। মাস্টারমশাই অখিলেশের পরিচিত।আবার বাড়ি ভাড়া নেবার সময় তরুলতা নিজেকে মিসেস সেনগুপ্তই পরিচয়ই দিয়েছিল।না হলে ঘর পাওয়া যেত না এ অঞ্চলে।এইসব নানা কারণে নজরবিনিময় দীর্ঘমেয়াদী হতে পারলো না।তা না হোক।মুড়িঘন্ট ছাড়া সে রান্না করবে বনমুরগীর ঝোল আর ভাত।বনমুরগী অখিলিশের খুব প্রিয় খাবার।আজ কাজ সেরে তার সকাল সকাল চলে আসা র কথা।আসলে তীর্থর শারীরিক অবস্থার কথাটা জেনে যাবার পর তরুলতা একটু বেশিই নরম হয়ে পড়েছে।তাছাড়া আজকাল তার কী হয়েছে!কেমন যেন বেপরোয়া ভাব সবকিছুতেই।
বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে তরুলতা মোবাইলটা দেখবার সময় পায়।পরপর দুটো মেসেজ।প্রথমটা শুভব্রতর। দ্বিতীয়টি অখিলেশের।তরুলতা দ্বিতীয় মেসেজটাই আগে খোলে।প্রথমজন এখন তার জীবনে অতীত।অখিলেশ লিখেছে সে আসছে রাতে।গাড়ি রেখে আসবে।লোকদৃষ্টি এড়িয়ে। শিরশির করে কেঁপে ওঠে ভিতরটা।আজ সারারাত সে থেকে যাবে তার কাছে।সংক্ষেপে একটা অপেক্ষার সংকেত পাঠিয়ে তরুলতা ফিরে যায় প্রথম মেসেজে।শুভব্রত সেখানে লিখেছে সে তার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় আজ মহাজনের হাতে সঁপে এসেছে।ধাঁধা বা কবিত্ব নিরুপণ,কোনওটারই ইচ্ছাশক্তি খুঁজে পায় না আর তরুলতা।শুভব্রতর সারাজীবনের সঞ্চয়ে সে কি কোথাও কোনও দিন ছিল!থাকলেও তাকে সঁপে দেবার অধিকার তার আর নেই।আর তার পত্রিকা। সে সতিনের সংসার থেকে তরুলতা তো বেরিয়েই এসেছে।কী করছে মানুষটা কে জানে?ইস্কুলের চাকরিটা এখনও আছে কিনা,তাই বা কে জানে!তবে সে কৌতূহল তরুলতার মনে দীর্ঘস্থায়ী হয় না।কোনও উত্তর না দিয়েই সে এবার ফোন থেকে বেরিয়ে আসে।বরং তার মনোযোগ কেড়ে নেয় অখিলেশের প্রজাপতির খাতা।ওই খাতাটা আজকাল তার কাছেই থাকে। মাঝেমাঝে সে সময় পেলে উল্টে দেখে।পাতা খুলতেই ফিতেপলাশ।ঘুড়ির লেজের মতো ডানা। বর্ষার আগে এদের আনাগোণা।ঘুড়ির মতোই তারা উপরের দিকে উড়তে চায়।ভাবতে ভাবতে প্রজাপতির স্থির হয়ে যাওয়া কালো দুটো চোখে হঠাৎ নজর আটকে যায় তার।উপরে উঠতে চাইবার পরিণতি কি এটাই?তবে কি সেও এমন একটি ফিতেপলাশ হয়ে যাবে কোনওদিন!সেই আশঙ্কা মনের ভিতরে দানা বাঁধতে দেয় না তরুলতা।পাতা ওলটালেই ধরা দেয় সাগদা প্রজাপতি।তার জনপ্রিয় নাম ট্রি ফ্লিটার।এটি একটি স্কিপার।রোদ পোহানোর সময় স্কিপারদের রীতি অনুযায়ী এরা পিছনের ডানাজোড়া পেতে রাখে।ভাবতে ভাবতেই নাইটির ভিতর থেকে অন্তর্বাস খুলে নেয় তরুলতা।প্রজাপতির স্থির গাঢ় নীল চোখের মৃত্যু আর তাকে বিচলিত করে না।ফুলের রেণুর মতো মনে হয় সেও উড়ছে ডানা মেলে।উড়তে উড়তে পরের পাতায়।সেই পাতা জুড়ে যে প্রজাপতির শব,তার নাম রূংলি।পুরুষ প্রজাপতি।তার পিঠে রাংতা বসানো সবুজ।এরা থাকে সিকিমের পাহাড়ে।আহা কতোদিন পাহাড়ে যায়নি তরুলতা।হাল্কা মেঘের কোলে দোল খায়নি কতোদিন।ভাবতে ভাবতে পাতার ফাঁক দিয়ে গলে একটা ছোট্ট চিরকূট পড়ে গেল নীচে।কুড়িয়ে তুলতেই তরুলতা দেখলো সেটি তারই ব্যাঙ্কের একটি স্লিপ।কৌতূহল জমে উঠলো বিশেষত নিজের সইটি দেখে।সে সই অফিসে তার সহকর্মী ঋতবানের।কাগজটা একটা পে রোলের রিসিট।পে রোলের কোম্পানি যার নামে তার নাম দেখে তরুলতা আরও অবাক হয়ে যায়। সমরজিৎ দলুই।সেই পঞ্চাশ হাজার টাকার ভাউচারের রহস্য কিন্তু অখিলেশ এখনও সমাধান করে দেয়নি তাকে।তবে কি ঋতবানও এর সঙ্গে জড়িত।সেই কারণেই কি ছেলেটা রোজ অখিলেশের কাছে বকুনি খায়?ওকে বাঁচাতেই কি অখিলেশ সেদিন ওটিপিটা জেনারেট করেছিল?এতোসব ভাবতে ভাবতে তরুলতা ঘুমিয়ে পড়ে।
সে তন্দ্রা ভঙ্গ হয় কলিংবেলের আওয়াজে।ঈশ।কখন চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে।জানতেই পারেনি সে।আলো জ্বালাতেও ভুলে গেছে।কোনও রকমে চুলগুলো ঠিক করে বাইরের বাল্বটা জ্বালিয়ে আইহোলে চোখ রাখতেই তার মন ভরে গেল আনন্দে।তার জন্য দরজার ওপারে একটি জ্বলজ্যান্ত পুরুষ ব্যারনেট অপেক্ষা করছে।দরজা খুলতেই অখিলেশ তার উদ্বেগ চেপে রাখলো না।
-আলো জ্বালাওনি কেন?
-ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
অখিলেশকে জড়িয়ে ধরে তরুলতা।অখিলেশ তাকে কোলে তুলে নিয়ে সোফায় শুইয়ে দেয়।
-ভালোই করেছো।
-তাই তো।সুবিধে হবে তোমার।তা আজও কি দরজা খোলা রেখেই…
-থাক না।কে আর আসবে।
গভীর চুম্বনে ডুবে যায় দুইজন।ঘরের অন্ধকার জমে ওঠে আদ্রতা আর তরুলতার উন্মুক্ত শরীর জোছনায়। তারপর ফিসফিস করে কানেকানে সে অখিলেশকে বলে,”তোমার জন্য রান্না করেছি।মুড়িঘন্ট,মাংসের ঝোল।”
আবার দোলনায় দুলছে দুইজন।রাত বাড়ে।শ্রান্ত অখিলেশ সোফায় শুয়ে থাকে পেশোয়ার মতো।তরুলতা আবার নাইটি পরে নিয়ে ঘরের আলো জ্বালে।সদর দরজা বন্ধ করতে গিয়ে মনে হয় কোনও ছায়া সরে গেল বাইরে থেকে।দরজা খুলে তাকায় এদিকওদিক।নাহ।কেউ নেই।তার মনের ভুল।ঘরে এসে অখিলেশের হাতে ওই ব্যাঙ্কের চিরকুটটা তুলে দেয়। সেই চিরকূটটা হাতে নিয়ে অখিলেশ গম্ভীর হয়ে গেল হঠাৎ।
-এ কাগজ তুমি কোথায় পেলে?
-লেপিডপটেরিস্টের বইয়ের পাতায় আটকে ছিল।
অখিলেশ আর কিছু বলে না।পরম যত্নে চিরকূট পকেটে ঢুকিয়ে প্যান্ট পরে নেয়।
-কী হলো।খাবে না?
-নাহ।আজ থাক।একটা খুব জরুরি কাজ মনে পড়ে গেছে।
তরুলতা স্তম্ভিত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।সে মূর্তি দেখে বোধহয় অখিলেশের মনে দয়া হয়।একে কবি করুণা বলবেন।নাকি মায়া।তরুলতার গলার খাঁজে চুমো খেয়ে অখিলেশ বলে,”আমি আসছি এখুনি।এসে খাবো।আর আরেকটা কথা…”
তরুলতা সজল চোখের অভিমানে চেয়ে থাকে।কথা বলে না।
-রাগ করে না।আমি আসছি এখুনি।কাজটা সত্যিই খুব জরুরি। তোমাকে বলবো সব।এসে বলবো।
বলেই অখিলেশ হন্তদন্ত বেরিয়ে পড়ে।বাইরের অন্ধকারে তার ছায়ামূর্তিটা মিলিয়ে যায় এক নিমেশে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।