কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুজিত চট্টোপাধ্যায় (পর্ব – ৩)

নীলচে সুখ 

তখন বেলা গড়িয়েছে। মেঘলা আকাশ। এখানে যখন তখন বৃষ্টি নামে। অচেনা ভিনদেশী হাওয়ায় পাহাড়ের সোঁদাগন্ধ। দিন রাতের বালাই নেই, ঝিঁঝি পোকার অন্তহীন ক্রদন অব্যাহত। মিউজিক্যাল অর্কেস্ট্রা। একটা যাদুকরী প্রশান্তি ছড়িয়ে মন কে মাতাল করে তুলছে। চড়াই উৎরাই , পাহাড়ের ইইউ টার্ন । ভয়াবহ অথচ অপরুপা সৌন্দর্যের রাণীকে মনপ্রাণ ভরে দেখতে দেখতে চলে এলো গ্যাংটক।
গাড়ি থামলো সেই রিসর্টের সামনে। সুন্দর নিখুঁত একটি ডাকবাংলো। দুধসাদা রঙের বাড়ি। চারপাশ নানান রঙের ফুল দিয়ে সাজানো বাগান। সবুজ লন। বিরাট ছাতার নিচে পালিশকরা কাঠের চেয়ার টেবিল সাজানো। কারুকাজ করা বিশাল রেলিং গেট। ড্রাইভার গাড়ির হর্ন বাজাতেই ছুটে এলো একজন। দরজা খুলে গেল। বাংলোর মাথায় বিরাট গ্লোসাইনবোর্ড। তাতে নীল রঙের মোটা অক্ষরে লেখা ` নীলচে সুখ `।
ওদের একটা ফোর বেডের রুম। বেশ বড়ো এবং সাজানো। ওরা ব্যাগ খুলে সঙ্গে আনা জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল।
তন্ময় বললো,, নীলচে সুখ। হায় হায়। এ সুখ টিঁকলে হয় !
দীপেন বললো ,,, যা বলেছিস। লম্বা একখানা বিল ধরিয়ে দিলেই চিত্তির। বাজেট, জেড প্লেন হয়ে উড়ে যাবে। নীলচে সুখ,, হুঁ,,,, হ্যাঁ রে নীল,, সুখের কী কোনও রঙ হয়। নীলচে , লালচে?
নীল বললো হয় বৈকি। সুখ কী একরকম ? নানান সুখের নানান রঙ। কারোর পেয়ে সুখ , কারোর পাইয়ে দিয়ে সুখ।
তন্ময় বললো,,,,, ও, তাই বুঝি । তাহলে হারিয়ে সুখ ? তার কী রঙ ভাই , কালচে ?
সবাই হৈ হৈ করে হেসে উঠলো। নীল হাসতে হাসতে বললো,,, না রে ভাই , কালচের ওপর দুঃখের একচেটিয়া অধিকার। সেখানে সুখের প্রবেশ নিষেধ।
আজ বিশ্রাম। কাল সকালে লাচুন লাচেন যাওয়া। সিকিমের সবচেয়ে সুন্দর জায়গার মধ্যে এই দুটি নাম সবার আগে। সকাল সাতটার মধ্যে রেডি হয়ে বেরুতে হবে। তাছাড়া শরীর বেশ ক্লান্ত। রাতের খাবার খেয়ে ওরা তারাতাড়ি শুয়ে পরার তোরজোর করছে। এমন সময় দরজায় টোকা।
তন্ময় দরজা খুলে দিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে প্রফেসর প্রকাশ রায়। ওরা ঠিক পাশের রুমেই আছেন।
আসতে পারি? মানে , একটু কথা ছিল,,।
তন্ময় বললো,,, নিশ্চয় , আসুন স্যার।
প্রফেসর রায় কোনও অকারণ ভনিতা না ক’রে বললেন,,,,, তোমাদের কালকের পোগ্রাম কিছু ঠিক করেছ?
তন্ময় বললো ,,, হ্যাঁ স্যার , আমরা কালকে লাচেন লাচুন যাবো ঠিক করেছি।
স্যারের মুখ যেন খুশিতে ঝকমক করে উঠলো, বললেন,,, ওয়ান্ডারফুল । কিন্তু তার জন্য তো গাড়ি দরকার। আগেই বুকিং করতে হয়। তক্ষুনি পাওয়া খুবই মুশকিল। দুরাত তিনদিনের ব্যাপার। ওরা চুক্তিতে যায়। তোমরা তেমন কিছু ব্যবস্থা করেছ কী? শুধু তাই নয় , ওগুলো তো একেবারে পাহাড়ের কোলে ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম। তাই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এরা, এই সমস্ত কিছুর দায়িত্ব নেয় । তাই বলছিলাম,, সেইসব ব্যবস্থা করেছ কী ?
কথা গুলো শুনে ওদের এক্সপ্রেশন একেবারে হাঁদারাম মার্কা হয়ে গেল।
দীপেন হতাশ গলায় বললো ,,, সর্বনাশ। আমরা তো এসব কিছুই জানিনা। কোনও ব্যবস্থাই করিনি। আমরা তো ভেবেছিলাম , একটা গাড়ি ধরবো , চলে যাবো। কিন্তু আপনি যা শোনালেন স্যার , এরপরে তো,,, কিরে কী করবি?
তন্ময় বললো , কী আর করা যায়। পোগ্রাম ক্যানশেল।
সবাই হতাশ হয়ে বিছানায় ধপধপ করে বসে পরলো।
প্রফেসর রায় , ওদের সকলের মুখ গুলো দেখে নিয়ে বললেন ,,,, এতো আপসেট হবার কিছু নেই। উপায় আছে। যদি তোমরা রাজি থাকো।
নীল , ঘরের বন্ধ জানালাটা খুলে দিতে দিতে বললো ,,,, আপনারা কাল ঐ দিকেই যাচ্ছেন তো?
এইবারে প্রফেসর চেয়ারে বসলেন। এতক্ষণ দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন। বললেন,,, আমি ব্যাপারটা কোলকাতা থেকেই সেরে এসেছি। ওখানে এজেন্ট আছে কিনা । আমার খুবই পরিচিত। আমি তিন জনের জন্য বুকিং করেছি। এখন তোমরা যদি বলো, তাহলে এখনই ওকে ফোন করে , চারটে সিট বাড়িয়ে নিতে পারি।
তন্ময়, অবিশ্বাসের সুরে বললো,,, এখন কী আর হবে ?
প্রফেসর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন,,, আরে বাবা সে দায়িত্ব আমার। আগে তোমরা বলো রাজি কিনা ?
নীল , খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ রেখে বললো ,,,, রাজি , আপনি ব্যবস্থা করুন স্যার। ওখানে যাবো বলেই এখানে আসা। কোনও কিন্তু নেই। আপনি ব্যবস্থা করুন স্যার , প্লিজ।
প্রফেসর বিনয়ের সাথে বললেন,,, না না , ওভাবে বলোনা প্লিজ। তোমাদের ভালো লেগেছে বলেই না,, তাছাড়া মাঝরাস্তা থেকে একসঙ্গে এলাম , একই জায়গায় আছি , একসাথে সবাই বেড়াতে যাবো , এতো মহা আনন্দের কথা , তাইনা ? প্রফেসর চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন , ওকে , তাহলে এই কথাই রইলো। কাল ভোর পাঁচটায় ডেকে দেবো। ঠিক সাতটায় গাড়ি আসবে। গুডনাইট অল অব ইউ।
তন্ময়, দরজা বন্ধ করতে করতে বললো ,,,,
থ্যাংকস স্যার । গুডনাইট।
দীপেন ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে বললো ,
এখন আর কোনও কথা নয়। প্রবলেম সলভড। কাল ভোর পাঁচটায় ওঠা। গুডনাইট।
ব্রজেশ এতক্ষণ শ্রোতার ভুমিকায় ছিল। এখন শোবার সময় গায়ে কম্বল টেনে নিতে নিতে হালকা স্বরে উচ্চারণ করলো ,,,,, নীলচে সুখ ।
এই ছোট্ট একটি কথায় কেউ মুচকি হাসলো কিনা , অন্ধকার ঘরে তা টের পাওয়া গেল না।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।