গল্পেরা জোনাকি -তে সুজিত চট্টোপাধ্যায়

স্বাধিকার

ঠাকুমা বললো , থামতো, যতসব ব্যাজর ব্যাজর কথাবার্তা। ছেলে দেখতে তোর বাবা সেই নিউ বঙ্গাইগাঁও থেকে আসবে এই বনগাঁর গাঁয়ে ? ছেলেখেলা পেয়েছিস! মেয়ে দেখা হলে নাহয় কথা ছিল। ছেলে আবার দেখার কী আছে?
রোজগেরে জোয়ান সুস্থ হলেই হলো।
নাতনি ঠোঁট ফুলিয়ে বললো ,,, বারে বা। ট্যাঁরা, কালো মোটকা ধুমসো কিনা দেখতে হবে না। বেঁটে, মাথা ভর্তি টাক,,, না না,, ইয়ার্কি নাকি। ওইরকম বর নিয়ে আমি মরি আরকি।
ঠাকুমা, নাতনির গালে ঠোনা মেরে বললো,,,
ওরে আমার সুচিত্রা সেন রে,,। তোমার উত্তমকুমার বর চাই। যাও দ্যাখো কোথায় পাও তোমার মনের মতো ময়ূরবাহন।
তোর তো নাক চ্যাপ্টা। খুঁজলে অমন খুঁত আরও পাওয়া যাবে। সাজুগুজু সুন্দরী।
নাতনি, বোঁচা নাক ফুলিয়ে , গজগজ করতে করতে চলে গেল পাশের ঘরে।
নাতনির মা , মানে, ঠাকুমার বৌমা। পাশের ঘর থেকে সবই শুনেছে।মনে মনে ফুঁসেছে। মেয়ে কী আমার ফেলনা?
সুচিত্রা সেন , সাজুগুজু সুন্দরী, এসব কথা মোটেই বলা উচিৎ হয়নি। নেহাৎ বয়স্ক গুরুজন তাই মুখের ওপর কিছু বলা সাজে না, নইলে,,, এখন মেয়ে কে কাঁদতে দেখে, রাগ সপ্তমে চড়ে গেল। তবুও গলার আওয়াজ যতটা সম্ভব নামিয়ে বললো,,,
ন্যাকামি করতে গিয়ে ছিলি কেন , এবার বোঝ। হলো তো? দিলো তো নাক চ্যাপ্টা করে , ঠিক হয়েছে। তরসইছেনা না? হ্যাংলা কোথাকার।
তারপরেই মেয়ের হাত ধরে টেনে কাছে এনে, চোখের সামনে ফোন তুলে ধরে বললো,,,,, দ্যাখ, তোর বাবা হোয়াটসঅ্যাপে কী লিখেছে দ্যাখ। কালকের ফ্লাইটেই আসছে। সকালেই।
শ্রাবণের জমাট মেঘ সরিয়ে , ঝলমলিয়ে রোদ উঠলো।
সত্যিই,,, আই লাভ ইউ ড্যাড,,।তাহলে কালকেই যাবো,,,,?
নম্রতা কে থামিয়ে দিয়ে নমিতা বললো,,,,
না,, পরশু।
ঠিক আছে , তাই,, পরশু। পরশু আমরা,,,, নম্রতার কথা শেষ হলো না। নমিতা ফোনের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে এমন ভাবে তাকালো , নম্রতা ঢোঁক গিললো।
আমি আর তোর বাবা।
নমিতা, ফোন পাশে সরিয়ে রেখে, কপাল কুঁচকে বললো,,,,
তোর এখনই যাবার কী দরকার। কিছু ঠিক হয়েছে কী , তাহলে? ওরাই বা কী ভাববে। নির্লজ্জের মতো, ছিঃ।
নম্রতা , স্থির দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে। ঠাকুমা আর মায়ের ভাবনার মধ্যে তফাৎ কী!
শব্দ প্রয়োগের তফাৎ। ভঙ্গিমার তফাৎ। ভাবনায় এক। কোনও পার্থক্য নেই।
আবার মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো ঝলমলে রোদ।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ড্রইংরুমের সোফার দুমাথায় দুজন। মা আর মেয়ে। দুজনের হাতে দুটি এন্ড্রয়েড ফোন। যে যার পছন্দে মশগুল।
ঠাকুমার ঘরে টিভিতে একঘেয়ে চুইংগাম সিরিয়াল চলছে গমগম করে।
কালার মরণ। কেন রে বাপু একটু আস্তে বাজাতে কী হয়! শুনছে নাকি শোনাচ্ছে! আশ্চর্য সব লোকজন। বলিহারি যাই। সখ বটে এই বয়সে।
ভীমরতি। দুর দুর,,,,
এগুলো নমিতার মনের কথা। চোখ ফোনে , কান টিভিতে , মনে শাশুড়ী ।
এদিকে, নম্রতা কাউকে বন্ধু ভাবতে পারছেনা। ফোনেই নিষ্কৃতি। মনের আরাম।
আমার যে বর হবে , সে হবে আমার বন্ধু। হবে তো! যদি না হয়? সেই কারণেই তো একবার দেখতে চেয়েছি।
জানি , একবার চোখের দেখায় কিচ্ছু বোঝা যায় না। সারাজীবন দেখেও কী বোঝা যায়? সবাই কী সব কথা রাখে , নাকি রাখা সম্ভব ?
ঠাকুমা কী জানতো , তাকে রেখে দিয়ে দাদু চলে যাবেন পরপারে?
এমনই কী কথা ছিল , জীবনের অনেকটা সময় একা-একাই কাটাতে হবে তাকে?
কত অঙ্কই তো মেলে না জীবনের। তবুও স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়।
মন ভাঙে, ঘর ভাঙে, স্বপ্ন ভাঙে, তবুও স্বপ্ন , স্বপ্নই থেকে যায়। সুন্দর । ভোরের আকাশের মতো আলোকোজ্জ্বল। পবিত্র।
সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। খাওয়া দাওয়ার পাঠ শেষ। ঠাকুমা নিস্তব্ধ ঘরে ঘুমে অচেতন। হালকা নীলচে রাত বাতির আলোয় , নরম বিছানায় মা আর মেয়ে পাশাপাশি শুয়ে।
কাল সকালে বাবা আসবে। দুমাস, তিন মাস অন্তর বাবার আসা। কাজের প্রয়োজনে অতদূরে নিতান্ত বাধ্য হয়েই থাকা। তবে, রিটায়ারমেন্টের সময় ঘনিয়ে আসছে। হয়তো এটাই শেষ বছর।
নম্রতা প্রায় ফিসফিস করে বললো,,,,,,
মা,, বিয়ের আগে তুমি বাবাকে দেখতে গিয়েছিলে?
নমিতা , ঘুরন্ত পাখার দিকে তাকিয়ে বললো,,,
সেই সুযোগই ছিল না। আমাদের কুলগুরুর পছন্দের পাত্র। তেনার আদেশ। ঠিকুজিকোষ্ঠী তে নাকি রাজযোটক। এককথায় পাকা হয়ে গেল সবকিছু। বর্তমান ভবিষ্যৎ সব। ভালো মন্দ, ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনও মূল্য নেই।
চলমান পাখার শব্দের মাঝে নমিতার চাপা দীর্ঘশ্বাস মিশে গেল। কেউ তার হদিশ পেল না।
নম্রতা , প্রায় মায়ের বুকের ওপর উঠে পড়ে , দুচোখে চোখ রেখে , অদ্ভুত উৎকন্ঠা আর ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করলো,,,,,
মা,, তুমি কী সুখী হয়েছো,,,, মা,,
নমিতার বুকে যেন একটা ভারি পাথরের আস্তরণ। এখন আর ভার বোধ হয়না। সম্ভবত অভ্যেস হয়ে গেছে।
বনগাঁ আর নিউ বঙ্গগাঁই এর দূরত্ব শুধু পথের নয়, মনেরও ।
তাই এই প্রশ্নের উত্তর সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে বললো,, তুই ভালো থাকিস , সুখী হোস।
আধো আঁধারেও নম্রতা , মায়ের চোখের কোণের চিকচিক করা জলের অস্তিত্ব টের পেলো। কিন্তু তবুও হাত বুলিয়ে মুছে দিলো না। কেজানে , মনের অতলে লুকিয়ে রাখা একান্ত বেদনার এমন উন্মুক্ত প্রকাশ , হয়তো তাকে কুন্ঠিত অথবা লজ্জিত করবে। তাই , খুব ধীরে ধীরে উঠে বসলো নম্রতা। তারপর গম্ভীর , দৃঢ় স্বরে উচ্চারণ করলো,,,
মা,, আমার একটা দাবী আছে,,।
নমিতা খানিকটা অবাক হয়েই উঠে মেয়ের একেবারে মুখোমুখি বসে, বললো,,
দাবী,,,,, মানে,,, কিসের দাবী,,?
নম্রতা , অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে কেটে কেটে বললো,,,, বিয়ে আমার হোক বা নাহোক , আমি কিন্তু কিছুতেই আমার চাকরি ছাড়বো না। আমি কোনকিছুর বিনিময়ে আমার শক্তি , আমার ভরসা কিংবা আমার বেক্তি স্বাধীনতা খোয়াতে পারবো না।
নমিতা , কয়েক মুহূর্ত চুপ করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপরেই সজোরে মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে ধরে , আকুল ভাবে কেঁদে উঠলো।
মাটির কাঁচা বাঁধ ভেঙে যেমন বানভাসি নদী ভাসিয়ে নিয়ে যায় সাজানো সংসারের যাবতীয় সবকিছু। তেমন করেই উথলে উঠলো নমিতার মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা সমস্ত অভিমান আর পাওয়া না-পাওয়ার অনুযোগ গুলো।
সেই বিগলিত অশ্রুধারায় মিশ্রিত হলো একটি অতি নির্মম সত্য বাণী,,,,
ঠিক বলেছিস মা আমার। একেবারে সত্যি এটাই , স্বাধিকারই জীবনের প্রকৃত সুখ। মেয়েদের জীবনে মাথা উঁচু করে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার একমাত্র মন্ত্র,, পরনির্ভরতা নয় স্বনির্ভর, আত্মনির্ভর।
স্বাধিকার , স্বাধিকার,,,
ঠিক তখনই , শ্রাবণের আকাশ ভেঙে এলো প্রবল বর্ষন । খোলা জানালা দিয়ে পূবালী বাতাস বয়ে নিয়ে এলো রাশি রাশি শ্রাবণ বৃষ্টি কণা।
নম্রতা বললো ,,,,, মা, জানালাটা বন্ধ করে দিই?
নমিতা , বিছানা থেকে নেমে , জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রাত শ্রাবণের জলধারা মাখতে লাগলো সারা শরীরে মনে। একেবারে অবাধ্য বেপরোয়া ছেলেমানুষের মতো।
নম্রতা অবাক হয়ে দেখতে থাকলো , আচমকা যৌবন ফিরে পাওয়া শ্রাবণ স্নাত প্রৌঢ়া মা’কে।
শাওণ রাতে যদি , স্বরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে , নয়নে বারি ঝরে ।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।