জন্ম কলকাতায়(২৭ নভেম্বর ১৯৮০)।কিন্তু তার কলকাতায় বসবাস প্রায় নেই।কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।সেখান থেকেই হয়তো ইন্ধন পেয়ে বেড়ে ওঠে তার লেখালিখির জগত।প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আকাশপালক "(পাঠক)।এর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শিকারতত্ত্ব(আদম), আড়বাঁশির ডাক(দাঁড়াবার জায়গা), জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার(পাঠক), কানাই নাটশালা(পাঠক),বহিরাগত(আকাশ) ।কবিতাথেরাপি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।এই বিষয়ে তার নিজস্ব প্রবন্ধসংকলন "ষষ্ঠাংশবৃত্তি"(আদম)।কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও গল্প লিখতে ভালোবাসেন।প্রথম উপন্যাস "কাকতাড়ুয়া"।আশুদা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশিত "নৈর্ব্যক্তিক"(অভিযান)।'মরণকূপ' গোয়েন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় অভিযান,যদিও তার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে সে একেবারেই স্বতন্ত্র।এই সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস 'সাহেববাঁধ রহস্য '(চিন্তা)।সম্পাদিত পত্রিকা "শামিয়ানা "। নেশা মনোরোগ গবেষণা,সঙ্গীত,অঙ্কন ও ভ্রমণ ।
বিন্দু ডট কম
-আপনি তাহলে সত্যিই চাকরিটা আর করবেন না?
প্রশ্নকর্তা প্রভাবতী মেমোরিয়াল গভরমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়ের টিচার ইন চার্জ অলোক রাহা।এই লোকটার সঙ্গে শুভব্রতর সমীকরণ কোনও দিনই ভালো ছিল না।লোকটা আদ্যোপান্ত মেকি।জিজ্ঞেস করলেই বলে সে বামপন্থী।এদিকে পার্টি ফান্ড থেকে টাকা চুরি করে রাণাঘাটেই তিনতলা বাড়ি বানিয়েছেন হালে।ওই লোকটার ওয়েভলেন্থ শুভব্রতর সঙ্গে মেলে না।অলোক রাহা একসময় কবিতা লিখত!’লহিবে’ ‘মরমে’ ‘আপনারে’ গোছের কবিতা।তখন শুভব্রতর পত্রিকা ‘দোয়াব’ মনজ্ঞ পত্রিকা হিসেবে আশপাশে বেশ একটা নাম করে ফেলেছে।একদিন একগুচ্ছ অপাঠ্য কবিতা সে গুঁজে দিয়েছিল শুভব্রতর হাতে।একবার পড়েই শুভব্রত সেগুলো ফেলে দিয়েছিল।কবিতা প্রকাশিত না হবার বেদনা ঢাকতে লোকটা বানিজ্যিক পত্রিকার অফিসে যাতায়াত শুরু করলো।কদাচিত কোনও চার লাইনের কবিতাও সেখানে প্রকাশিত হলে স্টাফরুমে তাকে শুনিয়ে পাঠ করতো।সেসব বিগত দিন।কিন্তু এই মানুষটির কাছেই নতজানু হয়ে হাত পাততে হবে শুভব্রতকে।হেড মাস্টার সুপ্রিয় সামন্ত এখন সিক লিভে।স্কুলে ঢুকতে গিয়েই এই খবরটা সে পেয়েছে সৌম্যর কাছে।সৌম্য দাশ।প্রভাবতী হাই স্কুলের গেটকিপার।একদিন ওর মায়ের পক্ষাঘাতের চিকিৎসার টাকা তুলে দিয়েছিল সেইই।সেই কৃতজ্ঞতা এখনও তার চোখে লেগে আছে।সেই বলল সুপ্রিয়বাবুর ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়েছে।শহরের হাসপাতালে ভর্তি।ভেনটিলেটরে দেওয়া হয়েছে।অবস্থা ভালো না।অলোক রাহার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়েই বলল শুভব্রত।
-ক্লাস তো করছি না কিছু অলোকদা।একটা পোস্ট আটকে রেখেছি শুধু…
শুভব্রতর কথা শুনে অলোক রাহা হাসতে থাকে।
-কে আর কাজ করছি শুভব্রত?ছেলেমেয়েরা মাঝেমাঝে আসে।ওদের চাল আলু দিই।এই কাজ করতে তো আর ইতিহাসে মাস্টার্স করার দরকার হয় না।কী বলো?
শুভব্রত ঘাড় নাড়ে।তার হঠাৎ অক্ষয় মালবেরির কথা মনে পড়ে যায়।সেই প্রবল উৎসাহে সকলে মিলে বুনো আলু মাটি খুঁড়ে বের করা।আজ যেন সেও তেমনই এক বুনো আলু বের করতে এসেছে।
-তা তোমার বৌয়ের খবর কি শুভব্রত?কোথায় যেন পোস্টিং?বেলদা না কোথায়?
শুভব্রত এবারেও কিছু বলে না।
-তোমার লেখালিখি পত্রিকা,কী খবর সেসবের?
-আমি তো তেমন লিখি না অলোকদা।তবে পত্রিকা বের হবে শীঘ্রই।
-বলো কি!এতো বড় খবর।আর কোথাও কোনও বিজ্ঞাপন দেখলাম না যে।
বুনো আলুর খন্ড এতোটাই মাটিতে গেঁথে আছে,তাকে বের করা যাচ্ছে না কিছুতেই।অলোক রাহার শেষ কথায় একটা ঠেঁস আছে।কিন্তু তার সদুত্তর শুভব্রত এখন দেবে না।সে যে কাজে এসেছে সেই কাজ তাকে সফলভাবে করতে হবে।
-আমার তো এই বছরও পূজাবার্ষিকীতে পনেরোটা লেখা বের হলো নানান জায়গায়।
-ভালোই তো অলোকদা।
-তা এই বাজারে প্রেস তো বন্ধ। ছাপাবে কী করে?
-ছাপাবো না।অনলাইন বের হবে।
শুভব্রতর উত্তরে বিস্ময়ভরে তাকিয়ে থাকে অলোক রাহা।তার দুচোখে একধরনের প্রশান্তি দেখা যায়।শুভব্রত তার মেরুদণ্ড কতোটা বাঁচাতে পেরেছে,আপাতত সেটুকুই অনুসন্ধান করা যেন তার লক্ষ্য।
-তোমার পত্রিকা অনলাইনে?ভাবা যায় না।অনলাইন কেউ পড়ে?
শুভব্রত সরাসরি আবার কাজের কথায় চলে আসে।
-ইস্তফাপত্র দিয়েছি অলোকদা।এইবার বকেয়া টাকাগুলো পেলে কিছুটা সুবিধা হতো।
মুহূর্তে বদলে যায় অলোক রাহার চোখের ভঙ্গি।
-ফাইল দেখতে হবে শুভব্রত।ঘটনাটা অতো সহজ নয়।অনেক আনঅথরাইজড লিভ নিয়েছ তুমি।সেসব প্রসেস করতে হবে।সুপ্রিয়বাবু ফিরুন।
-আপনি পারবেন না অলোকদা?
-দেখছি চেষ্টা করে।মানুষের জন্য কাজ করতেই তো আশা।কিন্তু আমারও তো সীমাবদ্ধতা থাকে।তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
-বলুন।
-এই বাজারে চাকরি ছেড়ে দিলে।কেন?কী করবে এর পর?তুমি চাইলে আবার জয়েন করতে পারো।আমি বাকিটা সামলে নেব।
-না অলোকদা।আমি আর চাকরি করবো না।
-কী করবে?
-জানি না।হয়তো পত্রিকাটাই করবো।
-আর তার জন্য টাকাটা?
-জানি না।আসবে কোনও ভাবে।
-বেশ।পড়শু একবার এসো।আমি তোমার ফাইল দেখে রাখবো।তা কীভাবে পড়বো তোমার পত্রিকা।
-কম্পিউটারে টাইপ করতে হবে।বিন্দু ডট কম।
চাঁদের ওপিঠের মতোই অলোক রাহার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো শুভব্রত।আবার আসতে হবে তাকে দুদিন পরে।অথচ এ সপ্তাহের শেষেই রোহিতের ‘বিন্দু ডট কম’ প্রকাশ করার কথা।সেটা হলে শুভব্রতকে ফোন বা ল্যাপটপ আগেই হাতে পেতে হবে।আর তার জন্য দরকার অনেকগুলো টাকা।এতোদিনের জমানো বকেয়া আজ মিটে গেলে সমস্যা হতো না।
খেলার মাঠ আড়াআড়ি পার করে সদর গেটের দিকে যেতে যেতে সে শুনতে পেল পেছন থেকে কেউ যেন তাকে ডাকছে।শুভব্রত ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো তার পিছনে উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করছে ভূগোলের দিদিমণি স্রোতস্বীনি সান্যাল।তার চোখে মুখে আর্তি।যেদিন শুভব্রত শেষ এই স্কুলে এসেছিল,সেইদিন এই ম্যাডামের বিবাহবার্ষিকী ছিল।স্রোতস্বীনির স্বামী পুলিশে কাজ করে।একথাও শুভব্রত জানতে পেরেছে দ্বাররক্ষকের কাছ থেকেই।আপাতত সে বেলডাঙায় পোস্টেট।শুভব্রতর সঙ্গে তেমন কথা ছিল না কখনও। আজ সেইই যেন পিছুটানের মতো এসে উপস্থিত।
-শুনুন না।
-বলুন।
-আপনি তো মৃন্ময়কে চেনেন।কেমন আছে ও?কোথায় থাকে এখন?
শুভব্রত সচকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ে।মেয়েটি মৃন্ময়কে চিনলো কীভাবে?স্রোতস্বীনি বলে চলে।
-বলুন না।ও কেমন আছে?
-আছে একরকম।মনে হয় যক্ষ্মা হয়েছে বুকে।
-হা ঈশ্বর।
শুভব্রত দেখে মেয়েটির দুগাল বেয়ে জল নেবে আসছে।
-আপনি মৃন্ময়কে চেনেন।
-হ্যাঁ। চিনতাম।আপনারা তো পত্রিকা করেন।ওর কর্ণ পত্রিকা। আমার কাছে আছে।ও চিরকালের অবুঝ।কোথায় থাকে এখন।
-কাঁকিনাড়ার একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে।
-ওকে বলবেন যেন ওষুধ খায়।স্রোতস্বীনি বলেছে।বলবেন তো?
-বলবো।আর?
-আর কিছু না।
বলে স্রোতস্বীনি যেমন হঠাৎ এসেছিল,তেমনই হঠাৎ মিলিয়ে গেল দিনের আলোয়।শুভব্রত ভাবছিল।মৃন্ময় তো কখনও তাকে বলেনি। বিচিত্র মানুষের মনোবিতান।অক্ষয়।মালবেরির মতোই।