গ এ গদ্যে সুব্রত ভট্টাচার্য্য

প্রেমে সততা

আজ সকালেই খবর পাওয়া গেল যে রেখার  দিদার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তাই, রেখার বাবা, মা ও ভাই আজকেই রেখার দিদাকে দেখতে চলে গেল; সব ঠিকঠাক থাকলে, আগামীকাল ফিরে আসবে। রেখার সামনে পরীক্ষা,তাই সে যেতে পারলো না। আজ আর রেখা কলেজেও যায় নি। তাই, দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে পড়াশোনা করছিল। পড়তে বসেছিল ঠিকই, কিন্তু মনটা বড়ো বিচলিত ছিল যার জন্য পড়াতে একাগ্রতা ছিল না। মনটা বিচলিত ছিল এই জন্য নয় কি ওর দিদার শরীর খারাপ, বরং এই জন্য যে এখন যদি বিমলের সঙ্গ পেতো গল্প করার জন্য। তাই, মোবাইলটা নিয়ে বিমলের সাথে কথা বলা শুরু করে দিল। বিমল আর রেখা একই কলেজে পড়াশোনা করে। বিমল পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের ছাত্র এবং রেখা গ্র্যাজুয়েটের ছাত্রী। বিমল গরীব পরিবারের ছেলে। মেধাবী ছাত্র। স্কলারশিপ পেয়ে পড়াশোনা করেছে এবং এখন পড়াশোনার সাথে সাথে দুএকটা টিউশনিও করে। রেখাকেও বিমল প্রয়োজন বোধে মাঝে মাঝে টিউশন পড়ায়। ওদের দুজনের মেলামেশার পরিপক্বতা এতোটাই উর্ধ্বে উঠেছে যে এখন তারা একে অপরকে প্রেমের বন্ধনে বাঁধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে কিন্তু মনের কথা উভয়েরই মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রেখা বিমলকে মোবাইলে বলল, “তুমি আজ রাতে চলে এসো আমাদের বাড়িতে,আমি একা আছি। মা, বাবা ও ভাই  মামার বাড়িতে গিয়েছে, দিদাকে দেখতে। আগামী কাল আসবে। আমরা দুজনে মিলে খুব গল্প করবো। খাওয়া দাওয়া করবো। খুব ভালো লাগবে। কি আসবে তো?”,  রেখা সীমাহীন আনন্দের সাথে ফোনে বিমলকে এই কথাগুলো বলল। বিমলও খুবই আনন্দিত হলো। বিমল ভাবলো, “আমার আর রেখার মাঝখানে কেউ থাকবে না, আমরা দুজনে জ্যোৎস্নার আলোয়  ছাদে বসে চাঁদকে সাক্ষী রেখে  মনের মধ্যে জমে থাকা কথাগুলো একে অপরের সাথে সেয়ার করবো। ঐ রাতটা হবে শুধু রেখার  আর আমার বিনোদনের রাত”। এই ভেবে, বিমল রেখাকে বলল,  “ঠিক আছে, আমি তাহলে আসছি; তবে, আমার সন্ধ্যা সাতটা সারে সাতটা হবে আসতে”।  রেখা বলল, “নো প্রবলেম “।
রাত ন’টা বেজে গেল, রেখা ওদিকে রান্নাটান্না সেরে বিমলের আসার অপেক্ষায় রইল।  এদিকে বিমলের মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের ঢেউ খেলছে – ‘যাওয়াটা আদৌ উচিৎ কিনা’ – এই ভাবনাকে কেন্দ্র ক’রে। নানারকম অশনিসংকেত চিন্তা বিমলকে ঘিরে ফেলেছে। বিমল ভাবল, মনের দুর্বলতা যদি কোনো দুর্বিপাকে ফেলে দেয়; যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়; আমরা তো সাধারণ মানুষ, পার্থিব সুখের প্রতি এতোটাই নতজানু যে মনকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না – এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত প্রায় এগারোটা। নিশ্চয় রেখা অস্থিরচিত্তে সময় কাটাচ্ছে। যেই না ভাবা ওমনি মোবাইলের রিংটা ক্রিং ক্রিং ক’রে বেজে উঠল, রেখার ফোন। ফোনটা ক্রমাগত বাজতেই থাকল; একবার…, দুবার…, তৃতীয় বারে বিমল ফোনটা  রিসিভ করল। “কি গো ফোন কেন উঠাচ্ছো না?”, রেখার আওয়াজ ওপার থেকে ভেসে এলো।বিমল দ্বন্দ্বের ঢেউয়ে খাবি খেতে খেতে মিথ্যার সাহারা নিয়ে, বলল, “একটু সমস্যার মধ্যে পড়েছি। আসলে সুনীলের মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, যার জন্য, আমি আর সুনীল মাসিমাকে নিয়ে এখন হাসপাতালে এসেছি।  তার জন্য দেরি হচ্ছে। আমি আসছি, তুমি চিন্তায় থেকো না”। রেখার কাছে যাওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল হয়ে উঠলেও, বিমলকে এরকমই একটা অজুহাতের সাহায্য নিতে হলো, না যাওয়ার জন্য।
ধৈর্য্যের সীমা হারিয়ে আবার রেখার ফোন। রাত প্রায় দুটোর কাছাকাছি। অস্থির ও চিন্তিত গলায় রেখা বলল, “এখনও কি তুমি হাসপাতালে; সুনীলদার মা এখন কেমন আছেন”? বিমল নাটকীয়ভাবে ব্যাকুলতার সাথে গম্ভীর আওয়াজে বলল, “একটু… ঠি-ক লাগছে”। রেখার অস্থিরচিত্তে ঔষধ পরলেও ঘুমের নিমন্ত্রণে চোখ দুটো কুয়াশাচ্ছন্ন এবং   কখন বন্ধ হয়ে এসেছে  রেখা টেরও পায়নি।  ভোর সারে চারটে বেজে গিয়েছে। এবারতো যেতেই পারে বিমল।  পৌছাতে পৌছাতে সকাল হয়েই যাবে; তাহলে তো আর কোনো  দুর্বলচিত্তের প্রলোভন থাকবে না এবং দুর্বিপাকেও পরতে হবে না। এই ভেবে, বিমল সকাল পাঁচটাই রেখার কাছে পৌঁছালো। “পরিকল্পিত খুশিতে গ্রহণ লেগেছিল সেইজন্য রাতের অন্ধকার জোৎস্নায় পুলকিত আলোকে গ্রাস করেছে”।  বিমলের ঠিক এমনই মনে হলো রেখার চেহারাটা দেখে। যাইহোক, বিমল মৃদুস্বরে সুপ্রভাত জানালো রেখাকে। কোনো Reciprocation পাওয়া গেল না। তা না পাওয়া গেলেও, বিমল এখন মনের মধ্যে আলোড়িত দ্বন্দ্বকে একটু উপশম করতে পেরেছে এবং চেহারার মধ্যে একটা সাবলীল  ভাব আনতে পেরেছে। যাইহোক, বিমলকে দেখামাত্র রেখার চিন্তান্বিত চেহারা রাগান্বিত হয়ে উঠল।  বিমল অনুমান করলো, হয়তো রেখা বুঝতে পেরেছে যে আমি ইচ্ছে করেই গতরাত্রে আসিনি। তাই, বিমল আর দেরি না করে  যখন বললো, “রাতে এলে হয়তো  দুর্বলচিত্তের কাছে নতজানু হয়ে কোনো দুর্বিপাককে আমন্ত্রণ দেওয়া হতো এবং কোনো একটা অঘটনকে প্রশ্রয় দিয়ে পরবর্তী জীবন হয়তো সমস্যা জড়িত হয়ে যেতো”, তখন রেখার বিমলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ভাবনা  ও ভালোবাসার ঘনত্ব গতরাতের কল্পিত খুশির পরিমাণ থেকে দিগুন হয়ে উঠল। বিমলের এই প্রেমের সততাকে রেখা তার মনের  ডায়েরিত চিরদিনের জন্য লিখে রাখার জন্য কোনো রকম দ্বিধাবোধ না করে বিমলের চরণস্পর্শ করল এবং নিজেকে বিমলের কাছে সমর্পণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করল। বিমল এবার রেখার চেহারাতে খুশির আলোড়ন উপলব্ধি করলো এবং খুশীভরা মনে রেখার হাতদুটো ধরে কাছে টেনে নিয়ে রেখাকে জিজ্ঞেস করল যে সে গতরাতে না এসে ঠিক করেছে কি’না। রেখা প্রত্যুত্তরে কিছু না ব’লে সোজা রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো এবং কিছুক্ষণ পরে এক কাপ চা নিয়ে এসে বিমলের হাতে তুলে দিল তারপর, দুজনে বারান্দায় বসে সকালের এক পেয়ালা চায়ের সাথে গল্পে  ও পড়াশোনায় মগ্ন হলো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।