“কি চায় ও” ধারাবাহিক বড়ো গল্পে সায়নী বসু (পর্ব – ৭)

সদ্য ফিজিওলজি তে মাস্টার্স করে উঠেছে সায়নী বসু। ছোটবেলা থেকে নাচ গান আর সব রকম গল্প উপন্যাস নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসে। তবে ভৌতিক সাহিত্যের ওপর ঝোঁক চিরকালই বেশি। কয়েক বছর নিজেও লেখালিখি শুরু করেছে। পাঠক পাঠিকাদের ভালোলাগাই তার প্রেরণার উৎস।
এমনিতেই আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। আর বেশি দেরি করলে আরো সাংঘাতিক কিছু ঘটে যেতে পারে। তোমাদের সন্তানের জীবন ও বিপন্ন। তাই তোমাদের আমার পাশে চাই। আমার প্রতি আস্থা রাখতে পারো। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করবো সব যাতে ঠিক হয় আর কারুর ক্ষতি যাতে না হয়।
হসপিটালের বাইরে ডেকে এনে রৌনক ও পিয়ালী কে কথাগুলো বলেন অসীম বাবু । পিয়ালীর প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল কোনো অতিপ্রাকৃত জিনিসের প্রভাবেই তার ছেলের এই দশা, এখন সে ধারণা আরো দৃঢ়। যা ঘটছে তা তার ছেলের পক্ষে ক্ষতিকারক এ সে অনেকদিন ধরেই বুঝতে পারছে, তবে তার হাতে করার কিছু ছিলোনা। এখন অসীম বাবু কে পেয়ে পিয়ালী হাতে বল পেলো। সে তৎক্ষনাৎ অসীম বাবুর কথায় সম্মতি জানালো। তবে রৌনক কে এখনও চুপ থাকতে দেখে অসীম বাবু আবার বলে উঠলেন,
– তোমার মনে এখনও কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো। আমি জানি আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ দের অলৌকিক কিছু তে বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়। তবে ভালো করে ভেবে দেখো তো সত্যিই কি এসব অলৌকিক? বিজ্ঞান ও কিন্তু সুপার ন্যাচরাল কে একেবারে দূরে ঠেলে দিতে পারেনি? তাই নয় কি? একটা খুব সুক্ষ্ম ব্যবধান আছে আমাদের এই লোক আর ওদের ওই লোক এর মাঝে। যতদিন না মনের সব ইচ্ছে পূরণ হয় ওরা বার বার ফিরে আসে আমাদের লোকে।
– কিন্তু আমরা তো কোনো ক্ষতি করিনি? আমাদের ছেলের ওপর এরকম কেন হচ্ছে?
মুখ খোলে রৌনক। মৃদু হেসে আবার বলেন অসীম বাবু,
– কি চায় ও তা বোঝা আমাদের পক্ষে খুবই শক্ত। তবে ওর প্রতিশোধ এর পালা যদি মিটে গিয়ে থাকে তাহলে হয়তো আমি যা ভাবছি তাই।
– কি?
সমস্বরে জিজ্ঞেস করে ওঠে পিয়ালী ও রৌনক।
– চলো আমার সাথে যেতে যেতে বলছি।
একটি গাড়ি করে ওরা তিনজন আবার রওনা হন অসীম বাবুর বলা ঠিকানার উদ্দেশ্যে।
সেইদিন পরেশের ওপর ওই মহিলার আক্রমণ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম তার মধ্যে যে আছে সে পরেশের ক্ষতি চায়। কিন্তু সেই ক্ষতি করার জন্য তার একটা দেহের দরকার। শান্তার থেকে সব শুনে বুঝেছিলাম এটা ওই বাচ্চাটার অতৃপ্ত আত্মার কাজ। তার মা এর সাথে জীবিত অবস্থায় তার গাঢ় বন্ধন ছিল আর তাই মৃত্যুর পর ও সেই বন্ধনের সাহায্যে সে ফিরে আসতে পারছে। আমি শান্তার সাথে তোমাদের ফ্ল্যাটে তখন যাই এবং অনেক ছলে কৌশলে বাচ্চাটার আত্মা ওই ফ্রিজে বন্দী করতে পেরেছিলাম আর ওই দম্পতি কে বাইরে বের করে এনেছিলাম। পরেশ কে বলেছিলাম ওনাদের সমস্ত আসবাবপত্র ও ওই ফ্রিজ টা সন্তর্পনে কোথাও রেখে দিতে আর কেউ যাতে ওগুলো ব্যবহার না করে। কিন্তু পরেশের লোভ আবার ওকে দিয়ে ভুল করালো। আপনার স্বামী কে আবারও ওই জিনিস গুলো বিক্রি করলো পয়সা পাবে বলে। ব্যাস আপনাদের জীবনে বিপদ ঘনিয়ে এলো। আত্মা টি আপনাদের ছেলের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে বন্ধন তৈরি করে তার শরীরে ঢুকে আছে। কার্যসিদ্ধি হয়ে গেলে ও আর বেশিক্ষন আমাদের লোকে থাকতে পারবেনা, তবে যাওয়ার সময় নিজের সঙ্গী করে নিয়ে যেতে পারে একই দেহে সহাবস্থান করা অন্য আত্মা টি কে।
– ম.. মানে আমার ঋক…
ভয়ে কঁকিয়ে ওঠে পিয়ালী।
– হ্যাঁ আপনাদের সন্তান কে। আর সেটা যাতে না হয় সেই চেষ্টা আমি করবো। আমি এখন ওই বাচ্চাটার বাবা মা এখন যেখানে থাকে সেখানে যাচ্ছি। শুনেছিলাম মহিলা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু আমার বিশ্বাস উনিই পারবেন আপনাদের ছেলে কে রক্ষা করতে।
গাড়িটা নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছতে দেখা গেলো একটি পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তারা। অসুস্থ স্ত্রী কে নিয়ে সবকিছু হারিয়ে কোথায় যাবেন ভেবে উঠতে পারেননি তোজো র বাবা, তখন অসীম বাবুই ওনাদের এই বাড়িতে নিয়ে আসেন, বাড়িওয়ালা অন্যত্র থাকেন তাই অসীম বাবু কে ভরসা করেই ওনাদের এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। কয়েকবার দরজা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন একটি মাঝবয়সী ভদ্রলোক, রৌনকের থেকে একটু বড় হবে অথচ দুশ্চিন্তার ভারে তাকে অনেক বেশি বয়স্ক দেখাচ্ছে। মুখে যেন একটা পরাজিত ছাপ, দরজা খুলে অসীম বাবুকে দেখে খুব নিস্পৃহ ভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
– আপনি? আবার কি মনে করে?
অসীম বাবু লোকটিকে সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বিবরণ দিতেই লোকটি কেমন যেন ক্ষেপে উঠলেন।
– তো? আমাদের আর কি করার আছে? আমরা তো নিজেদের সন্তান কে বাঁচাতে পারিনি। ও আমাদের সব ছিল। চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। আর আপনি এখনও বলে চলেছেন যে ও আসে প্রতিশোধ নিতে, ওর সাথে কাউকে নিয়ে যেতে? কেন বলুন তো? ছেলে টা তো আর নেই এবার ওকে একটু রেহাই দিন, শান্তি দিন ওকে একটু।
– ওকে শান্তি দিতে চাই বলেই আবার আপনার কাছে আসা। তোজোর মা এর সাথে আমার একটু দরকার আছে। ওনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।
গম্ভীর গলায় উত্তর দেন অসীম বাবু।
– তোজোর মা কে? আপনার মাথা খারাপ? আপনি জানেন না ওর শারীরিক অবস্থার কথা? ও নিজেকেই ঠিক রাখতে পারেনা আপনাদের কি সাহায্য করবে?
এই কথা চলা কালীন পিয়ালী রা শুনতে পায় একটা কান্নার আওয়াজ। একটি মহিলা কণ্ঠস্বর যেন বিলাপ করছে – আয় সোনা আমার, ফিরে আয় আমার কাছে….
– ওই শুনুন , শুনতে পাচ্ছেন?
লোকটি আবার গর্জে ওঠে,
আমার স্ত্রীর কণ্ঠস্বর, মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওর, এখনও ঘুমের ঘোরে ছেলে জে দেখতে পায়, ওর সাথে খেলা করে হাসে, আর জেগে উঠে না দেখতে পেয়ে বিলাপ করে। তবে যাই হোক, ও যেমন আছে থাকুক, আপনাদের আর ভাবতে হবেনা। আমি সব হারিয়েছি, ওকে হারাতে চাইনা। আপনারা দয়া করে চলে যান।
পিয়ালীর কি একটা মনে হতে সে বলে ওঠে,
– আমি তো এক মা, আমি ওনার কষ্ট টা উপলব্ধি করতে পারছি। আপনি একবার অনুমতি দিলে আমি একবার আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা করি?
এবার ভদ্রলোক রীতিমত গর্জন করে উঠলেন,
– বললাম তো না, কথা কানে যায়না আপনাদের? ওর সাথে দেখা হবেনা, আপনারা যা ইচ্ছে করুন, কেন অসীম বাবু আগেরবারের মতই বন্দী করুক আমার ছেলের আত্মা টা কে! সব দোষ আমার ছেলের তাই না? আর ওকে যে চলে যেতে হল ওইটুকু বয়সে তার দায় কার? যা পারেন করুন আপনারা, আমরা কোনো সাহায্য করতে পারবো না।
অসীম বাবু এবার যেন একটু রেগে গিয়ে বললেন,
– যা হবার হবেই। আপনি কি তাকে আটকাতে পারবেন? আমি আগেরবারেই বলেছিলাম আপনাকে যে আপনার ছেলের আত্মা একা যেতে চায় না, আপনার স্ত্রী যে তার জন্য আত্মাহুতি দিতে হবে, আপনি কিছুতেই রাজি হলেন না, এবং আরও অনেকের বিপদ বাড়িয়ে তুললেন, এভাবে কোনো আত্মা কে বন্দী করে বা খালি হাতে ফেরানো যায় না, সে যা চায় নিয়ে তবেই ছাড়বে, কেন বুঝছেন না জানিনা। যাই হোক চলে আসুন আপনারা, আমিই দেখছি কি করা যায়।
এই বলে অসীম বাবু বেরিয়ে গেলেন। পিয়ালী ও রৌনক পিছন পিছন বেরিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেলো বাড়ির ভিতরে কোনো দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজ। তারা ফের গাড়িতে ফিরে এলো। পিয়ালীর চোখের সামনে যেন আস্তে আস্তে সব আশা র আলো নিভে যেতে লাগলো। ওর খালি মনে হতে লাগলো যে ছেলে কে বাঁচানোর এখন একটাই পথ আছে, নিজেকে বলি দেওয়া। কথা টা পিয়ালী অসীম বাবুকে বলতেই রৌনক চেঁচিয়ে উঠলো,
– তোমার কি মাথা খারাপ হয়েগেলো পিয়ালী? এসব কি কথা বলছো? নিশ্চই অন্য কোনো উপায় থাকবে ঋক কে বাঁচানোর। তার জন্য কখনোই তোমাকে মরতে হতে পারে না।
তবে অসীম বাবু পিয়ালীর কথা তে সায় দিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়িয়ে ব্যক্ত করলেন যে পিয়ালী ঠিকই বলেছে। মা রূপে যদি কোনোভাবে ও ওই আত্মাটাকে নিজের সাথে জড়াতে পারে তাহলে সে রিকের শরীর ছেড়ে তার শরীরে আসতে পারে। তাহলে ঋক নিরাপদ হতে পারে তবে সে ক্ষেত্রে পিয়ালী কে নিজের জীবন বাজি রাখতে হতে পারে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।