• Uncategorized
  • 0

|| ভাষাতে বাংলা, ভাসাতে বাংলা || সংখ্যায় সুব্রত ভট্টাচার্য্য

“বিদ্যাপতি – বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক চিরস্মরনীয় প্রত্যয়”

সাধারনত: কোন যৌক্তিক বিবেক চিন্তাধারার কলাত্মক প্রকাশই হলো সাহিত্য যেখানে মানবিক আবেগ যেমন; সুখ, দু:খ, ভালোবাসা, আনন্দ, খুশি, ঘৃণা এবং সৌন্দর্য্যের প্রকাশ কোন এক ভাষার স্পর্শ দ্বারাই সম্ভব৷ খ্যাতিনামা চিন্তাবিদগণ বিশ্বাস রাখেন যে যদি মানুষ ভাষার প্রতি সম্পুর্ণ বোধ রাখে, তাহলে মনুষ্য-জড়িত সমস্যার প্রায় বেশির ভাগ অংশেরই সমাধান হয়ে থাকে৷ একমাত্র ভাষায় হলো মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, শৈক্ষিক এবং পেশার মুখ্য শক্তি৷ মানুষ তার অভিজ্ঞতাকে যেমন; আবেগ, প্রেম, ঘৃণা, আশা, শক্তি, জয় এবং দূঃখকে ধ’রে রাখার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম অবলম্বন করেছেন; যেমন; সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন, মুর্তিকলা, লেখনী প্রভৃতি আর এই সবের মুলে ভাষা বোধের প্রয়োজন অপরিহার্য্য ঠিক যেমন জীবনে বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য্য ৷ সামাজিক জীবনকে একমাত্র সাহিত্যই প্রতিনিধিত্ব করে। সাহিত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব-মনের সৌন্দর্য্যকরণ এবং নিশ্চিত জ্ঞানের উপলব্ধি৷ যেহেতু সাহিত্যের প্রকাশ ঘটানোর জন্য প্রয়োজন কলা, সুতরাং সমস্ত কলাই হচ্ছে মানবজীবনের সৌন্দর্য্যের এবং সত্যের ভাব প্রকাশ আর এই ভাব প্রকাশের জন্য ভাষায় হলো একমাত্র অস্ত্র। এই অস্ত্রের সৃষ্টি বিশেষ কোনো সংবেদনশীল মহীয়ান মানব আত্মার দ্বারাই হয়েছে।
UNESCO-এর তত্তাবধানে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” পালন করার জন্য ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে নির্ধারিত করা হয়। তাই, বঙ্গবন্ধুরা এই দিনটিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করার জন্য “আ-মরি বাংলা ভাষা” – এই মাতৃভাষার সৃষ্টিকর্তাদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ ক’রে ঐ সমস্ত মনিষীদের স্মরণ করার সৌভাগ্য পেয়ে থাকেন।। এই বাংলা ভাষার সৃষ্টির কথা উল্লেখ করতে হলে, অনেক সংবেদনশীল মহীয়ান মানব আত্মা আমাদের জীবনে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত এবং তাঁদের মধ্যে বিদ্যাপতি হলো এক অন্যতম এবং সেই সুত্রে উনাকেই শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ ও স্মরণ ক’রে উনার কৃতিত্ব প্রদর্শনের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হলো।
‘বিদ্যাপতি’ শব্দটীর বাংলা আক্ষরিক অর্থ যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে এই রকম দাঁড়ায়-বিদ্যাকে পরিচালিত করার দক্ষতা য়ার মধ্যে বিদ্যমান, তাকেই বলা হয় বিদ্যাপতি৷ যেমন সৈন্যদের পরিচালককে বলা হয় সেনাপতি, কোন বিচারকে সার্বজনীন ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষমতা যার থাকে, তাকে আমরা বলে থাকি বিচারপতি, ইত্যাদি৷ ‘বিদ্যাপতি’ নামে কোন এক সংবেদনশীল মানব আত্মার পৃথিবীতে আবির্ভাব হয়তো একটা ঐশ্বরিক পুর্ব পরিকল্পিত যোজনা, কারণ কোন ব্যক্তির নামের সঙ্গে কর্মের সামঞ্জস্যতার অনুরূপ মিলন সাধারণ ক্ষেত্রে একটি দুর্লভ অভিজ্ঞতা৷
যদিও বাংলা ভাষার উৎস ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা সংগোষ্ঠীর শাখা ইন্দো-আর্য, বিদ্যাপতির বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে অবদান, তার ফলস্বরূপ উনাকে বাংলা ভাষার জনক হিসাবে গন্য করা হয়েছে৷ ভাষা রচয়িতা হিসাবে বিদ্যাপতির স্থান ইংরাজী সাহিত্য রচয়িতা শওসারের(Chaucer) অনুরূপ৷
বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির অনুমানিত জীবন কাল হলো ইংরাজীর ১৩৫২-১৪৪৮ সাল এবং জন্মস্থান হলো বিহার রাজ্যের মিথিলায় অবস্থিত মধুবনী গ্রামের এক ব্রাহ্মন পরিবারে৷ তিনি রাজা শিব সিংহের রাজদরবারের সভাকবি ছিলেন এবং সেই জন্য তাঁর দ্বারা রচিত পদাবলীর ভনিতায় শিবসিংহ এবং উনার পত্নী লছিমাদেবীর নাম যুক্ত হয়েছে৷ কবি প্রতিভাকে প্রদর্শন করার যে উপযোগী অসাধারণ বুদ্ধি ও অনুভূতির প্রয়োজন তার পরিচয় বিদ্যাপতির দ্বারা রচিত কাব্য গ্রন্থ হলো এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ এক বার রাজা শিব সিংহ যখন মুঘল শাসকের দ্বারা কারারুদ্ধ হন তখন বিদ্যাপতি তাঁর রচিত কবিতার দ্বারা মুঘল শাসকের মন জয় করেন এবং রাজাকে মুক্তি দেওয়ান৷
কালীদাসের সংস্কৃত ভাষায় রচিত কাব্যগ্রন্থ “কুমারসম্ভবম” এবং জয়দেবের “গীত গোবিন্দ পদাবলী” রচনার পরেই সাহিত্য জগতে স্থান পায় “বিদ্যাপতি পদাবলী” যেটা তিনি মৈথিলী ভাষায় রচনা করে ছিলেন৷ মৈথিলী ভাষা হলো বাংলা এবং হিন্দী ভাষার সংমিশ্রন যেখানে অধিকাংশ শব্দের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকেই প্রয়েোগ করা হয়েছে৷ বিদ্যাপতির পদাবলী হলো তাঁর দ্বারা রচিত শত-শত কবিতার সংগ্রহীত কাব্যগ্রন্থ যেটার মুল বিষয়বস্তু হলো ব্রজের গ্রামীণ কিশোরী রাধা এবং ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণের মধ্যে রঞ্জিত বিভোর প্রেমালেখ৷ বিদ্যাপতি যদিও প্রবাসী বাঙালী ছিলেন, প্রথমে কিন্তু তিনি মৈথিলী ভাষায় প্রেম সম্বন্ধীয় সঙ্গীত ও কবিতা রচনা করেছেন৷ আজও বিহার বাসীগণ তাঁদের বিবাহ মন্ডপে বিদ্যাপতি রচিত লোকগীত তাঁদের জীবনের একটা আনন্দের উৎস হিসাবে গন্য ক’রে থাকেন৷
প্রেম এবং ভক্তি বৈষ্ণব ধর্মের মুল নীতি হওয়াতে কবি জীবনের প্রারম্ভ কাল থেকেই বিদ্যাপতি মনে-প্রানে মানব প্রেম এবং ঈশ্বর প্রেমকে কামনা করেছেন৷ প্রেম ছাড়া মানুষের মূক্তি সম্ভব নয় – এরকম একটা ধারনা তাঁর জীবন দর্শনের অন্তর্গত৷ বাংলা প্রণয় কবিতায় ইন্দ্রিয়জ আবেগের এক অকুন্ঠ হৃদয় প্রকাশ তাঁর রচিত রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা এবং শিব-দূর্গার ঈশ্বর প্রেমকথা থেকে বিদ্যাপতির উপরোক্ত দার্শনিক চিন্তাধারার পরিচয় আমরা পেয়ে থাকি৷ বিদ্যাপতি প্রেম নিবেদনের প্রতি নিজেকে গভীর বিভোরের মধ্যে নিমাজ্জিত করেছেন যার প্রমাণস্বরুপ আমরা পেয়েছি বিদ্যাপতী পদাবলী৷ বিদ্যাপতির প্রেম ও ভক্তির প্রতি যে ঝুকায়মান প্রবণতা সেটাকে বিশ্লেষণ করলে ঠিক এরকম দাঁড়ায় – যেমন পাখীর জন্য পাখা, মাছের জন্য জল, বাঁচার জন্য জীবন ঠিক তেমনি আমার জন্য তূমি৷
যেহেতু রাজনীতি এবং ধর্ম মনুষ্য জীবনের আদর্শতাকে প্রতিফলিত করার দূটো মুখ্য অস্তিত্ব, বিদ্যাপতি তাঁর রচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় জ্ঞানের প্রদর্শন দিয়েছেন তাঁর পৌরাণিক প্রণয় সম্বন্ধীয় লোক কথার মাধ্যমে৷ বিদ্যাপতি তাঁদের জন্যই লিখেছেন যাঁদের স্বপ্ন এবং আশা অমরণশীল৷ ভারতীয় সাহিত্যে তাঁর অবদান অপরিমেয়৷ মহান–মহান লেখক এবং কবিগনের দ্বারা বাংলা ভাষা পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পেয়েছে যার প্রমান আমরা পেয়েছি বিদ্যাপতি পদাবলীর ভাষা রুপান্তরনের মধ্য দিয়ে৷
ডক্টর আনন্দ কে. কুমারস্বামী – একজন মহান ভাষাবিদ, ইতিহাসকার, দার্শনিক এবং ভারতীয় সাংস্কৃতির খ্যাতিনামা বিদুষী, বিদ্যাপতির কবিতা এবং সঙ্গীতের প্রতি চৌম্বকের ন্যায় আকৃষ্ট হন এবং বিদ্যাপতি পদাবলীকে ১৯৪১সালে ইংরাজী ভাষায় রুপান্তরিত ক’রে সারা বিশ্বে পাঠক প্রেমীদের স্মৃতিকে করেছে জাগৃত এবং মুগ্ধ৷
পূর্বভারতীয় সাহিত্যের প্রতি বিদ্যাপতির প্রেম ও ভক্তি সমায়িত কবি প্রতিভা প্রবাহের প্রকাশতীব্রতা যে কতটা উচ্চমানের নৈতিক ধারক সেটা তাঁর দ্বারা প্রনীত “পূরুষ পরীক্ষা”, “দুর্গাভক্তি তরঙ্গীনি”, “বিবাদ সার” এবং অন্যান্য গীতমালা থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি৷ এমন-ই একটা গীত নমুনা প্রিয় পাঠক প্রেমীকদের কাছে তুলে ধরা হলো, যেটার দ্বারা ঘরোয়া পল্লী সমাজ চিন্তাধারাকে মৈথিলী ভাষার লোককথার মাধ্যমে বিদ্যাপতির হিন্দূ প্রেমীকদের হৃদয়ে এক অফূরন্ত প্রেমানন্দের গুঞ্জন প্রলেপ প্রদান করেছেন আর এই গুঞ্জন প্রলেপের উৎস যে প্রকৃতি সেটাও এই গীত নমুনাতে কবি বিদ্যাপতি বসন্তের মধুর আবওহাওয়ার দ্বারা মনকে সিঞ্চিত ক’রে প্রমান করেছেন:
‘নব বৃন্দাবন, নবীন তরুগণ,
নব নব বিকশিত ফুল৷
নবীন বসন্ত নবীন মলয়ানিল
মাতল নব অলিকুল৷
বিহরই নওল কিশোর৷
কালিন্দী-পুলিন-কুঞ্জ নব শোভন,
নব নব প্রেম বিভোর৷
নবীন রসাল-মুকুল মধু মাতিয়া
নব কোকিলকুল গায়৷
নব যুবতীগণ চিত উময়তাই
নব রসে কাননে ধায়৷
নব যুবরাজ নবীন নব নাগরী
মিলয়ে নব নব ভাতি৷
নিতি নিতি ঐছন নব নব খেলন
বিদ্যাপতি মতি মাতি৷’
১৮৮৪ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রথম আত্মকথা “ভানুসিংহের পদাবলীর” রচনা করেছেন যেখানে ১৫-টি পুরাতন এবং ৬-টি নূতন কবিতাকে সংযোজিত করা হয়েছে৷ রবি ঠাকুর এই সমস্থ কবিতা গুলো রচনা করার সময় বিদ্যাপতির কবিতা রচনার যে ভাবাত্মক ছন্দ সেটাকেই অনুস্মরন করেছেন আর এই কবিতাগুচ্ছের মধ্যে প্রথম কবিতাটা হলো – “সজনিগো-শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা” এবং দ্বিতীয় অন্যতম শ্রেষ্ট কবিতা হলো – “গহন কুসুম-কুঞ্জ মাঝে”, সুতরাং, অষ্টোদশক শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে, রবি ঠাকুরের রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর দ্বারা বিদ্যাপতি পদাবলীকে প্রতিনিধিত্ব এবং উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আনন্দ কে. কূমারস্বামীর দ্বারা বিদ্যাপতি পদাবলীর ভাষা রুপান্তরন – সাহিত্য জগতে এটাই উপপাধিত করে যে চতুর্দশক শতাব্দীর কবি বিদ্যাপতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় প্রত্যয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।