মার্গে অনন্য সম্মান সুচন্দ্রা বসু (সর্বোত্তম)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৬১

বিষয় – পরকীয়া

পরকীয়া ঝড়

রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে চোখ মেলে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখব কি আর?দেখি শুধু এপাশে ওপাশে সব ঘুরছে জোড়ায় জোড়ায়।তরুনী থেকে বয়স্করা সবাই যে যার সঙ্গীনির হাত ধরে। কেউবা বাইকে বসে প্রেমিককে জড়িয়ে হাওয়ায় ভাসছে।তবে মনে হয় লুকিয়ে প্রেমের মজাই আলাদা।প্রকাশ করলেই সেই অনুভূতি হারিয়ে যায়।অন্ধকারেই তো গাঢ় ভালবাসা হয়।আলোয় সেই মাখামাখির অনুভূতি আর আসে কতটা…..যদিও প্রেমের কাছে আলো আর আঁধারের তফাৎ কিছু থাকে না।হ্যাঁ সন্ধ্যায় সেদিন হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই পার্কে ঢুকে পড়ি একাকী।
নিয়নের আলোয় পার্কটি বেশ সুন্দর লাগছিল।
কি মনোরম পরিবেশ।হাওয়ায় কৃষ্ণচূড়া দুলছে। আর বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখি কেউ একা বসে বিড়ি ফুঁকছে,কেউ বা তার সঙ্গীনির সাথে প্রেমালাপে ব্যস্ত,কেউবা ফোনে নির্জন কথোপকথনে,কেউবা চারপাশ উপেক্ষা করে সাথীকে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। আমি এগিয়ে চলেছি,কিছুদূর এগিয়ে দেখি, একাকী একজন
বয়স্ক লোক বেঞ্চে বসে ফোনে যেন কাউকে বলছে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব?আমাকে তো আবার ফিরতে হবে?কতদিন দেখিনি
মনে আছে?আমিও বেঞ্চটি ফাঁকা দেখে নিঃসঙ্কোচে পাশে গিয়ে বসি। হঠাৎ ভদ্রলোকের চোখে চোখ পড়তেই তাকে চিনতে পারি। বলি ভাল আছেন স্যার।উঠে তাকে প্রণাম করতে যাই। তিনি চিনতে পারলেন না।
বললেন কে তুমি?
মনে নেই স্যার, আমরা চারজন যে একসাথে পড়াতাম।কি উৎপাত করতাম।আজ ফুচকা খাব, ঘুগনি হেঁকে গেলে বলতাম স্যার শুনতে পাচ্ছেন আর আপনি বলতেন কানে দিয়েছি আজ তুলো।আর আমরা বলতাম আজ ছাড়ছি না।ঠিক খেয়েই তবে ছাড়তাম।কিন্তু এখন কার জন্য অপেক্ষায় বসে।ম্যাডাম কেমন আছেন?
সে তো দু’বছর হল গত হয়েছেন।আমি চাঁদনির
অপেক্ষায়।
চাঁদনি কে স্যার?
চাঁদনি মেয়েটি খুব ভাল।আমি মেয়েটিকে পড়াই।আমি আর কাউকে পড়াই না,ভাল লাগে না। পড়তে পড়তে তার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী ইঞ্জিনিয়র বিদেশ থাকে। শাশুড়ির অসুস্থ বলে আমার বাড়িতে পড়তে আসছে না।আমি তো তার বাড়ি যেতে পারি না।তাই যদি একবার এখানে আসে।
তার বাচ্ছা নেই?
থাকলে কি আর আমার প্রতি তার টান থাকে?মেয়েটি পড়াশোনায় ভাল। ডিগ্রীটা কমপ্লিট করতে চায়। তাছাড়া ভাল কবিতা লেখে।
— আপনিও তো কবিতা লিখতেন স্যার?
তিনি উৎসাহিত হয়ে বললেন হ্যাঁ লিখি তো এখনও। ওকেও উৎসাহ দিই।সুন্দর লেখে।
আলাপ করবে?ভারী সুন্দর মেয়ে চাঁদনি।মেয়েটির হৃদয়ে যেন একটা চুম্বক আছে।আমি তার প্রতি কেমন যেন আকৃষ্ট হয়ে পড়ি।সারাদিনে তাকে একবার কাছে না পেলে কেমন অস্থির হয়ে যাই।
—তাই নাকি স্যার?
—হ্যাঁ মেয়েটি যেন আমায় যাদু করেছে। এখন তাকে ছাড়া আমার অসহায় লাগে।
তাহলে এর পরিণতি কি স্যার?
আমার ছেলে বৌমাও আলাদা থাকে। আমি বাড়িতে একা।কাজের লোক আছে।সে কাজ
করে চলে যায়। তারপর আমি নিঃসঙ্গ। মনে হয়
ফাঁকা ঘর গিলতে আসছে।
বললেন
যখন ভালোবাসা ছিল তখন সময় ছিলনা। সে
আজ দূরে চলে গেছে। সময় দেখি অঢেল কাটতে চায়না কিছুতেই। সারাদিন এখন ফোন করে বিরক্ত করি মেয়েটাকে।তবু যেন বাকি থেকে যায় কথা।সারাদিন চাঁদনির কথা ভাবতে ভাবতে —আহ্নিকগতির হিসাব ভুলে যাই। রোজ ঘুম ভেঙে তার মুখখানা ভাসে চোখের সামনে।

দর্শনের এই প্রবীণ অধ্যাপকের কথায়
বুঝতে পারলাম প্রেমের কোন বয়স থাকে না। শরীরের বয়স সকলের বাড়ে ঠিকই কিন্তু মন যেন সব সময় সবুজ থাকতে চায়।

মনে পড়ে না আপনার স্ত্রীকে? সে রাগ করবে না?
এই কথা চাঁদনিও জানতে চেয়েছিল।বলেছিলাম
সে মরে গেছে।মরার পর আর কিছু থাকে না। ওসব কুসংস্কার মানি না।সে ছিল তার জায়গায়। এখন চাঁদনি আমার মণি কোঠায়। একদিন আমি ওকে সাবধান করেছিলাম কখনো প্রেমে
পড় না। কিন্তু সেই আমিই কেমন যেন চাঁদনির
প্রেমে জড়িয়ে পড়েছি।সেই আগুনে আমি দিনরাত পুড়ছি। পুড়ে পুড়ে খাক হচ্ছি। জীবনে নতুনের স্বাদ এলো তার স্পর্শে। তাকে আমার বুকে গোপনে বয়ে চলেছি।

মনে পড়ে সে কথা_
সেদিন আমার ডাইনিং রুমে বসেছিলাম আমি ও চাঁদনি।সে খুব মন,দিয়েই লিখছিল আর আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম এক দৃষ্টিতে। আবেগের বশে তার পাশ ঘেঁষে বসি।
চাঁদনি বিস্ময়ে আমার দিকে তাকায়।
আমি তার চিবুক তুলে ধরে মুখখানা পরিপূর্ণ
ভাবে দেখি।চোখে তার লজ্জার ছায়া পড়ে।
আমি ঘোরের মধ্যে কপালে তার চুম্বন করি।
সে কোন বাধা দেয় না।
সে একবার মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা নামিয়ে নেয়। আর বলে উঠল, দিলেন তো সব গুলিয়ে।
এটা ঘটতে কত সময় লেগেছিল স্যার?
যা ঘটার আচমকাই ঘটে। সময় মেপে প্রেম হয়
না।
আরও বললেন, আমি যে ভীষণভাবে চাই তাকে,
কি করব বলো?
কিছুই করার নেই। এ তো হতেই পারে।তিনি আমার কথায় উৎসাহিত হয়ে বললেন,
আমি তার বুকের ভিতরে ঢুকে থাকতে চাই আজীবন।
আপনি কখনও জানতে চেয়েছিলেন,সে আপনাকে ভালবাসে ক না?
হ্যাঁ চেয়েছিলাম তো। তুমি কি আমার কাছে সব ছেড়ে আসতে পারবে?
তখন সে চমকে উঠে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
তা কি করে সম্ভব?শুনে আমি বলেছিলাম,ভয় নেই। সে ভাবে সব ছেড়ে আসতে বলছি না।তোমার সংসার তোমারই থাকবে।তা তুমি তাকে কি করেই বা ছেড়ে আসবে বল?এইভাবেই আসবে তুমি আমার কাছে।তুমিও বুড়ি হবে আমিও বুড়ো হব,আর আমাদের প্রেম জমে ক্ষির হয়ে যাবে।

কথাটা শেষ হতেই একটি ছিপছিপে চেহারার মেয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়।
অধ্যাপক তার দিকে চেয়ে বলে এতক্ষণে তোমার সময় হল?
কি করব বল? শাশুড়ি ছাড়তে চাইছিল না।
আমি যে স্যারের পাশে বসে হাঁ করে কথাগুলো গিলছিলাম তা দেখে প্রথমে সে কিছুটা ঘাবড়ে যায় । আমি উঠেই পড়ছিলাম।
স্যার বললেন আলাপ না করেই চলে যাবে?এই হল সেই চাঁদনি।যে দু’বছর আগেও ছিল অচেনা।
আমি বললাম চেনা হল কিভাবে?
তিনি বললেন চেনা হল বোধ হয় স্ত্রী চলে গেল বলে।আজ মনে হয় এ’যেন কত কালের চেনা।
অমনি চাঁদনি বলে ওঠে,তখন কি মনে হত?
কি আর মনে হবে? তখন তো দেখা শোনা হয়েছিল কেবল। সেই কবিতা পাঠের সভাঘরে।
তিনি যেতেই আমি চেনা হয়ে গেলাম!আশ্চর্য
কথা।
আশ্চর্য আমি নিজেও কম হই না।তুমি তার
ব্যতিক্রম।
তিনি কি কখনো তোমায় ভালবাসেন নি?
তা কেন,দুজনের প্রতি দুজনে কর্তব্য পালন করেছি। তাতে সন্দেহ নেই কোন।
তবে কি মনের টান ছিল না?ছিল তো বটেই,
তবে তখন প্রেমের মূল্য আমি অতটা বুঝিনি।
তবে কি আমার কাছে এসে প্রেমের মূল্য বুঝলে?
কেন তুমি তা বুঝ নি?তোমার মনকে প্রশ্ন কর?উত্তর পেয়ে যাবে।হ্যাঁ বুঝলাম….’ রঙ মিলান্তি খেলা ‘খেলতেই বুঝলাম। চলো এবার উঠি আমরা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ আমি আহত হলাম।তোমার উপর নয় চাঁদনি,আমার নিজের উপর। আমার কপাল মন্দ আমি জানি। এও জানি সুখের সময় অল্প।দুঃখের সাগর জীবনের তিনভাগ।স্যার বললেন চাঁদনি দশ মিনিট বস। বলেই হাতটা ধরে খুব কাছে বসিয়ে নিয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন আরও নিবিড় ভাবে বুকের কাছে টেনে নিলেন।আমি সংকোচে উঠে পড়লাম।বললাম আসি।এসো। ভাল থেকো।তোমার দিন আরও রঙিন হয়ে উঠুক।
এতক্ষণ আমি পরকীয়ার ঝড়ের মুখে পড়েছিলাম। এবার বাড়ির দিকে এগোলাম।বুঝলাম,সময় বদলে গেছে অনেকটা। মানুষ খোলা বাতাস চায় প্রাণ কুঠরীতে।যাই আমার ঘর সামলাই।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।