সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৮৭)

রেকারিং ডেসিমাল

ট্রেনে রাত কাটানো ছানাদের এই প্রথম।
তারা এর আগে বাবা মায়ের সঙ্গে প্লেনে করে বম্বে হয়ে গোয়া ঘুরে এসেছে।
ছেলে তখন সবে আড়াই বছর ছিল। সে আর সাড়ে চার বছুরে দিদি আকাশে উড়ে, জানালা দিয়ে মেঘ দেখে, এয়ারহোস্টেস আন্টিদের আদর খেয়ে খুব সহজেই প্রথম বেড়ানো সেরে বাড়ি ফিরেছে বীরদর্পে।
বেড়ানো তাদের কাছে তাই জলভাত।
প্লেনে লজেন্স ও পাওয়া গেছে মুঠো মুঠো। ফলের পুরো বাস্কেটটাই সামনে ধরে দিয়েছেন ইউনিফর্ম পরা আন্টিরা। তার থেকে যেটা ইচ্ছে তুলে নিয়েছে। ছোটকে হাগিজ ডায়াপার পরানো ছিল। দিদি গম্ভীর হয়ে মায়ের সঙ্গে গিয়ে এরোপ্লেনের টয়লেট ইউজ করতে শিখে নিয়েছে।
মুস্কিল হয়েছিল সান্টাক্রুজ এয়ারপোর্টে নেমে।
মায়ের কোলে ঘুমিয়ে ছিল ভাই। অনেক ভোরের ফ্লাইট তো, প্রায় রাত তিনটেয় বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। আবার রাস্তায় চিড়িয়াখানার কাছাকাছি এসে ট্যাক্সির টায়ার পাংচার হয়েছিল। দুই ভাইবোনের কী চিন্তা!!!
যদি দেরি হয়ে ফ্লাইট মিস হয়ে যায়!!
ত, সে যাই হোক, এত কান্ডের পর গরম দুধ আর কর্নফ্লেক্স খেয়ে এয়ারহোস্টেসদের দেয়া নরম ব্ল্যাংকেট মুড়ি দিয়ে ঘুম।
দিদি স্মার্ট মানুষ। স্যান্ডউইচ, ডিম সেদ্ধ, মাফিন সঅঅব পরিপাটি খেয়ে টিসুর ন্যাপকিন দিয়ে হাত মুখ মুছেও নিয়েছে।
নামার একটু আগেই ফলের বাস্কেটটা এনেছিলেন সামনে সেই আন্টি।
ভাই ঘুম থেকে উঠে খপ করে টুকটুকে লাল চকচকে আপেলটা তুলে নিয়েছে।
দিদি কমলা লেবু হাতে নিয়ে নেমে এসেছে গট গট করে মায়ের হাত ধরে।
এয়ারপোর্টের চেয়ারে বসে মা অপেক্ষা করছেন লাগেজ নিয়ে আসবেন বাবা।
দিদির পকেটে ছোট্ট ফ্রূটির প্যাকেট ছিল। সে স্ট্র লাগিয়ে চুমুক দিয়েছে।
ভাই লাল আপেলে কামড়।

আপেলের শক্ত খোসার কুচি ছোট মানুষের গলায় যেতেই বিষম আর কাশি। কাশতে কাশতে বমি।
সাণ্টাক্রুজের দোতলার সাদা মেজে ভেসে গেল দুধ কর্নফ্লেক্সে। ছেলের নাক-মুখ লাল। কি কষ্ট!
তার মধ্যে বাবা এসে পৌঁছেই বকা।

বললাম এত কিছু খেতে দিও না! এবারে কী হবে? আমি জানি না। আয় তো মা..

ঘাবড়ে যাওয়া মেয়ের হাত ধরে তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিয়ে গেলেন বাবা।
মায়ের কাঁধে বড় ঝোলার মত ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল ওয়াইপের ভিজে টিসু, ছোট বেবি পাউডার। এক্সট্রা জামা হাফ প্যান্ট যেটা সব সময় মায়ের হাত ব্যাগে থাকে। জলের বোতলের জল খাইয়ে ছেলেকে একটু সামলাতে সামলাতেই, ভীষণ এফিসিয়েন্ট “বাই” এসে গেল এয়ারপোর্টের স্টাফ।
মাকে আশ্বস্ত করে এক গাল হেসে মুছে টুছে সাফসুতরো ঝকঝকে করে দিল মেজে।
মা হাঁফ ছেড়ে কোলের পুচকেকেও মুছে টুছে পাউডারের মিষ্টি গন্ধ মাখিয়ে নরম টি শার্ট আর ডাংগেরিতে বাবুমশাই বানিয়ে ফেললেন ততক্ষণে।
তাকে দেখে সাফ করতে আসা মাসি আর মা যে বিগলিত হাসি বিনিময় করলেন, সেটা পৃথিবীর পুরোনোতম ভাষা।
মায়ের জাতের একান্ত নিজস্ব ভাষা সেটি।
এই চলন্ত জীবন্ত টুকটুকে পুতুলদের দেখে মা-জাতীয়দের কিরকম যে গলে যায় ভিতরটা!
কোন জাত, দেশ, ভাষা, কিছু দরকার হয়না। দুই মহিলা অনায়াসে নিজেদের অনুভূতির আদান প্রদান করে ফেলতে পারেন মৌখিক অভিব্যক্তিতেই। সেই ভাষাতেই দুই হাত ঘুরিয়ে কপালে এনে আদর আর মঙ্গল কামনা করলেন এক মাঝবয়সী নারী, আর বিনয়ের সাথে হেসে তার শুভকামনা মাথা পেতে নিলেন এক নতুন মা। বাবা আর দিদি ফিরে এসে দেখল, সব ঝকঝকে তকতকে। ভাই এক গাল হেসে পকেটে হাত পুরে দাঁড়িয়ে আছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।