সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সায়ন (পর্ব – ১৩)

অমৃতায়ণ

একটা শোষণের ভাষা ভয়াবহ ভাবে আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে, এখানে সুলগ্না কে , কেনই বা বারবার মনে হচ্ছে একটা অন্ধকার প্যাঁচ আমাদের গলার চারপাশ থেকে টান হয়ে যাচ্ছে ।
বাসটা তখন মেট্রো ক্যশ অ্যন্ড ক্যরির সামনে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। পর পর ল্যাম্পপোস্ট এ হঠাৎ ধুলোমাখা লালঝান্ডার ছায়া ঘিরে আসছে জানলার কাছে।
বাসে একটা রেডিও বাজছে, মনে হল এটা কি ভাষা – জার্মান !
জার্মানির উদাহরণ টেনে বলা যায় জার্মানিতে ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী বামপন্থী আন্দোলনের উপস্থিতি থেকেছে। রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটলেও যে দেশটিতে বিপ্লবের সম্ভাবনা নিয়ে পৃথিবীর সমস্ত কমিউনিস্টরা আশান্বিত ছিল সেটি হলো জার্মানি।বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার সাথে সাথেই জার্মানিতে শক্তিশালী হয় দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি। বামপন্থা এবং দক্ষিনপন্থা উভয়েরই শক্তিশালী আন্দোলন তুলনায় উদারবাদী পার্লামেন্টারী শাসন হিসেবে ওয়েমার রিপাবলিকের জন্ম দেয়। বামপন্থী আন্দোলনের চাপে এই ওযা়ইমার রিপাবলিক বাধ্য হয় সাধারণ মানুষের স্বার্থে নানাবিধ আইন পাশ করতে।
অমৃতার কথা খুব মনে পরছে……
বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী জার্মানির সবথেকে ভালো সময় হিসেবে এই পর্বকেই দেখানো হয়। সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার কাজ, স্বাস্থ্য বিমা, বেকার ভাতা সহ একাধিক আইন পাশ হয় এই সময়ের জার্মানি তে। ১৯২৩ সালে ফ্রেইকর্পস( যাদের হাতে রোজা লুক্সেমবার্গ, কার্ল লিবনিকট খুন হন) এবং নাত্সী পার্টি ক্ষমতা দখলের লড়াই এ ভাগ নেয়।
ছোটো , রথীন, রাজা আর সুলগ্না- এই লড়াইটা ঠিক কি ? বারবার কেন এই বিপজ্জনক সময়ের ছবি আমার চোখের সামনে চলে আসছে !
চেষ্টা বিফলে যায়. হিটলার কে আর্নেস্ট রহেম নামের আরেক জাতীয়তাবাদী নেতার সাথে গ্রেপ্তার করা হয়। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর নাত্সী পার্টির পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। কিন্তু ওই সময়েও নাত্সী পার্টির ভোটের ফলাফল খুবই নগণ্য, মোট ভোটের ২.৬%(১৯২৮ সালে)। ভোটে ফলাফল ব্যাপক কিছু না হলেও তলায় তলায় সংগঠন জোরদার করার কাজ চালাতে থাকে নাত্সীরা। ১৯৩০ এ দুনিয়াজোড়া অর্থনৈতিক সংকটের পরে পরেই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। একদিকে পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির এই সংকটের সামনে অসহায়তা আর অন্যদিকে দেশে দেশে শ্রমজীবী জনগণের সামনে (যারা এই সংকটের প্রকৃত ভুক্তভোগী ছিলেন) সদ্য পুঁজির জোয়াল থেকে মুক্ত সোভিয়েত রাশিয়ার উদাহরণ পুঁজিবাদের কাঠামো নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়। বিশেষত জার্মানীর মত দেশে, যেখানে ১০ বছর আগেই রাশিয়ার উদাহরনে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রমিকেরা ক্ষমতা দখল করার ব্যাপক লড়াইতে নেমেছিলেন; সে’ স্মৃতি তখনো পর্যন্ত টাটকা ছিল। এ’থেকে মুক্তির জন্য পুঁজিবাদের কাছে সামরিক অর্থনীতি ও তাকে লাগু করার মত উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শে জারিত রাষ্ট্রকাঠামো হয়ে পড়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সংকট পরবর্তী শ্রমিক আন্দোলন ও বিক্ষোভের হাত থেকে পুঁজিবাদ কে বাচানোর জন্য পুঁজিপতি শ্রেণী ফ্যাসিবাদ কে গড়ে উঠতে সবরকম সাহায্য করে। দু বছরের মধ্যে নাত্সী পার্টি রাইখস্ত্যাগে সবথেকে দুর্বল দল থেকে দ্বিতীয় শক্তিশালী দলে পরিনত হলো, তার পরের বছর জার্মান চ্যান্সেলর হিন্ডেনবুর্গ হিটলারকে ক্ষমতা দখলের আহ্বান জানালেন। ১৯৩৩ সালে ক্ষমতা পাওয়ার পরে পরেই নাত্সি শাসন ওয়েইমার রিপাবলিকের সময়কার সমস্ত সংস্কার কে বাতিল করে দেয়. জার্মানীর উন্নতির পথে প্রধান বাধা হিসেবে ইহুদীদের চিহ্নিত করে শুরু হয় ইহুদী নিধন যজ্ঞ; একদিকে এর স্বপক্ষে জনমত গঠন আর অন্যদিকে প্রথমে ইহুদীদের পৃথকীকরণ (Ghettoization) ও তারপর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে নির্বিচারে হত্যালীলা চলতে থাকে। বিশ্বখ্যাত ইহুদী বিজ্ঞানীদের প্রাণভয়ে দেশ ত্যাগ করতে হয়। (তার মধ্যে আইনস্টাইনও ছিলেন) শুধু তাই নয়, মেয়েরা রাজনৈতিক পরিসর থেকে বাদ পড়ে. শিক্ষকতা,আইন,ডাক্তারি,রাজনীতি সমস্ত পেশা থেকে মেয়েদের বের করে দেওয়া হয়, তাদের একমাত্র দায়িত্ব মাতৃত্ব বলে ঘোষণা করা হয়. এরপরে পরেই শুরু হয় সমকামী দের চিন্হিত করে তাদের উপর হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর আক্রমন. কত জনকে স্রেফ মেরে ফেলা হয়েছে, কতজনকে কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে তার কোনো হিসেব পাওয়া যায়না. হিটলার ক্ষমতায় আসার একদিন পরেই নিষিদ্ধ হয় কমিউনিস্ট পার্টি, কয়েক মাসের মধ্যে নিষিদ্ধ করা হয় সোসালিস্ট পার্টিকেও; হত্যা করা হয় লাখো বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের। তবে শুধু এই অত্যাচারের বর্ণনা দিলেই সমগ্রতায় হিটলারের ফ্যাসিবাদকে বোঝা যাবে না। এই সমস্ত কিছুর চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল জার্মান জাতির হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের শ্লোগান; প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর শোচনীয় হার ও ফ্রান্স-ব্রিটেনের সাথে ভার্সাই চুক্তির অসম্মানের স্মৃতিকে জনমননে জাগিয়ে তোলে নাৎসীরা, ডাক দেয় ইউরোপ তথা বিশ্বজুড়ে জার্মানীর শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপনের। আর এ’কাজে তাদের হাতিয়ার হয় নর্ডিক আর্যদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব; নিজেদের খাঁটী নর্ডিক আর্য বলে ঘোষনা করে আর্যজাতির প্রাচীন গৌরব কে আধুনিক দুনিয়ায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার নেয়া হয়। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সামরিক সজ্জা; অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী-চেকোশ্লোভাকিয়ার দখল নেয় জার্মানবাহিনী। সামরিক অর্থনীতির ঢালাও বৃদ্ধি সংকটাপন্ন পুঁজির পুনর্জাগরনে সাহায্য করলেও ৬ বছরের মধ্যেই দুনিয়াজোড়া আরেকটা বিশ্বযুদ্ধকে তা অবশ্যম্ভাবী করে তোলে; ১৯৩৯ এ হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণে শুরু হয়ে তা শেষ হয় নাগাসাকীতে পরমানু বোমার আঘাতে; মাঝে পড়ে থাকে ৬ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস, কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর ইতিহাস।
– দাদা বাস গড়িয়াতে এসে গেছে নামুন!
– হ্যাঁ, কি…. কোথায় এটা
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।