গল্পেরা জোনাকি -তে রাখী সরদার

রঙ

ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে লাল রঙের
বাড়িটি নিজেকে ধুয়ে ধুয়ে
আরো রহস‍্যময়ী করে তুলেছে,
,পাড়ার শেষ প্রান্তে এই বাড়িটি থেকেও যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের
মতো অচঞ্চল, অথচ বাড়িটি
যে একেবারে প্রাণহীন তা নয়।
এখানে তিনজন মানুষ বাস করে,
তাদের দেখলে মনে হয় কোনো
অতীত অন্ধকার থেকে উঠে আসা
এক একটি বিষণ্ণ ছায়া,তারা শুধু
নড়েচড়ে, কোনো গতি নেই
বিশেষ করে এ বাড়ির বছর পঁচিশের
ছেলে বাবিন।বাবিন সুদীপ ও রাণুর
একমাত্র সন্তান।একসময় বাবিন
অত্যন্ত প্রাণচঞ্চল মেধাবী স্টুডেন্ট
ছিল।পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো ,
ক্লাসে দ্বিতীয় হতো। কিন্তু সুদীপ
ও রাণুর আকাশচুম্বী চাহিদার
কাছে বাবিন দিন দিন কেমন
ফুরিয়ে যাচ্ছি ল।বাবিন এর স্বপ্ন
হল রঙ,তুলি।সে পড়াশোনার
পাশে রঙ তুলি আঁকা নিয়েই
ব‍্যস্ত থাকতো ।মাধ্যমিক টেস্ট
পরীক্ষায় সে যথাসাধ্য নম্বর
তুললেও বাবা মায়ের মনঃপুত
হলোনা।টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টের
পর দিন সুদীপ ছেলে বাবিনের
সাথে অত্যন্ত বাজে ব‍্যবহার
করলো —
বাবিন তোমার কোথায় অসুবিধা
বলতে পারো? আমরা দুজন
মানুষ সারাদিন পরিশ্রম করছি
তোমার জন‍্য‌ই ,তোমার থেকে
এটুকুই তো আশা করি যে তুমি
ফার্স্ট হ‌ও,বড় ডাক্তার হবে এটা
আমাদের স্বপ্ন, সারাদিন শুধু রঙ
তুলি নিয়ে বসে আছো!যতদিন না
পরীক্ষা শেষ হয় রঙ তুলি হাতে
দিতে পারবে না।
রাণুও বকতে থাকে –
“তোমার জন্য আমরা পৈতৃক বাড়ি
ছেড়ে এত টাকা দিয়ে এই বাড়িটি
কিনেছি যাতে নিরালায় পড়াশোনা
করতে পারো,বাড়ির লোকজনদের
ভিড় ভাট্টা থেকে তোমাকে এজন্য
এই সুন্দর ,শান্ত পরিবেশে এনেছি।”
“রাণু তুমি ওর যত রঙ,তুলি,আঁকার
খাতা সব নিয়ে আলমারিতে চাবি
দিয়ে রেখে দাও।পরীক্ষা হয়ে গেলে
ভাববো দেওয়া হবে কিনা, তারপরও
তো আবার কোচিং যেতে হবে ।”
বাবিন কান্নায় ভেঙে পড়ে,আঁকা
তার প্রাণ।সে ছুটে মায়ের পা জড়িয়ে
ধরে -“মা ,তুমি অন্তত বাবাকে
বোঝাও,আমি সারা দিন রাত পড়ব,আমার থেকে রঙ তুলি কেড়ে নিওনা।”
রাণু ছেলের গালে ঠাস করে চড়
কষিয়ে দিয়ে ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে –
“যাও পড়ার ঘরে যাও।এখন
থেকেই বাবা ,মায়ের অবাধ‍্য!”
সেদিন বাবিনের সমস্ত আঁকার
সরঞ্জাম সরিয়ে রাণু আলমারিতে
রেখে চাবি দিয়ে অফিসে যায়।
বাবিনের বাবা ও অফিস চলে
যায়।বাবিন চুপ করে বসে থাকে।
তার ঠাকুমার কথা মনে পড়ে।তার মনে হয় বাবা মা তাকে একটুও
ভালোবাসেনা।তারপর থেকে
বাবিন দিনরাত পড়ার ঘরের
জানালার ধারে বসে থাকতো।
ব‌ই খাতা খোলা থাকলেও তির
চোখের সামনে কোন ব‌ইয়ের
ভাষা নয় ভেসে উঠতো নানা রঙ,
জলভরা মেঘ,পাহাড়।নানা ছবি
সে মনের তুলিতেই এঁকে যেতে
লাগলো।সময় এ খাওয়া দাওয়া
ও করতোনা।মাধ্যমিক পরীক্ষার
পনের দিন আগে রানু অফিস
ছুটি নেয়।সারাদিন বাবিন ঘর
থেকে বের হতোনা।যখনই রানু
খাবার নিয়ে ওর ঘরে ঢুকতো
দেখতো বাবিন জানালা দিয়ে
দূরে তাকিয়ে।অনেক ডাকাডাকির
পর সাড়া মিলতো।সে যেন কোনো
বহুদূরের জনমানবশূন‍্য প্রান্ত থেকে
এই মাত্র হকচকিয়ে উঠে এলো।
একদিন রাণু রেগে ছেলের কাঁধ
ঝাঁকিয়ে বলতে থাকে —
” কি ভেবেছিস?কিছু বুঝিনা?আমাদের উপর রেগে এভাবে
সময় নষ্ট করছিস?আর কদিন
পর‌ই তোর পরীক্ষা সে খেয়াল
আছে?”
কোন উত্তর না দিয়ে বাবিন চুপ
করে থাকে ভাবলেশহীন ভাবে।
রাণু ওকে দেখে ভয় পেয়ে যায়।
সুদীপ বাড়ি ফিরলে ওরা ডাক্তারের
কাছে নিয়ে যায়।ডাক্তারের পরামর্শে
আঁকার সমস্ত রঙ তুলি বাবিনের
সামনে এনে রাখে।কিন্তু বাবিন
তখন অন্য জগতের।কোনো কিছু
ছুঁয়েও দেখেনা।চুপ করে ওর চেনা
জানালার ধারে বসে থাকে,কিছু
তেমন খাওয়াতেও পারেনা রাণু।
অনেক ডাক্তার দেখায় ওরা কিন্তু
বাবিন আর কারো সাথে কথাও
বলেনা।পরীক্ষা তো দিতেই
পারলোনা।বাবিন হাসতে ওভুলে গেল।
সেই থেকে আজ দশবছর বাবিন আর কোন কথা বলেনি।এখন
সে পঁচিশ বছরের যুবক।ওই জানালার ধারেই সারাদিন চুপ করে
বসে থাকে।অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে লাভ হয়নি।বরং এই ঘর,এই জানালা ছেড়ে গেলেই
ও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে।যতদিন
যাচ্ছে সে আরও অনড় পাথর
হয়ে পড়ছে,আগে তাও স্নান ঘরে
যেত এখন স্নান ও করতেও চায়না।
সুদীপ ও রাণু তাদের একমাত্র
সন্তানের এমন পরিণতির জন্য
নিজেরাই যে দায়ী সেই অপরাধ বোধে
তারাও চুপ হয়ে যায়।এই বাড়িতে
এখন যেন কয়েক টি ছায়া বাস
করে একান্ত নির্জনতার সাথে।
এইভাবে এদের জীবন কাটছিল।
হঠাৎ একদিন একটা ঘটনায়
বাড়িটি চঞ্চল হয়ে ওঠে।
এ বাড়িতে সাধারণত কেউ আসেনা।
বাড়ির পূর্ব দিকের বাড়িটিতে
দুদিন হল একজন ভাড়াটে এসেছে।
তাদের ছোট্ট ছয় বছরের একটি
মেয়ে টিকলি সেদিন গেট খোলা
দেখে বাবিনদের বাড়িতে ঢুকে
পড়ে।আগের দিন ভোরে খুব
বৃষ্টি হয়েছে।সেই বৃষ্টিতে বাবিনের
জানালার কাছ ঘেঁষে থাকা
লেবু ফুল ঝরে পড়েছে।তার গন্ধে
পুরো বাগান মাতোয়ারা।মেয়েটি
এক মুঠো লেবু ফুল কুড়িয়ে
হঠাৎ বাবিনের জানালার কাছে
চলে আসে –
“এ্যাই কে তুমি?চুপ করে ঘরে
বসে আছো যে!দ‍্যাখো কত ফুল,
কি সুন্দর না,গন্ধ পাচ্ছো? আরে
বের হয়ে এসো,কত্ত ফুল,ফুল
কুড়াতে ভালো লাগেনা?”
বাবিনের চোখে একটা খুশির
ঝিলিক, সে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে
থাকে।
“তুমি বোবা? কথা বলছোনা যে,
নেবে ফুল? নেবেনা?”
বাবিন কোন কথা বলছে না দেখে
অভিমানে কচি গাল ফুলিয়ে
টিকলিকে ফিরে যেতে দেখে
বাবিন জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে
বলে ওঠে —
“দাও,দাও সব ফুল নেব।”
দীর্ঘ দশবছর পর এই প্রথম বাবিন
কারো সাথে কথা বললো।এই
প্রথম তার ভুলে যাওয়া কৈশরের
রঙ সে ফিরে পেল।জানালার
অদূরেই একটি কুচো কুচো
গোলাপি ফুলে ভরা গাছের ডালে
বসে থাকা একটি পাখি চুপ হয়ে
থেমে আছে।তার লেজের হলুদ
অংশটুকু দেখে বাবিন চেঁচিয়ে
ওঠে –
“মা-আ-আ,মা-আ-আ,আমার
রঙ ,তুলি দিয়ে যাও স্কেচ করবো।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।