সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে রীতা পাল (পর্ব – ৩)

যাও পাখি দূরে
ফোনটাকে সাইলেন্ট করে গ্রানাইড পাথরের মত বসে রইলেন। তখনো কানের মধ্যে রিংটোন বেজে চলেছে। আয়া দিদি এগিয়ে এসে বললেন,“ দিদি,দাদা অনেকক্ষণ ধরে ফোন করছে আপনাকে। আপনাকে না পেয়ে আমাকে ফোন করেছেন। এই নিন ধরুন।” সবিতা দেবী অসহায় হয়ে হাতটা বাড়িয়ে ফোনটা ধরল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো-“ কিগো? কখন থেকে ফোন করছি,ফোনটা ধরছো না কেন? মামনির শরীর ঠিক আছে তো? আর বমি করেছে? আচ্ছা শোনো,যার জন্য ফোন করলাম। স্কুলের কিছু দরকারী কাগজ টেবিলে ফেলে রেখে এসেছি। ওগুলো তুলে রাখ। আমার ক্লাস আছে,রাখলাম।” সবিতা দেবী যেন বোবার মত সবটাই শুনে গেল। আয়া দিদি,“ দিদি,আপনার শরীর ঠিক আছে তো? একটু চা খাবেন,করে দেব?”
“হুম,করো। এই শোন,সেদিন বলছিলে না যে তোমারো একটা বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে আছে?”
“হ্যাঁ দিদি। ও আমার খুব কাজের। সেই ছোট্ট থেকে পড়াশোনার সাথে সাথে সংসারটাও সামলায়। আমার পোড়া কপাল দিদি। সুখ আমার কপালে নেই। সেই কোনকাল থেকে খেটেই চলেছি। তবে আমার মেয়ে খুব ভালো দিদি। কাজ থেকে ফিরলে চা করে দেয়। টিফিন না খেলে বকুনি দেয়। রান্না করে মুখের গোড়ায় এনে দেয়। তাইতো ভাবি মেয়ে মানেই তো পরের ঘরের জিনিস। ও চলে গেলে আমি একা থাকবো কি করে? গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। বিএড এ ভর্তি হবে বলছে। মেয়েটাও খুব কষ্ট করে দিদি। ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে কি সুন্দর সব জিনিস বানায়। কতগুলো টিউশানও করে। মা-মেয়ের চলে যায়?”
“তুমি ওকে খুব বিশ্বাস করো,না?”
“হ্যাঁ,ও ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই।”
“ওর বাবা?”
“সে কাহিনী মনে করলে নিজের উপর ঘেন্না হয়। সত্তরের দাঙ্গায় বাবা ওপার থেকে এইপারে চলে আসেন। তখন আমি মায়ের পেটে। মায়ের কাছে শুনেছিলাম কিভাবে কাঁটাতার পেরিয়ে এপারে এসেছিলেন। সর্বহারা দলে নাম লিখিয়েছিল। পেটে সন্তান নিয়ে শুরু করেছিল উদ্বাস্তু জীবন। দিদি তুমি চা খাবে বললে না? আমি চা করে আনি।”
মুঠোফোনটা বেজে উঠতেই সবিতা দেবী চমকে উঠলেন। ডাক্তারবাবুর ফোন। সবিতা দেবী ফোনটা ধরে বললেন,“ বলুন স্যার।”
“বমি টা কি একটু কমেছে? রিপোর্ট এসেছে?” “ পজিটিভ স্যার।”
“কাল আমারও মনে হয়েছিল। ওর কথা বলাটা খুব দরকার। আমি কিছু ওষুধ চেঞ্জ করে দেবো। আপনারা ভাবুন কি করবেন? সময় কিন্তু খুব অল্প।”
ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেল। সবিতা দেবী কানের কাছে ফোনটা ধরেই রইলেন। বিড়বিড় করে বললেন-“ জানি স্যার। সময় খুব কম।”
আয়া দিদি গরম এক কাপ চা করে এনে দিল। সবিতা দেবী চা টা মুখে দিয়ে কেমন একটা বিষাদ লাগলো। মুখটা দেখে আয়া দিদি বলল,“ দিদি,চা ভালো হয়নি?”
“না,ঠিক আছে। আসলে আমি কিছুই স্বাদ পাচ্ছি না। তুমি কুমারীকে খাইয়ে দাও আমি স্নানটা সেরে আসি। শরীরটা বড্ড অস্থির করছে।”
আয়া দিদি কুমারীর ঘরে গিয়ে দেখে,কুমারী একদৃষ্টে বইয়ের তাকের দিকে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলেন,“ কোন বইটা দেবো বলো? আমি নামিয়ে দিচ্ছি।” কুমারী সেই একইভাবে বইয়ের তাকের দিকে তাকিয়ে রইল। পলক পরছে না। সামনে একটা সঞ্চয়িতা ছিল। বইটি এনে কুমারীর বালিশের পাশে রাখল। হেসে বলল,“ তুমি দেখো,আমি খাবার গুছিয়ে আনি।” যেতে যেতে আড়চোখে দেখল কুমারী বইটা নিচ্ছে কিনা। কিন্তু না,কুমারী সেই একইভাবে বইয়ের তাকের দিকে তাকিয়ে রইল।
ক্রমশঃ