গল্পেরা জোনাকি -তে ঋতশ্রী মান্না

হৈমন্তী

হৈমন্তীর সাথে প্রথম দেখা তপুর বাড়িতে।তপু,আমার ছোটবেলার বন্ধু।ওর সাথে কতবার গাছে উঠে কাঠবেড়ালীর ছানা পেড়ে এনেছি।ওর মা ভারি সুন্দর আলুকাবলি বানাতেন।টিফিনে দুজনে ভাগ করে খেতাম।তপুর মাসতুতো বোনের বান্ধবী হৈমন্তী।প্রথম দেখায় হৈমন্তীর দু’চোখে জড়িয়ে ছিল মুগ্ধতার আবেশ।নাহ্,আমার সে দৃষ্টি পড়তে ভুল হয়নি।
অবশ্য,হৈমন্তীর মুগ্ধ দৃষ্টিকে আমার প্রতি ভালোবাসায় পরিনত করতে তপুর অবদান বড় কম ছিলোনা।আমার অফুরন্ত যৌবনবহ্নি তৃষিত পতঙ্গের মত আকর্ষণ করে এনেছিল হৈমন্তীকে।
একটা বছর কিভাবে পেরিয়ে গেল,বুঝতেই পারিনি।
মাস্টার্স কমপ্লিট হলো।মা হঠাৎ করে চলে গেল স্ট্রোকে।আমি পি.এইচ.ডি করার সুযোগ পেলাম ইউ.কে.তে।পিছুটান ছিলোনা।তাছাড়া,মায়ের মৃত্যুর পর চেনা পরিবেশটাও একঘেয়ে লাগছিল।রওনা হবার আগের দিন বাড়ীতে গোছগাছে ব্যস্ত,হৈমন্তী এসে হাজির।চূড়ান্ত রক্ষণশীল ওর বাড়ী,কি বুঝিয়ে ও সেদিন প্রায় সন্ধের মুখে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল,জানিনা।একটা জংলা প্রিন্ট হলুদ চুড়িদার পরেছিল,হাল্কা বৃষ্টি পড়ছিল।ওর চুলে,মুখে বৃষ্টির ফোঁটা,শরীরময় মেঘের ঘ্রাণ।
হৈমন্তী কাঁদছিল।আসন্ন বিরহের চিন্তা ওকে অধীর করে তুলেছিল।আমার শিক্ষাদীক্ষা,সংস্কারলালিত অপেক্ষারা ক্রমশঃ অগোছালো হয়ে উঠছিল।ক্রমে বাইরে মেঘে মেঘে অন্ধকার ঘনিয়ে এল,আর সেই বৃষ্টিমথিত সন্ধেয়,ছন্নছাড়া মাতাল হাওয়ায় ভর করে সেদিন আমার একলাঘরে,আমাদের শরীরে অবশ্যম্ভাবী তুমুল বর্ষা নেমে এলো।

আমি ইউ.কে. রওনা হলাম।তপু এসেছিল এয়ারপোর্টে।বলেছিল,হৈমন্তীর বাড়ীতে কথা বলে রাখি।তুই এবার এলে বিয়েটা সেরেই বিদেশযাত্রা করবি।আমি শুধুই হেসেছিলাম,কিছু বলিনি।

হৈমন্তীর গল্প এখানেই শেষ।ওকে আমি আর মনে রাখিনি।আমার উজ্জ্বল,গতিময় জীবনযাত্রার ব্যস্ততায় একটি অবহেলিত অধ্যায় হয়ে থেকে গেছে হৈমন্তী।আমার ক্রমশঃ ঊর্ধ্বমুখী ক্যারিয়ারগ্রাফ একটি লাজুক,কালো,গ্রাম্য মেয়েকে ভুলিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল।
আজ চারবছর পর দেশে ফিরেছি।তপুর বাড়ি গেলাম।ও কর্মসূত্রে চেন্নাইতে।মাসীমা বহুদিন পর আমায় দেখে ভারি খুশি হলেন।
কথায় কথায় হৈমন্তীর কথা উঠল।চাকরি করছে,স্কুলে।বিয়ে নাকি করবেনা।কত ভালো সম্বন্ধ এল,কিন্তু না,ওই জেদ।ওর বাবা খুব চিন্তা করেন আজকাল…

জানিনা,কী হল আমার।বড় কষ্ট হল।চোখের কোণ ভিজে গেল অজান্তেই।
পাড়ার দোকানের বাচ্চা ছেলেটার হাতে খবর পাঠালাম হৈমন্তীকে,দেখা করতে চাই একটিবারের জন্য।
ছেয়ে আসা মেঘের অন্ধকার এখনও বৃষ্টির অপেক্ষায়।বিকেল যখন সন্ধে ছুঁই ছুঁই হবে,তখন আসার কথা হৈমন্তীর।আমার হাতের মুঠোয় একগোছা বুনোফুল।আমি প্রতীক্ষায় থাকি,অনুচ্চারিত শূন্যতায় ছেয়ে থাকে অরণ্য-বাতাস। কাঠবেড়ালীরা খসখস শব্দ তুলে দৌড়ে যায় ঝরাপাতাদের ওপর দিয়ে।এক দীর্ঘায়িত বিকেল সন্ধের গা ঘেঁষে জেগে থাকে অন্তহীন অপেক্ষায়…
ক্রমে বয়স বাড়ে অরণ্যের।গাছেরাও বয়োবৃদ্ধ হয়।শিথিল হয় হাতের মুঠো–জমিয়ে রাখা না বলা কথারা ভিড়ে যায় ঝরাপাতাদের দলে–অপেক্ষায় ক্লান্ত, শুকনো বুনোফুলের পাপড়িতে লেগে থাকে হলুদ বিরহ—অরণ্যে ঘন হয়ে জমে থাকে, ঝরাপাতাদের খয়েরী বিষাদ—শালফুলের ওপর টুপ্ টুপ্ করে ঝরে যায় প্রাচীন বৃষ্টির ফোঁটা…
হৈমন্তী আসেনা আর কোনোদিন।
কেউ লেখেনা যে ছোট গল্প,বিকেল আর সন্ধের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে তার শরীরে শুধু লেগে থাকে ক্রান্তীয় বিষাদের ছায়া,উপন্যাসের জন্মবেদনা..
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।